You dont have javascript enabled! Please enable it! ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ : একুশের হয়ে ওঠা- আবদুল মতিন - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ : একুশের হয়ে ওঠা১
আবদুল মতিন

[আবদুল মতিন ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে যােগ দেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে। তিনি ১৯৪৮ সালের ২৩শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি তার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নামেন। পরে গ্রেপ্তার হন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য তিনি ভাষা মতিন নামে পরিচিতি লাভ করেন।]
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলাে। এর মাস চারেক পর একদিন শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ফজলুল হক হলে আসেন। তিনি এক ছাত্রসমাবেশে বক্তৃতা দেন। আমিও শ্রোতা হিসেবে ওই ছাত্রসভায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। একে উন্নত করে গড়ে তােলা প্রয়ােজন। এ জন্য দরকার একটি শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন। চলুন, আমরা শাহ আজিজুর রহমানের কাছে যাই এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে নতুন করে শক্তিশালী করার। জন্য তাকে বলি।’ শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা বেশ কয়েকজন ছাত্র শাহ আজিজুর রহমানের কাছে গেলাম। শাহ আজিজুর রহমান তখন ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান শাহ আজিজুর রহমানকে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান
—————
লেখাটি মতিউর রহমান সম্পাদিত একুশের স্মৃতি একুশের পটভূমি গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত
—————
মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিল সভা ডাকার জন্য অনুরােধ করেন। শাহ আজিজুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব অনুযায়ী কাউন্সিল সভা ডাকতে রাজি হলেন না। শাহ আজিজুর রহমান সে সময় ছিলেন নাজিমউদ্দীন সরকারের সমর্থক। কাউন্সিল সভা আহবান করা হলে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে তাঁর নেতৃত্ব বহাল থাকবে না, তা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনারা এগিয়ে আসুন, আমরা একটি নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলি। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হলাম। মােগলটুলীর ওয়ার্কার্স ক্যাম্পসমর্থিত নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের আবেদনে সাড়া দিলেন। অলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, মােহাম্মদ তােয়াহা, আজিজ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমিসহ আরও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্র ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক কর্মীসভায় বসি। এ সভায় আমরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করি। অলি আহাদ ও মােহাম্মদ তােয়াহা সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়ার জন্য সভায় দাবি জানান। এই দাবির বিরােধিতা করে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘ এ সময় এটা বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। সরকার ভুল ব্যাখ্যা দেবে। পরে সময় হলে তা বাদ দেওয়া যাবে। আমি শেখ। মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানালাম। মুসলিম শব্দ রাখা হলাে। অলি আহাদ তা মেনে নিলেন। মােহাম্মদ তােয়াহা তা মানলেন না। তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে তাঁর আর কোনাে সম্পর্ক রাখলেন না। আমরা নঈমুদ্দীন আহমদকে এই নতুন ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়ক নির্বাচন করি। ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সরকারের কাজকর্ম থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের কোনাে শ্রদ্ধাবােধ নেই। সরকার ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়। মানি অর্ডার ফরম, পােস্টকার্ড, খাম ও কাগজের টাকার নােট থেকে সরকার বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়। গণপরিষদের ভাষারূপে উর্দু, ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু গণপরিষদে ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবি অগ্রাহ্য হয়। বাংলা ভাষার প্রতি সরকারের এসব অবজ্ঞার কারণে পূর্ববঙ্গের ছাত্ররা সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিকে বাস্তবায়িত করার জন্য এক সভায় মিলিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সংগ্রাম পরিষদ সারা পূর্ববঙ্গে ঘর্মঘট আহ্বান করে। ছাত্রলীগের। নেতারা হরতালে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে পাবনা যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমি পাবনা যাই। ১১ মার্চ ১৯৪৮ পাবনায় সফল হরতাল পালিত হয়। এডওয়ার্ড কলেজে এক বিরাট ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিই। শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করি। মিছিলে পুলিশ বাধা দেয়। তাতে অনেকে আহত এবং অনেকে গ্রেপ্তার হন। বিকেলে জনসভা করার কর্মসূচি ছিল। পুলিশ জনসভা করতে দেয়নি। ১১ মার্চের কর্মসূচি শেষ করে পরের দিন আমি পাবনা থেকে আমার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শৈলজানায় যাই। কয়েক দিন বাড়িতে থাকার পর ঢাকায় ফিরে আসি। ঢাকায় এসে শুনলাম, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এতে মন খুব খারাপ হয়ে গেল। রাগে-দুঃখে আমি আন্দোলনের নেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলি। মনে হলাে, এটি নেতাদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত, সুবিধাবাদী নেতারা গােটা আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
১৯ মার্চ ১৯৪৮ জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। জানতে পারলাম, ২১ তারিখ তিনি রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় ভাষণ দেবেন। তাঁর বক্তৃতা শােনার জন্য আমি আগ্রহান্বিত হই। আমার ধারণা ছিল জিন্নাহ একজন। বিচক্ষণ নেতা। উদ্ভূত ভাষা-সমস্যা সম্পর্কে তিনি জনসভায় নিশ্চয়ই সুচিন্তিত বক্তব্য দেবেন। তাঁর বক্তৃতায় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দিকনির্দেশনা অবশ্যই থাকবে। বড় আশা নিয়ে ২১ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে যাই। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি জনসভায় বক্তব্য দেন। তাতে আমার প্রত্যাশা পূরণ হলাে না। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ওকালতি করেন। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে তিনি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন না। জিন্নাহর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও আস্থা ধূলিসাৎ ৭ হয়ে গেল।
২২ মার্চ ১৯৪৮ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন সভা আহ্বান করা হয়েছে। জিন্নাহ সভার প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করবেন। আমি আগের বছর বিএ পাস করেছি। সনদ গ্রহণের জন্য কার্জন হলে সমাবর্তন সভায় যাই। যথারীতি সমাবর্তন সভা শুরু হলাে। জিন্নাহ প্রধান অতিথির ভাষণের একপর্যায়ে তাঁর রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, “উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, ‘না’, ‘নাে’।
সভায় সনদ গ্রহণের জন্য আগত অন্যান্য ব্যক্তি আমার মতাে একই ধ্বনি তুললেন ‘নাে’, ‘নাে’। জিন্নাহ বিমর্ষ হয়ে গেলেন। ভাষা সম্পর্কে তিনি আর বক্তব্য বাড়ালেন না।
বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীরা ১৯৪৯-এর মার্চ মাসে ধর্মঘট শুরু করেন। তাঁদের দাবিদাওয়া ছিল ন্যায্য। আমি এ আন্দোলনকে সমর্থন দিলাম। একদিন ধর্মঘটী কর্মচারীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সেক্রেটারিয়েটের গেটের কাছে যাই। পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। এক মাস ডিটেনশন দিয়ে আমাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠানাে হলাে। সরকার ডিটেনশন আর বাড়াল । জেল থেকে মুক্তি পেলাম। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তাঁর অফিসকক্ষে যাই। রুমে ঢুকেই তাঁর টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে পড়ি। উপাচার্য আমার দিকে তাকিয়ে রুক্ষ স্বরে বললেন, তুমি কার নির্দেশে এখানে চেয়ারে বসলে?’ তিনি আমাকে চেয়ার থেকে উঠে যেতে আদেশ করলেন। উপাচার্যের এই অশালীন আচরণে আমি অপমান বােধ করি। তার ওপর আমার রাগ হলাে। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছাত্রশিক্ষকের সম্পর্ক এটা নয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর আমি তাঁর ছাত্র। তার কাছ থেকে স্নেহ পাওয়াটাই আমি প্রত্যাশা করেছিলাম। এর বিপরীতে তাঁর কাছ থেকে পেলাম তিরস্কার আর অবমাননাকর আচরণ। কত বড় আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা তাঁর মধ্যে সেদিন কাজ করেছিল, যার দরুন তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে অশােভন ব্যবহার করতে সংকোচবােধ করেননি! আমি মনে মনে ভাবলাম, তার কথা অমান্য করলে হয়তাে তিনি আমার ক্ষতি করতে পারেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবকিছু বিবেচনা করে আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। উপাচার্য আবার আমাকে লক্ষ করে বললেন, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে তােমাকে বন্ড সই করতে হবে। প্রতিবাক্যে তাঁকে আমি সবিনয়ে বললাম, “স্যার, আমি তাে কোনাে অন্যায় করিনি। কেন আমাকে বন্ড সই করতে হবে। তার কোনাে কারণ আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’ তিনি রাগতকণ্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কে বললাে অন্যায় করােনি? তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা মানছ না। এ জন্য তােমাকে জেল খাটতে হয়েছে। আমি জবাব দিলাম, স্যার, আমি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হইনি। পুলিশ সন্দেহ করে আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল, সন্দেহমুক্ত হয়ে আবার ছেড়ে দিয়েছে। আমার বক্তব্য তাঁর পছন্দ হলাে না । তিনি আবার আমাকে বললেন, ‘বন্ড সই না করলে তােমাকে শাস্তি ভােগ করতে হবে। আমি উত্তর দিলাম, স্যার, শাস্তি পাওয়ার মতাে কোনাে অপরাধ আমি করিনি। বন্ড সই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্রুদ্ধ স্বরে উপাচার্য আমাকে তাঁর কক্ষ ত্যাগ করার আদেশ দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার কক্ষ ত্যাগ করে ফজলুল হক হলে চলে আসি।
কয়েক দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিঠি পেলাম। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। ফজলুল হক হল ত্যাগের নির্দেশও দেওয়া হলাে। আমার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। বহিষ্কারের কথা বাড়িতে বাবাকে জানানাে সম্ভব নয়। এ খবর শুনলে তিনি মনে ব্যথা পাবেন। আমার ওপর তিনি খারাপ ধারণা নেবেন। বাবাকে আমার এই দুঃসংবাদের কথা জানালাম না। ফজলুল হক হল ছেড়ে দিলাম। আমি ইকবাল হলে আশ্রয় নিলাম। ইকবাল হল ছিল তখন বাঁশের তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখানে বিনা ভাড়ায়। থাকতেন। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাই। ড. কামাল হােসেন আমার ছাত্র ছিলেন।
একদিন ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা আমাকে বললেন, ‘মুসলিম লীগ। সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের উন্নতির কোনাে আশা করা যায় না। আসুন, আমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করি।’ তাঁদের কথার প্রতি আমি সম্মতি জানালাম। ঢাকার রােজ গার্ডেনে বশীর আহমদের বাসায় সরকারবিরােধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে শামসুল হক, খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, শওকত আলী, শামসুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, ইয়ার মােহাম্মদ খান, আমিসহ প্রায় ৩০০ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলাম। এ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানি আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভার উদ্যোক্তারা আমাকে এই নবগঠিত দলের কর্মকর্তার পদ দিতে চেয়েছিলেন। আমি বড় পদ গ্রহণ করতে রাজি হইনি। কোনাে সংগঠনের। উচ্চতর পদ গ্রহণের যােগ্যতা ও অভিজ্ঞতা তখনাে আমি অর্জন করতে পারিনি। তাই কর্মকর্তার পদ গ্রহণ করতে রাজি হলাম না। সাধারণ সদস্য হিসেবে পার্টির কাজ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করি। উদ্যোক্তারা আমাকে সাধারণ সদস্য হিসেবেই পার্টিতে রাখলেন। আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল ১৯৪৯-এর ২৪ জুন। অচিরেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক চুকে যায়।
১৯৫০-এর কথা। আমি ফজলুল হক হলের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে ব্যারাকে একটি চায়ের দোকানে বসে আছি। আমার পাশের টুলে বসা সেক্রেটারিয়েটের দুজন কর্মচারীর কথােপকথন আমার কানে ভেসে আসে। তাঁরা একজন আরেকজনকে বলছেন, ছাত্রদের আন্দোলন থেমে গেল, বাংলা আর রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে না, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হয়ে যাবে। আমরা উর্দু পড়তে-লিখতে পারি না। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে আমাদের কতই না অসুবিধা হবে! কী আর করি! আমরা চাকরি করে খাই। আন্দোলনে নামা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ছাত্ররা ছিল আশা-ভরসা। তারাও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এ কথাগুলাে আমার পছন্দ হলাে। কথাগুলাে একেবারে সত্য, সমকালীন সমাজের জনমতের প্রতিধ্বনি। এই বর্ণনা আমার মনের মধ্যে গ্রথিত হয়ে গেল। সরকারি কর্মচারীর এই মূল্যবান বক্তব্য আমার ভবিষ্যৎ চলার পথে আলােকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পালন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে আমতলায় এক ছাত্রসভা চলছে। সভার এক কোণে বসে ছাত্রনেতাদের বক্তৃতা শুনছি। কোনাে বক্তার বক্তৃতাই আমার ভালাে লাগছে না। এক পর্যায়ে আমি দাড়িয়ে সভার সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আমি কিছু বলতে চাই।’ সভাপতি আমাকে বলার অনুমতি দিলেন। সেক্রেটারিয়েটের সেই কর্মচারীর বক্তব্যের আলােকে আমি সভায় বক্তৃতা দিলাম, এভাবে সভা করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা যাবে না। আপনারা আজ যা কিছু করছেন আর বলছেন, তা সবই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এতে কোনাে কাজ হবে না। যদি বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তবে রাস্তায় আন্দোলনে নামুন। আন্দোলন করতে হলে চাই সংগঠন। আপনারা সংগঠন গড়ে তুলুন। আমার এই, বক্তব্য শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া জাগাতে সমর্থ হলাে। তারা করতালি দিয়ে আমার বক্তৃতাকে স্বাগত জানায়। উপস্থিত শ্রোতাদের চাপে সভার উদ্যোক্তারা তাৎক্ষণিকভাবে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সভামঞ্চ থেকে শ্রোতাদের কাছে কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যদের নাম ঘােষণা করা হলে দেখা গেল, তাতে আমাকে। | একজন সাধারণ সদস্য হিসেবেও রাখা হয়নি। ফলে সভায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সভার শ্রোতারা আমাকে সংগ্রাম কমিটিতে নেওয়ার জন্য দাবি তােলে। তাদের শান্ত করার জন্য কমিটির সদস্য হিসেবে আমাকে নেওয়া হয়। এতেও সভার শৃঙ্খলা ফিরে এল না। শ্রোতারা আমাকে কমিটির প্রধান কর্মকর্তারূপে পেতে চায়। তাদের দাবি অগ্রাহ্য করার মতাে সাহস সেদিন ওই সভার কর্মকর্তাদের ছিল না। শ্রোতাদের চাপে সভার উদ্যোক্তারা আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক করেন।
আমি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি-কোনাে দলেরই নই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের ওপরও আমার ব্যাপক কোনাে প্রভাব নেই। এর ফল দাঁড়াল এই যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা। সংগ্রাম কমিটির সব সদস্যই আমার সঙ্গে অসহযােগিতা করেন। মৌখিকভাবে আমি কয়েকবার সংগ্রাম কমিটির সভা আহ্বান করি। কোনাে সদস্যই কোনাে সভায় যােগদান করলেন না। এরপর সদস্যদের। লিখিত নােটিশ দিয়ে সভা আহ্বান করি। তাতেও কোনাে কাজ হলাে না। কেউ সাড়া দিলেন না। কোনাে সদস্যই সভায় উপস্থিত হলেন না। কমিটির কোনাে ফান্ড নেই। ফান্ড ছাড়া কোনাে সংগঠনের কাজ চালানাে। যায় না। এমনি পরিস্থিতিতে সংগ্রাম কমিটির অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন। আমি নিরাশ হলাম না। একদিন সংগ্রাম কমিটির নামে আমি নিজে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করি। প্রস্তাবটি হলাে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকায় পতাকা দিবস উদ্যাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবটি নিয়ে আমি অবজারভার অফিসে যাই। প্রস্তাবটি। পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব জামাল জাহেদীর হাতে দিয়ে আমি তাঁকে। সেটি ছাপানাের জন্য অনুরােধ জানাই। জাহেদী ভাই প্রস্তাবটি একবার পড়লেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিটিং ঠিক হয়েছে তাে? আমি উত্তর দিলাম, ‘জি, হঁা।’ সভা হয়নি, আহূত সভায় কমিটির কোনাে সদস্যই যােগ দেননি। প্রস্তাবটি যাতে পত্রিকায় ছাপানাে হয় সে জন্য সভা হয়েছে বলে চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলাম। জাহেদী ভাই আমার। অনুরােধ রক্ষা করেছিলেন। পরের দিন প্রস্তাবটি বক্স করে অবজারভারএর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়। পত্রিকায় সংবাদটি পাঠ করে আমি। শাঁখারীবাজারে যাই। সেখানকার একটি দোকান থেকে কয়েকটি টিনের কৌটা কিনি। এরপর একটি প্রেসে যাই। প্রেসের অফিসে বসে এক টুকরা সাদা কাগজে একটি ব্যাজের খসড়া তৈরি করলাম। কাগজে মােটা অক্ষরে লিখলাম, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। নিচে লিখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’। খসড়া ব্যাজটির ৫০০-৬০০ ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য প্রেস ম্যানেজারকে অনুরােধ জানাই। তিনি ঘন্টাখানেকের মধ্যে সেগুলাে ছাপিয়ে দেন। ব্যাজগুলাে ছাপার খরচ পড়েছিল ৩০-৩৫ টাকার মতাে। টিনের কৌটাগুলাের গায়ে বড় অক্ষরে লিখলাম, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সবাই সাধ্যমতাে সাহায্য করুন।
১০-১৫ জন ছাত্রসমেত ব্যাজ ও কৌটাগুলাে নিয়ে সেক্রেটারিয়েটের গেটে যাই। আমরা সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীদের ব্যাজ পরিয়ে দিয়ে আর্থিক সাহায্যের জন্য কৌটাগুলাে তাদের সামনে তুলে ধরি। তাঁরা সবাই কৌটার ভেতরে টাকা-পয়সা গুঁজে দিলেন। সেদিন সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীদের কাছ থেকে ৯০০ টাকার ওপরে সাহায্য পাই। সিকি, আধুলি, এক টাকা, এমনকি পাঁচ ও ১০ টাকার নােটও কৌটার ভেতরে পড়েছিল। নেতাদের সাহায্যে প্রথম পতাকা দিবস পালন করি। এই দিবস পালন করার ফলে আমি বহু কর্মী পেয়ে যাই। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির ফান্ডও তৈরি হয়ে যায়। এবার আমি সম্পূর্ণ হতাশামুক্ত হয়ে ভাষা আন্দোলনকে সক্রিয় করে তােলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করি।
পােস্টার করে পতাকা দিবসে অর্থ সংগ্রহের খবর ছাত্রদের জানিয়ে দিলাম। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি বিরাটভাবে ১১ মার্চ পালন করে। অবজারভার পত্রিকায় ১২ মার্চ সংখ্যায় এ সংবাদ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের সদস্যদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করার সিদ্ধান্ত আমরা নিই। আমি নিজেই এটি লেখার কাজে হাত দিলাম। লিখে ফেলতে সমর্থও হলাম।
১১ এপ্রিল আমি স্মারকলিপি লিখেছিলাম। এতে আমরা বলেছিলাম, ‘বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা এবং পাকিস্তানের অধিকাংশ লােকের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমেই কেবল পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা করা সম্ভব। এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এ দেশের ছাত্রসমাজ ও জনগণ কখনাে আন্দোলন থেকে ক্ষান্ত হবে না। আন্দোলন জয়যুক্ত হবেই।
স্মারকলিপিকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আপনারা দেখবেন বলে আমরা আশা করি।’ গণপরিষদের সব সদস্যের কাছে এবং পাকিস্তানের সব পত্রিকা অফিসে এই স্মারকলিপির কপি ডাকযােগে পাঠানাে হয়। এই স্মারকলিপি বিরাট আলােড়ন সৃষ্টি করে। দেশের উভয় অংশের বহু পত্রিকায় এই স্মারকলিপির সংবাদ ছাপানাে হয়। সীমান্ত প্রদেশের দৈনিক খাইবার মেল সম্পাদকীয় লিখে আমাদের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানায়। পাকিস্তান। টাইমস-এ এ স্মারকলিপি সমর্থন করে অনেক চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়। এসংক্রান্ত যাবতীয় খবর আমরা পােস্টারে লিখে, দেয়ালে এঁটে তা ছাত্রদের জানিয়ে দিই। ছাত্রদের মধ্যে এতে বিরাট উৎসাহের সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেন, ১৯৪৮ সালে মার্চের পরে ১৯৫২ সালের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত। ভাষার ব্যাপারে কোনাে তৎপরতা ছিল না। তাদের এই ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। ১৯৫০-৫১ সালে ভাষার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির ব্যাপক তৎপরতা ছিল।
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫১ আমরা স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি স্থাপন করুন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন’ শিরােনামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করি। এটি ছাত্রদের মধ্যে আমরা ব্যাপকভাবে প্রচার করি।
২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে ঘােষণা দেন। এর প্রতিবাদে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ ৩০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীক ধর্মঘট আহ্বান করে। এ ধর্মঘট স্বঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। এদিন ১০-১৫ হাজার লােকের অভূতপূর্ব মিছিল হয়। জনসাধারণ রাস্তায় সমবেত হয়ে সে মিছিল দেখে এবং তাকে অভিনন্দন জানায়। মিছিল শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানাই। এ কর্মসূচিও সফলভাবে পালিত হয়।
৩০ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। এর অন্যতম প্রধান শরিক দল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় যেসব সংগঠন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম।
প্রধান ছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। ২১ ফেব্রুয়ারির মাত্র ২০ দিন আগে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়মতান্ত্রিকতা রক্ষার দোহাই দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চরম বিরােধিতা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, যুবলীগ ও সাধারণ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে এ আন্দোলনের অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম