বাংলার বাণী
২৯শে মে, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
লন্ডনে বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্ত
লন্ডনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে একটা ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা করছে বলে গতকালে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদ। পত্রিকাতে বলা হয়েছে যে, লন্ডনে সদর দফতর স্থাপন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী শাসকদের একটি ষড়যন্ত্রকারী দল বিশেষ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানোর জন্যে একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াসে ভুট্টো সরকারের পুতুল স্টেটমন্ত্রী কুখ্যাত মাহমুদ আলী ইতিপূর্বে দু’বার গোপনে লন্ডন সফর করে গেছেন বলেও সংবাদে বলা হয়েছে। মাহমুদ আলী সম্প্রতি যে সকল অভিসন্ধি নিয়ে লন্ডনে তৎপর রয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- বাংলাদশে সরকার কর্তৃক সাম্প্রতিক ঘোষিত নাগরিকত্ব হারানো ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার রটনা চালানো। জানা গেছে, মাহমুদ আলী সাহেব নাকি লন্ডনে পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক্ত কতিপয় ব্যক্তিদের সঙ্গে নবজাত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভুল তথ্য দিয়ে দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ চালাচ্ছেন। লন্ডনস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত ষড়যন্ত্রকারীদেরকে আর্থিক ও কলাকৌশলগত সাহায্য দিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রয়েছে, বিশেষ করে নিষিদ্ধ জামায়াত ও মুসলিম লীগের সদস্য, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সবিশেষ তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এ ব্যাপারে তারা মুসলিম বাংলা শ্লোগানকে আশ্রয় করেছে। বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে জাতীয় ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে যে একটা বিরাট চক্রান্ত চলছে তা মোটেই অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের অভ্যন্তরে কিছু সংখ্যক অনভিপ্রেত নিষিদ্ধ দল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের সদস্য ও এদেরকে ইন্ধন জোগানো জনধিকৃত কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের একটি দেশোদ্রোহিতার লক্ষণ ও তৎপরতা এবং সাম্প্রদায়িক বীজ বপনের অশুভ প্রচেষ্টা আমরা প্রত্যক্ষ করে আসছি। তথাকথিত মুসলিম বাংলার ভূতও মাঝে-মধ্যে আমাদের কানে ভেসে আসছে। এ সমস্ত লক্ষণকে অবশ্যই উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন নয়। গতকালের সংবাদ অনুযায়ী লন্ডনে ভুট্টোর স্টেটমন্ত্রী মাহমুদ আলীর তৎপরতা এক্ষেত্রে অবশ্যই সবিশেষ অনুধাবনযোগ্য। আমাদের সরকারকে পূর্বাহ্নেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। এবং দেশব্যাপী এ সকল শত্রুদের বিরুদ্ধে জনগণকে সজাগ করে তোলার জন্যে ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে এ সকল শত্রুদের মোকাবেলার জন্যে দেশে দেশে তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাকিস্তান তার সর্বশেষ চেষ্টা চালাবে এদেশের সংহতি ও স্বাধীনতা বিপন্ন করার। তারা প্রচেষ্টা চালাবে এদেশের অভ্যন্তরের শত্রুদের মদদ জুগিয়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে। কঠোর হস্তে এসব তৎপরতা বন্ধ করতে হবে আমাদেরকে। আমাদের বিশ্বাস রয়েছে ত্রিশ লাখ মানুষের শহীদী আত্মার উপর যে দেশের ভিত রচিত হয়েছে, তার কোন অমর্যাদা দেশবাসী সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সময় থাকতেই সরকারকে তাই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এ ব্যাপারে।
শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য স্থায়ী ট্রাস্ট
স্থায়ী ট্রাস্ট চাই। দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও সৃজনশীল প্রতিভাধর মানুষগুলো যেন আর্থিক অনটনের কবলে পড়ে শিল্প সৃষ্টিতে বাঁধাগ্রস্ত না হন। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের জীবন যেন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তলিয়ে না যায়। সরকারের কাছে এ দাবী উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান। গত পরশু জনাব জিল্লুর রহমান এক বিবৃতিতে ব্যক্ত করেছেন, দেশের যে সব প্রতিভাবান শিল্পী ইতিমধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেছেন, তাদের পরিবার-পরিজনের জন্যে বঙ্গবন্ধু সহানুভূতিশীল হয়ে নানা সময়ে নানা জনকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছেন। সঙ্গীত সাধক মুন্সী রইসউদ্দীনের জীবনাবসানের পর বঙ্গবন্ধু তার দুঃস্থ পরিবারবর্গের জন্যে দশ হাজার টাকা এবং চলচ্চিত্র শিল্পী রাজু আহমদ, ওস্তাদ আয়াত আলী খান প্রমুখের পরিবারবর্গের জন্যেও আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়েছে। জনাব রহমান প্রসঙ্গতঃ পঙ্গ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এটা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের মহানুভবতারই পরিচায়ক। তিনি বিবৃতিতে মন্তব্য করেছেন যে, ঔপনিবেশিক শাসনামলে আমাদের দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা ছিলেন চরমভাবে উপেক্ষিত এবং প্রবঞ্চিত। স্বাধীন দেশে শিল্পী-সাহিত্যিকদের যেন আর্থিক অনটনের কবলে পড়ে সৃজনশীল প্রতিভা অবলুপ্ত না করতে হয় এবং তাদের মৃত্যুর পরে যেন পরিবার-পরিজনকে দুর্গত মানবেতর জীবন যাপন করতে না হয়, সে জন্যে একটি স্থায়ী ট্রাস্ট গঠন অত্যাবশ্যক।
আওয়ামী লীগ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের এ বিবৃতিটি মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভঙ্গির পরিচায়ক। কারণ, আমাদের দেশের রাজনীতিকরা শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমস্যা-সংকট, সম্ভাবনা-ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে বড়ো বেশী মাথা ঘামান না। বলা চলে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতারা এতোদিন প্রায় উটকো মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছেন। জনাব রহমানকে ধন্যবাদ যে, তিনি দেশের চিরদিনের উপেক্ষিত শিল্পী-সাহিত্যিকদের কল্যাণের জন্য চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ পেয়েছেন। বস্তুতঃপক্ষে, দেশের আনাচে-কানাচে এমন অনেক প্রতিভাসম্পন্ন কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পী রয়েছেন, যারা আর্থিক দুর্যোগের কারণে নিজেদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হচ্ছেন না। আবার এমনও অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক-সঙ্গীতজ্ঞ রয়েছেন, যাদের মৃত্যুতে দেশে শূন্যতার সৃষ্টি হয় এবং তাদের পরিবারের বেঁচে থাকার কোন নিশ্চয়তা থাকে না। প্রতিভাবান শিল্পীরা এমনি করেই যুগে যুগে করুণ ও মর্মান্তিক কাহিনীর নায়ক হয়ে থাকেন। বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনে যেন কোন অভাব-অনটন রাহুর মতো তাদের গ্রাস করতে না পারে, সে জন্যে ট্রাস্ট একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সত্যিকার অর্থে প্রতিভাবান, সৃজনশীল অথচ দুঃস্থ শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য যদি একটি কল্যাণ ট্রাস্ট গঠিত হয়, তাহলে এদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা একটি মস্ত বড়ো দুর্ভাবনা থেকে মুক্তি পাবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অভ্যাস বদলাতে হবে
যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে সমস্যার অন্ত নেই। সর্বত্রই নতুন করে গড়বার পালা। প্রচুর শ্রম বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ দেশের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সকল পর্যায়ের সরকারী কর্মচারীদের জড়তা আর কর্তব্যের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা বর্তমান সরকারের সম্মুখে এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ ব্যাপারটি বাংলাদেশ সরকারকে সবিশেষ উদ্বিগ্ন করেছে। বিশিষ্ট সংবাদ প্রতিষ্ঠান সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, একঘন্টা পরে অফিসে আসা এবং ছুটির এক ঘন্টা আগে অফিস ত্যাগ করা বর্তমান সরকারী কর্মচারীদের প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোন সময় জরুরী পরিস্থিতি দেখা দিলেও এই সব কর্মচারীরা রবিবারে কাজ করতে চান না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধোত্তর জাতীয় অবস্থার ভিত্তিতে সবাইকে বার বার দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান অতীতেও জানিয়েছেন এবং এখনও জানাচ্ছেন। এমতাবস্থায় ছুটির দিনে কাজ করার বদলে তারা ঘরে বসে আরাম আয়েশে হাই তুলতে বেশী পছন্দ করেন। অপরদিকে অফিসের কাজেও তারা নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিচ্ছেন না। সেখানে কাজের পাহাড় জমে থাকে, এবং ফাইলের পর ফাইল স্তূপাকারে হ’য়ে পড়ে থাকে। অবশেষে বহু ফাইল পত্র বেমালুম গায়েবও হ’য়ে যায়। সকল সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মোটা বেতনের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এরা দেশের পরগাছা। যে মূল গাছের রস খেয়েই এদের পুষ্টি, সেই মূলের ভালোমন্দের সঙ্গে উন্নতি, অগ্রগতি বা অধোগতির সঙ্গে এদের কোন যোগ যেন থাকতে নেই। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এদের কাছে অর্থহীন। দেশের আপামর জনসাধারণের ব্যাপক স্বার্থে এদের কাছে অতি তুচ্ছ। আত্মসর্বস্ব এই সকল সরকারী কর্মচারীরা ‘আত্ম’ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না, বুঝতে চানও না।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মারফত আমরা জানতে পারছি যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবিবারেও কাজের বিরতির কথা চিন্তা না করে অহোরাত্র ফাইল নিয়ে কাজ করে চলেছেন। প্রশ্নটা উঠছে সেখানেই। কারণ তিনি একা কাজ করে চললেই তো সমগ্র দেশের চাকা ঘুরবে না! সবাইকে কাজ করতে হবে। অক্লান্তভাবে কাজ করতে হবে। সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রত্যেক সরকারী কর্মচারীকে তাদের নিজেদের উপর ন্যস্ত কাজগুলো যথাযথভাবে করে যেতে হবে এবং তাঁকে সহযোগিতা দিতে হবে। কারণ সরকারী কর্মচারীদের সহযোগিতা না পেলে বঙ্গবন্ধুর সকল পরিশ্রমই পন্ডশ্রম হবে।
পরিশেষে তাই আমরা বলতে চাই—যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকারী কাজে গাফিলতি প্রদর্শন করছেন, অফিসের সময়ের নিয়ম ভঙ্গ করছেন এবং তার ফলে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির সকল পর্যায়ে একটা কৃত্রিম অচলাবস্থার সৃষ্টি করেই চলেছেন, তাদের প্রতি সরকারের কঠোর নীতি অবলম্বন করতে হবে। দেশের স্বার্থের পরিপন্থী ঐ সব অকর্মার ধাড়ীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান করতে হবে। অর্থাৎ দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই সরকারকে অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে এই সব ‘ধীরে চলা’ নীতির মুলোৎপাটন করতেই হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক