You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.12 | ময়মনসিংহ-ঢাকা সিলেটের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ | সাক্ষাৎকারঃ মেজর এম,এ, মতিন - সংগ্রামের নোটবুক

ময়মনসিংহ-ঢাকা সিলেটের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এম,এ, মতিন
১২-৪-৭৩

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

২৯শে মার্চ ২য় বেঙ্গল জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে আসে। মেজর মইনুল হাসান, মেজর নূরুল ইসলামও ছিলেন। আমি তাদের সাথে দেখা করে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। তখনই বাড়ি গিয়ে মা-বাবা কে বলে চলে আসি। পাকবাহিনী কি করে আমাদের সবার খবর পেয়েছিল। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে পাক বিমান এসে ভৈরবের ওখানে বোমা ফেলে এবং কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে যায়।

রাত ১১ টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হই। আমরা সংখ্যায় ৮০০’র উপরে ছিলাম। সেকেণ্ড বেঙ্গলের পুরা ব্যাটালিয়নসহ বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাত্রা করি।

৩০শে মার্চ ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাই। ওখান থেকে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে (সিলেট) যাই সকাল ৮টার দিকে। ওখানে মেজর খালেদ মোশাররফ আগে থেকেই ছিলেন। মেজর মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ছিলেন। ৩১শে মার্চ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। দুটি বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার ওখানে করি।

দুটি বাহিনী মিলে আলাপ আলোচনা করে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঐ তারিখে বিএসএফ-এর অফিসারবৃন্দ আমাদের হেডকোয়ার্টারে আসে এবং আশা-ভরসা দেয় সম্ভাব্য সব কিছু সাহায্য দেবার জন্য। কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আলাপ করেন এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানীকে জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে পাঠানো হয় চট্রগ্রামের দিকে। অপরদিকে ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সেকেণ্ড বেঙ্গলের অপর একটি কোম্পানীকে সিলেট পাঠানো হয়।

এপ্রিল মাসের ১/২ তারিখে কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন ইপিআর বাহিনী নিয়ে নরসিংদী পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। ব্যাপক যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীর বহু লোক মারা যায়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীও কিছু লোক হারায়।

ক্যাপ্টেন এ,এস,এম নাসিমের আর একটি দলকে কর্নেল শফিউল্লাহ আশুগঞ্জে (কুমিল্লা) পাঠান পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১লা এপ্রিলের দিকে। ইপিআর বাহিনী ১০০ মত এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৫/৩০ জন লোক নিয়ে একটি কোম্পানী গঠন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইলে পাঠানো হয় রিজার্ভ হিসাবে। সরাইলে গিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষা দেবার জন্য একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলি।

১৩ই এপ্রিল আমার উপর হুকুম হলো আশুগঞ্জের সংলগ্ন লালপুরে জাবার জন্য শত্রুর মোকাবিলা করতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ষ্টেশন পৌঁছে আমার বাহিনী নিয়ে আমরা আলোচনা করছি এমন সময় পাক বাহিনীর ৪টি স্যাবর জেট দেড় ঘণ্টা যাবৎ আক্রমণ চালায়। আমার বাহিনীর অনেকে মেশিনগান নিয়ে বাড়ির ছাদে গিয়ে আক্রমণ চালায়। বিমান ষ্টেশন থেকে চলে যায়। ওখানে আমরা মহসিন নামে একজন সিপাইকে হারাই। রাতে আমরা রওনা হয়ে আশুগঞ্জ পৌঁছাই। মেজর নাসিমের সাথে আলাপ করে লালপুরে যাই। রাত ৪টার দিকে লালপুরে পৌঁছাই।

১৪ই এপ্রিল পাক বিমান আশুগঞ্জ ও লালপুরে গোলাবর্ষণ করে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাক বাহিনী জলযানে করে গুলি করতে করতে আসে। ভারী অস্ত্র ব্যবহারের দরুন আমাদের বেশ কিছু হারাতে হলো। পাক বাহিনী তীরে উঠে পড়লে আমরা পিছু হটতে থাকি। ঐ দিন আশুগঞ্জ ও লালপুরে পাক বিমান ব্যপকভাবে বোমাবর্ষণ করে। আমরা পিছু হটি, সেখানেও টিকতে পারিনি। ইতিমধ্যে আমাদের পেছনে হেলিকপ্টারে করে পাক বাহিনী সৈন্য নামায়। সামনে পিছনে বিমান আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটি। ওখানে বেশ কিছু লোক হারাই। ১৫ই এপ্রিল কুমিল্লা জেলার শাহবাজপুরে পৌঁছাই। আমাদের দুটো বাহিনীর প্রায় ৪০ জনের মত মারা যায়। আশুগঞ্জ ও লালপুরে অধিকাংশ বাড়িঘর পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। লোকজনকে হত্যা করে মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে ব্রীজ ভেঙ্গে ওখানে আমি অবস্থান করতে থাকি কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশক্রমে। রাস্তাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের মধ্যে যোগ ছিল।

১৭ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৭/৮টার দিকে পাক বাহিনী এক ব্যাটালিয়ন আর্টিলারি ও অন্যান্য সব কিছু নিয়ে আক্রমণ চালায়, গানবোটও তাদের ছিল। সামনে আমাদের উপর তারা আক্রমণ চালায়। অপর পাক দল অন্য দিক থেকে নদীর পার হয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধ হয়। আমার ৫ জন মারা যায়। পাক বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমরা পিছু হটে মাধবপুরে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ি। সেখানে ক্যাপ্টেন নাসিম তার দল নিয়ে ছিলেন। আমাদের ঘাঁটি দৃঢ় করি। কর্নেল শফিউল্লাহ দেখাশোনা করেন।

২১/২২ এপ্রিল পাক বাহিনী এক বিগ্রেড সৈন্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় বেলা বারটার দিকে। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। আর্টিলারি মর্টার নিয়ে আক্রমণ চালায়। আমাদের ২৫০ মত ছিল। এক পর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীর ৪০০/৫০০ জন মারা যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রধানতঃ যোগাযোগের অভাবে আমরা পিছু হটি সন্ধ্যা ৭টার দিকে। আমাদের ২০/২৫ জন মারা যায় ঐ যুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত দুই কোম্পানীসহ তেলিয়াপাড়া পৌছাই। আমরা সিলেট হারালাম।