সঙ্কটের ক’দিন আগরতলায়
(আসাম-ত্রিপুরা সীমান্ত সফরান্তে প্রত্যাগত বিশেষ প্রতিনিধি)
পয়েলা ডিসেম্বর যখন কলকাতা থেকে রওনা হলাম তখন ভাবতেই পারিনি একেবারে তােপের মুখী গিয়ে পড়তে হবে। এক মাস আগে যখন গৌহাটি থেকে আগরতলার বিমানে চড়েছিলাম তখন যাত্রী ছিল সাকুল্যে জনা বারাে। এবারে প্লেনে জায়গা খালি নেই। গতবার যাত্রীদের মনে ছিল আতঙ্ক কী জানি কী হয়। এবারে সকলেই বেশ স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছে। এমনকি মহিলা যাত্রীদের মধ্যেও কোনাে আতঙ্ক দেখলাম না। ফ্রেন্ডশিপ’ বিমান আমাদের যখন আগরতলা বিমান বন্দরে নামিয়ে দিল এবং আগরতলার যাত্রীদের নিয়ে গৌহাটি অভিমুখে পাড়ি দিল তখনও জানি না আগরতলা বিমান বন্দরে যাত্রীবাহী বিমানের সেই শেষ অবতরণ। তখনও জানি না, আখাউড়ার লড়াইয়ের আমি হব প্রত্যক্ষদর্শী, তখনও জানি না ধর্মনগরের পথে শিলচর, শিলং, গৌহাটি হয়ে আমাকে কলকাতা পাড়ি জমাতে হবে।
বিমান বন্দর থেকে আগরতলা শহর অভিমুখে যেতে যেতে দেখলাম, লােকজন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে, দোকানপাট খােলা। গতবার দেখেছিলাম সন্ধ্যা হতে না হতেই দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট জনশূন্য। এবারে দেখলাম সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট গম গম করছে। একটি স্থানীয় কাগজে আগরতলা সীমান্তে পাকিস্তানি সৈন্য সমাবেশের খবর দিয়েছিল। তাই নিয়ে সর্বত্র আলােচনা চলছিল কিন্তু কেউই তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি বলেই মনে হলাে। এমনকি চায়ের দোকানে তাই নিয়ে হাসিঠাট্টাও শুনলাম।
কিন্তু রাত্রি আটটা বাজতে না বাজতেই অবস্থা গেল পালটে। হঠাৎ একটা শেলের আওয়াজ। দোকানপাট সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। ভীত চকিত লােকজনের কিছু ছুটোছুটি। রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র সান্ত্রী মােতায়েন হয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে কামান চৌমােহানি জনশূন্য, একটা পরিত্যক্ত এলাকার রূপ পরিগ্রহ। করল।
কিন্তু এটা ছিল মাত্র উপক্রমণিকা। আমরা তখনও ভাবছি এটা বােধহয় নিত্য-নৈমিত্তিক গােলাবর্ষণের অঙ্গ এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে। কিন্তু রাত্রি যতই রাড়ছে গােলাবর্ষণের তীব্রতাও ততই রাড়ছে। আগরতলার অধিকাংশ ঘর-বাড়িই খুব হালকা গাথুনির। পাত্তলা দেয়াল, ছাদ তিন ইঞ্চির বেশি পুরু নয়। এক-একটা গােলার আওয়াজ হচ্ছে আর হােটেলের দরজা-জানালা ঝনঝন করে কাঁপছে। এক-একটা আওয়াজ এত বিকট আর এত কাছে যে মনে হচ্ছে হােটেলের উপরই বুঝি এসে পড়ল। বিনিদ্র রজনী বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটল। সকালবেলা শুনলাম সরকারি প্রচার ভ্যান থেকে বলছে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত কারফিউ। পরে তা বাড়িয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত করা হলাে। আমরা আটক। রাস্তা-ঘাট জনশূন্য। দোকান-পাট, হাট-বাজার সব বন্ধ। সশস্ত্র শান্ত্রীরা টহল দিচ্ছে। আমাদের চা খাবার পর্যন্ত ব্যবস্তা নেই। হােটেলের রেস্তোরা রাস্তার অপর পারে। ওদিকে গােলাবর্ষণের বিরাম নেই। আর রাস্তা দিয়ে অবিরাম যাচ্ছে সামরিক গাড়ি। ওরই মধ্যে কিছু কিছু লােক মালপত্র নিয়ে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে, সীমান্ত থেকে দূরবর্তী স্থানে। আমরা হােটেলের বারান্দা থেকে দেখছি।
হঠাৎ আকাশে বিমানের শব্দ কৌতূহলী লােক রাস্তায় দু পাশে ভিড় করল। আমরাও হােটেলের বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আখাউড়ার দিকে তিনটি পাকিস্তানি স্যাবার জেট ছোঁ মেরে মেরে আক্রমণ চালাচ্ছে। আমাদের বিমানধ্বংসী কামানগুলাে গর্জে উঠল। মনে হলাে একটি বিমান আহত হয়েছে। বিমান আক্রমণের সংকেতধ্বনি যখন বাজল ততক্ষণে পাক বিমানগুলাে পালিয়ে গেছে। অল ক্লিয়ার’ বাজল আরও মিনিট পনেরাে পরে।
সেদিন সারা দিনে বিমান আক্রমণের সংকেত শােনা গেল সাকুল্যে তিনবার। প্রতিবারই হানাদার বিমান পালিয়ে যাবার পর। প্রতিবারই রাস্তায়, বাড়ির ছাদে কৌতূহলী জনতার ভিড়। ভাগ্যে আমাদের বিমানধ্বংসী বিমানধ্বংসী কামানাের বেড়া অতিক্রম করে শহরের কেন্দ্রস্থলে আসতে পারেনি বিমানগুলাে, নইলে কত অসামরিক লােক যে হতাহত হতাে তার ঠিক নেই।
সন্ধায় টেলিফোনে স্থানীয় এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। তার কাছ থেকে জানলাম আমাদের সৈন্যরা এগােচ্ছে। তারা প্রায় আখাউড়া পৌঁছে গেছে। আখউড়ার পতন আসন্ন। এদিকে বিমান বাহিনীর ঈস্টার্ন কম্যান্ড হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আগরতলার উপর নৈশ বিমান আক্রমণ হতে পারে। সকালের বিমান আক্রমণ হতে পারে। সকালের বিমান হানায় মারা গেছে ৫ জন, আহত হয়েছে অনেকে, সরকারি হিসেবে ৪৫ জন।
কাউকে বলতে হলাে না, সারা শহর আপনা থেকেই নিষ্প্রদীপ। তবু বােধহয় সাবধানের মার নেই মনে করে রাত্রি ৮টা থেকে বিজলী সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হলাে।
মুক্ত কসবা থেকে প্রথম ছবি
হে হােটেলে খাওয়া দাওয়া সারতে হলাে মােমবাতি জ্বেলে। এদিকে সন্ধ্যার পর থেকেই আবার শুরু হয়েছে। অবিশ্রাম গােলাবর্ষণ। আর একটি বিনিদ্র রাত কাটল।
পরদিন সকাল থেকে গােলার আওয়াজ স্তিমিত হয়ে এলাে। দুপুরবেলা একেবারে শান্ত। কারফিউর বাঁধন শিথিল হলাে—একটা থেকে বিকেল চারটে। দু-দিন আটক থাকার পর রাস্তায় লােকচলাচল শুরু হলাে। কিন্তু এক আধটা ছাড়া দোকানপাট প্রায় বন্ধই থাকল। দেখলাম দলে দলে লােক সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভেতরের দিকে চলেছে। এদিকে এয়ারলাইনস অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আগরতলার সমস্ত ফ্লাইট বাতিল। সুতরাং শহর ছাড়ার উপায় নেই।
বিকেলে আবার হােটেলে বন্দি। কাগজ আসেনি। রেডিও একমাত্র বর্হিজগতের সঙ্গে যােগসূত্র। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে গ্রাউন্ডে ইন্দিরাজীর বক্তৃতার রিলে’ শুনলাম। তারপর সন্ধায় পাকিস্তান রেডিওর খবর-পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় এলাকর উপর পাক বিমান গােলা বর্ষণ করেছে। আকাশবাণীতে একই খবর। শেষ রাতে ইন্দিরাজীর বেতার ভাষণ: ভারতে জরুরি অবস্থা ঘােষত।
রাতে এক আধটা গােলাবর্ষণের আওয়াজ শােনা গেল। তবে অনেক দূরে।
৪ ডিসেম্বর প্রথম কারফিউ মুক্ত দিন। শহর ঘুরে দেখার সূযােগ পাওয়া গেল। কোনাে কোনাে অঞ্চলে গােলাবর্ষণের বেশ কিছু ক্ষতি হয়েছে। বেশ কিছু হতাহতও হয়েছে। তবে শহরে তেমন কিছু আতঙ্ক নেই। সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে বেশ কিছু লােক সরে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই।
৪ তারিখের খবর : মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের সহায়তায় আখাউড়া দখল করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে গেছে। আকাশবাণীতে অবশ্য কোনাে খবর নেই। পাকিস্তান রেডিও দাবি করছে আখাউড়ার উপর আক্রমণ নাকি তারা প্রতিহত করেছে।
খবর নিয়ে জানলাম, আখাউড়ার কোনাে কোনাে বাঙ্কারে তখনও পাকিস্তানি সৈন্য দু-চারজন আছে। ‘মপিং আপ’ চলছে। তাই আখাউড়ার পতন তখনও ঘােষণা করা হয়নি। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, আর একদিন থেকে যান, আখাউড়া ঘুরে যাবেন। কাল-পরশু আখাউড়া নিয়ে যাব বলেছে। কিন্তু আমার আর থাকার উপায় ছিল না। পরদিন ধর্মনগরের পথে আসামের দিকে রওনা হরাম।
কলকাতা থেকে যখন বেরােই তখন অনেকই সাবধান করেছিলেন, এবারে আটকে পড়তে পারেন। জবাবে বলেছিলাম, প্লেন না চলুক ধর্মনগরের রাস্তা তাে ভােলাই থাকবে। শেষ পর্যন্ত সেই ধর্মনগরের রাস্তTয়ই রওনা হতে হলাে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১