You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.05.11 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বন্যার পদধ্বনি | ফনীবাবু দু’পা এগিয়েছেন আর এক পা বাকী | সময় থাকতে তৎপর হোন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১১ই মে, শুক্রবার, ১৯৭৩, ২৮শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বন্যার পদধ্বনি

গত কয়েকদিন ধরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। একটি সংবাদে জানা গেছে যে, নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টির জন্যে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কুমিল্লার গোমতী এবং ফেনীর মহুরী নদী দিয়ে যে ঢল নেমেছে তাতে ফেনী মহকুমার পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া থানার প্রায় একশ’ বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে। ফলে গোমতী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গোমতী নদীর পানি আরও বাড়তে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এবং সেটা হলে উক্ত এলাকা নিশ্চিত বন্যা কবলিত হবে। কুমিল্লা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ঢলের পানি প্রবেশ করে প্রচুর ফসলের ক্ষতিসাধন করেছে এবং কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাঁধেও ফাটল ধরেছে বলে সংবাদে বলা হয়েছে। আসন্ন বন্যা পরিস্থিতির জন্যে কয়েক লক্ষ লোক সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্রীষ্মের নিদারুণ দাহ শেষ হতে না হতেই বর্ষার ঢল নামতে শুরু করেছে। বাংলার মানুষের ভাগ্যে গ্রীষ্মকাল যেমন একদিকে সমস্ত ফসলকে বিনষ্ট করে দেয় তেমনি বর্ষাকালের প্রবল বারিপাতে ফসল ডুবিয়ে দিয়ে হাহাকার ডেকে আনে। প্রকৃতির নিষ্ঠুর পরিহাসের শিকার বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়তই হচ্ছে। এবারের বিভিন্ন ফসলের সময় অনাবৃষ্টির দরুণ প্রচুর ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে গবাদিপশু ও বীজের অভাবে দেশে বহু অনাবাদী জমি পড়ে রয়েছে। গ্রীষ্ম যেতে না যেতেই আবার বর্ষার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বর্ষার কবল থেকে বাঁচার জন্যে পূর্বাহ্নেই আমাদের কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিলো। কিন্তু সারাদেশব্যাপী বন্যা নিরোধের পরিকল্পনা একটা বিরাট কর্মসূচী। সরকার বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্যে ব্যাপক পরিকল্পনার কথা ভাবছেন বলে আমরা জানি এবং আগামী পাঁচসালা পরিকল্পনায় এ খাতে একটি পদক্ষেপ গৃহীত হবে বলেও আশা করা যাচ্ছে। বর্ষা সমাগত। এবং প্রতিবারের নিয়মে বন্যাও আর বেশী দূরে নেই। বন্যার হাত থেকে এদেশের কোটি কোটি মানুষকে বাঁচাতে হবেই। এদেশের লক্ষ লক্ষ একর জমির সোনার ফসল রক্ষা করতেই হবে। উল্লেখিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিত বুঝতে পারছি ‍কুমিল্লা জেলা ও তার সংলগ্ন এলাকায় যে প্রবল বারিপাতের দরুণ ঢল নেমেছে তাতে উক্ত এলাকার ফসল ও জনজীবনের সমূহ ক্ষতি প্রকট হয়ে উঠেছে। এই ক্ষতি আমাদের জাতীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিবে। একেতো দেশে প্রচুর খাদ্যাভাব রয়েছে তার উপর নানা কারণে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য। এমতবস্থায় যদি দেশের ফসল ও জনজীবনকে বন্যার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি না দেওয়া যায়, তাহলে জাতির ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। আপাতঃ বন্যার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে একটা প্রাথমিক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। তবে বাংলাদেশের সমস্ত জনশক্তি ও সম্পদকে বন্যার হাত থেকে মুক্তিদানের নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যানিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা যে কোন মূল্যেই হোক বাস্তবায়িত করতেই হবে। কেননা দেশের সামগ্রিক উন্নতি এই মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নের উপর সম্পূর্ণ অর্থে নির্ভরশীল।

ফনীবাবু দু’পা এগিয়েছেন আর এক পা বাকী

হাতের কাছে এক্ষুণি যথেষ্ট খাদ্যশস্য না পেলেও চট্টগ্রামে খাদ্যমন্ত্রীর ভাষণ আমাদের মনে আশার সঞ্চার করেছে। চলতি বছরের খাদ্য ঘাটতি পঁচিশ লাখ টন। এর মধ্যে ঊনিশ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানীর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা প্রায় শেষ। বাকী ছয় লাখ টন খাদ্যশস্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণের মাধ্যমে কেনার চেষ্টা চলছে। সারা দুনিয়ায় এবার চাল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য বেশ কিছু পরিমাণ গম আমদানী করতে হয়েছে আমাদের। এবার কিন্তু বাকী ছয় লাখ টনের সবটুকুই চাল আমদানীর জন্য ফনীবাবু ‘আপ্রাণৎ চেষ্টা করছেন।
আমদানীর পর রয়েছে খাদ্যশস্যের দ্রুত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। খাদ্যমন্ত্রী সে ব্যাপারেও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য পৌঁছানোর কাজ তদারকির জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিজেন্টকে নিযুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম থেকে খাদ্য পরিবহনের জন্য পূর্বে সপ্তাহে যে ষাটটি ওয়াগন দিতো, ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তারা এখন একশত তেইশটি ওয়াগন দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া যেখানে সম্ভব সরকার নৌযানযোগে খাদ্য পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।
মোটামুটি খাদ্যমন্ত্রীর দেয়া তথ্যাবলী খাদ্য সংকটের ব্যাপারে একটা আশাবাদী চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। আশা মানুষকে বেঁচে থাকবার প্রেরণা দেয়। খাদ্য সমস্যার এই চরমতম অবনতির দিনেও মানুষ হয়তো খাদ্যমন্ত্রীর আশ্বাসকে সম্বল করে ভবিষ্যত সুখের দিন গুণছে।
খাদ্যমন্ত্রী দু’পা এগিয়েছেন। আরো এক পা বাকী। খাদ্য আমদানী এবং খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা প্রায় সমাপ্ত। কিন্তু খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং জনসাধারণের হাতে তা পৌঁছিয়ে দেয়া এর মধ্যে রয়েছে আর এক কদমের ফারাক। পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ার পরও যে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ার দল জনগণের দুর্ভোগে দয়ার্দ্র হয়ে এগিয়ে আসবে, এমনটি আশা করা যায় কিভাবে? ভুয়া কার্ড ডিলারশীপের ফোকরাটা বন্ধ করবার কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হয়তো খাদ্যমন্ত্রীর এই পরিশ্রম সফল হতো। জনসাধারণ হাতের কাছে ন্যায্যমূল্যে চাল-গম পেতো। হাড়িতে চাল ফুটতো। আমরাও খুশী হতাম।

সময় থাকতে তৎপর হোন

অবশেষে দু’জন মন্ত্রী ও দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সহযোগিতায় দীর্ঘ বারো ঘন্টা পানাহার এবং আতিথেয়তা থেকে বঞ্চিত হতভাগ্য বিমানযাত্রীরা উদ্ধার পেয়েছেন। লন্ডন থেকে আগত সিলেটগামী এই যাত্রীরা গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন এবং বুধবার অপরাহ্ন একটা পর্যন্ত তাঁদেরকে লাউঞ্জেই কাটাতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাঁরা কোনপ্রকার আতিথেয়তা এমনকি এক কাপ চা কিংবা সৌজন্য সেবা পর্যন্ত পাননি। উপরন্তু তাঁদের কিছু জিনিসপত্র হারানোর কথা তাঁরা মন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়েছেন বলে স্থানীয় একটি ইংরেজী দৈনিকে গতকাল খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিমান কর্তৃপক্ষের এহেন দুঃখজনক আচরণের কথা ইতিপূর্বে বহুবার পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে এবং প্রবাসী বাঙালীরাও এ ব্যাপারে দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিমান কর্তৃপক্ষের তবুও টনক নড়েনি।
আতিথেয়তা প্রদর্শনে বাঙালীর একটা ঐতিহ্য রয়েছে দীর্ঘকাল থেকে। অথচ সেই বাংলাদেশের বিমানবন্দরেই বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারীরা বিমান ব্যবসায়ের অন্যতম দুর্নীতি ‘অতিথিপরায়ণতা’ প্রদর্শনে চরম কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিলেন। শুধু তাই নয়, দেশের আভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের ক্ষেত্রেও নানা অব্যবস্থা এবং যাত্রীদের দুর্ভোগ-দুর্গতি মোচনে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট তৎপরতা দেখাতে পারেননি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বিমান সংস্থা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যেখানে এই বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা চলছে সেখানে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের বিমান সংস্থা সেদিকে সচেষ্ট হওয়াতো দূরের কথা, বরং যাত্রীদের প্রতি সামান্য সৌজন্য সেবা প্রদর্শনেও দারুণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের বিমান সংস্থায় অনেক অভাব-অভিযোগ আছে সত্য। সেগুলো ধীরে ধীরে মেটানোর প্রচেষ্টাও চলছে। কিন্তু আতিথেয়তা এবং সৌজন্য প্রদর্শনের জন্যও কি অর্থের প্রয়োজন? নিশ্চয় না। এ ব্যাপারে বিমান সংস্থার কর্মীরা সচেতন হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলেই এর সমাধান সম্ভব। দেশবাসীর সঙ্গে আমরা তাই দেশ ও জাতির সম্মানের স্বার্থে বিমান কর্মীদের কাছ থেকে সেই আন্তরিকতা এবং কর্মতৎপরতাই কামনা করি। সময় থাকতে তৎপর হওয়াই মঙ্গলজনক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন