You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.25 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | গোঁফ নামাতে হবে | চলমান আঁস্তাকুড় | গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা সংকট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৫ এপ্রিল বুধবার, ১২ই বৈশাখ, ১৩৮০

গোঁফ নামাতে হবে

এ উমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ থেকে যে যুক্ত ঘোষণা প্রচারিত হয় তাতে স্পষ্ট ভাষায় যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে বলা হয়েছে। যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দেয়া হবে আর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে। অন্যদিকে পাকিস্তানি আটক বাঙ্গালীদের ছেড়ে দিতে হবে।
বক্তব্যে কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই। সহজ সরল বক্তব্য। অথচ পাকিস্তান সরকার ব্যাপারটাকে যেন সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। কোথায় যেন একটু ‘কিন্তু’ রয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশ গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কতগুলো বানোয়াট অভিযোগ এনে গত ২০শে এপ্রিল এক বিবৃতিতে নির্দোষ বাঙ্গালীদের বিচারের হুমকি দিয়েছে।
এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ ধরনের বিচার অনুষ্ঠিত হলে তা হবে ব্ল্যাকমেইল করার এক নগ্ন প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লংঘন করে বিচারের এক বর্বরোচিত হুমকি। এর ফলে মানবিক সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য পরিস্থিতি বিষময় হয়ে উঠবে।
পাকিস্তান বাইরে যাই বলুক না কেন, ভুট্টো সাহেব দুই কান হারিয়ে যতই সটান রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলতে চেষ্টা করুন না কেন ভেতরের ব্যাপার কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশ ভারতের যুক্ত ঘোষণার পর পরই পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পট পরিবর্তন ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর রাজনৈতিক বৈরী ‘ডন’ সম্পাদক জনাব আলতাফ গওহর জেল থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। এই মুক্তিদানের নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ভুট্টো। ‘ডন’ সম্পাদক আলতাফ গওহর এবং ‘ডন’ পত্রিকার মালিক সিন্ধুর হারুন পরিবার বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার পক্ষপাতী। বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার জন্য প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে পরামর্শ দিয়ে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার কথা স্বীকার করে দৈনিক ‘ডন’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধন প্রকাশ করা হয়েছিল। এই ‘ডন’ পত্রিকার সম্পাদক আলতাফ গওহর প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আকস্মিকভাবে মুক্তি লাভ করায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার পট পরিবর্তনের আভাস পেয়েছেন পর্যবেক্ষক মহল। বিদেশি সংবাদসূত্রে বলা হয়েছে জনাব আলতাফ গহবর শীঘ্রই এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে দিল্লি অথবা লন্ডন রওনা হবেন। ভুট্টো সাহেব যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন গোঁফ যে নামছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তা স্বীকার করতেই যা লজ্জা।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্যই বাংলাদেশ-ভারত যে যুক্ত বিরতি দিয়েছেন তাতে যদি পাকিস্তান সাড়া না দেয় এবং অসহায় ও নিরপরাধ বাঙ্গালীদের বিচারের জন্য যদি এগিয়ে আসে তাহলে তার পরিণাম শুভ হবে না। বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে আজ হোক কাল হোক ভুট্টো সাহেবকে গোঁফ নামাতেই হবে। এছাড়া অন্য কোন পথ আজ আর খোলা নেই।

চলমান আঁস্তাকুড়

ট্রেন নয়, চলমান আস্তাকুঁড়। সংবাদের শিরোনাম। আসলেও তাই। অন্ততঃ বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থাটা এখন যা হয়েছে নিঃসন্দেহে এটাকে চলমান আস্তাকুঁড় বলা চলে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব স্থানীয় ও মেল ট্রেন চলাচল করছে, সেগুলোতে বেশির ভাগ সময়ই পানি থাকে না, আলো থাকে না-থাকে না পাখা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও করা হয়না রেলের কামরাগুলো। নোংরা আর আবর্জনা পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন ট্রেনের কামরাগুলো এক একটি ভাগাড় ছাড়া আর কিছু নয়। আবর্জনার পুঁতিগন্ধে যাত্রীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
বস্তুত এ দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনদিনই উন্নত মানের ছিলনা পাকিস্তানি উপনিবেশিক আমলে তো নয়ই। পাকিস্তানি শাসকরা এদেশকে কেবল শোষণই করেছে। এদেশের আরো অনেক কিছুর মতো ট্রেন চলাচল ব্যবস্থার দিকে বিন্দুমাত্র নজর দেয়নি। তারপর নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রয়োজনেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উপর কখনো কখনো আঘাত হানতে হয়েছে। কিন্তু এ দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বশেষ এবং সর্বাত্বক গুরুতর ক্ষতি সাধন করেছে পাকহানাদার বাহিনীর বর্বর সৈন্যরা। তারা দেশের আরো অনেক কিছুর মতোই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গত ১৬ মাসের শাসনকালে সেই ভেঙে পড়া রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার রেল চলাচল কিছুটা চালু করতে সক্ষম হয়েছেন মাত্র, কোন প্রকারের উন্নয়ন সাধন করতে পারেননি। এবং এটা দুঃখজনক হলেও সত্য।
ফলে আজ ট্রেনের কামরায় বাতি নেই। আর সেই অন্ধকারের রেলের যাত্রীসাধারণ সহজেই চোর, ডাকাত ও ছিনতাইয়ের নির্মম শিকারে পরিণত হন। স্থানাভাবে যাত্রীরা ছাদের উপর চড়ে বসেন। এতে তাদের যেকোনো ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিতে হয়ই অনেক সময় ছাদের উপর পানির ট্যাংকে মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেই দূষিত পানি পান করে অন্য নানারূপ পীড়ায় আক্রান্ত হন। ফলে ট্রেনে ভ্রমণ আজকাল এক ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে পরিণত হতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে ট্রেনে এসব অবস্থার জন্য কোন কোন দায়িত্বজ্ঞানহীন জাতীয় কম দায়ী নন। এরা অনেক সময় কামরা থেকে পাখা, ফ্লাগ এমনকি বালব পর্যন্ত খুলে নিয়ে যান। কামরা সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ না করে ওপরেই তা করে থাকেন। ঠিকমতো পানির কল না চালাতে পারে অনেক সময় তা নষ্ট করে ফেলেন। কাজেই যাত্রীদের এ দিকটায় সচেতনতা অবলম্বন করা দরকার।
তাছাড়া ট্রেন যোগাযোগই হচ্ছে বর্তমানে দেশের সবচাইতে বড় পরিবহন ও যানবাহন ব্যবস্থা। এমনতাবস্থায় জরুরিভিত্তিতে যথার্থ সচেতনতার সাথেই এই ব্যবস্থার প্রতি সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা সংকট

জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ জন গ্রামে বসবাস করে। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় গ্রামবাসীদের চিকিৎসার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। গ্রামের মানুষ রোগ জর্জরিত হলে তার সুচিকিৎসার কোন বন্দোবস্ত উপনিবেশিক পাকিস্তানি আমলে ছিল না। গ্রামের মানুষের চিকিৎসার প্রতীক সরকারি শৈথিল্য প্রকট ছিল। তাছাড়া চিকিৎসকরাও ডাক্তারি পাশ করার পর গ্রামের দিকে আগেও যেমন মুখ তুলে তাকাতে না, এখনো তেমনি তারা গ্রামবাসীদের প্রতি আগের মতোই উদাসীন রয়েছেন বলা যেতে পারে। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামের সাধারণ মানুষকে চিকিৎসার সুযোগ দানের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার জন্য শব্দ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারদের মধ্যে ১৫০ জনকে এক বছরের জন্য পল্লী অঞ্চলে পাঠানো হবে বলে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেছেন, দেশের ঘরে ঘরে চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রথম পাঁচসালা মেয়াদ শেষে প্রায় দশ হাজার লোককে গ্রামের হাসপাতালগুলোতে নিয়োগ করা হবে। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনামলে সূচনা থেকে শেষাবধি পর্যন্ত গ্রাম বাংলার মানুষ সামান্য চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা রোগের সঙ্গে নৃত্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু তাদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেছিলেন। ডাক্তাররাও গ্রামমুখী বড় একটা হয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রামবাসীদের চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা দানের কর্মসূচি নিয়েছেন। এই মহতী কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে হলে ডাক্তারদেরকে অবশ্যই গ্রামবাসীদের চিকিৎসা কল্পে গ্রামের চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে গিয়ে নতুন উদ্যোমে কাজ করতে হবে। কারণ, গ্রামই বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামের মানুষকে যদি রোগমুক্ত করা না যায়, গ্রামের মানুষের জীবনে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠিত না করা যায় তাহলে দেশের একটি বড় অংশই কর্মে অক্ষম হয়ে পড়বে। এ জন্যে গ্রামে গ্রামে থানায় থানায় যেমন পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে তেমনি সব সেইসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে সঠিকভাবেই পরিচালনার জন্য চিকিৎসকও নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষিত সম্প্রদায়কেই আমরা দেশ ও সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে গণ্য করি, তাই চিকিৎসকদের উচিত গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করা। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি চিকিৎসক ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নাড়ির সম্পর্ক না থাকে তাহলে সে দেশ নাগরিকতার অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে উঠবে। পল্লী অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। গ্রামবাসীরা যে তিমিয়ে ছিলেন সেই তিমিরেই থেকে যাবেন। এই অবস্থায় ঘরে ঘরে চিকিৎসার আলো পৌঁছে দেয়ার কথা ঘোষণা করাটাই যথেষ্ট নয়। চিকিৎসা সংকট থেকে গ্রামবাসীদের রক্ষা করাই হল প্রধান কাজ। কথা নয়, ঘোষণা নয়, কাজের প্রতিই আমরা সর্বাধিক আস্থাশীল।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন