বাংলার বাণী
১২ই মে, শনিবার, ১৯৭৩, ২৯শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বন্যা দুর্গতদের সাহায্য
বন্যার নিদারুণ মূর্তি প্রতিবারের মতো আবার ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। অবিরাম বৃষ্টিপাত ও পাহাড় থেকে উচ্ছ্বসিত ঢলের দরুণ দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলো প্লাবিত হয়ে গেছে। সংবাদে প্রকাশ ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মহুরী ও খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণকার্য জোরদার করার জন্যে নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইতিমধ্যে ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন। বন্যার করাল থাবা প্রথম বিস্তার লাভ করেছে কুমিল্লা জেলার উপর। এ পর্যন্ত যে খবর পাওয়া গেছে তাতে কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নোয়াখালী জেলার তিনটি থানার বিস্তীর্ণ এলাকার আউশ ও আমন ধান পানির নিচে ডুবে গেছে বলে সংবাদে প্রকাশ। এদিকে ফেনী মহকুমার তিনটি থানার শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ফসল বন্যার দরুণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। সিলেট জেলা মৌলভীবাজার থেকে সংবাদ পাওয়া গেছে যে, গত কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিপাতের দরুণ ধোলাই নদীর বাঁধে কয়েকটি স্থানে ভাঙ্গন ধরেছে এবং তার ফলে তিনটি ইউনিয়নের হাজার হাজার জনপথ ভেসে গেছে। এবং ছিন্নমূল মানুষ হাহাকার করে ফিরছে। রংপুর থেকেও একই সংবাদ পাওয়া গেছে। সেখানে প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুণ গ্রাম-গঞ্জ ভেসে গেছে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বন্যার পদধ্বনি প্রকট হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই সরকার প্রয়োজনীয় প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
এবং অবস্থার মোকাবেলা করার জন্যে প্রাথমিক বরাদ্দ বেশ কিছু টাকা সাহায্য হিসেবে পাঠিয়েছেন। কাল বোশেখীর মরণ ছোবল শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হয়েছে বন্যার নিদারুণ আঘাত। বাংলার মানুষ প্রকৃতির এই নির্মম পরিহাসের শিকার নিত্যনিয়ত। প্রতি বছর যেন একটি নিয়মে প্রবর্তিত হয়েছে কাল বোশেখী আর বন্যার করালগ্রাসের ছোবল। এই ছোবল যেন বাংলার মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। এই ছোবলের শিকার যেন হতেই হবে সবাইকে। দেশে সরকারকে প্রহরীর মতো নিয়োজিত থাকতে হবে কখন কালবোশেখী হবে কখন বন্যা হবে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের হাজারো সমস্যা। সেই সকল নিদারুণ সমস্যা নিয়ে আজ সরকার তার প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। বহু সমস্যায় জর্জরিত বাংলার মানুষ আজ ন্যূনতম বাঁচার তাগিদে সংগ্রামরত। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতির সময় আবার দেখা দিয়েছে বন্যার ভয়াল মূর্তি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করার মহান দায়িত্ব যেমন সরকারের তেমনি দেশের মানুষেরও। দেশের প্রতিটি মানুষকে বন্যা কবলিত মানুষের বেদনার সমব্যথী হতে হবে। যতদূর সম্ভব যা দিয়ে সম্ভব তাদের দুঃস্থ জীবনের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সকল সেবা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে বন্যা দুর্গতদের সাহায্য করার কাজে নিয়োজিত হওয়া আবশ্যক। রাজনৈতিক দলগুলো এ মুহূর্তে সরকারের উপর দায়িত্ব অর্পণ করে হাত গুটিয়ে-বসে থাকবেন—এটাও হতে পারে না। কেননা সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেরই মূল খাত দুঃস্থ মানবতার সেবা করা। আমরা আহ্বান জানাবো, সরকারের ঐকান্তিকতার সঙ্গে সকল সেবা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের কাজে এগিয়ে আসেন। সবাই যেন দুর্গত মানবতার সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন।
ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পোরেশন প্রসঙ্গে
জনজীবনের সংকট মোচনের জন্যেই সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে চার হাজারেরও বেশী ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করা হয়েছিলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশবাসী যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের অভাবে দিশেহারা না হয়, সেই মহতী জনকল্যাণমুখী উদ্যোগেরই বাস্তবায়ন ঘটেছিলো ন্যায্যমূল্যের দোকান ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতান্ত্রিক সরবরাহ ব্যবস্থা এবং দেশের নিম্ন আয়ভুক বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বহু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তড়ি-ঘড়ি করে ন্যায্যমূল্যের দোকানে প্রায় তেইশ হাজার কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। সাইন বোর্ড লটকানো হয়েছে। কিন্তু এইসব ন্যায্যমূল্যের দোকানে পণ্যসামগ্রী নেই। সিগারেট ও সোডা কোন কোন সময় পাওয়া গেলেও তেল কিংবা শিশু খাদ্য মওজুত থাকে না। কিংবা তেল পাওয়া যায় তো, সোডা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ দেশের ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোতে কর্মচারীরা মাসের পর মাস ধরে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে। মাসের শেষে মাইনে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দোকান ভাড়া তো রয়েছেই।
গতকাল প্রকাশিত ‘বাংলার বাণী’র রিপোর্টারের তথ্যানুযায়ী জানা গেলো, ছয় কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ এবং এক কোটি টাকা সরকারী সাহায্য এবং সাত কোটি টাকার মূলধন নিয়ে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পোরেশনের যাত্রা হয়েছিলো শুরু। কিন্তু ভারী প্রতিষ্ঠানিক খরচ মেটাতে গিয়ে কর্পোরেশন দেউলিয়া হতে বসাতে সম্প্রতি কর্পোরেশনকে সরকার আরও তিন কোটি টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাতেও নাকি ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোকে পণ্যসম্ভারে সজ্জিত করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি মাসে চল্লিশ লক্ষ টাকা অপচয় তাই কিভাবে রোধ করা যায়, সেটাই এখন সাধারণ মানুষের কাছে একটা বিরাট জিজ্ঞাসার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের উদ্দেশ্য যে শুভ ছিলো, তা আমাদের সন্দেহাতীত, কিন্তু যে ব্যবস্থা বৃহত্তর জনসাধারণের কল্যাণে না লেগে বরং জাতীয় লোকসানের অংককেই বর্ধিত করে, সে ব্যবস্থা সম্পর্কে কি নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করার এতোটুকু অবকাশ নেই?
সারাদেশে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা লক্ষ্য করে আসছি যে, ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো সত্যিকার অর্থে জনসাধারণের চাহিদা মেটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ন্যায্যমূল্যের দোকান জনগণকে আশার আলোয় আলোকিত করতে পারেনি। বরং এর জন্য তেইশ হাজার কর্মচারীকে ভরণপোষণ বাবদ কর্পোরেশনকে ফি মাসে চল্লিশ লক্ষ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। আশংকা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দশকোটি টাকার মূলধন নিঃশেষিত হয়ে ভোগ্যপণ্য কর্পোরেশনটি দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো লাটে উঠবে। এমতাবস্থায়, আমরা সাইনবোর্ড সর্বস্ব ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোর দীর্ঘায়ু কামনা করতে পারি না। কিন্তু যেহেতু ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোর সঙ্গে স্বল্প আয়সম্পন্ন জনগণের সংকট ও সম্ভাবনা জড়িত সেহেতু ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো পর্যাপ্ত ও নিয়মিত পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনাকে চাঙ্গা করে তোলা হোক এবং ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোকে সত্যিকার জনকল্যাণমুখী করার জন্য অতীতের ভুলভ্রান্তি শুধরে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক বলে অভিমত পোষণ করছি। নইলে ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো হস্তীপোষার মতো বাহুল্য ব্যয়ভাবে তলিয়ে যাবে।
পানি ও বিদ্যুতের লুকোচুরি—
‘রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে বিদ্যুৎ নিয়ে তামাসা’ শিরোনামায় গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, সরকারের পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে যে বিভাগটি রয়েছে, সেটি আজকাল যেন বেসরকারী মসকারী বিভাগে পরিণত হয়েছে। বিভাগটির নামের সাথে একটি ‘উন্নয়ন’ শব্দ সংযোজিত থাকলেও কার্যতঃ তা যেন অবনতি বোঝানোর জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে।
বস্তুতঃ শুধু মতিঝিল এলাকা কেন সমগ্র ঢাকা শহরে পানি আর বিদ্যুতের এই আছে-এই নেইর যেন এক লুকোচুরি খেলা দৈনিক গড়ে দু’ থেকে চার ঘন্টা যাবৎ চলে। আর এই লুকোচুরি খেলার ফলে জন-জীবন যে কি রকম দুর্বিষহ হয়ে উঠে পানি-বিদ্যুৎ কর্তারাও নিশ্চয়ই সেটা টের পেয়ে থাকবেন।
পানি আর বিদ্যুৎ অন্য কথায় নাগরিক জীবনের প্রাণ। আর সেই দু’টি জিনিসের উন্নয়নের জন্য আলাদা মন্ত্রী পর্যায়ের দফতর থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এ দু’টি জিনিসের সর্বক্ষেত্রে অবনতি ছাড়া উন্নয়ন লক্ষ্য করার মতো কিছুই চোখে পড়েনা। দেশের কল-কারখানাগুলোতে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে উৎপাদন ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
পানি আর বিদ্যুৎ উন্নয়নের খাতে পাকিস্তানী আমল থেকে প্রতিবছরই একটি বিরাট অংকের টাকা বাজেট বরাদ্দ থাকতো। পাকিস্তানী আমলের কথা বাদ দিলেও গত বছরের বাজেট বরাদ্দের কত অংশ পানি আর বিদ্যুত উন্নয়নের কোন ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে, জনগণ তার একটা হিসেব জানতে চায়।
অন্যদিকে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোর প্রাণকেন্দ্র। জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর বেশীর ভাগেরই অফিস এখানটায়। সেখানে যদি দফায় দফায় বিদ্যুৎ চলাচল তিন-চার ঘন্টা ব্যাহত হয়, তবে সংবাদপত্রগুলোর অবস্থাটা কি দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়।
এমতাবস্থায় পানি-বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পানি ও বিদ্যুতের সত্যিকারের উন্নয়নের দিকে যদি দৃষ্টিদান করেন, তবে দেশের মানুষ স্বস্তি পেতে পারে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক