You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | খলের ছলের অভাব নেই | বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা | জিনিসের দাম বাড়ছেই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ১৩ই বৈশাখ, ১৩৮০

খলের ছলের অভাব নেই

খলের ছলের অভাব হয় না। প্রেসিডেন্ট ভুট্টোরও তেমনি ওজর-আপত্তির সীমা নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে এটা সুস্পষ্ট ভাবে বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণায় স্থান পাওয়ার পর তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন পাকিস্থানে আটক বাঙ্গালীদের বিচার করতে। তাদের অপরাধ তারা বাঙালি। আর যেহেতু তাদের মুক্ত স্বদেশ বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে সেইহেতু তাদের আটকে রাখা হবে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগের বুনোট যত শক্ত হবে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকবে। অবশেষে লক্ষ লক্ষ জীবন নিয়ে ছেলেখেলারই আশ্রয় নিয়েছেন পাক-তখতের গদীনসীন সম্রাট।
আমরা শান্তি চাই। শান্তির পথে সমৃদ্ধিই আমাদের কাম্য। মূলত এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ এবং ভারত উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য রেখেছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকল সুযোগ সুবিধা। কোন গোপন আদালতের নয়, বরং প্রকাশ্যে বিচার করা হবে তাদের। সেখানে আসামিপক্ষকে যে কেউ সমর্থন করতে পারবেন, দেশি-বিদেশি যেকোনো ব্যক্তি এই বিচারনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবেন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে কি কি অপরাধ করেছে, কত নৃশংসভাবে হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র জনসাধারণকে তা আর বিশ্ব মানুষের অজানা নেই। এটা অপরাধ এবং এই অপরাধ যাতে কোনো স্থানে কোন দেশে পুনঃসংগঠিত না হয় অন্তত সে জন্যও প্রয়োজন রয়েছে অপরাধীদের বিচার হওয়ার। কিন্তু ভুট্টো সাহেব এই সহজ-সরল সত্যটা কি হজম করতে পারছেন না। প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিচার প্রহসনের আয়োজন করছেন নিরীহ বাঙ্গালীদের।
ইতিমধ্যে তার এই উম্মাদসুলভ ঘোষণা বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছে বিশ্বজনমনে। ফ্রান্সের প্রবীণ চিন্তাবিদ আঁদ্রে মালরো একে চরম নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করেছেন। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভুট্টো সাহেবের এই সিদ্ধান্ত অন্তরায় সৃষ্টি করবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমাদের রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে বিশ্ব বিবেককে অধিকতর সোচ্চার হবার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ রাষ্ট্রপতি আহবানে সাড়া দেবেন। পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের অবিলম্বে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সব্বাই সমবেতভাবে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের যে আড়াই লাখ অবাঙালি পাকিস্থানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাদের ও পাকিস্তানের প্রত্যাবর্তন এর ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হোক এটা আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার এটাই পূর্ব শর্ত।

বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা

অবস্থা খুবই খারাপ। খারাপ বলেই মার্কিন সপ্তম নৌবহর কম্বোডিয়ার উপকূলবর্তী উপসাগরে এসে ভিড়েছে। অন্যদিকে মার্কিন বি ৫২ বোমারু বিমান গুলো লননলের সাহায্যে এগিয়ে এসে নমপেনের চারিদিকে এলোপাথাড়ি বোমা বর্ষণ শুরু করেছে।
কমিউনিষ্ট বাহিনী গত ক’দিন ধরে প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে রাজধানীকে একবারে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। সরকারি বাহিনী এই আক্রমণ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আক্রমণ মোকাবেলায় ব্যবহার করেছে বি ৫২ বোমারু বিমান।
সপ্তম নৌবহর এসেছে। ওকিনাওয়ার ঘাঁটি থেকে নাকি মার্কিন নৌ সেনারা ও কম্বোডিয়ার দিকে যাত্রা করেছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা খুবই গুরুতর।
কম্বোডিয়ার মাটি থেকে যদি লননলের মতো তাঁবেদার মোসাহেব বিদায় নেয় তাহলে তো একে একে সব প্রদীপ নিভে যাবে। অবস্থার চাপে পড়ে ভিয়েতনামের মাটি থেকে মার্কিন সৈন্যরা পাততাড়ি গুটালেও থাইল্যান্ডের একটা বোমারু বিমান ঘাঁটির অস্তিত্ব রয়েছে। প্রয়োজন পড়লে সেখান থেকে যেন হামলা চালানো যায় ঝাকে ঝাকে বোমারু বিমান গুলো সেখান থেকেই উড়ছে। সংবাদে আরো প্রকাশ, জরুরিভিত্তিতে কম্বোডিয়ায় উন্নত মানের সৈন্যদের নিয়োজিত করার কথাও মার্কিন সরকার গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করছেন।
মার্কিন সরকার যাই করুন না কেন শেষ রক্ষা যে হবেনা এটা বাস্তব সত্য। বাস্তবতাকে মার্কিন সরকার একচক্ষু হরিণের মতো উপেক্ষা করলেও এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। উত্তর ভিয়েতনামের মাটিতে প্রচন্ড বোমাবর্ষণ করে মাইন পেতে হাইফং বন্দর অবরোধ করে ও শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনামের মুক্তিকামী জনসাধারণের মনোবলকে দমন করা যায়নি। কম্বোডিয়ায়ও যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর এলাকায় এসেছিল। কিন্তু নৌবহরের হুমকিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউয়ের গতি স্তিমিত হয়ে যায়নি।
মার্কিন সরকার যে এ সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন না এমন নয়। তবে দুই যুগ আগে ভুল করে যে অন্যায় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়েছিল তা থেকে পরিত্রাণ লাভের কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। বাঘে ছুঁলে নাকি আঠারো ঘা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাটাও আজকের দিনে তাই।

জিনিসের দাম বাড়ছেই

দেশের সর্বত্র খাদ্যদ্রব্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। পত্র পত্রিকার পাতা উল্টালেই তা চোখে পড়ে। চালের দাম কমাবার কার্যকর ব্যবস্থা চাই শীর্ষক একটি রিপোর্ট তো গত সোমবারের বাংলার পানিতে প্রকাশ পেয়েছে। অথচ তবুও চালের দাম সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, ইদানিং দ্রব্যমূল্য যে হারে বেড়ে চলেছে তা দেখে মনে হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে কে কোন জিনিসের কতখানি মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বৃদ্ধির মত এখন চক্রবৃদ্ধিহারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর ফলে আপামর জনগণের, বিশেষ করে শহর অঞ্চলের নির্ধারিত আয় এবং পল্লীর গরীব কৃষক, দিন মজুর ইত্যাদি স্বল্প আয়ের মানুষের যে কি নিদারুণ দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হতে হচ্ছে সে কথা বলাই বাহুল্য।
দেশে খাদ্য ঘাটতি আছে তা সরকার স্বীকার করেছেন। এই ঘাটতি পূরণের প্রচেষ্টাও সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন সেকথা সরকারি ঘোষণা থেকে জানা যায়। কিন্তু জনগণের কাছ থেকে এই অভিযোগও শোনা যায় যে, যে জিনিস বাজারে বা দোকানের নেই বলে জানা যায় সেই জিনিসের চলতি মূল্যের চাইতে অধিক মূল্য দিতে চাইলে তা তক্ষুনি পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের মর্জির উপর নির্ভর করছে জিনিস পাওয়া যাবে কি না। সরকার খাদ্য দ্রব্য এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যত কমানোর চেষ্টা করছেন জিনিসপত্রের দাম তত বেশি বেড়ে চলেছে। এবং ক্রমান্বয়ে এই অবস্থার পরিণতি যে দিকে এগিয়ে চলেছে তা কোনক্রমেই দেশের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা অবসানের এতোটুকু ইঙ্গিত বহন করছেন না। স্বাধীনতার পর পরই দেশের অর্থনৈতিক সংকট যে মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করেছিল তা সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাটিয়ে উঠেছিলেন। ভবিষ্যৎ অবস্থার প্রতি সরকার সজাগ আছেন সত্য, কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে যেভাবে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করে চলেছেন তাতে এই অবস্থায় সরকারকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর মনোভাব পোষণ করতে হবে কার্যকরভাবে। সেইসঙ্গে জনগণকে সতর্ক হতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে ইচ্ছামত সংকট সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে সরকার যেসব বিষয়ে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এবং জিনিসপত্রের অভাবে উদ্ভত সংকটাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন