You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.05.30 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শান্তির সৈনিক বঙ্গবন্ধু | মানবতার নামে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
৩০শে মে, বুধবার, ১৯৭৩, ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শান্তির সৈনিক বঙ্গবন্ধু

‘প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মহান নেতাই নন, তিনি শান্তির সক্রিয় সৈনিক।’ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে সোভিয়েত শান্তি প্রতিনিধি দলের নেতা মিঃ কামালভ গত সোমবার সোভিয়েত সাংস্কৃতিক বিভাগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বলেন।
মিঃ কামালভ বলেন, এশীয় শান্তি সম্মেলনের চার দফা ঘোষণা বিশ্ব শান্তি উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ সকল সময়েই বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের পাশে দাঁড়াবেন।
মিঃ কামালভ আরো বলেন যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এবং তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে সর্বতোভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ শান্তিতে বিশ্বাসী। বাংলার মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে যায়। আর এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ শান্তির সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে বেরিয়ে বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারী স্বদেশের মাটিতে ফিরে এসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী জনসাধারণের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নাই। তোমরা সুখে থাক। আমরাও সুখে থাকি।’
মানবতা, ন্যায়নীতি ও শান্তিতে বিশ্বাসী বলেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এত নির্যাতন, নিপীড়ন, শাসন ও শোষণের পর এমনি কথা বলা সম্ভব। উদার ও মানবপ্রেমিক না হলে কারো পক্ষে এমন বক্তব্য উপস্থাপন সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার সব সময়েই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। জোটনিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌলনীতি।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার জোটনিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী বলেই পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে চান। আর এ কারণেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণার জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশ চায় এ উপমহাদেশ তথা সমগ্র এশিয়ায় শান্তির পারাবত পাখা মেলে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে উড়ে বেড়াক। বাংলাদেশ কোন অবস্থাতেই আরেকটা যুদ্ধের আগুন এ উপমহাদেশে জ্বলে উঠুক-এটা চায় না।
বাংলাদেশের বুকে যে শান্তি সম্মেলন হয়ে গেলো তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। সোভিয়েত শান্তি প্রতিনিধিদলের নেতা মিঃ কামালভের ভাষাতেই বলতে হয়, ‘শান্তি সম্মেলন অত্যন্ত সফল হয়েছে এবং সম্মেলনে গৃহীত ঢাকা ঘোষণা শুধুমাত্র এশিয়ায় নয়, সমগ্র বিশ্বেও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পারন করবে।’
পরিশেষে আমরা একথাই বলবো, বাংলাদেশের মানুষ সব সময়েই সব অবস্থাতেই বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এশিয়ার বুকে যে ‍যুদ্ধের আগুন জ্বালাবার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তির সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বলিষ্ঠ ও প্রত্যয় দীপ্ত কন্ঠে বাংলার আকাশে ও বাতাসে ধ্বনিত হবে—আমরা যুদ্ধ চাইনা—শান্তি চাই।

মানবতার নামে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে

পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের রক্ষার উদ্দেশ্যে আশু সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী গত সোমবার জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নীরব দর্শকরূপে আর এক মানবীয় বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করার জন্য তিনি বিশ্বসংস্থার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের রিলিফ ও পুনর্বাসন হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিরীহ বাঙালীদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে জাতিসংঘের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে এক নৈশ অভিযান চালিয়ে বাঙালীদের বন্দী শিবিরে আটক করা হয়েছে।
পাকিস্তানের এই কাজকে বর্বরোচিত আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রপতি আরো বলেন যে, নিরীহ বাঙালীদের উপর এই ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা পাকিস্তানের বিবেকের দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে।
পাকিস্তানে আটক নিরীহ বাঙালীদের সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা আজ তার একার বক্তব্য নয়। এ বক্তব্য আজ বিশ্ববিবেকের। পাকিস্তান আজ সবরকম ন্যায়নীতি ও মানবতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে চার লাখ নিরীহ নিরপরাধ বাঙালীকে আটকে রেখেছে ‘জিম্মি’ রূপে। পাকিস্তানের ভুট্টো সাহেব যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আটক বাঙালীদের একই দাঁড়ি-পাল্লায় তুলেছেন। ভুট্টো সাহেব সারা পৃথিবীর মানুষের চোখে ধুলো দেবার জন্যে যুদ্ধবন্দী আর যুদ্ধাপরাধীদের জন্য মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছেন এবং আটক বাঙালীদের স্বদেশে ফেরত পাঠাবার ব্যাপারে গড়িমসি করছেন। বাংলাদেশ বৃহত্তর কল্যাণ, স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে ভারতের সঙ্গে যে যুক্ত ঘোষণা পেশ করেছে, তাতে ভুট্টো সাহেব সাড়া না দিয়ে বিশ্ব আদালতের আশ্রয় নিয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতির অনুসরণ করে যাচ্ছেন। যুদ্ধবন্দীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেবার ইচ্ছে যে তাঁর আদৌ নেই তা ভুট্টো সাহেবের বর্তমান কার্যকলাপেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
ভুট্টো সাহেব যা-ই করুন না কেন বিশ্ব বিবেক তো নিশ্চুপ থাকতে পারে না। রাষ্ট্রপতি যা বলেছেন তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়েই আমরা বলবো জাতিসংঘকে নীরব দর্শক হলে চলবে না। অন্ততঃ মানবতার নামে পাকিস্তানে আটক চার লাখ বাঙালীকে স্বদেশে পাঠাবার বিষয়ে জাতিসংঘকেই এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন