You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.02 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | যে দীপশিখা তিনি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন | একটি কার্যকরী পদক্ষেপের আশ্বাস | পল্লী অঞ্চলের নলকূপ স্থাপন প্রকল্প | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২রা জুন, শুক্রবার, ১৮ই জৈষ্ঠ্য, ১৩৮০

যে দীপশিখা তিনি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন

তিনি সৎ এবং নির্ভীক সাংবাদিকতার আলোকবর্তিকা হাতে এসেছিলেন। সারাটা জীবন তিনি সেই আলোকবর্তিকা হাতে সংগ্রাম করেছেন আর সেই সংগ্রামেরই একপর্যায়ে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। দেশের মাটিতে নয়, যে দেশকে তিনি তার সংগ্রামী চেতনা দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন সেই দেশ থেকে সহস্রাধিক মাইল দূরে ইসলামাবাদের এক হোটেলে তার লোকান্তর ঘটে। আমরা তখন এক যুগ সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। সামরিক একনায়ক জেনারেল আইয়ুব গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতায় আসুন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, শাসন ভার অর্পণ করেছেন তার সামরিক অনুচর ইয়াহিয়ার কাছে। দেশের জারি হয়েছে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক আইন। জনসাধারণের কাছে আশ্বাস দেয়া হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের। মানিক মিয়া সহ অন্যান্য সম্পাদকদের ডাকা হল ইসলামাবাদে। সেই শেষ। আর তিনি ফিরে এলেন না। ইত্তেফাকের রঙ্গমঞ্চ ও কলাম প্রকাশ বন্ধ হল।
মানিক মিয়া নেই। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় যে গতিবেগ সঞ্চার করেছিলেন তা অনন্য। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ যন্ত্রণা তার লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে তাদের ভাষায়। এদেশে এমন কোন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন নেই যার অগ্রভাগে মানসিক মানিক মিয়াকে দেখা যায়নি। গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল নেতৃত্বের ঐক্যসূত্র ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। যে কথা বলতে সেকালে অনেকের বুক কাঁপতো সে কথা অনায়াসে এবং অত্যন্ত সহজ ভাবে তিনি লিখতেন। এজন্য তাকে কারারুদ্ধ হতে হয়েছে, তার প্রাণপ্রিয় কাগজ হয়েছে বাজেয়াপ্ত। সংসারের নেমে এসেছে অভাব-অনটন, দারিদ্র। সে নকল প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে দেশ এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মহান লক্ষ্যে তাকে দেখা গিয়েছে অবিচল। অসম্ভব দৃঢ়তা নিয়ে তিনি তার সংগ্রামী জীবন অব্যাহত (অস্পষ্ট) ছিলেন। আমৃত্যু যে সংগ্রামের দীপশিখা সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া জানিয়ে রেখেছিলেন তাকে বহন করে নেবার দায়িত্ব কি স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের সাংবাদিকরা গ্রহণ করবেন? একমাত্র সেভাবেই মানিক মিয়ার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা দেখাতে পারি।

একটি কার্যকরী পদক্ষেপের আশ্বাস

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ত ও গৃহ নির্মাণ মন্ত্রী জনাব সোহরাব হোসেন গত পরশুদিন সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি পরিত্যক্ত সম্পত্তির ভুয়া মালিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি পরিসংখ্যান জানিয়ে তিনি বলেছেন শুধু ঢাকায় ছয় হাজার দশটি পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে এখনও চার হাজার দুইশত একান্নটি পরিত্যক্ত বাড়ি অননুমোদিত দখলদারদের করায়ত্তই রয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, পরিত্যক্ত বাড়ি ঘর থেকে উৎখাত ও বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে দলগত কোন প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শন করা হয়নি। আগামী পাঁচসালা পরিকল্পনায় পয়ত্রিশ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে তার কিছু রদবদল হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া ঢাকায় যে এক হাজার একশত চল্লিশটি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলছে তা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি জানান। পূর্ত গৃহনির্মাণ মন্ত্রী জনাব সোহরাব হোসেন সাংবাদিক সম্মেলনে যে প্রতিবেদন পেশ করেছেন তার মধ্যে কোথায় আমরা অনুমান করছি পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি বেআইনিভাবে যারা দখল করে রেখেছে তাদের কাছ থেকে তা উদ্ধার করার শত চেষ্টা সত্ত্বেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। সে কারণে সর্বশেষে সরকার আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। আইনের মাধ্যমে বেআইনিভাবে সম্পত্তি দখলকারীদের নিকট থেকে তা করার পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে ন্যায়ানুগ। দেশের প্রতিটি অন্যায় কে আইনের দ্বারা রোধ করা হোক এটা আমরা অবশ্যই কামনা করি। কিন্তু আইনপ্রয়োগকারী যন্ত্রের উপর দেশের মানুষের ভরসা যে নিতান্তই কম এ কথা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। গৃহনির্মাণ ও পুর্ত মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিনের পরিশ্রম সত্য আশানুরূপ দখলকৃত সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারেননি সে প্রশ্ন না তুলেই আমরা চর্বিতচর্বণ করে বলবো-বেআইনিভাবে যারা দেশের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে তাদেরকে উৎখাত করতেই হবে, এবং একটা আইনের মাধ্যমে সকল সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে করতে হবে। আইন প্রণয়ন ও আইন প্রয়োগকারী দের মাঝে পারস্পারিক যোগসুত্র তৃণ হতে হবে। নইলে কল্যাণমুখী আইন প্রয়োগের ত্রুটিতে অকল্যাণ ডেকে আনতে পারে। আমরা আশা করি গৃহ নির্মাণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয় সত্যিকার অর্থেই যোগ্য বিভাগের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন।

পল্লী অঞ্চলের নলকূপ স্থাপন প্রকল্প

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন পরিকল্পনার অধীনে গত পরশু বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় এক লাখ ষাট হাজার নলকূপ স্থাপনের জন্য ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শদাতা এবং ইউনিসেফ এক কোটি পাঁচ লাখ ডলার আর্থিক সাহায্য প্রদান করবে। প্রকল্প অনুসারে এক লাখ নয়া নলকূপ বসানো এবং ষাট হাজার নলকূপ পুনঃস্থাপিত হলে তিন কোটি মানুষের পানীয় জলের অভাব দূর হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রতি দু’শ জন গ্রামবাসী জন্য একটি করে নলকূপের ব্যবস্থা হবে। এই প্রকল্প তৃতীয় পর্যায় আগামী চুয়াত্তর সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এছাড়া এই এক লাখ ষাট হাজার নলকূপ বসানোর ব্যতিরেকেও উপকূলীয় দ্বীপ এবং ঘূর্ণিঝড় প্রধান এলাকাগুলোতে এক হাজার দুশ’ গভীর নলকূপ বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ কাজে এই তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
আমাদের দেশে সুপেয় পানির যে কি নিদারুণ অভাব সে কথা বলাই বাহুল্য। আর তাই এখনও পল্লীর শতকরা সত্তুর আশি ভাগ লোক এ কাঁচা অথবা পুকুরের পানি পান করতে হয়। কুয়োর অবিশুদ্ধ পানি পান করার ফলে মৃত্যুর মানুষকে নানা অসুখে ভুগতে হচ্ছে। মিঃ ডেভিসও কেন জাতিসংঘের জরুরি শিশু ত্রাণ তহবিল এই প্রকল্পের সাহায্য করছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, এ দেশের বিভিন্ন রোগের অর্ধাংশ দূষিত পানি থেকে সৃষ্টি হয় এবং রোগাক্রান্তদের মধ্যে শিশুরাই হচ্ছে পঞ্চাশ ভাগ। সুতরাং এই তথ্য থেকে একথা সুনিশ্চিত করে বলা যায় বাংলাদেশে পানীয় জলের সুব্যবস্থা করতে পারলে এদেশের জরা ব্যাধি সংখ্যা সুনিশ্চিতভাবে হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় আশি ভাগ লোকের বাস পল্লী এলাকায়। সুতরাং এই দেশের উন্নয়ন এবং জনগণের কল্যাণ সরকারকে প্রথমেই গ্রামের জনগণের কথা ভাবতে হবে এবং যে কোন প্রকল্প প্রণয়নের সময় তাকে পল্লী কেন্দ্রিক করে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। বঙ্গবন্ধু সরকারও এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছেন বলে আমরা মনে করি।
সুতরাং পল্লী এলাকার যেসব মানুষকে আজও কাঁচা কুয়ো কিংবা পুকুর ইত্যাদির দূষিত পানি স্নানাহারে ব্যবহারের মাধ্যমে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে। স্বায়ত্তশাসন বিভাগের নেয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সে অভাব এবং দুর্ভোগ দূর হবে বলে আশা করি। অতএব বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় নলকূপ স্থাপনের জন্য ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি কে আমরা স্বাগত জানাই এবং প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কামনা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন