যা অনিবার্য ছিল
শঙ্কর দাশগুপ্ত
ঢাকায় সােভিয়েতের কন্সাল শ্রীপােপােড় যখন শেখ মজিবর রহমানের সঙ্গে অনির্ধারিত এক বৈঠকে মিলিত হবার জন্য টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে যান অনেক আগেই বাঙলাদেশের, শুধু বাংলাদেশ বলি কেন সমস্ত বিশ্বেও, মানুষই বােধ হয় জানত যে আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাঙলাদেশে সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে সােভিয়েত ইউনিয়ন।
পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলাের মধ্যে সর্বপ্রথম সােভিয়েত ইউনিয়নই গত ২৪ জানুয়ারি বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিল। ইতিপূর্বে যে সমস্ত দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে তার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক দেশের সংখ্যাই বেশি। সােভিয়েত ইউনিয়ন বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার পরে বাঙলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ বলেন, সােভিয়েত ইউনিয়নের এই স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত খুবই স্বাভাবিক। বাঙলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ অত্যন্ত আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল এই স্বীকৃতির জন্য। বাঙলাদেশ সরকারকে ও জনগণকে এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
বাঙলাদেশের সরকারের কাছে যা স্বাভাবিক বাঙলা ও ভারতের সর্বস্তরের জনগণের কাছেও তাই ছিল স্বাভাবিক ও অনিবার্য। কারণ বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই সােভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। উভয় দেশের জনগণ তাদের সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে, চেতনা দিয়ে একথা খাটি বুঝে নিয়েছিল যে, ভারত যে দৃঢ়তা নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং চীনের প্রত্যক্ষ বিরােধীতায় নেমে বাঙলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকে মদত দিয়েছে সেই দৃঢ়তার পটভূমি রচনা করেছে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী-চুক্তি। বাঙলা- সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে সােভিয়েত ইউনিয়ন তৃক বাঙলাদেশের স্বীকৃতি ছিল স্বাভাবিক ও অনিবার্য, কারণ বিশ্বের মুক্তি আন্দোলনে সােভিয়েতের ভূমিকাকে তারা বাস্তব ঘটনার আলােতে নির্ভুলভাবে দেখতে পেয়েছিল। কুতর্ক অথবা ভুয়ােতত্ত্বের আড়ালে তাদের দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারেনি। তাই ইতিহাস তাদেরই পক্ষে রায় দিয়েছে।
কিন্তু যারা ইতিহাসের ঘটনাকে বিকৃত করে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থের কাঁঠাল জনসাধারণের মাথায় ভেঙে খেতে চায় তাদের ধারণা, তাদের প্রচার ছিল ভিন্ন। সােভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে সি পি এম-এর ইতিহাসদ্রষ্টা শ্রীপ্রমােদ দাশগুপ্ত যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা প্রকাশিত হয়েছিল ২৪ এপ্রিল গণশক্তিতে। প্রমােদবাবু বলেছিলেন “আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলাে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিল সেই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আর হয়তাে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না। পাকিস্তানের বাজার তাহলে এই রাষ্ট্রগুলাের হাতছাড়া হয়ে যাবে।” গণশক্তি(২৪/৪/৬১)।
আমেরিকা, চীন ও গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে এক পংক্তিতে ফেলে সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতির যে “পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রমােদবাবু সেদিন করেছিলেন দেখা গেল কয়েক মাস যেতে না যেতেই তা দয়ে মজে গেল। প্রমােদবাবুর অনুগামীরা কী করবেন জানি না কিন্তু তাদের উচিত এখন এইসব নেতাদের প্রশ্ন। করা, পাকিস্তানে তথাকথিত দেশের মুক্তিযুদ্ধকে শেষ পর্যায়ে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করার জন্য নিকসন যে মানােয়ারি বহর পাঠিয়েছিল বাঙলাদেশের দরিয়ায়, সেই দস্যু-জাহাজ পিঠটান দিতে বাধ্য হয়েছিল
ভিয়েত ইউনিয়নের জন্যই। বৃহৎ শক্তি হিসেবে সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের এক সংকটজনক মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যান্য বৃহৎ শক্তিকে জানিয়ে দিয়েছিল যে পাক-ভারত উপমহাদেশের ঘটনায় কোন বাইরের শক্তি যদি হস্তক্ষেপ করতে চায়, তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়ন তা সহ্য করবে না। সােভিয়েতের এই সময়ােচিত হুমকি যেদিন সে অন্যান্য আগ্রাসী শক্তিকে পাক-ভারত যুদ্ধ ও বাঙলাদেশের ব্যাপারে নাক গলাতে দেয়নি তা বুঝতে কারাে দেরি হয়নি। এক কথায়, বাঙলাদেশের সদ্যমুক্ত মানুষ এবং ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ করে কী কারণে তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়ন বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিল? পণ্ডিত নেতার পাণ্ডিত্য যে ইতিহাসের ধাপে টিকল না এর জবাব তাঁরা নেতাদের কাছ থেকে চাইবেন কি? | সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বাঙলাদেশের স্বীকৃতি একদিকে যেমন জনসাধারণের আশাকে পূর্ণ করল তেমনি অন্যদিকে প্রমাণ করল সি পি এমের রাজনীতি কতদূর দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
বলা বাহুল্য সােভিয়েত ইউনিয়ন বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় সি পি এম বেজার হয়েছে। আর বেজার হয়েছে আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলাে। সােভিয়েতের এই স্বীকৃতির সংবাদ তারা নমাে নমাে করে পরিবেশন করার পর কেউ বড় করে লিখেছে ব্রিটেনের স্বীকৃতিও আসছে, কেউ লিখেছে অস্ট্রিয়ার স্বীকৃতি আসছে। কারণ এদের সকলেরই হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।
সূত্র: সপ্তাহ, ০৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২