You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মাইল ফলক- কাজী গােলাম মাহবুব - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের
একটি মাইল ফলক১
কাজী গােলাম মাহবুব

[কাজী গােলাম মাহবুব ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ দুই পর্বের ভাষা-আন্দোলনেই জেল-জুলুম এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন।]
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মাইলফলক। ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন মানেই আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। এই উপলব্ধি থেকেই আমি ভাষা আন্দোলনে জড়িত হই।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই আমরা ১৪ জন পাকিস্তানের। আন্দোলনের কর্মী পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের দাবি সম্বলিত ২১ দফা ইশতেহার প্রণয়ন করি। ২১ দফার অন্যতম প্রণেতা ও স্বাক্ষরদাতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমি ১৫০ নং মােগলটুলির ওয়াকার্স ক্যাম্পের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। আমি ছিলাম ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
——————-
১. লেখাটি এম আর মাহবুবের ভাষাসংগ্রামের স্মৃতি গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
———————-
ভাষা আন্দোলনের শুরুতে এই দুটি সংগঠনের সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ২ মার্চ ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ১১ মার্চের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। এ সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। ১১ মার্চ তােপখানা রােডস্থ দ্বিতীয় গেটে পিকেটিং-এ নেতৃত্ব দেই আমি, শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ, মাে. বায়তুল্লাহ প্রমুখ। দ্বিতীয় গেটটি ছিল সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরণুখ, কারণ এই গেট দিয়ে সবচেয়ে বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রবেশ করত। এখানে (২য় গেটে) আমি, খালেক নেওয়াজ, বায়তুল্লাহ এবং আমাদের সঙ্গে আরও অনেকে। মিলে পিকেটিং শুরু করি। কর্মচারীদের প্রবেশে বাধা দিলে একটু দূরে। দাঁড়ানাে পুলিশ লাঠিসােটা দিয়ে আমাদের ওখান থেকে তাড়ানাের জন্য অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি ও টানাটানি শুরু হয়। পুলিশ আমাদের লাঠিচার্জ করতে থাকে।
পুলিশ যখন আমাদের লাঠিপেটা ও টানাটানি করতে থাকে ঠিক এই সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর জাকির হােসেন তার বিরাট গাড়ি দিয়ে গেটের ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে আমার নেতৃত্বে সবাই গাড়ির সামনে মাটিতে শুয়ে পড়ি। এতে পুলিশ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং আমাদের ওখান থেকে সরাবার জন্য টানাটানি ও বেদম প্রহার শুরু করে। সে অবস্থায় পুলিশ সুপার চ্যাথাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, আপনাকে গ্রেফতার করা হলাে। জনাব জাকির হােসেন সাহেব ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার জন্য কোতােয়ালি থানায় আমার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। থানায় নিয়ে আসার পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে সকলকে জিজ্ঞেস করল, ‘শওকত আলী ও কাজী গােলাম মাহবুব কোথায়। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার কারণেই বিশেষভাবে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছিল। সেন্ট্রাল জেলে আমার সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, খালেক নেওয়াজ, অলি আহাদ, তােয়াহা, শওকত আলীসহ আরও প্রায় ৬৫ জন ছাত্র।
১৯৫২ সালের ৩১ শে জানুয়ারি আমরা ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সকলে একত্র হয়ে একটা সভা করলাম। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হলাে আমাকেই। আমরা সমবেতভাবে এই আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল সফল করতে আমি সারাদেশে ব্যাপক প্রস্তুতি নিই এবং সকল জেলায় প্রতিনিধি ও চিঠি প্রেরণ করি।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্রে নূরুল আমীন সরকার ঢাকা শহরে মাসব্যাপী ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, সমাবেশ, মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৭ ঘটিকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৯৪ নং নবাবপুর রােডস্থ অফিসে এক জরুরি সভা আহ্বান করে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গলে সরকার নির্বাচন বানচাল করার অজুহাত পেয়ে যাবে। এতে করে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে এবং গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে আমিসহ আরও কয়েকজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য বক্তব্য রাখি। শেষপর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় প্রতিবাদী ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে আসে। এই পরিস্থিতিতে আমি ও শামসুল হক রাস্তায় নেমে আসি এবং সাধারণ ছাত্র জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ি। এসময় ছাত্রদের উপর চলতে থাকে চরম নির্যাতন। আমতলার সভা শেষে আমরা ব্যারাক প্রাঙ্গণে চলে আসি। মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের সীমানার মধ্যে থেকে আমরা পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলছিলাম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে এ। ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন, নইলে গণশত্রু বলে চিহ্নিত হবেন। এই সময় উত্তেজনার মুখে হঠাৎ বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের চারদিকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে।
আবুল বরকতের উরুতে গুলি লাগে এবং সে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে। পড়ে। তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সে যে-কি এক করুণ ও ভয়াবহ দৃশ্য। সে দৃশ্য আমার সমস্ত বােধশক্তিকে মুহূর্তে অবশ করে দিয়েছিল। একুশের হত্যাকাণ্ডের পর আমি যে উত্তেজনা দেখেছি, যে। গণরােষ দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছি মানুষের ক্ষোভ আর ক্রোধ কাকে বলে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম