বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার, ১১ই বৈশাখ, ১৩৮০
মানবিক মূল্যবোধ অপরিহার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আঁদ্রে মালরোকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেছেন। বিশ্ব বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক আঁদ্রে মালরোকে এই সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করার বিষয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে করেছেন। আঁদ্রে মালরো কে স্বাগত জানাতে গিয়ে সভাপতির ভাষণে জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী দেশের জনগণকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি আরো বলেছেন, সুন্দর, সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপনের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ অত্যাবশ্যক। স্বাধীনতাযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাসের কথা ও রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ফরাসি সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক আঁদ্রে মালরো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই দুর্দিনের বন্ধু। তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব লিটারেচার উপাধি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী উক্ত অনুষ্ঠানের ভাষণ দিতে গিয়ে যে সকল বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত মূল্যবান ও সুদূরপ্রসারী। আমাদের এই নবজাতির প্রতিষ্ঠার পূর্বে অবশ্যই প্রত্যেকটি নাগরিককে আদর্শবান করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের প্রত্যেকটি মৌলিক সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। মনুষ্যত্বের বিকাশ যদি না ঘটে তাহলে জাতির সত্যিকারের মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। মানবিক মূল্যবোধের যদি জাগতি না ঘটে তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না। আমাদের এই নতুন জাতি প্রতিষ্ঠার পড়বে প্রত্যেক নাগরিককে তাই একটি আদর্শমুখী জাতির প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। আদর্শ ছাড়া যে জীবন তা কোনক্রমেই মানবিক মূল্যায়নের যোগ্যতা পায় না। যেহেতু বাংলাদেশে একটি বিশেষ আদর্শের জন্য সংগ্রাম করে শত্রুমুক্ত হয়েছে সেহেতু এ দেশকে নতুন প্রয়োগ করতে হবে এবং মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে হবে।
জালালাবাদ দিবস
গত পরশু ছিল বাইশে এপ্রিল। আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে এই বাইশে এপ্রিল তারিখে বাংলার বীর বিপ্লবীরা স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দিয়েছিলেন আত্মহুতি। শহীদদের তাজা তপ্ত রুধিরে ভেজা সেই রক্তস্নাত দিনটি আমাদের ছোঁয়া দিয়ে চলে গেল। তখন এদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া কোম্পানির দোর্দন্ড শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছিল। ব্রিটিশের গোলামির জিঞ্জিরকে ছিন্নভিন্ন করার জন্য কতিপয় বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের অধিনায়কত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নীল নকশা প্রণীত হয়েছিল। ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে জালালাবাদ পাহাড়ে বীর বিপ্লবীরা আত্মোৎসর্গ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাইশে এপ্রিল তাই মৃত্যুঞ্জয়ীদের স্মৃতিতে উজ্জ্বলভাবে অভিষিক্ত হয়ে রয়েছে।
স্বাধীনতার শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়, স্বাধীনতা একটি মন্ত্রোচ্চারণ। দেশে দেশে যুগে যুগে এই স্বাধীনতার জন্য কত মুক্তিকামী মানুষকে যে রক্ত দিতে হয়েছে, বরণ করে নিতে হয়েছে বীরের মৃত্যুকে, তা আজ ইতিহাসের পাতায় জ্বল জ্বল করছে। মাস্টারদার স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামের বুকে স্বাধীনতার রক্তিম পতাকা উড্ডীন করা। মাস্টারদা ও তার সাথীরা এদেশের বুক থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। সেই অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষরাই প্রথম মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য আত্মবিসর্জনের পথ প্রদর্শনের ভূমিকা পালন করে গেছেন। ব্রিটিশ বেনিয়াদের এ দেশ ছাড়তে হয়েছে। বাংলার বুকে হয়েছে স্বাধীনতার উদ্বোধন। মাস্টারদার দেখানো পথেই আজ আমরা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার নিগড় থেকে মুক্ত হয়েছি। বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করেছি। বাইশে এপ্রিল তাই প্রতিটি বাঙালির জাগরণের দিন। বাইশে এপ্রিলের স্মৃতি বাঙালি জাতিকে নতুন প্রেরণা অনুপ্রাণিত না করে পারে না। বাইশে এপ্রিল তাই জালালাবাদ দিবস হিসেবে বাংলা ঘরে ঘরে বরেণ্য হয়ে থাকবে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সহ সমগ্র বাংলাদেশে এবার জালালাবাদ দিবসটি পরম শ্রদ্ধায় উদযাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও বাইশে এপ্রিল তারিখটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করেছে। জালালাবাদ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সামাজিক ও দুর্নীতিবাজদের উচ্ছেদ করে শোষণমুক্ত সোনার বাংলা কায়েম হলেই মাস্টারদা’র স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। তিনি আরো বলেছেন, ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম মাস্টারদা পরাক্রমশালী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ নির্দেশ করে গেছেন। যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে টিকে থাকবে ততদিন পর্যন্ত বাঙালির হৃদয়ে মাস্টারদার স্মৃতি অমর হয়ে থাকবে বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন।
একথা দিবালোকের মত সত্য যে, মাস্টারদা এবং তারই সাথীরাই এদেশের বুকে সর্বপ্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের অংকুরিত করে গেছেন। এবং পরবর্তীকালে আমরা তাদের পদাংক অনুসরণ করে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের অক্টোপাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছি। আজ তাই তাদের আত্মত্যাগের প্রতি আমাদের মর্যাদা প্রদর্শন করছি। পাকিস্তানি শাসনামলে আমরা তেমন উদ্যম নিয়ে জালালাবাদ দিবস উদযাপন করতে পারিনি, কারণ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী আমাদের হাতে পায়ে বেরি দিয়ে রেখেছিল। বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তি ও স্বাধীনতাই ছিল মাস্টারদা ও তার সাথীদের কামনা। কাজেই তাদের স্বপ্নকে সফল করে তোলার জন্য আমাদের সমস্ত উদ্যম নিয়োজিত করতে হবে, নইলে মাস্টারদার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেনা। জালালাবাদ দিবসে এই প্রতিজ্ঞাই আজ উচ্চারণ করতে হবে।
সংস্কৃতি ও সভ্যতা
নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, সংস্কৃতি ও সভ্যতা ফরমায়েশ দিয়ে তৈরি করানো যায় না। সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়ে ওঠে দেশ ও জনতার মধ্যে থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তিনি আরো বলেছেন, সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য পথ নির্দেশ এর প্রয়োজন আছে।
বাঙালি সংস্কৃতি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অনেকদিন আগে থেকে পরিচিত। তবে এর পরিপূর্ণ বিকাশের যে অব্যাহত ধারা রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কালে ছিল তা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে শাসকচক্রের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টায়। তাই আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে ছিল এবং কিছুটা বিপথগামী হতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সচেতনতা জনতা শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়িয়েছিল।
এখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে উদ্ভাসিত। আমাদের এই স্বতন্ত্র ভৌগলিক সীমারেখায় নয়, আমাদের স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য। সুতরাং আমাদের সেই স্বকীয়তাবোধকে পরিপূর্ণ করে পৃথিবীর বুকে আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির সার্বিক জীবনের প্রকাশ। সুতরাং এই সংস্কৃতিকে ফরমায়েশ দিয়ে তৈরি করা যায় না। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে পুরুষানুক্রমে। উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে আজ আমরা যেমন সভ্য দেশ কে অনুসরণ করছি তেমনি আমাদের সংস্কৃতির প্রতি কি অন্যেরা অনুসারী হতে পারে না?
আমাদের সেই বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য তার জন্য আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে, পল্লীর মানুষের একান্ত কাছে। কেননা কৃষিপ্রধান আমাদের দেশের সংস্কৃতি বাংলার মাটির রসে সঞ্জীবিত হয়ে , সবুজ বনানীর বাতাসে ললিত হয়ে গড়ে উঠেছে। সুতরাং আমাদেরকে বাউলের গান বাঁশির সুর, ভাটিয়ালি গানের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আমাদের সবাইকে আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যমন্ডিত বাঙালি সংস্কৃতিরই চর্চা করতে হবে। ফরমায়েশ দিয়ে কোন সংস্কৃতি সভ্যতা গড়ে উঠবে না। যে সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে তাকেই লালন করতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক