বাংলার বাণী
১৯শে মে, শনিবার, ১৯৭৩, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
খাদ্য ঘাটতি পূরণে তৎপরতা
বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার সম্প্রতি খুলনায় বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যে, দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলার জন্যে সরকার দৃঢ়সংকল্প। প্রতিমাসে দুই লাখ টন খাদ্যশস্য বাজারে ছেড়ে দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটানো হবে বলে মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এ বছর পঁচিশ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সরকার এই সংকট মোকাবেলায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এদিকে একটি সংবাদ সংস্থার সংবাদে জানা গেছে, গত বুধবার নিউইয়র্কে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ত্রাণ কর্মসূচীর ডিরেক্টর স্যার রবার্ট জ্যাকসন বলেছেন, যে পরিমাণ খাদ্য মওজুত আছে এবং যা পাওয়া যাবে তা দিয়ে বাংলাদেশের জুলাই-অক্টোবরের সংকটকাল কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে সুষ্ঠু খাদ্য সরবরাহের জন্যে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী অন্য একটি তথ্যে বলেছেন, খাদ্য বোঝাইয়ের জন্যে পূর্বে যেখানে চট্টগ্রামে প্রতিদিন মাত্র ৬৭টি ওয়াগন পাওয়া যেতো, এখন সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ১৫৬টি ওয়াগন পাওয়া যাবে। পূর্বে যে ওয়াগনের অভাবে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হতো এখন তা আর হবে না বলে মন্ত্রীর বিশ্বাস। জাতিসংঘের সদর দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মিঃ জ্যাকসন বলেছেন, বাংলাদেশ বিদেশ থেকে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য কিনেছে তা নিয়ে চলতি সালে বাংলাদেশে সরবরাহকৃত মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ হবে সাড়ে তেইশ লাখ টন। মিঃ জ্যাকসন সাংবাদিকদের কাছে আরো বলেছেন যে, চলতি গ্রীষ্মকালে যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশে ত্রাণ তৎপরতার জন্যে আরো পাঁচ লাখ টন খাদ্যশস্য মঞ্জুর করে তাহলে ঘাটতি পূরণের ব্যাপারে তা অত্যন্ত সহায়ক হবে। এছাড়া আরো তিন থেকে চার লাখ টন খাদ্যশস্য সংগৃহীত হলে পুরো ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে বলে মিঃ জ্যাকসন মনে করেন। বস্তুতঃপক্ষে দেশের বর্তমান নিদারুণ খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই সরকারী দৃঢ়পদক্ষেপ আবশ্যক। সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী বন্ধুদেশসমূহের আন্তরিক সহযোগিতাও প্রয়োজন। এ পর্যন্ত যে পরিমাণ খাদ্যশস্য সংগৃহীত হবার আশ্বাস পাওয়া গেছে, তা যদি সুষ্ঠুভাবে সরবরাহ ও বন্টন করা যায় তাহলে এই অস্বাভাবিক অবস্থার রোধ সম্ভব। বিদেশ থেকে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য সাহায্যের ও আমদানীর আশ্বাস সরকার দিয়েছেন তার যদি সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সমস্যা অনেকখানি লাঘব হতে পারে। সরবরাহ ব্যবস্থা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এবং সরকারকে দৃঢ় ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জাতির জীবনের সেই মানবিক সমস্যার সমাধান যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
বিদেশী শক্তির অশুভ পাঁয়তারা
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির আট সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তাঁরা শুভেচ্ছা সফরে এসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, গণমান্য ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্যা ও সংকটও তাঁরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আগত ৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব আলী সিদ্দিকী গত পরশু এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেছেন। জনাব সিদ্দিকী অভিযোগ করেছেন যে, বিদেশী শক্তি দেশীয় এজেন্টদের উসকিয়ে দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের প্রশ্নটি নিয়ে হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে নালিশ রজু করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টোর সমালোচনা করেছেন। জনাব আলী সিদ্দিকী সুস্পষ্টভাবে অভিমত দিয়েছেন যে, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে যে লংকাকান্ড সংঘটিত করেছে, তা যথার্থভাবে বিচার করলে একশত পঁচানব্বুই জন কেন, এর চেয়ে বেশী যুদ্ধবন্দীদের বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো উচিত। জনাব আলী সিদ্দিকী সাংবাদিক সম্মেলনে অনেক কথা বলেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন। এবং বলেছেন, অন্তহীন দুঃখকষ্ট ও জটিলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশ সরকার যে দুর্জয় সাহসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছেন তা বিস্ময়কর ও প্রশংসনীয়। জনাব সিদ্দিকী আরো বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের যৌথ আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে সুদৃঢ় মৈত্রী ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা অটুট থাকেব। তিনি বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তপথে চোরাচালানী বন্ধ করার জন্য দুই দেশের জনগণকেই শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জনাব আলী সিদ্দিকী ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী ও ঐক্যে ভাঙন ধরানোর জন্য বিদেশী চক্রান্তকারী ও দেশীয় এজেন্টদের কাঁধে পা না দেয়ার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জনাব আলী সিদ্দিকী ভারত থেকে বাংলাদেশে সফরে এসেও এ কথাটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্রকারী সংঘবদ্ধ দল তাদের অশুভ পাঁয়তারা সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশী শক্তি ও তার এজেন্টদের যোগাযোগ সৃষ্টির অপচেষ্টা সম্পর্কে ইতিপূর্বেও আমরা দেশবাসী ও সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছি। কিন্তু গোলযোগকারীরা ক্রমাগত নানা রকম চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে কোন রকম কসুর করছে না। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজিত থাক, এটা পাকিস্তান চায় না। চাইলে যুদ্ধবন্দীদের ইস্যুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে উপমহাদেশের শান্তিকে বিঘ্নিত করার হীন উদ্যোগ গ্রহণ করতো না। পাকিস্তান শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়, ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও পাকিস্তানপন্থী দালালদের মাধ্যমে এই দুই দেশের বন্ধুত্বকে নস্যাৎ করার রকমারী ব্যবস্থা করেছে। কেউ মুসলিম বাংলার ধূয়া তুলছে আবার কেউবা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। তাছাড়া, গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো অসাধু ব্যবসায়ী, পারমিট শিকারী, চোরাচালানী ইত্যাদির উৎপাত তো বাংলাদেশের নির্মল আকাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছেই। এমতাবস্থায় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জাগ্রত নাগরিকদের শক্ত করে হাল ধরতে হবে। ভারত ও বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্বের বন্ধনকে কিছুতেই শিথিল করা যাবে না। যারা এই বন্ধুত্ব বিরোধী কাজ কারবার করবে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে সরকারের বিচারের পাত্রে পরিণত হবে বলেই বিশ্বাস করি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি জনাব আলী সিদ্দিকী ভারত ও বাংলাদেশে গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন, তার প্রতি আমরা জনগণ ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিদেশী শক্তি ও দেশীয় এজেন্টদের আঁতাত প্রতিহত না করতে পারলে ভারত-বাংলাদেশের বিরাজিত সম্পর্কে হয়তো ফাটল ধরতে পারে। এ প্রচেষ্টাকে ভ্রুণে হত্যা করাই আমাদের কাম্য।
শুভ বুদ্ধির উদয় হোক
বিশ্ব আদালতের রায় ফ্রান্স মানবে না। প্রশান্ত মহাসাগরে পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরীক্ষা করিয়েই ছাড়বে। অন্ততঃ হেগস্থ ফরাসী দূতাবাসের কথা এবং ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা থেকে তাই প্রমাণিত হয়। ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি বেশ পরিস্কার ভাষাতেই বলেছেন, আন্তর্জাতিক আদালত যে রায়ই দিক না কেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড যা-ই বলুন না কেন—যত প্রতিবাদই করুক না কেন ফ্রান্স তার পরিকল্পনা ত্যাগ করবেনা।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আন্তর্জাতিক আদালত প্রশান্ত মহাসাগরে ফ্রান্সের আসন্ন পারমাণবিক বিস্ফোরণের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আবেদনক্রমে এক ইনজাংশন অগ্রাহ্য করবার কথা ভাবছে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল রবার্ট ফ্রান্সের জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশ্ব আদালত কোন হস্তক্ষেপ করতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, এ ধরনের কোন ইনজাংশন জারীর এখতিয়ার বিশ্ব আদালতের নেই।
অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার শ্রমিক সংস্থাগুলো ফ্রান্সের সাথে দেশের সকল তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং অস্ট্রেলিয়ার নৌ ও বিমান বন্দরে অবতরণকারী কোন ফরাসী জাহাজ ও বিমান থেকে মাল খালাস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্রীষ্মকালে প্রশান্ত মহাসাগরে ফ্রান্সের পারমাণবিক পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অস্ট্রেলীয় শ্রমিক সংস্থাগুলোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বেই ফ্রান্সের ইউ.টি.এ. বিমানপথের সকল বিমানই অস্ট্রেলিয়ায় যাতায়াত না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এসব ঘটনাবলীতে ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সম্পর্কে বিশেষ করে মৈত্রী সম্পর্কে একটি চির ধরার লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং তা স্বাভাবিকভাবেই।
কেননা, ফ্রান্সের মতো তার এই পারমাণবিক বিস্ফোরণ তার জাতীয় নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করার জন্যে। বর্তমান বিশ্বের বৃহৎ পঞ্চশক্তির অন্যতম ফ্রান্সও পারমাণবিক শক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজের স্বগোত্রীয়দের আসনে নিজের আসনটিকে আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আজকের বিশ্বে অস্ত্র আর বলদর্পী এই পাঁচটি শক্তির কেউই কারো পেছনে পড়ে থাকতে চায়না। কেননা, তাতে অনেক কিছুই তাদের হয়তো ক্ষুন্ন হতে পারে—তারই আশঙ্কা প্রকট।
অন্যদিকে ফ্রান্সের এই শক্তি পরীক্ষার সকল ভোগান্তি গিয়ে পড়বে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের সাধারণ মানুষের উপর। ঐ এলাকার দূষিত আবহাওয়া তাদের ক্ষতিই করবে বেশী করে। সে জন্য তারা প্রথমে ফ্রান্সের কাছে আবেদন নিবেদন জানিয়েছে এবং শেষটায় বিশ্ব আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। ফ্রান্স সেখানেও অনড়।
বস্তুতঃ এই পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা রোধের জন্য আজ বিশ্বের সর্বত্র উদ্যোগ-আয়োজন চলছে। বিশ্বশান্তি, মানবতা, সভ্যতা, কৃষ্টি আর সংস্কৃতিতে রক্ষার জন্যেই বিশ্বের সর্বত্র এই পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ করতে চাইছেন সবাই। সেই সময় এই একগুঁয়েমিভাবে ফ্রান্স সকলের আহ্বান-আবেদন উড়িয়ে দিয়ে পারমাণবিক পরিমন্ডলে না প্রবেশ করলেই নয়? আমরা আশা করবো বিশ্বশান্তি মানবতা ও সভ্যতার নামে ফরাসী সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক