You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.31 | বাঙলাদেশে বিদেশি সাংবাদিকদের অপকর্ম | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশে বিদেশি সাংবাদিকদের অপকর্ম
[ঢাকা থেকে সপ্তাহ-র প্রতিনিধি]

ভারত সরকারের পাশপাের্ট নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা ঢাকায় গিয়ে বাঙলাদেশ ও ভারত-বিরােধী চক্রান্ত চালাচ্ছে। ভারত সরকার জামাই আদরে এই সাংবাদিকদের বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে ও ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। এই সাংবাদিকরা ভারত ও বাঙলাদেশ বিরােধী সংবাদ পাঠিয়ে চলেছেন। যুদ্ধ চলাকালে ও পরে ভারতীয় সাংবাদিকরা বাঙলাদেশে প্রবেশে সরকারের বিন্দুমাত্র সহযােগিতা পাননি, বরং নানাভাবে তাদের হয়রান হতে হয়েছে। একখানা কার্ডের জন্মে ভারতীয় সাংবাদিকদের দিনের পর দিন কর্নেল রিখির অফিস আর পি আই বির মি. রায়ের অফিসে ছােটাছুটি করতে হয়েছে। তারপরও অনেকে কার্ড পাননি। কিন্তু বিদেশি সাংবাদিকদের বেলায় দেখা গেল তার শুধু কার্ড পাওয়া নয়, অবলীলাক্রমে বাঙলাদেশে চলে যাচ্ছেন। বিদেশিরা চলে যাচ্ছেন সরকারি সাহায্যে। ঢাকা বিমান বন্দরে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভারতীয় সাংবাদিকরা বিমানে কলকাতা যাতায়াত দূরে থাক, বিমানে করে সামন্য সংবাদ কলকাতা পাঠাতে কত হয়রান হচ্ছেন। কিন্তু বিদেশিরা সুন্দরভাবে দমদম-আগরতলা থেকে ঢাকায় এসে নামছেন, আবার ঢাকার সংবাদ দিয়ে ছবি নিয়ে কলকাতা চলে যাচ্ছেন।
যেদিন পাকিস্তানি জেনারেল ফরমান আলি আত্মসমর্পণ করেন, জেনারেল আরােরার সঙ্গী হবার সুযােগ মাত্র দুজন ভারতীয় সাংবাদিকের হয়েছিল। অন্য সবাই ছিলেন বিদেশি। ভারত সরকারের পি আই বি কিছু সাংবাদিককে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে মাথাপিছু দাবি করা হয়েছিল ২৮০০ টাকা। কলকাতা থেকে আগরতলায় বিমান ভাড়া ৯৪ টাকা আর ঢাকা ১২৭ টাকা, কিন্তু কলকাতার সাংবাদিকদের কাছে দাবি। করা হলাে ২৮০০ টাকা ! এই ২৮০০ টাকাও সময়মত জমা দিতে বলা হয়নি। ১৮ ডিসেম্বর সকালে বিমান যাবে আগরতলা কিন্তু ১৭ই রাত ৯টার সময় কোনাে কোনাে কাগজকে জানানাে হলাে, আপনি এক্ষুনি। ২৮০০ টাকা দিলে একজন সাংবাদিক আগরতলা হয়ে ঢাকা যেতে পারবে। কোনাে কাগজের পক্ষেই রাত ৯টায় বললে সকাল ৬টায় ২৮০০ টাকা দিয়ে সাংবাদিক পাঠানাে সম্ভব নয়। তাই বলে বিমান খালি গেল তাও নয়। সেইসব জায়গায় বিদেশি সাংবাদিকরা চলে গেল। রাত নটায় খবর দিয়ে ভাের ছটায় ২৮০০ টাকা জমা দিতে বলার একটিমাত্র কারণ হলাে এই যে, ভারতীয় সাংবাদিকরা না গেলে তার জায়গায় বিদেশিরা যাবে। গেছেও তাই। শুধু যাওয়া নয়, সর্বত্র গিয়ে উৎপাতের একশেষ করেছে এরা। কারা মুক্তিফৌজ, কারা ভারতীয় সেনা, কাদের হাতে কী অস্ত্র, সব নিয়ে প্রশ্ন ও কৌতূহল। এরপর ঢাকা যখন গেল তখন দেখা গেল এরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তার হিসাব নেবার কেউ নেই। কে কী খবর পাঠাচ্ছে দেখবার কেউ নেই। শুধু তাই নয়, নিজ নিজ দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করা, তাদের গােপন বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া, এমনকি দূতাবাসের বেতার মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদান করা—সবই করেছে এরা। ঢাকায় বা বা অন্যত্র যখন স্বাভাবিক অবস্থা, এরা তখন ঢাকা সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ দেশে পাঠিয়ে বলেছে, ঢাকায় খুন চলছে, অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এখনও এই সাংবাদিকরা ঢাকায় থেকে দিবা-রাত্র নানা মহলের সাথে সংযােগ স্থাপন করছে ও নানা ধরনের ছবি তুলছে।
ঢাকায় অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসগুলাের কেউই এখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে বাঙলাদেশে সরকারের কাছেও এই দূতাবাসগুলাে কোন কূটনৈতিক মর্যাদা লাভের অধিকারী নয়। কিন্তু এরা নিজেদের স্বদেশ আগত সাংবাদিকদের মাধ্যমে অনেক কাজই করিয়ে নিচ্ছে। ঢাকায় পেট্রলের খুবই অভাব। পেট্রল পাম্পের মালিকরা কোনাে বিদেশিকে পেট্রল দেয় না। সাফ বলে দেয় ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ ছাড়া আমাদের পেট্রল অন্য কারাে জন্য নয়। বিদেশি সাংবাদিকরা এই দূতাবাসের গাড়িগুলাে নিয়ে বেরিয়ে তেল ভরে আনে। খবর পাঠাবার বেলায় এরা সব সময় খোঁজ করে কোথায় একটু বিরােধের চিহ্ন আছে ; একটা খুন কোথাও হলে এরা শকুনের মতাে এসে পড়ে ও ছবি তােলে। কিন্তু এই সবই সম্ভব হয়েছে ভারত সরকারের বিদেশি সাংবাদিক তােষণের কারণে।

সূত্র: সপ্তাহ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১