স্বীকৃতিদানে বিলম্ব খুবই ক্ষতিকর
বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানে ভারত সরকারের আর কোনাে বিলম্ব করা উচিত নয়। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র সাতপাঁচ বিবেচনার জন্য আরও কিছু সময় নিতে পারে; কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের কাছে কিছুই আর অজ্ঞাত নেই। ভারতে লাখ লাখ শরণার্থী আসছেন। ভারতের সীমান্তে আগুন জ্বলছে, শুধু তাই নয়, কামানের গােলা ভারতের ভিতরের মানুষকেও খুন করছে। সীমান্তে রাষ্ট্রীয় নিয়মের পরিবর্তে কালােবাজারি ও চোরাকারবারীর রাজত্ব কায়েম হচ্ছে বলে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে অভিযােগ করেছেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেবার অর্থ হলাে এই অরাজকতা ক্রমে আরও বৃদ্ধি পাওয়া এবং ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির উপরও তার ধাক্কা বহন করা। বাংলাদেশের জন্য ভারতের পার্লামেন্ট নৈতিক সমর্থন ঘােষণা করেছেন। তার আর কোনাে পিছুটান অসম্ভব। আর সে কারণেই ভারতকে এখন আগুয়ানই হতে হবে। ভারতের অগ্রগামিতা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের দোমনা ভাবকে দূর করতেও সাহায্য করবে।
ভারতের ভিতরে অবশ্যই কিছু ব্যক্তি ও গােষ্ঠী আছেন যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামের মধ্যে বাঙালি জাত্যাভিমান আছে কিনা তা নিয়ে ভাবিত। গােটা ঘটনা ও ইতিহাসকে তারা বেমালুম ভ্রান্তভাবে বিবেচনা করছেন এবং ‘জুতাে ঠিক উল্টো পায়ে পরিয়েছেন। প্রাপ্তবয়স্কের ভােটে নির্বাচিত সব পাকিস্তানি পার্লামেন্টের হাত জঙ্গি শাসকেরা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেছে এবং সেই অস্বীকৃতির অন্যতম কারণ হলাে এই যে, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। বাঙালি বলেই যদি নিজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও এমন অপমান সহ্য করতে হয়, তার প্রতিক্রিয়াও সহজেই অনুমেয়। তবু আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সংস্থা ও ব্যক্তি দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে আত্মাভিমান মুক্ত রাখার জন্য সর্বতােভাবে প্রয়াস করেছেন। বলা বাহুল্য যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি বাংলার বাইরের লােক এবং অবাঙালিদেরও পূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করবে, শুধু তাই নয়, ঐরূপ অকুণ্ঠ সমর্থন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে বিজয়ী করারও শর্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক জনমত ইয়াহিয়া খানের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রায়ই যেভাবে ব্যক্ত হচ্ছে, বাংলাদেশের সংগ্রামীদের বুক তাতে ভরে উঠছে। এই অবস্থায় ভারত সরকার কর্তৃক আর একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান ভারত উপমহাদেশের চিন্তা ও চেতনায় নতুন ইতিবাচক উপাদান দেবে।
ভারতে অপর এক ধরনের চিন্তাও আছে যে, বাংলাদেশের এই স্বাধীকারের সংগ্রাম বুঝি শেষ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলাকে এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যকেও স্পর্শ করবে। বিচ্ছিন্নতার ফেরিওয়ালা কিছু রাজনীতিক দেশে নেই তা নয়। সিপিএম নেতৃত্বের রাজনীতি ও প্রচার তার কিনারা ধরেই চলছে। তাছাড়া নকশালদের চিন্তাধারা ও কার্যকলাপ সবকিছুকে ছিন্নভিন্ন করার দর্শনেরই ফলশ্রুতি। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি ও সংকীর্ণতাবাদী কার্যকলাপকে জব্দ ও স্তব্ধ করার একমাত্র উপায় হলাে গণতন্ত্রের বিস্তার ও বিকাশ- যার ফলে দেশের মানুষই বিচ্ছিন্নতাকামী ও সঙ্কীর্ণতাবাদীদের ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি ভারত সরকারের স্বীকৃতিদান ভারতের গণতন্ত্রীদেরও উৎসাহিত এবং সােচ্চার করবে। পক্ষান্তরে এই স্বীকৃতি দানে বিলম্বই বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সঙ্কীর্ণতাবাদীদের প্রলাপ বকার সুযােগ করে দেয়।
সূত্র: কালান্তর
২৪.৪.১৯৭১