You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.31 | নিকসনের নতুন বজ্জাতি | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

নিকসনের নতুন বজ্জাতি

বাঙলাদেশের ব্যাপারে মাতব্বরে মাতব্বরি করতে গিয়ে থেতা মুখ ভোঁতা হবার পর প্রেসিডেন্ট নিকসন এবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বাহাদুরির পরিচয় দেবার চেষ্টা করছেন উত্তর ভিয়েতনামে প্রবল বিক্রমে আবার বােমা বর্ষণ শুরু করে। বড়দিন উপলক্ষে ভিয়েতনামে যে যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হয়েছিল সে সময় মার্কিন তরফে কোনাে হতাহতই হয়নি। সায়গানের সামরিক মহল থেকেই স্বীকার করা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের বড়দিনের যুদ্ধবিরতির সময়টা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দিন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির সময় পার হতে না হতেই মার্কিন যুদ্ধবাজরা ঝাঁকে ঝাঁকে বিমান আক্রমণ শুরু করে দেয় উত্তর ভিয়েতনামের উপর।
স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে গিয়ে গালে চড় খেয়ে মার্কিন যুদ্ধবাজরা এখন ভিয়েতনামের যুদ্ধ আবার চাঙ্গা করে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মার্কিন ডলারের দামের মতােই আন্তর্জাতিক জগতে আজ মার্কিন মর্যাদাও ক্রমহ্রাসমান। নিকসন এবং তাঁর সাকরেদদের ভিয়েতনামের হত্যালীলা আরাে জোরদার করে তুললে বুঝি মার্কিন মর্যাদাটা বাড়বে। তাই তারা উত্তর ভিয়েতনামে ব্যাপকভাবে বােমাবর্ষণই শুধু করেনি, নতুন ধরনের মারাত্মক বােমাও ব্যবহার করেছে। পেন্টাগণের যুদ্ধবাজরা স্বীকার করেছে যে, এবার তারা ৬৮০০ কিলােগ্রাম ওজনের বােমা ব্যবহার করেছে। দুজন মার্কিন বৈজ্ঞানিক বলেছেন, ধ্বংস ক্ষমতার দিক থেকে এগুলাে পারমাণবিক বােমার প্রায় কাছাকাছি। নিজেদের এই জঘন্য অপরাধের সাফাই গাইতে গিয়ে পেন্টাগণের কর্তারা বলেছে, ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। অনেকদিন ধরেই এই ধরনের বােমা ভিয়েতনামে ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিন বিমানবাহিনী ভিয়েতনামে এমন একটা বােমা ব্যবহার করছে যা ৩২৭০ ফুট ব্যাসার্ধ জুড়ে গােটা এলাকার সমস্ত কিছুকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
মার্কিন সরকারি মহলের এই সব স্বীকৃতি থেকেই প্রমাণ হচ্ছে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বর্তমানে মানব সভ্যতায় নিকৃষ্টতম শত্রু। মুখে নিকসনের দলবল প্রচার করছিলেন যে, তারা অদূর ভবিষ্যতে ভিয়েতনাম থেমে মার্কিন ফৌজ ধাপে ধাপে সরিয়ে নেবেন। কিন্তু এটা যে নিছক ধাপ্পা তা ভিয়েতনামে যুদ্ধবিস্তৃতির এই নতুন মার্কিন প্রচেষ্টা থেকেই স্পষ্ট। প্যারিসে যখন ভিয়েতনামে শান্তিপ্রতিষ্ঠার আলােচনা চলছিল তখন এই বীভৎস আক্রমণ চালিয়ে নিকসন প্যারিস বৈঠক বানচাল করে দিয়েছেন। এটাও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, নিকসনের পিকিং সফরের তােড়জোড় পাকা করার জন্যে যে দিন নিকসনের প্রেস সেক্রেটারি দলবল নিয়ে পিকিং-এর উদ্দেশে যাত্রা করেছেন তার তিন দিন আগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা উত্তর ভিয়েতনামের ওপর বর্বরতম বিমান আক্রমণ চালিয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। উত্তর ভিয়েতনামের ওপর এই নতুন হামলা চীনের তরফে বিশেষ কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটবে না—এই ধরনের আশ্বাস না পেলে নিকসন কি এই নতুন জুয়াখেলায় নামতেন?
ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হামলার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম গ্রহণের পথে চীন নানাভাবে বাধা দিয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম গ্রহণে রাজি হয়নি। তা যদি হতাে তবে ভিয়েতনামের যুদ্ধ হয়ত অনেক দিন আগেই হয়তাে শেষ হত। একদিকে অন্ধ সােভিয়েত বিরােধীতা আর অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভাব জমাবার যে নীতি চীন গ্রহণ করেছে তার ফলে পেন্টাগণের সাহস কতখানি বেড়ে গেছে ভিয়েতনামে মার্কিন বিমানের নৃশংস আক্রমণ তারই নবতম দৃষ্টান্ত। কিন্তু চীনের সঙ্গে হাত মেলালেও এশিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার সাধ্য আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেই। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খতম করার মার্কিন চক্রান্ত শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ভিয়েতনামের মানুষ অসীম সাহসের সঙ্গে লড়াই করে মার্কিন দস্যুদের কোণঠাসা করেছেন, কম্বােডিয়া এবং লাওসেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর তাবেদার ফৌজদের অবস্থা হয়ে উঠেছে শােচনীয়। নিকসনের হাজার বজ্জাতিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

সূত্র: সপ্তাহ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১