ভাষা আন্দোলনের শহীদগণের প্রতি ঢাকার নাগরিকদের শ্রদ্ধাঞ্জলী
শনিবার ছছাবে সাদেকের সাথে সাথে দলে দলে নগরবাসী আজিমপুর কবরস্থানে যাইয়া শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ও কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। অতঃপর বেলা সাড়ে দশটা হইতে দলে দলে ছাত্রছাত্রী আসিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে থাকে। সকাল হইতেই শহরের সমস্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে এমনকি রাস্তায় একজন সাইকেল আরােহীকেও দেখা যায় নাই। কেবলমাত্র ডাক্তারখানা ছাড়া শহরের সমগ্র দোকান বন্ধ রাখিয়া সকলে যথাযথভাবে শহীদের স্মৃতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বেলা ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শােভাযাত্রীগণ আসিয়া সমবেত হয় এবং ১২টার সময় শােভাযাত্রীগণ তথা হইতে সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে বাহির হয়। শােভাযাত্রীগণ শােকজ্ঞাপক কালাে পতাকা, কালাে ব্যাজ ধারণ করতঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই প্রভৃতি স্লোগান সহকারে অগ্রসর হইতে থাকে।
শােভাযাত্রার সম্মুখভাগে পাকিস্তান এম্বুলেন্স কোর এর একখানি জীপ গাড়ী প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধপত্রসহ অগ্রসর হয়। শােভাযাত্রার পুরােভাগে সাইকেল। আরােহী দল এবং তাহার পশ্চাতে ছিলেন শহীদ দিবস আহ্বানকারী দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে জনাব আতাউর রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব, ওয়াদুদ। জনাব আবদুল ওয়াদুদই শােভাযাত্রা পরিচালনা করেন। এই মিছিলের পেছনে স্কুল ও কলেজের ছাত্রী ও অন্যান্য মহিলাগণ নগ্নপদে অগ্রসর হন।
শােভাযাত্রীগণ মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখ দিয়া পরিষদ ভবনের পাশ দিয়া ময়মনসিংহ রােড হইয়া প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সম্মুখ দিয়া রমনা এলাকায় প্রবেশ করে। তথা হইতে সেক্রেটারীয়েট, পুরানাপল্টন, নবাবপুর রােড, এছলামপুর ও চকবাজার হইয়া জেলখানার সম্মুখ দিয়া আম্মানীটোলা ময়দানে বিনা বাধায় বেলা প্রায় তিনটার সময় আসিয়া উপস্থিত হয়। তথায়। জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক সভা হয়। ক্রমে ক্রমে জনতার সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করে এবং বেলা চারটার সময় ময়দানে আর তিল ধারণের জায়গা থাকে না। সভায় শহীদ দিবস পালনের সার্থকতা সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা করেন। আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সেক্রেটারী জনাব মুজিবুর রহমান সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, গত বৎসর ঠিক এমন দিনে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর ভাষা বাংলাকে আজাদ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীতে ঢাকা শহরে ছাত্র ও জনসাধারণ নির্ভীকভাবে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়াছে। তাহারা সেই দিন যে নতুন ইতিহাস রচনা করিয়াছে, সমগ্র জাতি তাহা চিরদিন শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিবে। ২১শে ফেব্রুয়ারীকে তিনি “জাতীয় কারবালা দিবস” বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খােলা রহিয়াছে। হয় তাঁহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলিয়া মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন। তিনি সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি এবং নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার করিবার জন্যও দাবী জানান।
রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কাজী গােলাম মাহবুব (ছাত্রলীগের সহসভাপতি) বলেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি না দিয়া | সরকার যে মনােভাবের পরিচয় দিয়াছেন, তাহা নিতান্তই অগণতান্ত্রিক। তিনি সরকারের এই মনােভাবের তীব্র নিন্দা করেন। … ছাত্রলীগের জনাব এ ওয়াদুর [ওয়াদুদ] … প্রমুখ আরও অনেকে বক্তৃতা করেন।
সূত্র: ঢাকা প্রকাশ, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম