বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৯ এপ্রিল রোববার, ১৬ই বৈশাখ, ১৩৮০
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের তালিকা
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের তালিকা প্রতিটি দোকানে টাঙ্গিয়ে রাখার জন্য সরকার আবার ব্যবসায়ীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিপূর্বেও সরকারি মূল্য তালিকা সর্বসময় সর্বসাধারণে প্রদর্শন করতে হবে বলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তথা আমদানিকারক, ডিলার, বিক্রেতা ও উৎপাদকের প্রতি এক নির্দেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সেই নির্দেশের প্রতি রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। তারা সরকারি নির্দেশের কোন তোয়াক্কা করেননি। নিজেদের খেয়ালখুশি মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য দ্রব্যের মূল্য দিনের-পর-দিন চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়িয়ে চলেছেন এতে জনগণের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। সীমিত আয়ের ভোগীদের অবস্থা যে কতটা সঙ্গীন তা কেবল ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করছেন। ডিলার, আমদানিকারক, উৎপাদক ও বিক্রেতাদের এই আচরণ সরকার আর বরদাস্ত করবেন না বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেল। নির্দেশ অমান্যকারী দের বিরুদ্ধে সরকার শাস্তিমুলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৭৩ সালের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য মূল্য ও বিতরণ আদেশ অনুযায়ী তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকার ইতিমধ্যেই ঢাকা শহরের ১৭০ জন ব্যবসায়ী ও নিয়মানুবর্তিতা সংশোধন করার জন্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, নইলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সাধারন জনগনের নিত্যদিনের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা মোচন করার জন্য সরকার যে তৎপরতা চালাচ্ছেন না, তা নয়। তবুও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে জনগণের জীবনে আজ ত্রাহি মধুসূদন রব উঠেছে। ব্যবসায়ীরা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী করে তুলেছেন। বাজারের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, ব্যবসার সমস্ত রীতিনীতি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আঙ্গুলি সংকেতে পরিচালিত হচ্ছে। বাজারদরের ব্যাপারে সরকারের জন্য ‘নীরব দর্শকে’র ভূমিকায় ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই। এই অবস্থায় কোন দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আকাল দেখা দেয়নি। মালকড়ি ছাড়লে বাজার থেকে অবাধে সব দ্রব্যই ক্রয় করা যায়। কিন্তু তাতে স্বপ্নবৃত্তের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে। জনসাধারণের মনে বিক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। যে দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’, সেদেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের একটি নির্ধারিত বাজারদর থাকা একান্ত দরকার। দোকান ভেদে একই দ্রব্যের বিভিন্ন মূল্য সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। অথচ বাংলাদেশের এই অবাঞ্ছিত ঘটনারই যেন জয়জয়কার চলছে। সরকারকে তাই বার বার জারি করতে হচ্ছে নতুন নতুন নির্দেশ। এতে কতটুকু কাজ হবে, কতটুকু কাজ হবেনা তা নির্ভর করছে ব্যবসায়ীদের সততা ও নিষ্ঠার ওপর। এ ব্যাপারে সরকারের কর্তব্য একবারে নগন্য নয়। কারণ সরকার যদি নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কোনো রকম কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তাহলে ব্যবসায়ীদের আস্কারা বেড়ে যাবে এবং সরকারের প্রতি জনসাধারণের রাস্তার অবনতি ঘটতে বাধ্য। ঘোষণা এবং নির্দেশ স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য দ্রব্যের রশি টেনে রাখতে পারেননি। ব্যবসায়ীরা বগল বাজিয়ে তাদের উদার করে চলেছে। জনগণকে বহন করতে হচ্ছে অন্তহীন দুর্ভোগের বোঝা। জনসাধারণ দীর্ঘদিন ভারবাহী হয়ে থাকবে না, সরকারকে এ কথাটি জেনে রাখা দরকার। দোকানে দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের তালিকা টাঙ্গানোর সরকারি নির্দেশটির আমরা বাস্তবায়ন চাই। এবং এই নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত দণ্ড প্রদান করতে সরকার ব্যর্থ হন, তাহলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ঊর্ধ্বগতি ইহজনমে আর রোধ করা সম্ভব হবে না। নির্দেশ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কঠোর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য দ্রব্যের মূল্য তালিকা দোকানে ও ব্যবসা কেন্দ্রের টাঙিয়ে রাখার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ প্রহসনে পরিণত হলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার-এ কথাটি যেনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভুলে না যান।
পরগাছা উচ্ছেদ অভিযান
স্বাধীনতার পর একশ্রেণীর ভুয়া ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্যে জনসাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এক টাকার মাল চার টাকায় বিক্রি পেছনে রয়েছে ভুয়া ব্যবসায়ী শ্রেণি। এদের বদৌলতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে আগুন। বিলম্ব হলেও সরকারের দমন করার জন্য এগিয়ে এসেছেন।
সরকার ঢাকা শহরে ৭৮ জন ডিলারের লাইসেন্স ও ডিলারশিপ বাতিল করে দিয়েছেন। এই ৭৮ জন এর মধ্যে ৩৯ জন সিমেন্টের, ২০ জন ভোগ্য পণ্যের, ৯ জন টায়ার টিউব এর, ৪ জন কাপড়ের এবং ৬ জন লোহা ও ইস্পাত সরঞ্জামের ডিলার। এদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়াও সরকার ১৭০ জন ডিলারকে বিবিধ অনিয়মের জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন।
গত শুক্রবার শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে ১হাজার ২শত ৭৭টি ভুয়া লাইসেন্স উদ্ধার করেছেন। তিনি আরো বলেন যে, এই সব ভুয়া ব্যবসায়ীর কোনো জমি নেই, বাড়ি নেই, ফ্যাক্টরি বা শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই। লাইসেন্স এর মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি করে কালোবাজারি করাই ছিল তাদের অন্যতম কাজ। সম্প্রতি এই সব ভুয়া ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করে আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আমদানি রপ্তানি বিভাগের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে শিল্প মন্ত্রী জানান। একথা আজ আর কারো অজানা নেই যে, একশ্রেণীর ফরিয়া ও টাউট অন্যায় ও অসঙ্গত উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জাঁকিয়ে বসেছে। এদের একমাত্র লক্ষ্য হল পরগাছার মত মুনাফা শোষণ করে নেয়া। এদের মধ্যে অনেকেই সামান্য ব্রিফকেস সম্বল করে নানান অফিসে দৌড়াদৌড়ি করে লাখ লাখ টাকা কামাই করেছে।
সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার লাঘব করার জন্য জরুরিভিত্তিতে জিনিসপত্র আমদানি করেছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যাতে আকাশচুম্বী না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময় সে জিনিসপত্র আমদানি করেছেন সেগুলো তথাকথিত ব্যবসায়ী নামধারী পরগাছারা লোপাট করে দিয়েছে। বেআইনিভাবে একহাতে লাইসেন্স নিয়ে অন্য হাতে চালান করে দেয়ার ফলে জিনিসপত্রের মূল্য হয়েছে আকাশচুম্বী। তাছাড়া আমদানিকৃত মাল বাজারে চলে যাবার মূলে এদের ভূমিকা ও কম নয়। এই পরগাছাদের জন্য সরকারের পক্ষেও সম্ভব হয়নি জিনিসপত্রের দাম কমানো।
সরকার তথাকথিত ব্যবসায়ী নামধারী পরগাছাদের উচ্ছেদ অভিযানের যে কর্মসূচি নিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। তবে এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই যে, ব্যবসায় ক্ষেত্রে এই যে সংকট ও সমস্যা, বাজারের দুরবস্থা তার কারণ ভালো ভাবে তলিয়ে দেখা প্রয়োজন এবং সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক