You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | রাষ্টপতির ভাষণ: একটি সতর্কবাণী | ডাক বিভাগের গাফিলতি | গরম বেজায় গরম! | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২৯শে চৈত্র, ১৩৭৯

রাষ্টপতির ভাষণ: একটি সতর্কবাণী

বহুতর সমস্যা, বিচিত্র আমাদের যাত্রাপথ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সমস্যা যেমন অন্ত নেই তেমনি তার সমাধানের জন্য আমাদের খুঁজতে হচ্ছে বাস্তবমুখী অথচ বিচিত্র নানা পথ। সমস্যা-সকল পথে এগিয়ে যেতে নানা প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে এসে দাড়াবে, ক্ষণিক হতাশা আবার বিজয়ের তৃপ্তি আমাদের প্রেরণা জোগাবে। চলার পথে ভুল ভ্রান্তিকে সংশোধন করে রচনা করতে হবে আগামীর পরিকল্পনা। গত দশই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী এমনই নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন আমাদের অতীত কার্যক্রমের মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে ভুলভ্রান্তি দূরীকরণের দিক নির্দেশ দিয়েছেন।
স্থিতিশীল সমৃদ্ধি অর্জনের কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই স্বাধীনতা-উত্তর এক শ্রেণীর মানুষের হঠকারী নানা কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে এই সরল সত্য কথাটা অত্যন্ত স্বার্থহীন ভাষায় তিনি উল্লেখ করেছেন তার ভাষণে। সত্যি কথা বলতে কি এক শ্রেণীর মানুষ যেমন ত্বড়িৎ কোন ফল লাভ না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন তেমনি আবার এক শ্রেণীর লোক যে করে হোক রোদ থাকতে ধান শুকিয়ে নেয়ার মহাজনী পন্থা অনুসরণ করছেন। লোভ-লালসা এবং সেইসঙ্গে নিরর্থক বঞ্চনাবোধ জনসাধারণের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে যা নবজাত এই রাষ্ট্রের পুনর্গঠন এবং বাস্তব উন্নয়নের পক্ষে বাধা স্বরূপ। রাষ্ট্রপতি তাই সৎ ও বাস্তবসম্মত চিন্তার আলোকে প্রতিটি মানুষকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নয়া সমাজ গঠনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
যে চেতনা একদিন বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল সেই চেতনা এবং অনুভব নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে মুক্ত স্বদেশ। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হলো বিশ্বের এই বৈপ্লবিক সমাজ ব্যবস্থা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞানার্জন। মোহাচ্ছন্ন সমাজ অথবা লোভাতুর ব্যক্তি গোষ্ঠী দ্বারা এই নয়া সমাজের নির্মাণকার্য সম্ভব নয়। অথচ তড়িৎ অর্থপার্জনের একটা প্রতিযোগিতা সমাজের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। এটা সংক্রামক ব্যাধির নায়ক বিস্তৃত লাভ করেছে এবং শক্তিশালী প্রতিরোধ এর অভাবে তারা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে চলেছে। রাষ্ট্রপতি এই অবাঞ্চিত অবস্থার প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন এটা সমাজতন্ত্রের পথ নয়। সমস্ত জনগোষ্ঠীর ন্যায়ানুগ সমৃদ্ধিই সমাজতন্ত্রের ভিত্তি। সমাজতান্ত্রিক দেশে একদিকে যেমন সকলের আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয় তেমনি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিশেষে হাতে অর্থ পুঞ্জিভূত হবার কোনো সুযোগ থাকেনা। সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষিত হবার পরও এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যে উল্টো স্রোত প্রবাহের প্রচেষ্টা চলছে সময় থাকতেই তা রোধ করতে হবে। রাষ্ট্রপতির এই সতর্কবাণী কি তাদের চোখ খুলতে সহায়তা করবে?

ডাক বিভাগের গাফিলতি

ডাক বিভাগের গাফিলতি শিরোনামায় প্রতিদিনই কোন না কোন কাগজে কোন না কোন খবর থাকছেই। এটা যেন একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার আগে এ সমস্যাটি যেমন ছিল এখন তার চাইতে কিছুতো কমেইনি-বরং বেড়েছে।
সাধারন চিঠিপত্র সময়মতো ঠিক ঠিক ভাবে বিলি হবে এমনটা পত্র-প্রেরকগণ কোনদিনই আস্থার সাথে বিবেচনা করেন নি এখনো করতে পারছেন না। কিন্তু টেলিগ্রাম, মানি অর্ডার বা টেলিগ্রাম মানি অর্ডার এর মত ব্যয়বহুল ও গুরুত্বপূর্ণ ডাক যোগাযোগের অনেক সময় অনেক গাফিলতি খবর পাওয়া গেছে।
বেশ কিছুদিন আগে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার দৈনিক রিপোর্টার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তো বেশ কিছু টেলিগ্রামের কপি কুড়িয়েই এনেছেন। অথচ এই টেলিগ্রাম গুলো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকা প্রবাসী পরিজনদের কাছে পাঠিয়েছিলেন তাদের স্বজনেরা। শুধু তাই নয়, খুব একটা মারাত্মক বা জরুরী কোন কিছু না হলে আমাদের দেশের মানুষ টেলিগ্রাম করে না, অথচ সেই টেলিগ্রাম তার প্রাপকের হাতে না দিয়ে রমনার মাঠে হাওয়া খেতে গেছে।
মানি অর্ডারের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা কোন কোন মানি অর্ডার নাকি ঢাকা থেকে খুলনা বা নোয়াখালী বা দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, ছয় মাস কোন কোন সময় বছরও পেরিয়ে দেয়। শুধু কি তাই, একটি টেলিগ্রাম মানি অর্ডার নাকি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে ৩৪ দিন সময় নিয়েছিল। এই হচ্ছে আমাদের ডাক যোগাযোগের একটি দিক। আর সেই অবস্থায় ডাক বিভাগের গাফিলতির অভিযোগও আসছে সংবাদপত্রে। ছাপাও হচ্ছে সেসব অভিযোগ। কিন্তু প্রতিকার কি খুব একটা হচ্ছে? তেমন তো কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
অথচ এসব এর প্রতিকার হওয়া উচিত। ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এহেন নৈরাজ্যের হাত থেকে দেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কেননা জাতীয় জীবনে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডাকো তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই ডাক ও তার বিভাগের কর্মপদ্ধতিকে ঢেলে সাজিয়ে গণমুখী করে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য নতুন পরিকল্পনা দরকার। আর নতুন পরিকল্পনার জন্য দরকার সমাজতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় উদ্বুদ্ধ কর্মীর। ডাক বিভাগের সেই কর্মীর অভাব সর্বত্রই পরিলক্ষিত।

গরম বেজায় গরম!

ঢাকায় লু হাওয়া বইছে। প্রচন্ড গরম, ঘরে তেষ্ঠানো দায়। বাইরে তো নরকের চিতা। এক পা এগুলে দর দর করে ঘাম ঝরতে থাকে। এটা ব্যতিক্রম। আমরা অভ্যস্ত নই তাই বাঁচা যাবে না বাঁচা যাবে না বলে হল্লা করছি। বেশি দূর দেশে নয়, দু’কদম এগুলেই ভারত। সেখান থেকে সংবাদ আসবে আর দুচার দিনের ভেতরেই প্রচণ্ড গরমে তেইশ জনের মৃত্যু।
বাংলাদেশের তেমন গরম নেই। গরম শুধু বাজার আর মেজাজ। গরম বাজারে এক চক্কর ঘুরে এলে মেজাজটাও গরম হয়ে ওঠে। গরম হয়ে ওঠে মানুষ আঁতেলেকচুয়ালদের নানা রকম রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। কথা নেই বার্তা নেই ‘শব্দ বিপ্লব’ অথবা ‘লেখা বিপ্লব’ ঘটে গেল কোনখানে। দুনিয়ার তাবৎ গোপন চুক্তি আর গোপন প্রেশারের খবর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণকারীদের মনে হাই প্রেসারের সৃষ্টি করে। তাদের ‘কাটুম কুটুমে’ ঠান্ডা মাথায়ও আগুনের ফুলকি জ্বলে।
গরম বেশ প্রচুর লোকের মাথা। এটা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। আসছে আর আসছে কোত্থেকে যে এত টাকা জেব-এ এসে ঢুকেছে তার হিসেব নিকেশ পাওয়া দুষ্কর। মাথা গরম, চাই আরো চাই। এত যখন এসেছে তখন আরও আসবে। আর একটা খুন, দুচারটা পারমিট। মন্ত্রণালয়ের এ দপ্তর সে দপ্তর মাথায় আগুন জ্বলছে। সব মিলে গরম। ঢাকার বাজার, মানুষের মেজাজ আর দিন-রাত্রির আবহাওয়া। লু হাওয়া বইছে ঢাকায়। স্বাধীনতার পর মুহূর্ত থেকেই এর তাপ আমরা অনুভব করছি। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে দিন-রাত্রির আবহাওয়াও বদলে যাবে লু হাওয়াও আর তখন বইবে না। কিন্তু এর তাপ। এ তাপ কমবে কবে? এ গরমে শেষ কোথায়?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন