তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব প্রসঙ্গ১
৫ মার্চ ‘৪৮, শুক্রবার আমি এফএইচ হলে গেলাম। বিকেল সাড়ে ৫টায় তােয়াহা সাহেবের সঙ্গে নাস্তা ও দুধ খেলাম। রাষ্ট্রভাষা কমিটির সভা চলছে। এ সময় মুজিব ঢাকা হল থেকে এলেন। ওয়াহেদ কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে আমার অভিমত জানতে চাইল। মুসলমানরা কেন কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তাকে কারণ বােঝালাম। [প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২২] ১১ মার্চ ‘৪৮, বৃহস্পতিবার।
Bapp সকাল ৭টায় সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করতে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম এফএইচএম হলে। তােয়াহা সাহেব এবং আমি এক সঙ্গে কাজ করছি। রমনা পােস্ট অফিসের কাছে তােয়াহা সাহেব ও অন্য কয়েকজন পুলিশ কর্তৃক আটক হলেন। আমি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলাম। একটু পরে তােয়াহা সাহেবকে পুলিশ ছেড়ে দিল।
————————-
১ ঋণ : তাজউদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮, প্রথম খণ্ড, প্রতিভাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা : জানুয়ারি ২০১৪।
———————–
১২টার পিকেটিং বন্ধ হলে ১টায় নাইমউদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হলাে। বেলা ২টায় সচিবালয় অভিমুখে মিছিল। শুরু হলে পুলিশ হাইকোর্ট গেটের কাছে বাধা দিল। আমরা উত্তর গেটের দিকে রওনা হলাম। তখনই পুলিশ লাঠিচার্জ করল। তােয়াহা সাহেবকে মারাত্মক মারধর করল, অন্যরাও মার খেল। কোথাও যেতে পারলাম না। সাড়ে ৩টায় সভার পর সবাই চলে গেল। * মুজিব, শামসুল হক, মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত, আনসার ও অন্যান্য ৬৯ জনকে আটক করে জেল হাজতে রাখা হয়েছে। ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে। সেন্ট্রাল জেল, কোতােয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এবং হাসপাতালে তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। ৮টায় হলে এলাম। সাড়ে ৮টায় মেসে ফিরলাম।…
বি. দ্র. : পুলিশের নির্যাতন ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের গুণ্ডামিতেও আজকের ধর্মঘট চমৎকার সফল হলাে। (প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৬]।
১৫ মার্চ ‘৪৮, সােমবার। সকাল সাড়ে ৬টায় বেরিয়ে প্রথমে এফএইচএম হলে গেলাম। বৃষ্টির জন্য বাইরের বা হলের কর্মীদের একত্রিত করলাম। তারপর আমি রমনা পােস্ট অফিস থেকে নীলক্ষেত ও পলাশি ব্যারাক এলাকায় পিকেটিংয়ের কাজ দেখতে বেরুলাম। এরপর গেলাম ডা. করিমের কাছে। তিনি তাঁর অ্যাম্বুলেন্স কোর ও কর্মী বাহিনী নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সেখান থেকে জগন্নাথ হােস্টেল, তারপর আগামাসিহ লেনে মেসে গেলাম এবং কর্মীদের বের করলাম।
সচিবালয়ে এবং রমনা এলাকার অন্যান্য অফিসের বাঙালি অফিসাররা পূর্ণ ধর্মঘট করলেন। সাড়ে ১১টায় রেলওয়ে কর্মীরা ধর্মঘটে যােগ দিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করলেন এবং আমাদের প্রধান প্রধান দাবির ব্যাপারে আলােচনার পর তিনি সংগ্রাম কমিটির শর্ত মেনে নিলেন। তাঁকে স্বীকার করতে হলাে যে, বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রের শত্রু নয়। ৮ দফা চুক্তি হলাে।
বিপুলসংখ্যক পিকেটারকে গ্রেপ্তার করা হলাে এবং দুপুর ১২টায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেটে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সভার পর এসেমব্লি ভবনের সামনে একটা বিরাট বিক্ষোভ মিছিল চললাে। আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চত্বরে অবস্থান নিলাম। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা ওই এলাকা ত্যাগ করলাম।। প্রধানমন্ত্রী ও সংগ্রাম কমিটির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী আজ সন্ধ্যার পর সব বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হলাে। ছাত্ররা খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে কোনাে শর্তে সমঝােতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বিক্ষোভের আগে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চত্বরে সংগ্রাম কমিটির কাছ থেকে এ কথা শুনে ১৬ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের ধর্মঘট ঘােষণা করতেই হলাে। (প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৯-২৩০]
১৬ মার্চ ‘৪৮, মঙ্গলবার। ৮টায় এফএইচএম হলে গেলাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংগ্রাম কমিটির গতকালকের বৈঠকে গৃহীত শর্তাদির কিছু সংশােধনী আনা হলাে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টার সভা শুরু হলাে। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সংশােধনীগুলি গৃহীত হলাে এবং অলি আহাদের মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানাে হলাে। যদিও সংগ্রাম কমিটির কোনাে কর্মসূচি ছিল না, তবু এসেমব্লি হাউস অভিমুখে ছাত্রদের একটা। বিক্ষোভ মিছিল পরিচালিত হলাে এবং সরকারি দলের এমএলএদের নিন্দা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করল। এএসই মেইন হােস্টেলের একটা রুমে মিলিত হলাম। পাঁচটা পর্যন্ত সেখানে থাকলাম। পরে ছাত্রদের এমএলএদের ‘ধর ধর’ শব্দে রুম থেকে বের হলাম। এর ফলে এসেমব্লি হল থেকে সরকারি দলের অনেক এমএলএ বের হলেন না।
ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় মি. গফুর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে একদল পুলিশ এসে ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ, ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। তারা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরেও গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। লাঠিচার্জে ১৯ জন মারাত্মকভাবে আহত হলাে। শওকত তাদের অন্যতম। বলিয়াদি ভবনে সভায় যােগদানকারী বিরােধী এমএলএদের আমি ও শামসুদ্দিন এই ঘটনা জানালাম।
হলের উত্তর ভবনে একটা কক্ষে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটির সভা বসল। রাত ২টা পর্যন্ত চলল। সভায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু প্রতিবাদ ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে। (প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৩১]
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম