You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলন : স্মৃতিচারণ- জিল্লুর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলন : স্মৃতিচারণ১
জিল্লুর রহমান

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতেই সর্বপ্রথম সর্বস্তরের জনতার মধ্যে ব্যাপক ব্যাপ্তি লাভ করে। আমার ধারণায় ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু একটা ভাষা-দিবস নয়, এটা সমগ্র জাতির সর্বকালের জন্য একটা চেতনা আর দিক নির্দেশের দিন। আমাদের দেশে সংগ্রামের যে প্রেরণা এবং রক্ত দিয়ে অধিকার আদায়ের যে পথ, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমার মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির যে দরদ, ‘৫২ সালের অনেক পূর্বেই অর্থাৎ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এর যাত্রা শুরু। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শাসনের নামে শােষণ করার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষকে আরাে উসকিয়ে দেয়ার মানসে ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে আসামকে বাংলার সাথে জুড়ে দিয়েছিলাে। বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করে বাঙালি সেদিন আন্দোলনে নেমেছিল আর তখন থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির একটা প্রীতি ও ভালােবাসা গড়ে উঠেছিল। বাঙালিরা বাঙালি, বাংলা তাদের মাতৃভাষা-এ অনুভূতি তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের দরুন আমাদের দেশের নেতৃত্ব যাদের হাতে এসেছিল তারা ছিল উর্দু ভাষাভাষী, বিশেষ করে ঢাকার নবাব পরিবার। ফলে, নেতৃবৃন্দের ভাষা হলাে উর্দু আর সাধারণ মানুষের ভাষা হল বাংলা। এই যে পার্থক্য, জনগণ সেদিন তা বুঝতে পেরেছিল।
১৯৪৭ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গণ-আজাদী লীগ নামে একটা রাজনৈতিক দলের জন্ম হয় সম্ভবত ১৯৪৭ সালের জুনজুলাইয়ের দিকে। তবে, সে ‘গণ-আজাদী লীগ’ আজকের ‘গণ-আজাদী লীগ নয়। এর আয়ুষ্কাল ছিল খুব কম। এ-দল সর্বপ্রথম বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। তখন
———-
১ লেখাটি ‘অমর একুশে/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ভালােবাসি মাতৃভাষা গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
———–
পাকিস্তান সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ‘গণ-আজাদী লীগ’ পূর্ব-বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তান ধরে নিয়ে বাংলা ভাষাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে আন্দোলন ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল, তৎকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাকে সহায়তা করেছিল। সে সময় ‘তে-ভাগা আন্দোলন শুরু হয়েছিল দিনাজপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহের কোনাে কোনাে অঞ্চলে। ফলে, কৃষক-বিদ্রোহ দেশে দানা বেঁধে উঠেছিল। এ কৃষক-বিদ্রোহকে দমন করার জন্য মুসলিম লীগ সরকার কৃষক-বিদ্রোহ দমনের নামে সেদিন সাঁওতাল এবং অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকে ‘ভারতের চর’, ‘ভারতের দালাল’ ইত্যাদি বলে এদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এ-ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দেশের বুকে ১৯৫০ সালে একটি ভয়াবহ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধ করার জন্যে ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রগতিশীল প্রতিটি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তির মিলিত প্রয়াসে গঠিত হয় শান্তি-কমিটি। হিন্দু-মুসলমান তথা সকল স্তরের মানুষ এ শান্তিকমিটিতে ছিলেন। বস্তুত শান্তি-কমিটিকে কেন্দ্র করেই একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মনােভাব নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের একসাথে কাজ করার সূচনা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করি।
১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের নামে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনীতিতে নেমেছিলেন। ১৯৪৮ সালের বাংলা। ভাষা-আন্দোলনে বগুড়ার মােহাম্মদ আলী এবং কুমিল্লার টি, আলী আমাদের দু-একটা মিটিংয়ে এসেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সুবাদে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধ করে বগুড়ার মােহাম্মদ আলী রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশ চলে গেলেন। টি. আলী সাহেব নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রিসভায় যােগদান করলেন। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার রাজনীতি আজও আমাদের দেশে রয়েছে। আমরা সেদিন তাঁদের ব্যবহারে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম।
পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের জিন্নাহ সাহেব সর্বপ্রথম ঢাকায় আসেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” জিন্নাহ সাহেবের এ উক্তির সাথে সাথেই জনতার মধ্য থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। সকলকে আমি চিনতাম না। কিন্তু অনেকের মধ্যে আমাদের বঙ্গবন্ধু, সেদিনকার মুজিব ভাই-তিনিই সকলের আগে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “না, বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।” সেদিনই সন্ধ্যা বেলা কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ সাহেবের একই উক্তির প্রতিবাদ হয়েছিল। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন না কিন্তু তাঁর অনুসারীরা এ প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ছেলেরা মি. জিন্নাহর কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতেই হবে। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব এ-কথা মেনে না নেওয়ায় সেখানে একটা গােলযােগের সৃষ্টি হয়েছিল। ছেলেরা সে সমাবর্তন-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে চলে এসেছিল।
১৯৫০ সালে ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে একটা শিক্ষা-সম্মেলন হয়েছিল। এ শিক্ষা-সম্মেলনে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন; তবে জনাব গাজীউল হক, জনাব অলি আহাদের কথা আমার বেশ মনে আছে। কিন্তু এ-সম্মেলনকে বানচাল করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের পাণ্ডারা আমাদেরকে আক্রমণ করে। আমরা কোনাে রকমে গা বাঁচিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা এ শিক্ষা-সম্মেলন ফজলুল হক হলের কম্পাউন্ডে। করেছিলাম। এ-সম্মেলনে আমরা প্রস্তাব পাস করেছিলাম যে, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করতেই হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-সময়ে একটি ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে ছাত্রদের বেতনের হার বৃদ্ধি করেন। ডাইনিং হলের চার্জও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তখন আমরা ঠিক করি যে, বেতনই দেব না। এছাড়া এ-সময় কৃষক-বিদ্রোহ, সাঁওতালদের ওপর অত্যাচার, ইলা মিত্রের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি মিলিয়ে রাজনৈতিক আবহাওয়া দূষিত হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থার মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি নাজিমুদ্দীন সাহেব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এলেন। পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি ছােটখাট একটা বক্তৃতা দিলেন। সেখানে তিনি রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বলেন। তাঁর এই উক্তি বাঙালিদের মনে জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটায়। সেদিন বাঙালিরা অধিকতর সচেতন হল। এ দেশের মানুষ স্পষ্টই বুঝতে পারল যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে শাসনের নামে তারা নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে ; তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নেই। পাকিস্তান হাসিল হওয়ার পর থেকে আজ অবধি স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালিরা ভােগ করতে পারেনি। এসব চেতনা বাঙালিদের মনে ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। নাজিমুদ্দীন সাহেবের ঐ উক্তি সেদিন বাঙালিদের মনে দাগ কেটে দিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলােনী হিসেবে রেখে শাসনের নামে শােষণ চালাবে এবং বাঙালিদের সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দিয়ে কালক্রমে এ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে শাসকগােষ্ঠী এ ষড়যন্ত্র সেদিন বাংলার মানুষের নিকট ধরা পড়েছিল। নাজিমুদ্দীনের উক্তির প্রতিবাদে ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট হয়।
১৯৫২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে আর একটা ছাত্র ধর্মঘট হয়। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন ধরে জেলে আবদ্ধ ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভেঙ্গে পড়ে, তাই তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। তখন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একই বিল্ডিংয়ে অবস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সে-সময় ছাত্রনেতাদের গভীর রাতে আলাপ-আলােচনার জন্য ডাকতেন এবং তাদের সাথে দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক বিষয় ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে আলােচনা করতেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি-দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধুই আমাদেরকে নির্দেশ দেন। কেন তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবাদ-দিবস বলে নির্ধারিত করেছিলেন তার যথেষ্ট কারণ ছিল। পূর্ব-পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বসার দিন ছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। নুরুল আমিন সাহেব তখন চীফ মিনিস্টার। আজিজ আহমদ নামে একজন অবাঙালি ছিলেন চীফ সেক্রেটারি। ঢাকার ডি. সি ছিলেন রহমতুল্লাহ নামে আরেক অবাঙালি। আইয়ুব খান ছিলেন ইস্টার্ন জোনের জিওসি।
রণ বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রথমদিনই পরিষদ-ভবন ঘেরাও করার জন্য বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি [১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি আমরণ অনশন করবেন। এ কথাটা আজ অনেকেই। রাজনৈতিক কারণে মানতে চান না। কিন্তু আমি এসব সত্য ঘটনা বলেই জানি। বঙ্গবন্ধুর সাথে ছাত্রনেতারা মেডিক্যাল কলেজে আলাপ-আলােচনা করে একটা আন্দোলন গড়ে তােলার প্রয়াস পাচ্ছে-এ সংবাদ সরকার জানতে পেরে বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে ফেরত পাঠায়। ১৯৫২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি (১৫ই ফেব্রুয়ারি) সেন্ট্রাল জেল থেকে ফরিদপুর জেলে খুব তাড়াতাড়ি স্থানান্তরিত করা হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতি হিসেবে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রসভা হয়। উক্ত সভায় আমি সভাপতিত্ব করি; যদিও আমি তখন কোনাে ছাত্রদলের সাথে জড়িত ছিলাম না। আমি আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিলাম। সেখানে অনেকেই বক্তৃতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব সে সভাতেই পাস হয়। আমরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত-এ কথা সরকারের জানা ছিল। তাই ২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ তখন গঠিত হয়েছে। এদের বক্তব্য ছিল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে না। কিন্তু আমরা তা মানিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও তার প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু প্রতিবাদে কেউ কান দেননি। আবুল হাশিম সাহেব। তখন বলেছিলেন যে, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে শামসুল হক। সাহেব (আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভায় সংগ্রাম পরিষদের রায় জানিয়ে আসবেন। যদি ছাত্রসমাজু সংগ্রাম পরিষদের রায় মেনে না নেয়, তবে সংগ্রাম পরিষদ রাখা। যুক্তিসঙ্গত হবে না। শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরা ঠিক করলাম যে, ১৪৪ ধারা যদি আমরা ভঙ্গ না করি, তবে আন্দোলন এখানেই থেমে যাবে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিও বানচাল হয়ে যাবে। ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফজলুল হক হল আর ঢাকা হলের মাঝখানকার পুকুরের পূর্বপাড়ে যে বাঁধানাে সিঁড়ি আছে সেখানে গাজীউল হক, এককালীন সাধারণ সম্পাদক মােহম্মদ সুলতান, আজকের বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী, আবদুল। মােমেন প্রমুখ আমরা আট থেকে এগার জন বসেছিলাম আলােচনার জন্য। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত আলাপ-আলােচনা করে আমরা ঠিক করেছিলাম যে, ১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে। নতুবা আন্দোলন এখানেই থেমে যাবে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে না। একটি ঘটনা আমার বেশ স্পষ্ট মনে। আছে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা যে সভা করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব-এর পােস্টার ফজলুল হক হলের ই/১৮ নং কামরার (গাজীউল হক এ-রুমে থাকতেন) মেঝেতে বসে গাজীউল হক সাহেব স্বহস্তে লিখেছিলেন। পােস্টারগুলাে দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা ঢাকা শহরের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্রোতের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এসে সমবেত হতে থাকে। সেদিন অনেক ছাত্রীও সেখানে এসেছিল; ইতিপূর্বে কোনাে সভা-সমিতিতে এমন ছাত্রী সমাবেশ দেখা যায়নি। ছাত্র-ছাত্রীতে সারা চত্বর ভরে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কেননা, আমরা খুব। সতর্ক ছিলাম যেন পুলিশের কোনাে আই.বি’র লােক এর মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। আমাদের সতর্কতা সত্ত্বেও বেশ কিছু সংখ্যক আই.বি’র লােক আমাদের সভায় প্রবেশ করেছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় অসংখ্য পুলিশ, মিলিটারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে টহল দিচ্ছিল। এসভায় জনাব গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেন। শামসুল হক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদেরকে বললেন। কিন্তু এ কথা কেউ মেনে নিল না। গাজীউল হক সাহেব জোরালাে ভাষায় এক বক্তৃতা দিলেন। তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল : কি করে আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব? আমরা কি সকলে মিছিল করে একসাথে অ্যাসেম্বলী হাউসের দিকে বেরিয়ে পড়ব? শেষ পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত হল যে, একসাথে গেলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, গুলি ছুড়ে আমাদের নাস্তানাবুদ করে দেবে। আমরা অ্যাসেম্বলী হাউসে পৌছাতেই পারব না। আমরা সে সময় খবর পেয়েছিলাম যে, আইয়ুব খান। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী নিয়ে অ্যাসেম্বলী হাউসের পেছনে অবস্থান করছেন। আমরা শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে, পাঁচজন করে গেট দিয়ে বেরিয়ে অ্যাসেম্বলী হাউসের (বর্তমানে জগন্নাথ হল) দিকে যাবাে। সকলেই এ-প্রস্তাব মেনে নিল। প্রথমে ৫ জন ছাত্রী গেট দিয়ে বেরিয়ে সেদিকে চলে গেল। আমরা প্রথমে মেয়েদের পাঠিয়েছিলাম একথা ভেবে যে, তাদের গায়ে চট করে হাত দেওয়ার সাহস পুলিশ পাবে না। তাছাড়া, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছোঁড়া হচ্ছিল। তারাও আমাদের লক্ষ করে চত্বরের ভেতরে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করছিল। একটা খণ্ডযুদ্ধই চলছিল তখন। পুলিশ প্রথমে আমাদের পরিকল্পনা বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ আমরা গেট দিয়ে পাঁচজন পাঁচজন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ইতােমধ্যে অ্যাসেম্বলীর সামনে আমাদের প্রায় ৪০/৫০ জন ছাত্রছাত্রী গিয়ে সমবেত হয়। পুলিশ কিছুক্ষণ পরে আমাদের রণ-কৌশল বুঝতে পেরে, যারা ইতােমধ্যে সেখানে জড়াে হয়েছিল, তাদেরকে একটি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। আমরা এদিকে পাঁচজন পাঁচজন করে গেট দিয়ে বের হচ্ছি, আর তারা আমাদের ধরে ধরে ট্রাকে তুলে নিচ্ছে এবং ট্রাক ভর্তি করে টঙ্গীতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। কোনাে কোনাে ট্রাক আবার চলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের দিকে। আমরা দেখলাম, এ রণ-কৌশলে আর কাজ হবে না। তখন হাজার হজার ছাত্র-জনতা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাে। মেডিক্যাল কলেজের সামনে মিলিটারি আমাদের বাধা দিল-তারা পজিশন নিয়ে মাটিতে শায়িত অবস্থায় ছিল। আমরা সেখানে পৌঁছলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে; একপর্যায়ে মিলিটারিরা গুলি চালায়। এখন যেখানে শহীদ মিনার হয়েছে, সেখানে তখন ছিল মেডিক্যাল কলেজের হােস্টেল। গুলি শুরু হলেই কেউ কেউ মেডিক্যাল কলেজের হােস্টেলের দিকে, কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের দিকে ছুটে যেতে লাগল। আমি মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাচ্ছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, দু-তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। আহতদের কোলে করে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলাে। আহতদের মধ্যে বরকতকে চিনতাম। জব্বার, রফিক এদের নাম পরে জানতে পেরেছি। এদের পূর্বে চিনতাম না। তিন চারজনের লাশ। মেডিক্যালে আনা হয়েছিল। এদের চিকিৎসা করার কোনাে উপায়ই ছিল না । বরকতের মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। মগজটা ছিটকে বেরিয়ে। গিয়েছিল। সে এক করুণ দৃশ্য। নার্স আর ডাক্তাররা তখন কাঁদছিলেন। তাঁরা লাশ নিয়েই কাজ-কারবার করেন। কিন্তু তাঁদের কান্না দেখে সেখানকার পরিবেশ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। তখনাে গুলি চলছে। মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক ভেদ করে গুলি ঢুকছে। এমনকি, সে গুলি মেডিক্যাল কলেজের দেয়ালেও এসে লাগছে। এভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি। দিনটা পার হয়ে গেলে।
২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারিতেও হরতাল হয়েছিল। সেদিন ঢাকার রাস্তায় জনতার স্রোত বয়ে গিয়েছিল। সেদিন সরকার বলে কেউ ছিল না। সরকারের পতন হয়েছিল বলা চলে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদই তখন। সরকার চালাচ্ছিল। সমগ্র ঢাকা শহর আমাদেরই কন্ট্রোলে ছিল। শহরের রাস্তায় রাস্তায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম-তহবিলে চাদা আদায়ের জন্য প্রচেষ্টা চলছিল। জায়গায় জায়গায় চাদর বিছানাে ছিল। সেদিন হাজার হাজার টাকা চাঁদা উঠেছিল। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটা গান-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানাে একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন এখন জনমনে দাগ কাটতে পেরেছে সে-সময় অর্থাৎ ১৯৫২, ১৯৫৩, ১৯৫৪, ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ‘আমরা ভুলব না, ভুলব না ২১শে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সারা বাংলার বুকে। এমনি শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। এ গানটি সম্পূর্ণ আমার মনে নেই। তবে এটির রচয়িতা ছিলেন গাজীউল হক সাহেব। তিনিই গানটিতে সুর সংযােগ করেছিলেন। এটিই বাংলা ভাষায় ২১শে ফেব্রুয়ারির ওপর রচিত প্রথম গান। এ গানটি তখন ২১শে ফেব্রুয়ারির গান হিসেবে সারা বাংলাদেশে পরিচিত ছিল। গানটির অংশ বিশেষ আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।
ভুলব না, ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না, লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, মিলিটারী আর মিলিটারী- ১ ভুলব না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এ দাবিতে ধর্মঘট, বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথভুলব না। স্মৃতিসৌধ ভাঙ্গিয়াছে জেগেছে পাষাণে প্রাণ, মােরা কি ভুলিতে পারি খুনে-রাঙা জয়-নিশান?
ভুলব না।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিটি রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এ চার নেতার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২১-দফা কর্মসূচির মাধ্যমে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। ২১-দফা ছিল আমাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো। এ ২১-দফা কর্মসূচির মধ্যে আমরা (ছাত্ররা) আমাদের দু’দফা কর্মসূচিও অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলাম। তখন ২১-দফা তৈরির পরিকল্পনা চলছিল। আমরা শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে আমাদের দু’দফার কথা বলেছিলাম। প্রথমত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, দ্বিতীয়ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন (বর্ধমান হাউস) থেকে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানাের ষড়যন্ত্র হয়েছিল বলে সেই বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করতে হবে। সেদিনের সে দাবির ফলশ্রুতিই আজকের বাংলা একাডেমি।
১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সে-সময় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বিভিন্ন সময়ে সভা, সমাবেশ ইত্যাদি হতাে। তাই এসব সভা-সমিতি, সমাবেশ ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ কিছু কালাকানুন তৈরি করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সভা, মিছিল ইত্যাদি করা যাবে না। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আন্দোলন। শুরু করি। | ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকেসহ দশজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেন। এঁদের মধ্যে গাজীউল হক, শামসুল হক, শামসুল হক চৌধুরী (আশির দশকের গােড়ায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন), কে. জি. মুস্তফা, ব্যারিস্টার আখতার (বর্তমানে সৌদি আরবে রয়েছেন)-এ কজনের নাম আমার মনে পড়েছে। এ দশজনের মধ্যে আবার গাজীউল হক ও আমার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়, যদিও আমরা পূর্বেই এমএ পাস। করেছিলাম। এর কারণ দেখানাে হয়েছিল, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গােলযােগের সৃষ্টি করছি। ফলে, এমএ ডিগ্রি রক্ষার যােগ্যতা আমাদের নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ আমাদের দুজনের এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেন। আমাদের এ-ব্যাপারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মঘট শুরু করে। তিন মাস অবধি এ ধর্মঘট চলেছিল। শেষ পর্যন্ত নূরুল। আমিন সাহেব আমাদের কাছে সারেন্ডার করলেন। আমাদের ওপর যে বহিষ্কার আদেশ হয়েছিল তা তুলে নেওয়া হল এবং আমাদের ডিগ্রি ফেরৎ দেওয়া হল।
যাহােক, আমরা যুক্তফ্রন্টের মেনিফেস্টোতে আমাদের দুদফা অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিলাম। ফলে ছাত্র-সমাজ পরিপূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়ে। ফলে, যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ মাত্র দশটি আসন লাভ করেছিল। এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এ যুক্তফ্রন্টের মধ্যে নেজামে-ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু আমাদের চাপে শেষ পর্যন্ত তিনি নেজামে-ইসলামকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনে রাজি হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীসহ অন্য সবাই রাজি ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। শেরেবাংলা এ. কে ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাত্র দু-জন লােক নিয়ে মন্ত্রী গঠন করলেন। এ দুজনের মধ্যে একজন হলেন তার ভাগ্নে সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) আর একজন কুমিল্লার আশরাফ আলি চৌধুরী। তিনি আর কিছুতেই মন্ত্রিসভা বাড়াতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা ক্যবিনেট গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি মন্ত্রিসভায় নিয়ে ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেননি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়। এর পূর্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়নি। আর বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা কেন্দ্র হিসাবে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তরিত করা হল। বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির যে নাড়ীর একটা টান আছে-এটা সাংঘাতিকভাবে বাঙালির মানসিকতায়, চেতনায় দোলা দিয়েছিল। ‘৫৩ সাল থেকে দেখা গেল যে, এ চেতনা শুধু সভা, মিছিল আর গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। থেকে বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকলার মধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। সে-সময় ২১শে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে প্রচুর কবিতার বই, নাটক, উপন্যাস এবং গান রচিত হয়েছিল। অনেক নাটক সে-সময় মঞ্চস্থ হয়েছিল। শিল্পীরা আন্দোলনের ছবিটাও তাঁদের শিল্পকলার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। ১৯৫২ সালের ঘটনা বাঙালির মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, আমার মুখের ভাষা। বাংলার । কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলা সংস্কৃতি-এসব আমাদের প্রাণের ধন। এভাবে আমাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধ জাগ্রত হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছি এবং রক্ত দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করেছি। আমরা ‘৫২-তে আন্দোলন করেছি, ‘৫৪-তেও আন্দোলন করেছি, আর একাত্তরেও আন্দোলন। করেছি। এসব আন্দোলনের পেছনে যেটা আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে তা হচ্ছে জাতীয়তাবোেধ। তা না হলে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তানের সুশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর সাথে। খালি হাতে আমাদের যুদ্ধ করা সম্ভব হতাে না। মােট কথা, এ বােধ ছিল বলেই সেদিন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে শুরু করে। স্বাধিকার অর্জন-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।
আমার মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি দিবস নয়, এ হচ্ছে আমাদের। প্রেরণার উৎস। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিল, কারা প্রগতির পক্ষে আর কারা প্রতিক্রিয়ার পক্ষে। সে-সময় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি দল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী ছিল না।
সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ সালে যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল তাকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলা যেতে পারে এবং এ আন্দোলনের গতিধারা ছিল ক্ষীণ। কিন্তু ‘৫২ সালের যে আন্দোলন, তার ব্যাপকতা সাতচল্লিশআটচল্লিশ সালের আন্দোলনে ছিল না। একটি জাতির ভাষাকে অস্বীকৃতি জানানাের অর্থই হচ্ছে জাতিকে অস্বীকৃতি জানানাে, তার অস্তিত্বকে অস্বীকৃতি জানানাে। তাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এত ব্যাপক হয়ে উঠেছিল। বায়ান্ন সালে খাজা নাজিমুদ্দীনের উক্তি, পাকিস্তান সরকারের কুশাসন আর শােষণ বাঙালিদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার একটা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল এ বাংলার মাটিতেই, কিন্তু তা কাজে পরিণত হওয়ার সুযােগ পায়নি। তমদুন মজলিসের বাংলা ভাষা। আন্দোলনে একটা ভূমিকা ছিল। বাংলাকে আরবি হরফে লেখার বিষয়ে। পার্লামেন্টে অধ্যাপক রাজকুমার সিং প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ধীরেন দত্ত প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সরকার এদেরকে কমিউনিস্ট বলে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু মানুষের ভেতরে সেদিন রাজনীতিবােধ ছিল বলেই সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য চাপ প্রয়ােগ করতে পারেনি। তাদের এ চেষ্টা মােটেই ফলবতী হয়নি।
১৯৫৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত যে কোনাে প্রগতিশীল আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
ভাষা-আন্দোলনে শহীদ বরকতের ভূমিকা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকার যে-সব। কথা বলা হয়েছে, সেটা জঘন্য অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়। কেন এবং কি উদ্দেশ্য নিয়ে এ কথা বলা হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু বরকতকে আমি যে কোনাে আন্দোলনে প্রথম সারিতেই দেখেছি এবং তিনিই প্রথম। বুকের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, দেশের সাথে তিনি বেঈমানী করেননি। আমি শহীদ বরকত সম্পর্কে রাজ্জাক সাহেবের উক্তির প্রতিবাদ করি।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম