You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.01.07 | বাঙলাদেশের মুক্তি ও ভারতীয় মুসলমান সমাজ- পঞ্চানন সেন | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশের মুক্তি ও ভারতীয় মুসলমান সমাজ
পঞ্চানন সেন

‘৪৭ সালে ভারতবিভাগের পর থেকেই এদেশের মুসলমান সমাজ এক অদ্ভুত মানসিক দোটানায় পড়ে রয়েছেন। ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই বাস্তব সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একদিকে জন্মভূমির প্রতি আনুগত্য আর অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতি একটা ভাবগত আকর্ষণ—এই দুয়ের টানাপােড়েন চলছে তাদের মনে। বাঙলাদেশের আবির্ভাবের ফলে ব্যাপারটা আরাে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুসলিম জনসাধারণ ব্যাপার দেখে যেন অনেকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন। আর এই অবস্থার সুযােগ নিয়ে একদিকে হিন্দু আর অন্যদিকে মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলাে সমস্যাকে আরাে গুলিয়ে তােলবার চেষ্টা করেছে।
ভারতবিভাগের পর থেকে মুসলমানরা কেন পাকিস্তানের প্রতি ভাবগত বন্ধন অনুভব করেন তার কারণ বােঝবার সত্যিকারের কোনাে চেষ্টা এপর্যন্ত হয়নি। অথচ কারণটা এখন কিছু দুর্বোধ্য নয়। বহু মুসলিম পরিবার পার্টিশানের ফলে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। পরিবারের কেউ কেউ রয়েছেন পাকিস্তানে, আবার কেউ কেউ ভারতে। যেসব মুসলমান এদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই সেখানে গিয়ে নতুন জীবন গড়ে তুলেছেন, সরকারি কাজকর্ম ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি করছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে এবং পাকিস্তানের সরকারি মহলের সঙ্গে তাদের ভাগ্যও জড়িয়ে গেছে নানাভাবে। সুতরাং পাকিস্তান খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে বা ভেঙে পড়েছে এমন কোন অবস্থা এখানকার মুসলমানদের (যাদের আত্মীয়স্বজন পাকিস্তানে রয়েছেন) পক্ষে প্রাণ থেকে মেনে নেওয়া শক্ত। কারণ তাতে এঁদের পাকিস্তানবাসী আত্মীয়দের জীবনযাত্রায় বিপর্যয় দেখা দেবে এটাই এঁদের আশঙ্কা। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে যাদের স্বার্থ এইভাবে নানা পাকে জড়িয়ে পড়েছে তাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম গভীর মানবিক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করতে কেন এঁরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন তা এ থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। পাকিস্তানে এক সময় যেসব হিন্দু বাস করতেন ভারতের ব্যাপারে তাদেরও এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এর ফলে মুষ্টিমেয় পাঞ্জাবি মুসলমান মাতব্বরি করত লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনগণের উপর। এরা ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ দেখবে কি করে? পাকিস্তানেই এরা লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে দাবিয়ে রেখেছে, নিষ্পেষিত করেছে। ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এদের মায়াকান্না নিছক ধাপ্পা ছাড়া আর কী?
এটা মনে রাখা দরকার যে, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন বাঙলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের অন্যতম। পশ্চিম পাকিস্তান এখনকার মুসলমানদের দাবিয়ে রাখত কিন্তু আজ আর কেউ তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীকেও বিদায় নিতে হবে। বাঙলাদেশের লুণ্ঠনই ছিল এদের ক্ষমতার বনিয়াদ। এই লুণ্ঠন বন্ধ হলে এদের ক্ষমতার বনিয়াদটাও ধ্বসে পড়বে। বাঙলাদেশের মুক্তির প্রভাব পশ্চিম পাকিস্তানেও পড়তে বাধ্য। ইতিমধ্যেই সেখানকার মানুষ গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেছেন। ভুট্টো পর্যন্ত তাই ক্ষমতা বজায় রাখার জন্যে গণতন্ত্রের কথা শােনাতে বাধ্য হচ্ছে, বড় বড় পুঁজিপতিদের হুমকি দিতে বাধ্য হচ্ছে। সিন্ধি, বালুচ, পাখতুন প্রভৃতি জাতিগােষ্ঠীগুলাে জাতীয় সমান অধিকারের দাবিতে সােচ্চার হয়ে উঠেছে।
বাঙলাদেশের স্বাধীনতার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানেও শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আবির্ভাব হবে এবং বাঙলাদেশ, ভারত এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এটা সম্ভব হলে এই উপমহাদেশে আসবে শান্তি এবং স্থায়িত্ব। তার ফলে ভারতে অর্থনৈতিক উন্নতির হার দ্রুততর হবে, কর্মসংস্থানের সুযােগ বাড়বে, ভারতীয় মুসলমানরাও এখন যেসব আর্থিক অসুবিধা ভােগ করেন তা দূর হবে।
এই অবস্থা সৃষ্টি হলে হিন্দু এবং মুসলমান জনসাধারণ পাকিস্তান এবং ভারতের মুসলিম আর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ভারত পাকিস্তান বিরােধকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানি দেবার হাতিয়ারটাই তখন নষ্ট হয়ে যাবে। ভারতীয় মুসলমানরা তখন এদেশেই নিজেদের জন্মভূমিতে পূর্ণ নিরাপত্তা বােধ করতে পারবেন। অন্যত্র এজন্য তাঁদের তাকাতে হবে না।
পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী ভারত বিরােধীতা করেছে এতকাল নিজেদের দেশের মানুষকে পদানত রাখার জন্যে, তাদের ওপর অবাধে শাসন-শােষণ এবং নিপীড়ন চালিয়ে যাবার সুবিধা আদায়ের জন্যে। আর এর ফলে ভারতের মুসলমান সমাজকে নির্ভরশীল হতে হয়েছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দয়ার উপর।
স্বাধীন বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জয়লাভ এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তান দু দেশের সাম্প্রদায়িকতার ওপরই স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাঙলাদেশের জন্ম তাই প্রচণ্ডতম আঘাত। ভারতের মুসলমান সমাজ এই সত্য যত বেশি করে উপলব্ধি করবেন ততই সুনিশ্চিত হবে তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা।

সূত্র: সপ্তাহ, ৭ জানুয়ারি ১৯৭২