খুলে গেল দ্বার
দ্বার খুলে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের স্বীকৃতি পেল। গণতান্ত্রিক ভারত ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাখীবন্ধন হলাে। ইতিহাস তার অনিবার্য পথে এগিয়ে চললাে। তিমির ভেদ করে এশিয়ার বুকে হলাে এক নব সূর্যোদয়। যারা অন্ধকারে পৃথিবীকে ডুবিয়ে রাখতে চায়, ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেবার স্পর্ধা যাদের, স্বাধীনতার নবসূর্যের এই উজ্জ্বল কিরণে তাদের চক্ষুপীড়া হবারই কথা। কিন্তু সর্বপ্রকার বন্ধন, পীড়ন, নির্যাতন ও শােষণ থেকে মানুষের মুক্তি যাদের কাম্য, এই নব অভ্যুদয়কে তারা নিশ্চয়ই স্বাগত জানাবে। পঞ্চান্ন কোটি মানুষের ভারত সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ ও তাদেরই ক্রীড়নক সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরােয়ানা ঘােষণা করে মুক্তি সংগ্রামকে জয়মালা পরিয়ে দিল। এই মুক্তিসংগ্রামে ভৌগােলিক ব্যবধান রইল না। ভারতের জওয়ানরা গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে দাঁড়ালাে এবং কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরলাে। পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসী ও সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একপ্রাণ হয়ে গেল।
ইতিহাসের এ এক উজ্জ্বল অধ্যায়। মহান অক্টোবর বিপ্লবে সাম্রাজ্যবাদের যে অরি ভূমিষ্ট হয়েছিল, ষােলকলায় বেড়ে উঠে সে আজ সাম্রাজ্যবাদের হৃৎকম্প উপস্থিত করেছে। যেখানেই সাম্রাজ্যবাদ ও নয়াউপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম সেখানেই সােভিয়েত ইউনিয়নের উদার হস্ত প্রসারিত। যে সদ্য স্বাধীন দেশেরই উপর সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের শ্যেন দৃষ্টি সেই স্বাধীন দেশেরই সার্ব রক্ষার জন্য সােভিয়েত রাষ্ট্র বরাভয় নিয়ে উপস্থিত। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের অপমৃত্যু ঘটাবার জন্য যখনই ঘাতক ইয়াহিয়ার খগড়াঘাত তখনই সােভিয়েত ইউনিয়নের মাভৈ বাণী। ইয়াহিয়ার কুটিল চক্রান্তে ভারত যখন বিপন্ন তখনই পরম বন্ধু রূপে সােভিয়েত রাষ্ট্র ভারতের পাশে হাজির। সাম্রাজ্যবাদী সমস্ত চক্রান্ত জাল ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রীর সৌধচূড়া আজ গগনচুম্বী আর তারই প্রসূত ফল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক ধারার স্বাভাবিক বিকাশ এশিয়ার এই খণ্ডে। একে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবিরােধী মুক্তিসংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে মূল্যায়ন ভুল হবে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের একটি অঙ্গ বলেই স্বাধীন বাংলা তার পাশে দেখতে পারে আরাে অসংখ্য বন্ধু। প্রতিবেশী বলেইn ভারত সর্বাগ্রে তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরাে অনেক মিত্রের হাত এগিয়ে আসবে তার দিকে। শিশুরাষ্ট্র হলেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মিত্র পরিবেষ্টিত হয়ে তার সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকা পালনে প্রশস্ত পথ পাবে নিশ্চয়ই।
এই সঙ্কটকালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনকে দৃঢ়তর করে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী যে ভূমিকা নিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ও সে দেশে পাক হানাদার মুক্ত করার জন্য ফৌজ পাঠিয়ে গণতন্ত্র ও মানবতাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তার জন্য কেবল ভারতের জনসাধারণই নয়, বিশ্বের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ও মানবতাবােধে উদ্বুদ্ধ মানুষমাত্রেরই অকুণ্ঠ প্রশংসা ও অভিনন্দন পাবেন তিনি। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি ভারতের আপামর জনসাধারণের অভিলাষই পূরণ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী ফাঁদে পা না দিয়ে তিনি ইতিহাসের নির্দেশ মেনে চলেছেন এবং বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়ে গণতান্ত্রিক ভারতের মর্যাদা বাড়িয়েছেন।
সাম্রাজ্যবাদী ও নয়া-উপনিবেশবাদীদের চক্রান্ত সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করা জন্য আরাে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল আদর্শ হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা স্থাপন করা। বাংলাদেশের সরকার আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তারা গােষ্ঠী নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের এবং সাম্রাজ্যবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবিরােধী নীতি অনুসরণ করে চলবেন। অতএব, সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকা পালনে ভারত তার এই প্রতিবেশী নয়া রাষ্ট্রটিকে পাশে পাবে। এতে ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তিও যে জোরদার হবে তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাগত জানাই আর আমাদের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। সমস্ত দুর্যোগের অবসান হয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা নির্মল নীল আকাশে উড়তে থাকুক আর ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রীডাের অচেছদ্য হয়ে অক্ষয় হােক।
সূত্র: কালান্তর
৭.১২.১৯৭১