You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.16 | প্রধানমন্ত্রীর দ্বিধা কেন? | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

প্রধানমন্ত্রীর দ্বিধা কেন?

পশ্চিম দুনিয়া সফরের পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কী সিদ্ধান্ত নেন তা জানার জন্য সারা ভারত যখন উদগ্রীব, তখন তিনি এক নিরাশার বাণী শুনিয়েছেন। পশ্চিমের বুর্জোয়া দেশগুলাের দু’মুখাে রাষ্ট্রনায়করা পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য উদ্যোগী হবেন বলে তাকে যে আশ্বাস দিয়েছেন তাতেই হয়তাে তিনি গলে গিয়ে থাকবেন। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত নেবার অভিপ্রায় আপাতত তার নেই। পশ্চিমেরই কপট নেতাদের মুখাপেক্ষী হয়ে কালহরণ করতে তিনি প্রস্তুত। তার অর্থ বাংলাদেশ ও শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সমস্যা অনির্দিষ্টকাল শিকেয় তুলে রাখা। ওয়েটিং ফর গােড়াে’র নায়কের মতােই তিনি এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকবেন।
শ্রীমতী গান্ধী রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান সদস্যবৃন্দ ও পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে তাঁর সফরের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন যে, পশ্চিমের দেশগুলাে বাংলাদেশ ঘটিত সঙ্কটের গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় বেশি করে উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং অবিলম্বে একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজন আছে বলে স্বীকার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত কয়েকটি রাষ্ট্রের নায়করা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলােচনার সূত্রপাত করার জন্য তারা ইয়াহিয়া খানকে বুঝিয়ে রাজি করার চূড়ান্ত চেষ্টা করবেন। অতএব, প্রায় এক কোটির মতাে শরণার্থী বুকে নিয়ে শ্রীমতি গান্ধী সেই মহাজনদের শুভেচ্ছা’ ও ‘সৎপ্রয়াসের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান পরিবর্তনে বিরত থাকবেন।
একেই বলে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করবে এবং তাতেই বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসবে আর শরণার্থীরা পরমানন্দে দলে দলে ভারত থেকে স্বদেশ অভিমুখে যাত্রা শুরু করবে- প্রধানমন্ত্রীর মনে তেমন আস্থা জন্মে থাকলেও দেশের মানুষ কিন্তু তা মােটেই বিশ্বাস করে না। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সাম্রাজ্যবাদী নেতাদের সততার উপর নির্ভর করলে শেষপর্যন্ত তা প্রবঞ্চনায়ই পরিণত হবে। বানরের পিঠা ভাগের গল্পটা কি প্রধানমন্ত্রীর পড়া নেই?
প্রতিদিন পাক হানাদাররা ভারত সীমান্তে হামলা ও গােলাগুলি বর্ষণ করে ভারতীয় নাগরিকদের খুনজখম করছে। অনেকের বাড়ি-ঘরও বিধ্বস্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর তুষ্টিভাব কি আক্রান্ত সীমান্তবাসীদের আশ্বস্ত করবে? মুক্তিযােদ্ধাদের হাত শক্ত না করলে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল থেকে এই পাক দুবৃত্তদের বিতাড়িত করা অসম্ভব। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েই তা করা সম্ভব। তা না করে সমস্যাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার অর্থ ভারতের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বাড়িয়ে ভােলা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিলম্বিত করা আর সাম্রাজ্যবাদীদের জাল বিস্তারের সুযােগ করে দেয়া।
পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া যে বাংলাদেশের অন্য কোনাে রাজনৈতিক সমাধানই হতে পারে না সে কথা তাে বাংলাদেশ সরকার ও তার যুক্ত উপদেষ্টা কমিটি স্পষ্টভাষায়ই ঘােষণা করেছেন। তা সত্ত্বেও পশ্চিমা দুনিয়ার বুর্জোয়া রাষ্ট্রনায়করা পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেই যে রাজনৈতিক সমস্যার কথা ভাবছেন তার মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকা কেন? কোনাে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলােচনায় বসতে হলে সে আলােচনা বৈঠক হবে স্বাধীন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে। সেখানে তৃতীয় পক্ষের কোনাে স্থান নেই।
সমস্ত সংশয় দ্বন্দ্ব থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ও ভ্রান্ত আশা পরিহার করে প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে বাংলাদেশের সরকারকে স্ব কৃতি দিন। শরণার্থীর বােঝা বহনের নামে এরই মধ্যে ৭০ কোটি টাকার করভার দেশের গরিবদের কাঁধে চাপানাে হয়েছে। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে যতই বিলম্ব হবে ততই কিস্তিতে কিস্তিতে দেশবাসীর উপর করভার চাপবে। জাতীয় অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থ ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সফলতা নির্ভর করছে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের উপর। নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।

সূত্র: কালান্তর
১৬.১১.১৯৭১