You dont have javascript enabled! Please enable it! ১৯৪১ সালের আজাদ পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৪১ সালের আজাদ পত্রিকা

রাজনৈতিক

ভারত-সচিবের ঘােষণা ভারত-সচিব মিঃ এমেরী বর্তমান যুদ্ধে ভারতের অংশ এবং ভারতীয় সমস্যা সম্পর্কে বেতার মারফতে একটি বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন। তিনি ভারতবর্ষ সম্পর্কে বৃটিশের নীতি আলােচনা করিতে যাইয়া বলিয়াছেন, “ডােমিনিয়নগুলি যে স্বাধীনতা ভােগ করিতেছে, ভারবর্ষকেও সেইরূপ অধিকার প্রদান করাই হইতেছে আমাদের নীতি।” এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৩৫ সনের ভারতীয় আইনেরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। কয়েকটি প্রদেশে এই ভারতীয় আইনানুসারে রচিত শাসন ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করিয়া মিঃ এমেরী বলেন, “কংগ্রেসীরা গণতন্ত্রের নামে ভারতের জটিল রাজনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান দল ও প্রতিষ্ঠানগুলির দাবী উপেক্ষা করার চেষ্টা করিতেছে।” মিঃ এমেরী এই প্রসঙ্গে ভারতের অন্যতম বিরাট জাতি ৯ কোটি মুছলমানের ও দেশীয় রাজ্যগুলির নাম করিয়াছেন। তিনি আরও ঘােষণা করিয়াছেন যে, যুদ্ধশেষে সকলের সম্মতিক্রমে নূতন শাসন ব্যবস্থা রচনার আয়ােজন তাহারা করিবেন। কিন্তু এ-কথাও তিনি এই প্রসঙ্গে জানাইয়া দিয়াছেন যে, ভাবী শাসন-ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত্তিতেই রচিত হইবে।

মিঃ এমেরীর এই বিবৃতি হইতে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, তিনি ভারতের রাজনৈতিক অচলাবস্থা, বিশেষভাবে কংগ্রেসী মতিগতি সম্পর্কে অনেকটা ওয়াকিফহাল। কিন্তু যুদ্ধকালে ভারতবর্ষের জন্য যে অস্থায়ী শাসন-ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব হইয়াছিল, তখন মুছলমানের দাবী তাহারা মানিয়া লইতে চান নাই কেন? লীগ যুদ্ধের সময়েই ভারতের জন্য নূতন শাসনতন্ত্র রচনার উদ্ভট কংগ্রেসী আব্দার ধরিয়া বসে নাই, লীগ কেবল স্বতন্ত্র জাতীয় ভিত্তিতে মুছলমানের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যতে সম-সংখ্যক প্রতিনিধিত্বের দাবীই করিয়াছিল । কিন্তু ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের এ প্রস্তাব মনপূত হয় নাই। তাঁহারা তখন কংগ্রেসী হুমকীর প্রতি লক্ষ্য করিয়াই লীগের দাবীর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছিলেন।

মিঃ এমেরী কংগ্রেসের কুকীত্তির কথাও উল্লেখ করিয়াছেন। কংগ্রেস কয়েকটি প্রদেশে শাসনতন্ত্র অচল করিয়া রাখিয়াছে, গণতন্ত্রের নামে ভারতের অন্যান্য জাতিগুলির দাবী-দাওয়াকে টুটি টিপিয়া মারিতে চায়- এসব কথা মিঃ এমেরীরই উক্তি।

কিন্তু কংগ্রেসের এই ফ্যাসিষ্ট-মনােবৃত্তিকে এতদিন ধরিয়া নিজেদের স্নেহচ্ছায়ায় তাহারাই লালন করিয়াছেন। ইহার জন্য সকল সুযােগের অনাসৃষ্টির দায়িত্ব সম্পূর্ণ ব্রিটিশের।

১৯৩৫ সনের ভারতীয় শাসন আইন তাঁহাদেরই রচনা। এই আইনের বলেই কংগ্রেসীরা কতিপয় প্রদেশে সংখ্যাগুরুত্বের দোহাই দিয়া শাসন-কাৰ্য্য বন্ধ করিয়া রাখিতে সক্ষম হইয়াছে। কংগ্রেস গণতন্ত্রের নামে ভারতের প্রধান প্রধান দল ও প্রতিষ্ঠানগুলির দাবী উড়াইয়া দিতে চায় বলিয়া মিঃ এমেরী যে অভিযোেগ করিয়াছেন, তাহার জন্য আসলে দায়ী কে? এই বৃটিশ গণতন্ত্র ভারতের বুকে প্রবর্তনের জন্য প্রধান উদ্যোগী ত বৃটিশ সরকার নিজেই। ভারতবর্ষ আয়তনে ও বৈচিত্র্যে একটি মহাদেশের তুল্য এবং এখানে একাধিক পরস্পর-বিরােধী স্বার্থ, ধর্ম, সভ্যতা ও তমদুন-বিশিষ্ট জাতির বাস। এখানে এই বিদেশী গণতন্ত্রের অর্থ-সােজা হিন্দুরাজ। কারণ হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু।
মিঃ এমেরী আশ্বাস দিয়াছেন যে, ভাবী শাসনতন্ত্র রচনার সকলেরই মতামত গ্রহণ করা হইবে কিন্তু বলগা ঢিল করিয়া ধরিলেও তিনি একদম রাশ ছাড়িয়া দেন নাই।—- ভারতের নয় কোটি মুছলমান কোনরূপ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সম্মত হইবে না। তাহারা পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জাতীয় আবাস রচনার দাবীর স্বীকৃতি ভিন্ন অন্য কোন ব্যবস্থাই মানিয়া না লইতে বদ্ধপরিকর। সুতরাং মিঃ এমেরীর এ-প্রস্তাবে ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূর হওয়ার তেমন কোন আশা আছে বলিয়া মনে হয় না।

২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, ১০ ফান ১৩৪৭, সম্পাদকীয় ১, পৃষ্ঠা-৪

গুরুতর পরিস্থিতি

কলিকাতা মােছলেম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী মিঃ এস, এম, ওছমানের আদমশুমারী সম্পর্কিত যে-বিবৃতি গতকল্যকার “আজাদে” প্রকাশিত হইয়াছে, তার প্রতি আমরা বাঙ্গলা সরকারের ও মােছলেম বাঙ্গলার তীক্ষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। বিবৃতিতে যে গুরুতর পরিস্থিতির আভাস দেওয়া হইয়াছে, সে-সম্পর্কে বাঙ্গলার মুছলমান যদি এখনাে সম্যক সচেতন না হন এবং বাঙ্গলা সরকার এর যথােচিত প্রতিকার-চেষ্টায় সচেষ্ট না হন, তবে মােছলেম বাঙ্গলার ভাগ্যাকাশ চিরতরে অন্ধকার হইয়া যাইবে। বর্তমান আদমশুমারীতে অনাচার কোথায় গিয়া পেীছিয়াছে এবং মুছলমানদের প্রতি অকিচার কিরূপ মারাত্মক হইয়া উঠিয়াছে, মিঃ ওছমানের বিবৃতিতে তার আভাস পাওয়া যায়। মিঃ ওছমান হিসাব খইয়া এবং হিন্দুদের গুপ্ত অভিসন্দি বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। মুছলমানদের সংখ্যা কমাইবার ও হিন্দুসংখ্যা বাড়াইবার প্রচেষ্টা বর্তমান আদমশুমারীতে কতটা ফলবতী হইতে চলিয়াছে আমরা মিঃ ওছমানের বিবৃতির এই অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিলামঃ

“অতীত আদমশুমারীতে বাংলাদেশে মুছলমানের সংখ্যা তেমন খারাপ হয় নাই। কিন্তু এ-বৎসর মুছলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা নষ্ট করিয়া সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ ও পাকিস্ত নি-পরিকল্পনা একসঙ্গে নষ্ট করার জন্য হিন্দুসভার কুচক্রী নেতাগণ বহু পূৰ্ব্ব হইতেই ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করিয়াছেন। কুচক্রীগণ পূর্ব হইতে কলকাঠি চালাইয়া বেঙ্গল সেন্সস অফিসে একজন মুছলমানকেও ঢুকিতে দেয় নাই। কলিকাতা সোস অফিসের তার দুইজন স্পেশাল অফিসারের উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁহারা অফিসে একজন মুছলমান কেরাণীকেও স্থান দেন নাই। ফলে এই হইয়াছে যে, মুছলমান মহল্লার শতকরা ২০ খানা বাড়ীতেও নম্বর পড়ে নাই। শতকরা ৩৫ খানা বাড়ীতে কোন লােক গমন করে নাই। প্রাথমিক গণনায় বাড়ীতে নম্বর দেওয়া ও প্রতি পরিবারের লােকসংখ্যা লওয়াই ছিল প্রধান কাৰ্য্য। ১৯শে ফেব্রুয়ারী লােক গণনা আরম্ভ হইলে হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মুছলমানের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য ব্যাপকভাবে কাৰ্য্য আরম্ভ হয় এবং শতকরা যে ৫ জন মুছলমান গণনাকারী, সুপারভাইজার ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হইয়াছেন, তাঁহাদিগকে কাগজপত্র প্রদান করিতে অঙ্গীকার করা হয়।”

মিঃ ওছমানের বিবৃতির উপরােক্ত কথাগুলি সত্য হইলে বাঙ্গলার মুছলমানের কি ভয়াবহ অদৃষ্ট-বিবত্তন হইতে চলিয়াছে, তাহা কাহাকেও বুঝাইয়া বলার দরকার করে না।
বাঙ্গলা সরকার এমন অনাচারের অভিযোেগকে উপেক্ষা করিতে পারেন না। এই ভুল আদমশুমারীর জন্য যদি বাঙ্গলার মুছলমান সংখ্যালঘু হইয়া পড়ে, কিংবা বাঙ্গলার হিন্দু-সংখ্যা অসঙ্গতরূপে বাড়িয়া যায়, তবে বাংলার মুছলমান কিছুতেই সে অবস্থা মানিয়া লইতে পারে না। বাংলার মুছলমান সংখ্যা ক্রমে বাড়িয়া আসিয়াছে গত ১৮৯১ সালের আদমশুমারী হইতে। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে কোনাে অসঙ্গতিও কিছু দেখা যায় নাই। এমতাবস্থায় এবারকার আদমশুমারীতে যদি মুছলমান-সংখ্যা কমিয়া যায় এবং হিন্দু-সংখ্যা বাড়িয়া যায়, তবে তাহাই হইবে অস্বাভাবিক ও অসম্ভব। বাংলার মুছলমান কিছুতেই এই ধরনের অস্বাভাবিক ও অসম্ভব অবস্থা মানিয়া লইতে রাজী হইতে পারে না, হইবে না।

তেমন সঙ্কট অবস্থার যাহাতে উদ্ভব না হয় তজ্জন্য সেন্সস কর্তৃপক্ষ ও বাঙ্গলা সরকার যথাসময়ে যথাকর্তব্যে অবহিত হইলেই সুখের বিষয় হইবে। এই সম্পর্কে মিঃ ওছমান যে প্রস্তাব করিয়াছেন, আমাদের মতে, তাহা সঙ্গত ও অনুসরণীয়। সে-প্রস্তাব হইতেছে এইঃ

“(১) আদমশুমারীর হিসাব পরীক্ষা ও সংশােধনের কাজ ৩০শে মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হউক; (২) কলিকাতা, ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, আসানসােল ও খড়গপুর ও অন্যান্য মিল এলাকার ও বিভিন্ন জেলার হিসাব পরীক্ষা ও সংশােধনের জন্য নূতন গণনাকারী ও সুপারভাইজার নিযুক্ত করা হউক এবং একমাত্র গেজেটেড অফিসারগণকে এই কার্যের ভার অর্পণ করা হউক; (৩) একজন হিন্দু ও একজন মুছলমান যুক্তভাবে সংশােধিত হিসাব স্বাক্ষর করিবেন।”

বস্তুত যদি সময় বৃদ্ধি করা না হয় এবং শতকরা ৫০ জন হিন্দু ও ৫০ জন মুছলমান গেজেটেড অফিসারকে প্রত্যেক কেন্দ্রের প্রদত্ত হিসাব পরীক্ষা করিতে ও প্রয়ােজন হইলে পুনরায় গণনার ক্ষমতা না দেওয়া হয়, তাহা হইলে বাঙ্গলা দেশের আদমশুমারীর কাৰ্য্য আদৌ সঠিক ও বিশ্বাসযােগ্য হইতে পারে না। এই ধারণা বাঙ্গলার মুছলমানের মতে দৃঢ়মূল হইয়াছে। এমত অবস্থায় মিঃ ওছমানের প্রস্তাব কার্যকরী করিতে চেষ্টিত হইলে অনাচারের কিছুটা সংশােধনও হয়ত সম্ভব হইতে পারে। কাজেই এই সঙ্গত প্রস্ত েিব উপেক্ষাশীল হওয়া সেস-কর্তৃপক্ষের কখনাে উচিত হইবে বলিয়া আমরা মনে করি না। আমরা আশা করি, বাঙ্গলা সরকারও উদ্যোগী হইয়া সোস কর্তৃপক্ষকে এই প্রস্তাব কার্যকরী করিতে পরামর্শ দিবেন।

১ মার্চ ১৯৪১, ১৭ ফান ১৯৪৭, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

বিমান আক্রমণ ও আত্মরক্ষার উপায়

বিগত কয়েকমাস যাবত কলিকাতা ও তন্নিকটস্থ কয়েকটী স্থানে মাঝে মাঝে নিপ্রদীপের মহড়া বা আলােক-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হইয়া আসিতেছে। সম্প্রতি এক সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে এখনও পর্যন্ত বলা হইয়াছে যে, কলিকাতার উপর হাজার হাজার আগুনে বােমা পড়িতে পারে। পাছে কেহ এই সতর্কবাণীতেও বিশেষ গুরুত্ব আরােপ না করেন, সেজন্য বিজ্ঞপ্তির শেষাংশে সাবধান করিয়া দিয়া বলা হইয়াছে যে, ইহা সরকারী বিজ্ঞপ্তি, কেহ যেন ইহা অবহেলা না করেন। বলা বাহুল্য, ইহার পর আর কলিকাতার উপর বিমান আক্রমণের সম্ভাবনাকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না।।

উল্লিখিত বিজ্ঞপ্তি হইতে জনসাধারণ এইটুকু অবশ্যই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, এতদিন যেরূপ নিশ্চিন্ত মনে ইউরােপীয় যুদ্ধের গল্প শুনিয়া বা কাহিনী পড়িয়া দিন কাটান গিয়াছে, ভবিষ্যতে তাহা আর সম্ভব না-ও হইতে পারে। কি সত্য সত্যই যদি কলিকাতার উপর কোনদিন বিমান-আক্রমণ শুরু হয়, তবে কলিকাতাবাসীরা কিভাবে আত্মরক্ষা করিবেন, সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে তাহা মাটেই সুস্পষ্ট হয় নাই। শুধু তাই নয়, আগুনে বােমা সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তিখানি যেরূপ হাস্যকর ভঙ্গীতে রচিত হইয়াছিল, তাহা পাঠ করিলে নিতান্ত সাধারণ লােকের মনেও এই ধারণাই আসিবে- যেন প্রচার-বিভাগ এই দুঃসময়েও জনসাধারণের সহিত রসিকতা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। যাহা হােক, সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিঃ এ কে ফজলুল হক সরকারী নীতি বিশ্লেষণ করিয়া বেতারযােগে যে বক্তৃতা দিয়াছেন, তাহাতে কলিকাতার উপর বিমান-আক্রমণ ও তার ফলে যে অনিষ্টপাতের সম্ভাবনা, সে সম্বন্ধে গবর্ণমেন্ট কতদূর কি করিতে পারিবেন, না পারিবেন, সে সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া গিয়াছে। যদিও সকল দিক দিয়া সরকারী ব্যবস্থা ‘উত্তম’ বলিয়া বিবেচিত হইবে না, তথাপি প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা হইতে নিঃসন্দেহে বুঝা গিয়াছে যে, বর্তমান অবস্থায় বাংলা সরকারের যাহা সাধ্যায়, তাহারা তাহা করিয়াছেন এবং ভবিষ্যতেও করিবেন। এ অবস্থায় ইংলন্ড প্রভৃতি স্থানের দৃষ্টান্ত এ স্থলে টানিয়া না আনিয়া যদি দেশবাসী এখন হইতেই সাধ্যানুসারে গবর্ণমেন্টের সহিত সহযােগিতা করেন, তবে আমাদের বিশ্বাস, তাঁহারা বিমান-আক্রমণ জনিত অনিষ্ট হইতে অনেকটা রেহাই পাইতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী তাহার বক্তৃতায় কোন কথাই রাখিয়া ঢাকিয়া বলেন নাই। তিনি পরিষ্কারভাবেই বলিয়া দিয়াছেন যে, প্রচণ্ড বিস্ফোরক বােমার সরাসরি আঘাত হইতে আত্মরক্ষার কোন উপায় এদেশে নাই। ইংলন্ডের দৃষ্টান্ত দিয়া তিনি দেখাইয়াছেন যে, সেখানে কোটী কোটী পাউন্ড খরচ করিয়া আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হইলেও, জার্মান বােমারু বিমানপােতের আক্রমণ হইতে ঘর-বাড়ী রক্ষা করা সকল ক্ষেত্রে সম্ভব হয় নাই। ইংলন্ডেই যাহা সম্ভব হয় নাই, এদেশে আর তাহা আশা করা যায় কিরূপে? তবে যদি বােমা কিছুদূরে পড়ে, তবে যাহাতে গুরুতর অনিষ্ট হয়, সে জন্য অবশ্যই কতকগুলি ব্যবস্থা অবলম্বন করা যাইতে পারে। বাংলা গবর্ণমেন্ট বর্তমানে সেই দিকেই বিশেষভাবে অবহিত হইয়াছেন।

এই উদ্দেশ্যে বাংলা গবর্ণমেন্ট খােলা জায়গায় কতকগুলি নালা কাটাইবার পরিকল্পনা করিয়াছেন। এই নালাগুলি প্রাকৃতিক কারণে খুব গভীর করা যাইবে না, কেননা, বেশী গভীর করিতে গেলেই নালাগুলি জলে ভরিয়া যাইবে। তবে যাহাতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের আত্মরক্ষার ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য এই সকল নালার দুইধারে ১৪ ইঞ্চি উঁচু করিয়া দেওয়াল তৈরী করিয়া দেওয়া হইবে। বােমা যদি একেবারে উপরে পড়ে, তবে এইরূপ ব্যবস্থাই আত্মরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট হইবে বলিয়া বিশেষজ্ঞগণের ধারণা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এইরূপই বলিয়াছেন। আমরা নিজেরা বিশেষজ্ঞ নহি। সুতরাং এই শ্রেণীর নালা কতখানি কাজে আসিবে না আসিবে, বলিতে পারি না। তবে শুনিয়াছি, জার্মান বােমারু-গুলি একটন ওজনের যে বােমাগুলি ফেলে, তাহার আঘাতে নাকি এক এক জায়গায় ৪০ ফিটেরও বেশী গভীর গর্ত হইয়া যায়, আর একশত ফিটের মধ্যে কোন জিনিষের চিহ্ন মাত্র থাকে না। বলা বাহুল্য, এ শ্রেণীর বােমা যদি এখানে আসিয়া পড়ে, তবে নালাই হােক আর ১৫ ইঞ্চি দেওয়ালই হােক, কোনটাতেই কুলাইবে না। তবে ভরসা এই যে, নিকটে শত্রুপক্ষের কোন ঘটী নাই। জাৰ্মাণীর পক্ষে কলিকাতায় বােমা ফেলান অসম্ভব। একমাত্র সম্ভাবনা আছে জাপানে- তাও আবার তাহাকে আসিতে হইবে সুদূর হাইনান দ্বীপ হইতে। এ-অবস্থায় একটন, এমনকি ৫০০ পাউণ্ড ওজনের বিস্ফোরক বােমা আনাও বােধ হয় শত্রুপক্ষের সম্ভব হইবে না। তাই নালা ও দেওয়াল কিছুটা কাজে আসিতে পারে, ইহা অসম্ভব নয়।

পার্কে পার্কে নালা কাটার কথা প্রচারিত হইবামাত্রই কোন কোন সংবাদপত্রে এরূপ মন্তব্য করা হয়, যেন সকলকেই ঐসব নালায় আশ্রয় লইতে হইবে। এ সম্পর্কে তাঁর বেতার বক্তৃতায় মাননীয় হকছাহেব দেখাইয়াছেন যে, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। যাহারা কোন গৃহে আশ্রয় লইয়াছেন, তাহারা বিমান-আক্রমণের সময় সেখানেই থাকিবেন শুধু যাহারা পথিমধ্যে আটকাইয়া গিয়াছেন এবং অন্যস্থানে আশ্রয় লইতে অসমর্থ, তাহাদের জন্যই এই সব নালার ব্যবস্থা হইয়াছে।

বিমান আক্রমণের সময় বাড়ীর লােকজনদের কর্তব্য সম্বন্ধেও মাননীয় মিঃ হক কয়েকটী উপদেশ দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, বিমান আক্রমণ ধ্বনি হওয়া মাত্রই তাহাদের উচিত যাহারা আশ্রয়প্রার্থী তাহাদের আশ্রয় দেওয়া। তাহা ছাড়া, দরজা ও কাঁচের ছাড়া অন্যান্য জানালা ভালরূপে বদ্ধ করিয়া দিতে হইবে। এই কৰ্তব্যগুলি নিঃসন্দেহেই অত্যন্ত সহজ। যদি বিমান-আক্রমণ কালেও কলিকাতা জনশূন্য না হয়, তবে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, কোন গৃহস্থই উপরােক্ত উপদেশ লন করিবে না।

পরিশেষে মিঃ হক বলিয়াছেন যে, অতঃপর বিমান আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার উপায় সম্বন্ধে ক্রমাগত সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হইতে থাকিবে। বিজ্ঞপ্তিগুলি যদি সুলিখিত হয়, তবে নিঃসন্দেহেই এই ব্যবস্থায় ক্ষমতায় জনসাধারণ এবিষয়ে অনেকখানি জ্ঞানলাভ করিতে পারিবে। তবে ইতিপূর্বে এ সম্বন্ধে দেশবাসীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ হইয়াছে, তাহাতে বাধ্য হইয়াই আমাদিগকে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর সমীপে এই প্রার্থনা জানাইতে হইতেছে যে, সরকারী বিজ্ঞপ্তির লেখকগণ যেন আর আগের মত হাস্যরসের অবতারণা করিয়া সমস্ত ব্যাপারটা লঘু করিয়া না ফেলেন।

৫ এপ্রিল ১৯৪১, ২২ চৈত্র ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

মিঃ জিন্না ও বর্তমান পরিস্থিতি

বর্তমান সময়ের ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে নিপুণ বিশ্লেষণ মিঃ জিন্না তার মাদ্রাজ-অভিভাষণে করিয়াছেন, এমনটি আর কেহ করিতে পারিতেন এবং বর্তমান সময়ে তাহা করার যােগ্যতা আর কোনাে দ্বিতীয় ব্যক্তির আছে, এ-বিশ্বাস আমাদের নাই। বস্তুতঃ এইদিক দিয়াও মিঃ জিন্নার অভিভাষণ একটী ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করিবে, সন্দেহ নাই। বর্তমান ভারতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে একদিকে বড়লাট ও ভারতসচিব, অন্যদিকে কংগ্রেস, হিন্দু-মহাসভা ও উদারনৈতিক সঙ্ যে ভাবগতিক অবলম্বন করিয়াছেন এবং এ-সবের মােকাবেলায় যাহা নিখিল ভারত মােছলেম লীগের অবলম্বিত নীতি ও মনােভাব- তার বিশ্বস্ত বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক বিচার-আলােচনায় মিঃ জিন্না যে পৰ্যবেক্ষণ শক্তি, যে অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়াছেন, ভারতীয় রাজনীতিতে তাহা সত্যই দুর্লভ- অতুলনীয়।

মিঃ জিন্না দেখাইয়াছেন, ভারতীয় সমস্যার সমাধানকল্পে মােছলেম লীগের পন্থানির্দেশের অনেকখানিই বড়লাট ও ভারত-সচিব মানিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছেন। প্রধানতঃ মােছলেম লীগের বিরােধিতার যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়াই যুদ্ধারম্ভের অব্যবহিত পরে বৃটীশ গবর্ণমেন্ট ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইনে পরিকল্পিত নিখিল-ভারত যুক্তরাষ্ট্র-পরিকল্পনা মুলতবী রাখার কথা ঘােষণা করেন। কিন্তু মােছলেম লীগ এই ঘােষণাকেও পৰ্যাপ্ত মনে না করিয়া যুক্তরাষ্ট্র-পরিকল্পনাকে একেবারে পরিত্যাগ করার দাবী জানাইতে থাকায় বৃটীশ গবর্ণমেন্ট অবশেষে ঘােষণা করিতে বাধ্য হন ঃ “যে-নীতি ও পদ্ধতির উপর ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইন গঠিত, তৎসহ ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত সমস্ত সমস্যাই নূতন করিয়া বিবেচনা করা হইবে।” এই ঘােষণার ফলে যুক্তরাষ্ট্র-পরিকল্পনার মূলেই আঘাত করা হইয়াছে। ফলতঃ যুক্তরাষ্ট্র যে এ-দেশে চলিতে পারে না, মােছলেম-লীগের এই দাবী কাৰ্যতঃ এই ঘােষণার স্বীকৃতি পাইয়াছে।।

মােছলেম লীগ ইহাতেই সন্তুষ্ট হয় নাই- পাছে বৃটীশ গবর্ণমেন্ট মােছলেম ভারতের কোনােরূপ মতামত গ্রহণ না করিয়াই একটা নূতন শাসনতন্ত্র তাদের ঘাড়ে চাপাইয়া দেন, এইজন্য লীগের তরফ হইতে দাবী করা হয় যে, ভারতের মুছলমানদের অনুমােদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে স্থায়ী বা অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক কোনাে পরিবর্তন হইতে পারিবে না। একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে মুছলমানদের এই দাবীর মধ্যে অসঙ্গতির কিছু নাই। ফলতঃ এই দাবীর সঙ্গতি বৃটিশ সরকারও স্বীকার করিতে বাধ্য হন। গত বৎসর ৮ই আগষ্টের বড়লাটের ঘােষণায় এবং ১৪ই আগষ্টের ভারত-সচিবের বিবৃতিতে এই দাবী স্বীকৃত হয়।

এই পর্যন্ত বৃটিশ গবর্ণমেন্ট কর্তৃক মােছলেম লীগের দাবী স্বীকৃতিলাভ করে বটে, কিন্তু এর পর হইতেই বড়লাটের ভাবগতিক অনুরূপ ধারণ করে। বস্তুতঃ এর পর মােছলেম লীগের দাবী সম্পর্কে বড়লাট যে মনােভাব অবলম্বন করেন, তার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা কঠিন। মুছলমানদের অনুমােদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে ভারতের দাবী শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হইতে পারিবে না, এ-দাবী মানিয়া লওয়ার অর্থই হইল মুছলমানদের পৃথক জাতিত্ব স্বীকার। মুছলমানদের এই পৃথক জাতিত্ব স্বীকারের পর বড়লাটের সম্প্রসারিত কাৰ্য্যকরী পরিষদ ও যুদ্ধ-পরামর্শ-কমিটী-সম্পর্কিত লীগের পরবর্তী দাবী না মানার কোনাে মানে হয় না। লীগের দাবী মাত্র এইটুকুই ছিল যে, মােছলেম প্রতিনিধিত্বকে সম-অংশীদাররূপে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক গবর্ণমেন্টসমূহে এবং যুদ্ধ পরামর্শ কমিটীতে সংযুক্ত রাখিতে সম্মত হইতে হইবে। মুছলমানের পৃথক জাতিত্ব স্বীকৃতির সাথে এই দাবী একান্তভাবেই সুসমঞ্জস্য।

কিন্তু বড়লাট লীগের এই দাবী অস্বীকার করেন এবং তারই ফলে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট অবস্থার উদ্ভব হইয়াছে। বড়লাটের এই অযৌক্তিক অস্বীকৃতির মূলে আছে তার অহেতুক কংগ্রেসভীতি। মিঃ জিন্না দেখাইয়াছেন ও বক্তৃতার স্বাধীনতা লাভের অজুহাতের উপর গান্ধীজী যে সত্যাগ্রহ সগ্রাম খাড়া করিয়াছেন, তাহা আসলে হইতেছে বৃটিশ গবর্ণমেন্টের বর্তমান যুদ্ধের অসুবিধাজনক অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করিয়া এই জবরদস্তীমূলক নীতি ও হুমকী দ্বারা গবর্ণমেন্টকে কংগ্রেস-দাবী স্বীকার করিতে বাধ্য করার চেষ্টা মাত্র। কংগ্রেসের এই সম্পর্কিত সমস্ত কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করিয়া মিঃ জিন্না তার উপরােক্ত অভিমত প্রতিপন্ন করিয়াছেন।
বৃটিশ গবর্ণমেন্টের উদ্দেশে এই সম্পর্কে মিঃ জিন্না যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন তাহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিঃ জিন্না বলিয়াছেনঃ “এই বক্তৃতামঞ্চ হইতে আমি পুনরায় দৃঢ়তার সহিত জানাইতে চাই যে, তাহাদের অনুসৃত নীতির ফলে ইউরােপে যে দুর্দিন দেখা দিয়াছে, ভারতে তাহাদের এই নিষ্ক্রিয়তা দুর্বলতা ও অস্থির চিত্ততার নীতি তদপেক্ষাও দুর্দৈবপূর্ণরূপে প্রতিভাত হইয়া উঠিবে। ঘটনাবলীর যে দ্রুত পরিবর্তন হইয়া চলিয়াছে, পৃথিবীর মানচিত্র যে বদলাইতেছে, তাহা কি এই মানুষগুলি দেখিতে পায় না এবং ইউরােপের ঘটনাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কাৰ্য্য করিতে পারে না? বৃটিশ গবর্ণমেন্ট কি করিতেছেন? – তােষামুদি ও অস্থির চিত্তের ন্যায় কার্যক্রম অনুসরণ।”

মিঃ জিন্নার উপরােক্ত কথাগুলি কড়া হইলেও অত্যন্ত সত্য, তাহা অস্বীকার করার উপায় নাই। কংগ্রেসের ধাপ্পাবাজীতে ভুলিয়া বড়লাট যে ভাবে একবার হিন্দু-সভার দিকে, আরেকবার উদারনৈতিক সজের প্রতি ঝুঁকিয়া পড়িতেছেন, একবার মিঃ সাভারকারকে এবং অন্যবার তেজবাহাদুর সাপ্লুকে দর্শন দান করিতেছেন, তাহাতে মিঃ

জিন্নার অভিযােগ অস্বীকার করা যায় কি করিয়া? ইহা অপেক্ষা বৃটিশ সরকারের দুর্বল ও অস্থিরচিত্ত নীতির পরিচয় আর কী হইতে পারে? কারণ, কংগ্রেস ও মােছলেম লীগই যে যথাক্রমে ভারতের হিন্দু ও মুছলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, এ-কথা বিস্মৃত হইয়া উহাদের শাখা-প্রশাখার পিছনে দৌড়াদৌড়ি করার স্থিরবুদ্ধির পরিচয় কোথায়?

১৬ এপ্রিল ১৯৪১, ৩ বৈশাখ ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

রাষ্ট্রভাষার সমস্যা

কলিকাতায় পূর্ব-ভারত রাষ্ট্রভাষা সম্মেলনের অধিবেশনে সভাপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ও অপরাপর কংগ্রেসীরা যেসব কথা বলিয়াছেন, তাহাতে আমাদের শুধু মিঃ জিন্নার সেই কথাটি মনে পড়িতেছে, “কংগ্রেসী নেতাদের হাতীর ন্যায় দুই প্রস্ত দাঁত রহিয়াছে, এক প্রস্ত দেখাইবার জন্য ও অপর প্রস্ত খাইবার জন্য। ভারতের রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে কংগ্রেসী নীতির এই দুইটি রূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে।

ভাষার প্রশ্ন লইয়া হিন্দু-মুছলমান বিরােধের অন্ত নাই। ভারতের নয় কোটি মুছলমান চিরকাল চাহিয়াছে, উর্দু ভাষা যেন তাহার প্রতিষ্ঠিত আসন হইতে স্থানচ্যুত না হয়। কেবল মুছলমান নয়, ভারতের বহু হিন্দু বিশ্বাস করে যে, যদি সর্বভারতীয় ভাষা বলিয়া আদৌ কোন ভাষা ভারতবর্ষে থাকে, তবে তাহা উর্দু। কিন্তু রামরাজ্যের স্বপ্নে বিভাের একশ্রেণীর হিন্দু কংগ্রেসের সহায়তায় উর্দুকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা হইতে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। মিঃ গান্ধীকে পৰ্য্যন্ত এই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্ট দেখা যায়। একদিন তিনি প্রথম বলিয়াছিলেন, ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হইবে, হিন্দী অথবা হিন্দুস্তানী’, তারপর যখন নানা দিক হইতে চাপ আসিল, তখন হইতে প্রকাশ্যে তিনি ‘হিন্দী’ বলার মােহ পরিত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু মনের কথা গােপন করিয়া একটী কৃত্রিম ভাষার নাম বলার অভ্যাস সহজে আয়ত্তে আসে না। মিঃ গান্ধীর বৈবাহিক মিঃ রাজ্য গােপল আচারিয়া প্রধানমন্ত্রিত্বের গদীতে রায় দিয়া মাদ্রাজে হিন্দীকে কথাকথিত রাষ্ট্রভাষারূপে কায়েম করিতে যাইয়া নূতন ফ্যাসাদ বাধাইয়া তুলিয়াছিলেন। অবশেষে কিভাবে ইহাকে মওলানা আবুল কালাম আজাদের কারসাজিতে চুনকাম করিয়া লওয়া হইয়াছিল, তাহা আজও হয়ত অনেকের মনে আছে।

কংগ্রেসীদের স্বরূপ আবার এই সম্মেলনে অনাবৃত হইয়া পড়িয়াছে। কংগ্রেসের অন্যতম প্রকাণ্ড স্তম্ভ ডাঃ রাজেন্দ্র এই সম্মেলনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন, “উত্তর-ভারতে হিন্দী প্রধান ভাষা এবং ভারতের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীরাই হিন্দী অল্প-বিস্তর বুঝিয়া থাকে। সুতরাং একমাত্র হিন্দী ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হইতে পারে বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। তবে যে-ভাষা রাষ্ট্রভাষা হইবে, তাহা উর্দু প্রভৃতি অপর কোন ভারতীয় ভাষা বা বিদেশী ভাষা হইতে কোন শব্দ গ্রহণ করিবে না- ইহা অসম্ভব।”
সুতরাং একথা পরিষ্কার হইয়া গেল, হিন্দুস্তানী’ ভারতের রাষ্ট্রভাষা’ বলিয়া কংগ্রেসওয়ালারা যে-কথা প্রচার করেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ যে হিন্দুস্ত নী’র ভাষ্যের পর ভাষ্য রচনা করেন, ডাঃ প্রসাদ তাহা বিশ্বাস করেন না। ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের এই ঘােষণাকে এক হিসাবে আমরা সানন্দে অভিনন্দিত করিতেছি। এ ঘােষণায় কংগ্রেসীদের হিন্দুস্তানী’র খােলস অনেকখানি খসিয়া গেল। আশা করি, আগামী কংগ্রেস অধিবেশনে এই মর্মে কংগ্রেসের তরফ হইতে, একটি সরকারী ঘােষণাও প্রচারিত হইবে। তাহা হইলে, যে সমস্ত লােক আজও কংগ্রেসকে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলিয়া বিশ্বাস করে, তাহাদের একটা বড় ভ্রান্তি দূর হইবে। ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ অন্যতম কংগ্রেসী মােড়ল হইয়া আজ যে কাজের সূত্রপাত করিলেন, তাহা একটিতে নিঃশেষিত হইয়া যাইবে না, আশা করি। এইভাবে আরও অনেক কাজে কংগ্রেসীরা দ্রুত হস্তক্ষেপ করিবেন। আজ ‘হিন্দুস্তানী’ গেল, ‘হিন্দী’ আসিল, কাল নয়া করিয়া যদি কংগ্রেসওয়ালারা কংগ্রেসকে জাতীয় কংগ্রেস’ না বলিয়া হিন্দু কংগ্রেস বলিতে আরম্ভ করেন, তবে দেশের যথেষ্ট কল্যাণ হইবে। সংখ্যালঘু অহিন্দু দেশবাসীর মধ্যে এখনও যাহারা কংগেসের দুয়ারে মান-মৰ্য্যাদা ও স্ব স্ব জাতীয় স্বার্থ খােয়াইয়া বসিয়া আছে, তাহাদের ইহাতে চৈতােন্যোদয় হইবে। ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে মিথ্যা, প্রতারণা ও ধাপ্পাবাজির একটী দীর্ঘ অধ্যায় পরিসমাপ্তি হইবে।

তবে ভারতের জাতীয় ভাষা’, রাষ্ট্র ভাষা প্রভৃতি ব্যাপারে পাকিস্তান-ওয়ালাদের মনে আজ কোন সন্দেহ ও গোঁজামিলের অবকাশ নাই। তাহারা বিশ্বাস করে, “অখণ্ড ভারতের ভিত্তিতে এদেশে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইবে না, এক জাতি, এক রাষ্ট্রও এখানে গঠিত হইবে না। সুতরাং ‘অখণ্ড ভারতের ‘অখণ্ড রাষ্ট্রভাষা রচনার কল্পনা হাওয়াই-কেল্লা ছাড়া কিছুই নয়। তাহারা আরও বিশ্বাস করে, পশ্চিম পাকিস্ত েিন উর্দু, হিন্দুস্তানে হিন্দী এবং পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে বাংলা। ভারতের এই তিনটি প্রধান ভাষার আবাস সুনির্ধারণের ইহাই বিজ্ঞানসম্মত প্রস্তাব। ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ও তাঁহার দলভুক্তদের খোল অনুসারে রাতারাতি এক-ভারত, এক-রাষ্ট্র ও এক-ভাষা গড়িয়া উঠিবে, এ উদ্ভট পরিকল্পনাকে আমরা পাগলামি বলিয়াই মনে করি।
২৬ জুন ১৯৪১, ১২ আষাঢ় ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

বাংলার লীগ।

বাংলার সাথে মােছলেম লীগের আজন্ম সম্পর্ক রচিত হইয়াছে। ১৯০৬ সনে ঢাকায়ই লীগের গােড়াপত্তন হয়। তারপর সুখে দুঃখে সুদিনে দুর্দিনে এতদিন লীগের পতাকা বাংলা বহন করিয়া আসিয়াছে। অতীতের লীগ-ইতিহাস আমরা এখানে আলােচনা করিব না। লাখনৌ অধিবেশনের পর হইতে লীগের জীবনে যে যৌবন জল-তরঙ্গ উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার আলােকে বাংলার লীগ-আন্দোলনের কৃতিত্ব খতাইয়া দেখার প্রয়ােজন আছে। আজ আমরা এ সম্পর্কেই কয়েকটি কথা বলি।
একদিন ছিল, এ-ব্যাপারে মুছলমান সংখ্যাগুরু বাংলার প্রশ্ন স্বতন্ত্রভাবে বিচার করিয়া দেখার বর্তমান গুরুত্ব দেখা দেয় নাই। এক হিসাবে অতীতে একদিন সংখ্যালঘু মুছলমান প্রদেশেই লীগের শক্তি আশ্রয় ও সংহতির প্রয়ােজন অধিকতর অনুভূত হইয়াছিল। সংখ্যাগুরু বাংলার মুছলমান নিরাপত্তার মনােভাব লইয়া যে কিছুটা নিশ্চিত ছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু লীগের আদর্শের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লীগের দায়িত্ব বহুগুণ বর্ধিত হইয়া পড়িয়াছে। লাহাের লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব জাতির সম্মুখে নূতন স্বপ্নের ছবি তুলিয়া ধরিয়াছে। মাদ্রাজ লীগে পাকিস্তান মূলনীতি বলিয়া ঘােষণা করা হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান বাংলা ও আসামকে লইয়া গঠিত হইবে। শুধু লাহাের প্রস্তাবের জন্য নয়, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় উত্তরাধিকার। পূর্ব পাকিস্তানে যে সংখ্যক মুছলমান বাস করে, জগতের কোথাও একসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক মুছলমানের বাস নাই। বাংলার লীগকে এই জাতীয় আবাস রচনার উপযুক্ত কার্যক্রম আজ গ্রহণ করিতে হইবে। যুগযুগান্তরের পরাজয় ও বিপর্যয়ের ঝড়ে বাংলার মুছলমানের জীবন আজ বিড়ম্বিত। এ-বিড়ম্বনা হইতে মুক্তি দানের দায়িত্ব আজ লীগকে গ্রহণ করিতে হইবে।
পাকিস্তানের প্রয়ােজন বাংলার জন্য আজ যত বেশী, অন্য কোন অঞ্চলের প্রয়ােজন ততখানি আছে কিনা, সন্দেহ। আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ভিন্ন বাঙ্গালী মুছলমানের ভবিষ্যত বলিতে কিছুই নাই। এতদ্ব্যতীত হিন্দু-রাজ্যের প্রবল সংঘ-শক্তির বিরােধিতা বাংলার সর্বাপেক্ষা অধিক। আমাদের ভুলিলে চলিবে না, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মােকাবেলায় আজ লীগকে দাঁড়াইতে হইবে।

কিন্তু বাংলার লীগ কি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে কোটি কোটী মুছলমানের মনে ভরসার সৃষ্টি করিতে পারিয়াছে? যে আয়ােজন, যে কর্মশক্তি আজ বাংলার নিকট দেশ আশা করে, তাহা আজও বাংলার লীগের ভিতর দেখিতে পাই নাই। পাকিস্তান আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। কেবল পশ্চিম পাকিস্তান নয়, সংখ্যালঘু প্রদেশের মুছলমানের ভিতর পাকিস্তান যে কর্মোদ্যম আনিয়া দিয়াছে, তাহার মত বাংলার লীগ দেখাইতে পারে নাই। এ-ব্যাপারে কাজের চাইতে লীগ বােধ হয়, অকাজ বেশী করিয়াছে। ভূতের পা যে পশ্চাত দিকে, বাংলার লীগের পাকিস্তান-কাৰ্য্যক্রমের দিকে তাকাইলেই তাহা বুঝা যায়। পাকিস্তান ডেপুটেশন বাংলা ভ্রমণের যে কাৰ্য্য তালিকা প্রস্তুত করিয়াছিল, লীগের কর্মকর্তাদের দোষেই তাহা বাস্তবে পরিণত হয় নাই। পাকিস্তান দিবস পালনের পথে বাংলার কর্তৃপক্ষ যে বিভ্রাট বাধাইয়াছিলেন, তাহার স্মৃতি আজও জনসাধারণ ভুলিতে পারে নাই। পরে পাকিস্তান দিবস পালন করা হইবে বলিয়া যে আশ্বাস দেওয়া হইয়াছিল, তাহাও মুলতবীর শিকার আজও ঝুলিতেছে। বাংলায় পাকিস্তানের ভিত্তিতে লীগের গঠনমূলক কাৰ্য। এ সম্পর্কে যত না বলা যায়, ততই ভাল।

বড়লাটের সাম্প্রতিক শাসনমূলক ব্যবস্থা লইয়া সমগ্র মােছলেম ভারত বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে। বােম্বাই, বিহার, সীমান্ত প্রভৃতি প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটি হয় বিশেষ সভা আহ্বান করিয়া, কিম্বা কর্মকর্তাদের এ-ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিমত জ্ঞাপন করিয়াছেন। কিন্তু সাধারণভাবে স্থানীয় ওয়ার্কিং কমিটীর দারুণ জড়ত্বই আমাদিগকে অধিক মাত্রায় পীড়া দেয়।

এ-সব হইল নিখিল ভারত বনাম বঙ্গীয় প্রাদেশিক লীগ সম্পর্কিত কার্যক্রমের পরিণাম, কাৰ্যকলাপ আরও শােচনীয়। বাংলায় লীগ-সম্মেলন যেন এক পরম নিষিদ্ধ বস্তু, লীগের বার্ষিক সভা হয়ত হয়, হয়ত হয় না কিন্তু সাধারণ নির্বাচন এড়াইয়া চলার প্রচেষ্টাও সহ্যের শেষ সীমায় আসিয়া পৌছিয়াছে। সেন্সস ঢাকার দাঙ্গা, প্রাকৃতিক বিপৰ্যয় চোখের উপর দেখিতেছি কিন্তু বাংলার লীগের আছহাব কাহহাকী নিশ্চেষ্টতা যে টলিয়াও টলিতে চায় না।

প্রাদেশিক লীগের কর্মকর্তাদের অনেক কাজ। সরকারী-বেসরকারী বহু ঝামেলা আজ তাহাদিগকে পােহাইতে হয়, তাহাও আমরা জানি। কিন্তু লীগ তাহাদের বুদ্ধি, প্রতিভা, পরিশ্রম ও সহায়তা একান্তভাবে লীগের কাজেই নিয়ােজিত থাকিতে দেখিতে চায়। এই দুকুল রক্ষার উভয় সংকট হইতে লীগকে আত্মরক্ষা করিতে হইবে। আন্ত র্জাতিক পরিস্থিতি, বড়লাটের নব-ব্যবস্থার ঘােষণা, হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের চক্রান্ত জাল ও গৃহযুদ্ধের বিভীষিকার ছায়া আজ চারিদিক হইতে নামিয়া আসিতেছে। এই ঘনায়মান বিপদ ও নৈরাশ্যের নিরন্তর মেঘ ছিন্ন করার জন্য ঘুমন্ত সাহস ও শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করিতে হইবে। বাংলার লীগের নিকট হইতে সত্যই আজ ইহা আমরা আশা করিতে পারি কি?

৭ আগস্ট ১৯৪১, ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

জাতীয়তাবাদের গােড়ার কথা।

কয়েকদিন ধরিয়া কলিকাতার সংবাদপত্রগুলিতে স্যার সুরেন্দ্রনাথের কথা লইয়া জোর আলােচনা চলিতেছে। সভায় বক্তৃতা হইয়া গিয়াছে, বহু খ্যাতনামা বক্তা এই পরলােকগত দেশপ্রাণ মনীষীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিয়াছেন। বস্তুত এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে স্যার সুরেন্দ্রনাথ যে একজন দিকপাল হিসাবে যুগ যুগ ধরিয়া কীৰ্ত্তিত হইবেন, তাহা অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং এত বড় একটি ব্যক্তিত্বের বিচিত্র কীর্তিগাথা যত আলােচিত হয়, ততই লাভ।

কিন্তু স্যার সুরেন্দ্রনাথের কথা আলােচনা করিতে যাইয়া যে একটী কথা কি সভায়, কি সংবাদপত্রে বার বার উচ্চারিত হইতেছে, তাহার প্রতি আমরা আজ পাঠকগণের বিশেষ মনােযােগ আকর্ষণ করিতে চাই। সবার মুখেই সেই একটী পুরানাে কথা আজ ধ্বনিত হইতেছে “স্যর সুরেন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক।” এ-কথাটা বিশেষভাবে আজ যাহাদের মুখে অধিক ঘন ঘন শুনা যাইতেছে, তাহারা বেশীর ভাগই কংগ্রেসী। কিন্তু যেসব কংগ্রেসী প্রচারক সফেন মুখে সে কথাটার এত পুনরাবৃত্তি করিতেছেন, তাঁহারা কি ইহার তাৎপৰ্য্য যথােচিত মনোেযােগের সাথে বিচার করিয়া দেখিয়াছেন? যদি তাহারা সত্যই এ-কথাটীর তাৎপৰ্য ভালভাবে তলাইয়া দেখিতেন, তবে তাঁহারা স্যর সুরেন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক এ কথা আবৃত্তি করার সময় এতটা উৎসাহ বােধ হয়ত করিতে পারিতেন না। কারণ, এ-কথাটাই এক হিসাবে কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদের মূলে কঠোর আঘাত করিতেছে। কংগ্রেসে উচ্চ গলায় বলিয়া বেড়ায়- ভারতবর্ষ স্মরণাতীত কাল হইতে এক জাতির এক দেশ মাত্র। সম্প্রদায়, দল, বর্ণ বিভাগ থাকা সত্ত্বেও জাতীয়তার যােগসূত্র এদেশের অধিবাসীদিগকে সুন্দর অতীত হইতে এক ও অভিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। তবে মজার ব্যাপার এই, স্যর সুরেন্দ্রনাথকে জাতীয়তাবাদের জনকের সম্মান দান করিয়া কিভাবে আবার সুদূর অতীতের গর্ভে তাহারা এই জাতীয়তাবাদের উৎসমূল নির্দেশ করেন, তাহা বুঝিয়া উঠা কঠিন। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে স্যর সুরেন্দ্রনাথ যে জাতীয়তাবাদের প্রথম আমন্ত্রণ করিলেন, তাহাকে উজান বহাইয়া কংগ্রেসীরা কি করিয়া আদিকালের সীমান্তে লইয়া উপস্থিত হইতে চান, তাহা কংগ্রেসী বুদ্ধি ছাড়া সাধারণ মানুষের সত্যই ধারণাতীত।

আসল কথা এই যে, এখানেই কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদের প্রাচীনত্বের মেকি রূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদ বৃটীশ সাম্রাজ্যের আওতায়ই জন্ম গ্রহণ করিয়াছে। স্যর সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন আদর্শবাদী মানুষ। ইংরাজী সাহিত্যের প্রেরণা হইতেই তিনি এদেশে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করিতে চাহিয়াছিলেন। ভারতবর্ষ এক দেশ, ভারতবাসী এক জাতি। এই কল্পনা তাহার মনে পাশ্চাত্য ভাবধারার সংস্পর্শে আসিয়াই জাগিয়াছিল। এ হিসাবে তিনি যে কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদের জনক, তাহা স্বীকার করিতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু এ-প্রসঙ্গে এ-কথাটিই আমরা জানাইয়া দিতে চাই, স্যর সুরেন্দ্রনাথ ভারতে যে বিদেশী জাতীয়তাবাদের অনুকরণ করিয়াছিলেন, দেশের সমাজ ব্যবস্থার কষ্টিপাথরে তাহা যাচাই করিয়া দেখার অবসর তাহার ছিল না। ফলে এই জাতীয়তাবাদ শীঘ্রই এক ব্যর্থ বিড়ম্বনার ব্যাপারে হইয়া দাঁড়াইল। একদেশ ও একজাতি বলিয়া হিন্দু-মুছলমান প্রভৃতি জাতিকে এক শৃঙ্খলে বাঁধিতে পারিলে শাসনের সুবিধা আছে। ভেদনীতি সচল হয়, সর্বোপরি ইহাতে সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি অনড় হয়। ব্রিটিশ তাই নিজের স্বার্থের গরজে এই নবাগত জাতীয়তাবাদের মহা ভক্ত হইয়া পড়িল। এই জাতীয়তাবাদের বেদীতে ঠিক একই কারণে সংখ্যাগুরু হিন্দুর ভক্তিও নিবেদিত হইল। দেখা গেল, কংগ্রেস উদারনৈতিক দল এই জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে হিন্দুরাজ’ প্রতিষ্ঠার আয়ােজন করিতেছে। স্যর সুরেন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতির কাল হইল। ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের এই মিলিত চেষ্টায় ভারতের মুছলমানের শিক্ষা, সভ্যতা, তমদুন শুধু বিপন্ন নয়, বহুক্ষেত্রে বিনষ্ট ও বিকৃত হইয়া পড়িল ।

তথাকথিত জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়া উঠিতে কিছুটা সময় লাগিলেও ধীরে ধীরে মুছলমান তাহার স্বকীয়ত্ব, স্বাতন্ত্র ও রাজনৈতিক লক্ষ্য আজ ফিরিয়া পাইয়াছে। পাকিস্তান আন্দোলন তাহারই প্রমাণ। সদিচ্ছা, আদর্শবাদিতার অভাব না থাকিলেও স্যর সুন্দ্রেনাথের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যে চোরাবালির উপর রচিত হইয়াছিল, আজ তাহা চারিদিকে দিবালােকের মত সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। স্যর সুরেন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জানাইয়া এ-কথা আজ আমরা এখানে উল্লেখ না করিয়া পারিলাম না।

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪১, ১৭ ভাদ্র ১৩৪৮, সম্পাদকীয় -২, পৃষ্ঠা-৪

সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্র

একটি সরকারী এশতেহারে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের একটি চমকপ্রদ ষড়যন্ত্রের বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। এই ষড়যন্ত্রের প্রধান নায়ক মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ । মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ একজন সমাজতান্ত্রিক ভাবাপন্ন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা পণ্ডিত জওয়াহেরলালের দক্ষিণ হস্ত। মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ দেউলী বন্দিনিবাসে বর্তমানে অবস্থান করিতেছেন। তিনি এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা তাঁহার স্ত্রী মিসেস প্রভাবতীর মারফতে বাহিরে চালান দিয়া বমাল ধরা পড়িয়াছেন। এই পরিকল্পনায় তিনি তাঁহার অনুচরদিগকে এই মর্মে উপদেশ দান করিয়াছিলেন যে, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল গঠন করিতে হইবে। তাহার আরও প্রস্তাব ছিল, কমিউনিস্ট দলকে কোণঠাসা করিয়া দিতে হইবে। মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ আরও উপদেশ দিয়াছিলেন যে, এই সােসালিষ্ট দল ভারতের যুবকদিগকে আকৃষ্ট করিবার চেষ্টা করিবে। এই গােপন শাখা পুরাতন পন্থা অর্থাৎ ডাকাতি করিয়া অর্থ সগ্রহ করিবে। তিনি এই শাখা দলটির বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন, ইহা একটী বে-আইনী দল হইবে এবং বে-আইনী কাৰ্যে রত থাকাই ইহার উদ্দেশ্য হইবে।” তিনি বর্তমান যুদ্ধ সম্পর্কেও তাহার অনুসারীদিগকে পক্ষ নির্বাচনের যে সুস্পষ্ট উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা হইতে জানা যায় যে, যুদ্ধরত রাশিয়াকে টানিয়া আনিয়া তাঁহাদের কাৰ্য-পন্থা নির্ধারণ করিয়া কোন লাভ নাই। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সগ্রাম পরিচালনা করাই হইবে প্রকৃত কাজ। তিনি তাই বলেন, “ইঙ্গ-জাৰ্মাণ যুদ্ধকে রুশ-জাৰ্মাণ যুদ্ধ হইতে স্বতন্ত্র করিয়া বিচার করিতে হইবে।” রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতি থাকিলেও “সঙ্গে সঙ্গে বৃটেনের যুদ্ধে আমাদের বিরােধিতা ও আমাদের জাতীয় আন্দোলন এবং আমাদের সকল শ্রেণীর আন্দোলন চলিতে থাকিবে।” মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ মিঃ গান্ধীকেও তাঁহার পরিকল্পনা প্রদর্শন, বিভিন্ন প্রদেশে তথাকথিত গুপ্ত আন্দোলনের সুযােগ সুবিধা এবং তাহার এবং তাহাদের বর্তমান ও ভাবী কাৰ্য্যক্রমের কথাও আলােচনা করিয়াছেন।

মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণের এই পত্রের এই কাণ্ডকাহিনী পাঠ করিয়া অনেকেই স্তম্ভিত হইবে। এ সব ব্যাপারে দেশ আর যে একটি আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়াইয়া আছে এবং কংগ্রেসীরা কি ভাবে গােপনে পঞ্চম বাহিনীর আয়ােজন সম্পন্ন করিয়া তুলিতেছে, তাহা আজ বেশ করিয়াই উপলব্ধি করিবার সময় আসিয়াছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, মিঃ জয়প্রকাশের পত্র মিঃ গান্ধীকে দেখাইতে বলায় পরিস্থিতির গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। এই মিঃ জয়প্রকাশ পণ্ডিত জওয়াহেরলালের দক্ষিণ হস্ত। ইহা হইতে কি ইহাই পরিষ্কার হইয়া উঠিতেছে না যে, কংগ্রেসের তথাকথিত সত্যাগ্রহের ধুম্র-যবনিকার আড়ালে ব্যাপার আজ অনেক দূর পর্যন্ত গড়াইয়াছে। এই বার ধরা পড়িবার ফলে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কোন নীতি অবলম্বন করিবেন, জানা নাই। কিন্তু তাহাদের ঘটে যদি বুদ্ধি বলিয়া কিছু থাকে, তবে যথাবিহিত সতর্কতা অবলম্বনে দেরী করার অবসর আর নাই। এইসব পঞ্চম বাহিনীর ষড়যন্ত্র হইতে দেশকে নিরাপদ ও নির্ভর করিয়া তুলিতে হইলে তাহাদের কর্তব্য কি, তাহা তাহারা ভাল করিয়া জানেন। সেজন্য আমরা কোন অযাচিত উপদেশ হইতে ইচ্ছুক নই। কর্তৃপক্ষ আজ যাহা ভাল বুঝিবেন তাহাই করিবেন। কংগ্রেসকে দিয়া তাদের অনেকখানি বাড়াইয়া তুলিয়াছেন। বৃটিশের নাকের ডগার উপর কংগ্রেস আজ সত্যাগ্রহের পতাকা আন্দোলন করিয়া পরােক্ষভাবে নাৎসী শত্রুদের প্রতি যে আহ্বান ও উৎসাহ জ্ঞাপন করিতেছে, তাহা বাস্তুবিকই বিস্ময়ের ব্যাপার।

১৮ অক্টোবর ১৯৪১,১ কার্তিক ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা

অর্থনৈতিক –
সরকারী আয়-ব্যয়

গত শনিবার বঙ্গীয় আইন সভায় ১৯৪১-৪২ সনের সরকারী বাজেট উপস্থাপিত হইয়াছে। বাজেট উপস্থাপন কালে অর্থ-সচিব মাননীয় মিঃ ছােহরাওয়ার্দি যে বক্তৃতা দিয়াছেন, তাহা হইতে শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাবই নয়, আলােচ্য বাজেটে যে ১ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা ঘাটতি পড়িয়াছে, তাহার কারণও যথাযথরূপে জানা গিয়াছে। মিঃ ছােহরাওয়ার্দি দেখাইয়াছেন যে, আলােচ্য বৎসরে শিক্ষার বাবদ ১৪ লক্ষ টাকা, সিভিল ওয়ার্ক বাবদ ১৭, ৬৪,০০০ এবং জনস্বাস্থ্য বাবদ মােট ৮,৮৫,০০০ অতিরিক্ত খরচের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। তাহা ছাড়া শাসন বিভাগের জন্য সাড়ে নয় লক্ষ টাকা, শিল্প বিভাগের জন্য চার লক্ষ টাকা, সমবায় বিভাগের জন্য তিন লক্ষ টাকা এবং সেচ বিভাগের জন্য ৩ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত পুলিস, পেন্সন ইত্যাদি বাবদও যথেষ্ট খরচ বৃদ্ধি পাইয়াছে। বলা বাহুল্য, যে কোন প্রগতিশীল দেশেই বৎসরের পর বৎসর খরচের হিসাব বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। তাই আলােচ্য বাজেটে অতিরিক্ত খরচের হিসাব দেখান হইয়াছে বলিয়াই তাহা নিন্দনীয় হইতে পারে না। তবে এই অতিরিক্ত খরচের জন্য যে ঘাটতি পড়িয়াছে, তাহা অবশ্যই দুঃখের বিষয়। গবর্ণমেন্টের খরচ যেমন বাড়িবে, আয়ও তেমনি বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। নয়তাে হয় গবর্ণমেন্টকে দেউলিয়া হইতে হইবে, আর তাহা না হইলে জনসাধারণকে অতিরিক্ত করভার সহ্য করিতে হইবে। বর্তমান যুদ্ধকালে বৈদেশিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের যে অবস্থা, তাহাতে সাধারণভাবে সরকারী আয় বৃদ্ধি পাইয়া অতিরিক্ত খরচ কুলাইয়া যাইবে, এমন আশা করাও বৃথা। বস্তুত তাহা হয়ও নাই। প্রধানতঃ এই কারণেই আলােচ্য বৎসরের বাজেটে এই ঘাটতি দেখা দিয়াছে।

প্রস্তাবিত বিক্রয়কর ও মােটর স্পিরিট বিল কাৰ্যকরী হইলে এই ঘাটতি হয়তাে পূরণ হইয়া যাইবে। কিন্তু মিঃ ছােহরাওয়ার্দি দেখাইয়াছেন যে, সরকারী কৃষি, সেচ প্রভৃতি জাতি গঠনমূলক বিভাগগুলিতে বর্তমানে যে শােচনীয় অবস্থা চলিতেছে, তাহার যথােচিত প্রতিকার করিয়া দেশের সত্যকার কল্যাণ সাধন করিতে হইলে অদূর ভবিষ্যতে আরও নূতন কর ধার্য্য করণের প্রয়ােজন হইবে। | বাংলার জনসাধারণ যখন নানা প্রকার করভারে বিশেষভাবে ক্লিষ্ট, তখন মাননীয় অর্থসচিবের এই ইঙ্গিত নিঃসন্দেহেই এক গুরুতর আশঙ্কার সৃষ্টি করিবে। অথচ ইহাও অবিসাবী সত্য যে, নূতন আয়ের পথ না পাইলে বাংলা গবর্ণমেন্টের পক্ষে জাতি গঠনমূলক কাৰ্য্যগুলিতে ব্যাপকভাবে হাত দেওয়াও অসম্ভব।

এখন নূতন আয়ের পথ কি, তাহাই হইল প্রশ্ন। মাননীয় মিঃ ছােহরাওয়ার্দি মনে করেন যে নূতন কর স্থাপনই এই অবস্থার প্রতীকারের একমাত্র পথ। কিন্তু আমাদের মতে ইহা ছাড়াও অন্যপথ আছে। প্রথমতঃ গবর্ণমেন্ট একটু চেষ্টা করিলেই তাহাদের ব্যয়ের পরিমাণ অনেকটা হ্রাস করিতে পারেন। প্রতি বৎসর সরকারের শৈলবিহার, সরকারী কর্মচারীদের অত্যুচ্চহারে বেতন ও এলাউয়েন্স গ্রহণ ইত্যাদিরূপ বিষয়ের প্রতি যদি গবর্ণমেন্ট একটুখানি কঠোর হন, তবে অনেক টাকা বাঁচিতে পারে। এই সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের পরেও যদি জাতি গঠন কাৰ্য্যের জন্য অধিক টাকার প্রয়ােজন হয়, তবে দরিদ্রের উপর আঘাত না করিয়াও অনেক রকমের নূতন ট্যাক্স বসান যাইতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিভিন্ন ক্লাবে ব্যবহৃত মাদকদ্রব্যের কথা ধরা যাইতে পারে। আমরা যতদূর জানি ইহার উপর ট্যাক্স ধরা হয় না। নূতন ট্যাক্স বসাইবার প্রয়ােজন হইলে সর্বাগ্রে ইহার উপর যথােচিত ট্যাক্স ধরা যাইতে পারে। তাছাড়া বােম্বাই গবর্ণমেন্ট যেহারে মাদক দ্রব্যের উপর ট্যাক্স ধরিয়াছেন, বাংলা গবর্ণমেন্টও অনায়াসেই তাহা করিতে পারেন। পরিশেষে প্রয়ােজন হইলে কৃষিজাত মােটা আয়ের উপরও কর ধার্য করা যাইতে পারে। বস্তুতঃ প্রস্তাবিত বিষয় করে ফলে সৰ্বসাধারণ যেরূপ গুরুতরভাবে ক্ষত্রিস্ত হইবে, সেরূপ সম্ভাবনা না ঘটাইয়াও বাংলা গবর্ণমেন্ট অনেক নূতন আয়ের পথ বাহির করিতে পারেন। বাংলা গবর্ণমেন্ট ভবিষ্যতে যদি সেইসব দিকেই অবহিত হন, তবেই সকল দিক রক্ষা হয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, ৬ ফান ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

অর্থনৈতিক পরিকল্পনা

যুদ্ধের শুরু হইতেই Economic Planning বা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা’- এই কথাটার প্রচলন বাড়িয়াছে। অর্থনীতি সম্পর্কিত গুরু আলােচনার তাে কথাই নাই, সাধারণ সভাসমিতিতে পর্যন্ত এই শব্দটা আজ অহরহ শুনা যাইতেছে। সেদিন কলিকাতায় যে নিখিল-বঙ্গ অর্থনৈতিক সম্মেলনের অনুষ্ঠান হইয়া গেল, তাহাতে তাে বক্তার পর বক্তা কেবলই বুঝাইতে লাগিলেন যে, অবিলম্বে এক সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মতে কাজ আরম্ভ না করিলে আর আমাদের আর্থিক উন্নতির কোন আশা নাই। শুধু তাই নয়, আমরা যদি অনির্দিষ্ট পথে এলােপাতাড়ীভাবে চলি, তবে যুদ্ধের শেষে আমাদের এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে হইবে, একথাও কোন কোন বক্তা ইঙ্গিতে প্রকাশ করিয়াছেন।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়ােজন সম্বন্ধে তাে অনেক কথাই শুনিলাম। আর তখন হইতে যতটুকু বুঝিতে পারিলাম, তাহাতে ইহাও মনে হইল যে, এই সঙ্কটদিনে আর যার তার মত চলিলে হইবে না, সঘবদ্ধভাবে আমদানী চাহিদা ও উৎপন্নের সুযােগ সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আমাদের দেশীয় শিল্পগুলিকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। আমদানী ও চাহিদার কথা বলিতে শুধু বর্তমানকে ধরিলেই চলিবে না, ভবিষ্যতেও আমাদের পরিকল্পনার বিষয়বস্তু করিয়া লইতে হইবে। এবং সেই অনুসারে আমাদের মুদ্রানীতি, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, খনিজ সম্পদ সবকিছুকে নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনার যেটুকু পরিচয় আমরা দিলাম, তাহা হইতেই বােধ হয় প্রতিপন্ন হইবে যে, দেশীয় উৎপন্নের উপর এক বিরাট শক্তির অব্যাহত ক্ষমতা থাকা প্রয়ােজন এবং সেই শক্তি দেশবাসীর ইচ্ছাধীনে পরিচালিত হওয়া দরকার। কারণ তাহা হইলে জনমতের দাবী অনুযায়ী শিল্পবাণিজ্য কোন কিছুরই আবশ্যকীয় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় আরও একটী বিষয় অপরিহার্য। তাহা হইতেছে অন্ততঃ কিছুকালের জন্য দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মােটামুটিরূপ নিশ্চয়তা। কেননা, যদি অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন কোন অর্থনৈতিক পরিবর্তন বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটে, যার ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই ওলটপালট হইয়া যায়, তবে আমরা যেকোনরূপ অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই গ্রহণ করি না কেন, তার ব্যর্থতা অনিবাৰ্য ।….

তারপর কয়েক মাসের মধ্যেই নরওয়ে, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম একে একে সব অপ্রত্যাশিতভাবে জাৰ্মাণীর পদানত হইল, সমুদ্র পথও বিপদসঙ্কুল হইয়া পড়িল। ফলে পাটের বাজারের যে দুরবস্থা উপস্থিত হইয়াছে প্রতিনিয়তই তাহা আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি। এই জন্যই বলিতেছিলাম যে, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা লইয়া যতই কেন সােরগােল উপস্থিত হােক না কেন, একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে তার সাফল্য সম্বন্ধে মােটেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। আজ যাহারা আরাম কেদারায় বসিয়া আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্বন্ধে সদুপদেশ বিতরণ করিতেছেন, আশা করি, তাহারা এই কথাগুলিও একটু ভাবিয়া দেখিবেন। কিন্তু উপরােক্ত উক্তি হইতেই কেন যেন ধরিয়া না যান যে আমরা যুদ্ধকালে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিরােধী। পক্ষান্তরে আমরা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি যে, বিজ্ঞানসম্মত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের শিল্পবাণিজ্য কৃষি ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতা আজ অত্যন্ত তীব্রভাবে দেখা দিয়াছে। তবে এই সঙ্গে আমরা এই কথাটাও দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, এই রাষ্ট্রীয় অনিশ্চয়তার দিনে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পরিপূর্ণ সাফল্য সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকাও সমীচীন নহে।

সে যাই হােক, যতদূর সম্ভব এই আশঙ্কিত অবস্থার মধ্যেও আমাদের আনুমানিক চাহিদার দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই উৎপন্ন নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে এবং যাহাতে যুদ্ধকালে অথবা তার পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা গুরুতর বিপৰ্যয় উপস্থিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। বলা বাহুল্য, এই জন্য শুধু ফরমূলা করিবার মত উপকরণ সংগ্রহ করিলেই যথেষ্ট হইবে না, কার্যক্ষেত্রেও যাহাতে এইগুলি প্রযুক্ত হইতে পারে, তারও ব্যবস্থা করা দরকার। পূৰ্বে বলিয়াছি, এজন্য শাসনতন্ত্রের উপর দেশবাসীর অধিকার অপরিহার্য্য। কারণ, তাহা না হইলে প্রতিপদে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থহানির সম্ভাবনা বিদ্যমান। গত মহাযুদ্ধের সময় এবং তারপরে ভারতবর্ষ কিভাবে তাহার প্রাপ্য লাভের অংশ হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, সে আলােচনা আর এস্থলে করিতে চাই না। সুপ্রসিদ্ধ অর্থনীতিক ডাঃ খানােভিকার হইতে আরম্ভ করিয়া অনেকেই সে আলােচনা করিয়াছেন। বর্তমান যুদ্ধের সময় আমরা আমাদের স্বার্থহানির সম্ভাবনা দেখিতেছি, তাহাতেই বুঝিতে পারিতেছি, সত্যকার গলদ কোথায়। ইষ্টার্ণ-গ্রুপ কনফারেন্সে গৃহীত প্রস্তাবাবলী হইতেও বুঝা গিয়াছে যে, এদেশে রাজনৈতিক কারণেই বিজ্ঞানসম্মত অর্থ-পরিকল্পনা মত কাৰ্য্য করা সম্ভব নহে।।

সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন অংশ হইতে কাপড়ের কলওয়ালারা বােম্বাই শহরে সমবেত হইয়া সরকারী রসদ বিভাগের প্রতিনিধির নিকট তাহাদের অভাব অভিযােগ সম্বন্ধে যে সমস্ত উক্তি করিয়াছেন, তাহাতেও আমাদের উপরােক্ত বিশ্বাসই অধিকতর বদ্ধমূল হইয়াছে। কলওয়ালাদের একটা অভিযােগ এই যে, রসদ বিভাগের কখন কোন্ কোন জিনিষের কি পরিমাণ দরকার হইবে, যথাসময়ে নাকি তাঁহারা কলওয়ালাদের তাহা জানাইতেছেন না এবং তারই জন্য কলগুলিকে মাল সরবরাহ ব্যাপারে নিতান্ত অসুবিধা ভােগ করিতে হইতেছে। এই যখন অবস্থা, দেশীয় শিল্পের সহিত সরকারের সম্বন্ধ যখন এইরূপ, তখন আর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সাফল্য আশা করা যায় কিরূপে? যদি গবর্ণমেন্ট কলওয়ালাদের আরও একটু বেশী বিশ্বাসভাজন মনে না করেন, তবে সরকারী প্রয়ােজন সম্বন্ধে উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে মিলগুলির শুধু যে সময় প্রচেষ্টা ব্যাহত হইবে তাহা নয়, যুদ্ধশেষেও বস্ত্রশিল্পে নানারূপী বিপৰ্যয় উপস্থিত হইবার আশঙ্কা আছে। কারণ অধিকাংশ ব্যবসায়ী চাহিদা সম্বন্ধে অন্ধ থাকিয়া ‘অন্ধকারে ঢিল মারিতে বাধ্য হয় বলিয়াই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বহুবিধ গােলযােগের সৃষ্টি হয়। আমরা আশা করি, অন্ততঃ এই কথাগুলি চিন্তা করিয়াও গবর্ণমেন্ট দেশীয় শিল্পের মালিকগণকে আরও একটু বেশী বিশ্বাসযােগ্যরূপে গ্রহণ করিবেন।
১১ মে ১৯৪১, ২৮ বৈশাখ ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

সামাজিক:
কলিকাতায় জলাভাব

কলিকাতার কয়েকটী অঞ্চলের আদিবাসীরা কিছুকাল যাবত জলাভাব জনিত বিশেষ অসুবিধা ভােগ করিতেছেন, এই সংবাদ পাঠকগণ নিশ্চয়ই অবগত আছেন। কর্পোরেশনের অন্যতম সদস্য মিঃ নরেশনাথ মুখার্জির প্রশ্নোত্তরে কয়েকদিন পূর্বে মেয়র মিঃ ব্রহ্ম আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, তিনি অবিলম্বে এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবেন এবং এ অবস্থার যথােচিত প্রতিকার করিতে যত্নবান হইবেন। গত বুধবার দিন কর্পোরেশনের এক সভায় তিনি যে সমস্ত তথ্য উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহাতে মনে হয়, পানীয় জলের সমস্যা সহজে সমাধান হইবার নয়- ইহাতে অনেক প্রকার জটিলতা রহিয়াছে।

ডেপুটী একসিকিউটীভ অফিসারের সহিত মিঃ ব্রহ্ম পলতা কারখানা পরিদর্শন করিয়া আসিয়াছেন এবং সেখানকার সকল অবস্থা স্বচক্ষে দেখিবার পর তিনি যেসব উক্তি করিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায় যে, প্রতিদিন সােয়া কোটী হইতে দেড় কোটী গ্যালন জল পানােপযােগী বিবেচিত না হওয়ায় বৃথা নষ্ট হইতেছে। এই পরিমাণ জল যদি কলিকাতায় আনা হইত তবে সহজেই সকল সমস্যার সমাধান হইয়া যাইত, এপ্রসঙ্গে মেয়র আশ্বাস দিয়াছেন যে, যাহাতে সত্বর এই জল বিশুদ্ধ করিয়া কলিকাতায় প্রেরণের ব্যবস্থা হইতে পারে, সেজন্য পলতা লেবরেটরীতে জোর গবেষণা চলিতেছে।

তারপর কলিকাতার কয়েকটী বিশেষ অঞ্চলের জলাভাবের কথা উল্লেখ করিয়া মেয়র বলেন, যে তিনি নিজে ঘুরিয়া দেখিয়াছেন যে, সে সব অঞ্চলে কলের জলের বেগ অতি সামান্য এমনকি নাই বলিলেই অত্যুক্তি হয় না। কর্পোরেশন অবশ্য ঐসব অঞ্চলে কয়েকটী নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দিয়াছিলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় বাজেটে তার জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় ঐ নলকূপগুলি স্থাপন করা সম্ভব হয় নাই। মেয়র মনে করেন যে, উপরােক্ত নলকূপগুলি বসাইতে পারিলে ঐসব অঞ্চলে আর জলাভাব লক্ষিত হইবে না। মেয়র মহােদয়ের বক্তৃতা হইতে আমরা যদিও তাঁর সদিচ্ছার যথেষ্ট পরিচয় পাইলাম, তথাপি কলিকাতার পানীয় জল সমস্যার আশু সমাধানের বিশেষ কোন ভরসা পাইতেছি না। পলতা হইতে কিভাবে স্বল্পবার জল বিশুদ্ধ করিয়া কলিকাতায় পাঠান যাইতে পারে, সে-সম্বন্ধে এখনও গবেষণা চলিতেছে। কে জানে, এই গবেষণার ফল কি দাঁড়াইবে। যদি গবেষণা সফলও হয়, তবে কবে পৰ্য্যন্ত কলিকাতাবাসীরা তার সুফল পাইবে, সে-সম্বন্ধে এখনও কোন নিশ্চয়তা নাই। তবে যে কয়েকটী স্থানে নলকূপ স্থাপন করিলেই জলাভাব মিটিয়া যায় বলিয়া মেয়র মহােদয়ের বিশ্বাস, সেখানে অবশ্য তাড়াতাড়িই অবস্থার উন্নতি হইতে পারে বলিয়া আমরাও মনে করি। যাহা হােক-এ সম্বন্ধে যথাশীঘ্ৰ কাৰ্য্য হইতে দেখিলেই সুখের বিষয় হইবে।

কিন্তু পূর্বে বলিয়াছি পলতা হইতে দেড় কোটী গ্যালন জল আনা সহজ ব্যাপার নহে। ইহাতে সময় লাগিবে, খরচও যথেষ্ট পড়িবে। ইতিমধ্যে শুনিয়াছিলাম যে, বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় নাকি গবর্ণমেন্ট কলিকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলি নলকূপ বসাইবার কথা চিন্তা করিতেছিলেন। এই পরিকল্পনা কোন অবস্থায় আছে, তাহা আমরা জানি না। তবে এইটুকু মনে হয় যে, যথাতথা এই নলকূপগুলি না বসাইয়া ঠিক যে যে স্থলে পানীয় জলের বিশেষ অভাব দেখা দিয়াছে, সেই সব স্থানে নলকূপগুলি স্থাপন করিলেই সকল দিক দিয়াই সুবিধা হয়। অবশ্য বিমান আক্রমণের ফলে জলের কল নষ্ট হইবার আশঙ্কায় যে যে স্থলে নলকূপ বসাইবার পরামর্শ বিশেষজ্ঞগণ দিবেন, বর্তমান জলাভাব দূরীকরণের জন্য হয়তাে সেইসব স্থলে নলকূপ বসাইবার পরামর্শ তাঁরা নাও দিতে পারেন। কিন্তু তাহা হইলেও মনে হয়, একটী অনিশ্চিত আশঙ্কায় যেখানে যেখানে ড্রেন কাটা ও দেওয়াল তােলার মত নলকূপ স্থাপনের চাইতে জনসাধারণের আশু উপকার হইতে পারে, ঐরূপ স্থানে অন্ততঃ প্রথম কয়েক দফায় নলকূপগুলি বসানই যুক্তিসঙ্গত।

১৩ ফুল ১৯৪১, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

সাংস্কৃতিক
প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলন

প্রবাসী, বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলনের অধিবেশন এবার জামশেদপুরে হইয়া গিয়াছে। বরাবরের ন্যায় এবারকার সম্মেলনেও মূল অধিবেশন এবং বহু শাখা-অধিবেশনের ব্যবস্থা হইয়াছিল। সম্মেলন মােটামুচী সফল হইয়াছিল, মানে, সাহিত্যের আসর বেশ জমিয়াছিল, সম্মেলন-সম্পর্কিত সংবাদাদি দেখিয়া তাহা কতকটা অনুমান করা যায়। বিশেষ করিয়া, শাখা-অধিবেশনগুলির সভাপতিদের অভিভাষণ মােটামুঢ়ী আমাদের ভালােই লাগিয়াছে। শাখা-অধিবেশনগুলির নেতৃত্বভার যাঁরাই পাইয়া ছিলেন, তারা প্রায় সকলেই সুসাহিত্যিক ও সুলেখক। কাজেই তাদের অভিভাষণগুলি উপভােগ্য হইবে, তাহাতে বিস্ময়ের বিষয় কিছু নাই। মূল সভাপতির অভিভাষণ- বিশেষ করিয়া, গুরুসদয় বাবুর অভিভাষণটাও হৃদয়গ্রাহী হইয়াছে। তার বাঙ্গলা রচনা সুন্দর, এ-কথা স্বীকার করিতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ দেখি না। কিন্তু অভিভাষণের উপসংহারে তিনি নিজের রচিত যে কবিতাটি সন্নিবেশিত করিয়াছেন, আমাদের বিবেচনায় তাহা বাদ দিলেই ভালাে হইত। কারণ এই কবিতা’ যিনি রচনা করিতে পারেন, তার হাত দিয়া অভিভাষণের অমন সুন্দর রচনা বাহির হইতে পারে সে-সম্বন্ধে স্বতঃই সন্দেহ উপস্থিত হয়।

দুঃখের বিষয় প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলন এবারও তার বিশিষ্ট হিন্দুরূপ ও প্রকৃতি ত্যাগ করিতে পারে নাই। ইহাকে প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলন বলিয়া অভিহিত করা হইলেও আসলে ইহা প্রবাসী হিন্দু-বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলন হইয়া উঠিতেছে। বাঙ্গলার বাহিরে যথেষ্ট সংখ্যক বাঙ্গালী মুছলমানেরও বাস আছে এবং তাদের মধ্যে সাহিত্যিকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য, এ কথা বলা যায় না। মধুপুরে মওলানা মােহাম্মদ আকরাম খাঁ ছাহেব ও বরােদায় ডক্টর মুজতবা আলী ছাহেবের ন্যায় মনীষী সাহিত্যিকগণ বাস করিতেছেন। দিল্লীতে ডক্টর এ এফ রহমান, রেঙ্গুণে অধাপক ছিদ্দিকী খান, লাহােরে ‘এছলামিক রিভিউ’র সম্পাদক মিঃ আফতাবুদ্দীন, কাদিয়ানে খান বাহাদুর আবুল হাশেম খাঁ ও আসামে মওলবী আবদুল মালেক চৌধুরী, মিঃ আবদুল মতীন চৌধুরী, দেওয়ান একলিমুর রেজা চৌধুরী, দেওয়ান মােহাম্মদ আহবাব চৌধুরী, খান বাহাদুর নাসির, মিঃ মকবুল হােসেন চৌধুরী প্রমুখ বাঙ্গলা সাহিত্যসেবী আছেন।

শুধু ইহাই নয়, সম্মেলনে অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘােষ যে-বক্তৃতা করিয়াছেন, তাহা হিন্দুমার্কা সাহিত্য-সম্মেলনেও অশােভন হইয়াছে, একথা যেকোনাে সত্যকার সাহিত্যামােদী ব্যক্তিও স্বীকার না করিয়া পারিবেন না। তিনি বলিয়াছেনঃ “কলিকাতা কর্পোরেশনে বসু-ছিদ্দিকী-চুক্তির ফলে বাঙ্গলার হিন্দুস্বার্থ বিপন্ন হইয়াছে।” সাহিত্যসম্মেলনে ‘হিন্দুস্বার্থ বিপন্ন’? ঘােষ মহাশয় ‘হিন্দুস্বার্থ বিপন্নের “জিগির’ দিবার জন্য হিন্দুসভা বা কংগ্রেসে না গিয়া সাহিত্য-সম্মেলনে গেলেন কেন? এইভাবে সাহিত্যসম্মেলনের জাতি না মারিলে কি তার চলিত না?

বস্তুতঃ অধ্যাপক হইলেই যে সাহিত্যিক বা সাহিত্যামােদী হওয়া যায় না, এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু অন্ততঃ দেবপ্রসাদ বাবুর থাকা উচিত ছিল। তিনি নিতান্তই ভুল করিয়া সাহিত্য-সম্মেলনে আসিয়া পড়িয়াছিলেন। তার যােগ্যস্থান সাহিত্য-সম্মেলন নয়হিন্দুসভা। সেখানে তিনি প্রাণ খুলিয়া ‘হিন্দু-বিপন্নের জিগির ছাড়িলে কেহ কিছু বলিত না।
১ জানুয়ারি ১৯৪১, মাঘ ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

সাহিত্যের পঁচিশ বৎসর

আগামী ৫ই এবং ৬ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গীয় মুছলমান সাহিত্য-সমিতির রজত-জুবিলী অনুষ্ঠানের আয়ােজন হইতেছে। আমরা অনুষ্ঠানের পূর্ণ সাফল্য কামনা করিতেছি। বাঙ্গালী মুছলমানের সাহিত্য-প্রচেষ্টার সাথে সাহিত্য-সমিতির দান অপরিমেয় এবং আমাদের সাহিত্য-আন্দোলনের সাথে সমিতির যােগাযােগ অবিচ্ছেদ্য।
সাহিত্য-সমিতির রজত জুবিলী অনুষ্ঠানের সাথে বাঙ্গালী মুছলমানের পঁচিশ বৎসরের সাহিত্য, শিক্ষা ও তমদুনের ইতিহাস তাইয়া দেখার প্রয়ােজন আছে। গত পঁচিশ বৎসরের মুছলমানের সাহিত্য-সাধনার ইতিহাস বলিতে যুদ্ধোত্তর বাংলা সাহিত্যের কথাই বিশেষভাবে স্মরণ করিতে হইবে। যুদ্ধোত্তর বাংলা মুছলমান সাহিত্য বিশেষ করিয়া, কাব্য, জীবনী এবং অনুবাদে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে, আমাদের পঁচিশ বৎসরের সাহিত্য সাধনায় এ-কথা আজ গর্বের সাথেই ঘােষণা করিতে পারি। এই পঁচিশ বৎসরের মধ্যে সাহিত্যের অপরাপর শাখায়ও আমাদের কল-গুঞ্জন শুনা যাইতেছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু এসব শাখায় আজও আমাদের জাতীয় জীবনের স্বকীয়ত্বের পরিচয় সাফল্যজনকভাবে ফুটিয়া উঠে নাই। পঁচিশ বত্সরের এই ব্যর্থতা ও সাফল্যের কারণও এই উপলক্ষে অনুসন্ধান করার প্রয়ােজন আছে।

বাংলা-সাহিত্য, বাংলা ভাষা একদিন মুছলমানের স্নেহচ্ছায়াই পুষ্ট হইয়াছিল। মুছলমানের দেওয়া শব্দ, প্রকাশভঙ্গি এবং অলঙ্কার লইয়া বাংলা সাহিত্য যে ঐশ্বৰ্য্যমণ্ডিতরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছিল, তাহার পরিচয় আমরা পুঁথি-সাহিত্য, গিতিকা, ভাটিয়ালী রচনার ভিতর পাই। আমীর হামজা, কাছাছল আম্বিয়া এবং ভারতচন্দ্রের রচনায় সে-নিদর্শন রহিয়াছে। কিন্তু ইংরেজী শিক্ষার প্রভাব এবং বিদ্যাসাগরী রচনাধারার শক্তি সঞ্চয়ের ফলে আজ বাংলার জাতীয়রূপ পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। নবপৰ্য্যায়ের এই সাহিত্যে হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং হিন্দু-তমদুনের প্রভাব-বৃদ্ধির ফলে আজ বাংলা ভাষার এই অধধাগতি হইয়াছে। কিন্তু অত্যন্ত সুখের বিষয়, আলােচ্য পঁচিশ বৎসরের ভিতর বাংলা সাহিত্যে দুই একজন শক্তিশালী প্রতিভার আবির্ভাব হইয়াছে, যাহাদের চেষ্টায় বাংলা ভাষা আবার তাহার জাতীয় রূপ ও বাস্তব রীতি ফিরিয়া পাইতেছে। কবি নজরুল ইসলাম এবং কবি জছিমুদ্দীনের রচনার শব্দ-সম্পদ এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য।

এখানে আরও একটা কথার আলােচনা অবান্তর হইবে বলিয়া মনে হয় না। মুছলমান সাহিত্যিকদের এই প্রচেষ্টা এবং আরবী-ফারসী বাংলার স্বাভাবিক ব্যবহারেও একদল লােক আজ বিরােধিতা করিতেছেন। মক্তব ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুস্তকের ভাষা লইয়া আজ যে বাদানুবাদের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহার সাথেও এই সমস্যার যােগাযােগ রহিয়াছে। একদল লােক বাংলা ভাষার নাম করিয়া সংস্কৃত চালাইবার এবং তাহাকে স্থায়ীরূপ দিবার উকট প্রয়াস পাইতেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাহারা জানেন না যে, তাহারা আজ বাংলা ভাষার কতখানি ক্ষতি করিতেছেন। বাঙ্গালীর প্রত্যাহিক জীবনে যে সব শব্দের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার সাথে বর্তমান সাহিত্যিক রচনার যে সম্পর্ক, তাহার চাইতেও অধিক সম্পর্ক পুঁথিসাহিত্যের। বর্তমান ভাষার কৃত্রিমতা দূর করিয়া ইহাকে জাতীয়-ধৰ্ম্মী, অকৃত্রিম ও গণজাগরণের অনুকূল করিয়া তুলিতে হইলে আমাদের ভাষাকে এই পুঁথিরূপ গ্রহণ করিতেই হইবে। ইহাতে বাংলা ভাষার জাতীয় ও বাস্তব রূপই শুধু ফিরিয়া আসিবে না- মুছলমানের প্রতিভা বিকাশের পথে ভাষার যে একটা প্রকাণ্ড বাধা রহিয়াছে, তাহাও দূর হইবে, তাহাদের ঘরের ভাষা ও সাহিত্যের ভাষার ব্যবধানও ঘুচিবে।

সাহিত্য-সমিতির জুবিলী উপলক্ষে আমাদের মনন ও রস-জগতের পঁচিশ বৎসরের সাধনার সকল দিক যাহাতে আমাদের কাব্য, কথা-সহিত্য, গদ্য রচনা ও মননসাহিত্যের একটা হিসাব-নিকাশ এই জুবিলী অনুষ্ঠানে যাহাতে হয়, এবং যে-আদর্শ আমাদের জাতীয় সাহিত্যের ধারাকে সত্যিকার পথের সন্ধানী করিয়া তুলিতে পারে, তাহাকে স্মরণ রাখিয়া জুবিলী উৎসবের বক্তাকে আজ কাজ করিয়া যাইতে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাইতেছি। ২

৩ মার্চ ১৯৪১, ৯ চৈত্র ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

বিবিধ প্রসঙ্গ

মিঃ বি, সি, চ্যাটার্জীর একটি প্রবন্ধ পত্রান্তরে প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে হিন্দুসংস্কৃতির অপরিহার্য্য আবশ্যকতা সম্বন্ধে আলােচনা করা হইয়াছে। প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে অবশ্য আমাদের বক্তব্য কিছু নাই- থাকিতেও পারে না। কারণ উহা ভারতীয় হিন্দুদের ঘরােয়া কথা। তবে মিঃ চ্যাটার্জীর একটি উক্তি অনেকের কাছে খুবই চমকপ্রদ বলিয়া মনে হইবে। আমরা এখানে তা উদ্ধৃত না করিয়া পারিলাম না। fola fouceat: “Hindu India is no doubt widowed at the present moment of all that creative leadership, statesmanship and the grasp of reality which had earned that a states in the eye of the civilized world”, “হিন্দু ভারত বৰ্তমান সময়ে সৃষ্টিমূলক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং সুস্থ বাস্তববুদ্ধির দিক দিয়া একেবারে দেউলিয়া হইয়া পড়িয়াছে- অথচ পূৰ্ব্বে এককালে এইগুলিই তাকে সভ্য-জগতের চোখে শ্রদ্ধেয় করিয়া তুলিয়াছিল-এর উপর টীকা-টীপ্পনী নিপ্রয়ােজন।

পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী স্যার ছেকান্দর হায়াত খা ভারতের আশু শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট দূর করার জন্য দেশের সম্মুখে এক প্রস্তাব পেশ করিয়াছেন। এই প্রস্তাবের প্রধান কথা হইতেছে এই যে অবিলম্বে একটি গােলটেবিল বৈঠকের আয়ােজন করা হােক তাহাতে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীগণ ও আইনসভাসমূহের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ যােগদান করিবেন। স্যার ছেকান্দরের মতে, এই বৈঠকে যােগ দিতে কাহারাে পক্ষেই কোনােরূপ মূলনীতিগত বাধা থাকিতে পারে না। কারণ, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র বা বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক দাবী সম্পর্কে কোনাে আলােচনাই ইহাতে হইবে না শুধু ভারতের তরফ হইতে যুদ্ধায়ােজন কিভাবে সাফল্যমণ্ডিত হইতে পারে, তৎসম্পর্কিত উপায় অবলম্বনই হইবে এই বৈঠকের মুখ্য উদ্দেশ্য। স্যার ছেকান্দরের প্রস্তাবিত বৈঠক বর্তমান অবস্থায় সাফল্যমণ্ডিত হইতে পারে কিনা, সে সম্পর্কে নানাজনের নানামত থাকিতে পারে, কিন্তু ইহাতে কোনাে দলের পক্ষেই আপত্তিকর বিবেচিত হইবার মতাে কিছু আছে, একথা সম্ভবত বলা যায় না। বিশেষতঃ জাতীয় ক্যাবিনেট’ প্রভৃতি আপত্তিকর কথা ইহাতে সযত্নে বঞ্চিত হইয়াছে, ইহাও লক্ষ্য করার বিষয় বটে।

পক্ষান্তরে বাঙ্গলার প্রধানমন্ত্রী মাননীয় মওলবী ফজলুল হক ছাহেবের প্রস্তাবের মর্ম যদিও প্রায় একই রকম অন্ততঃ ইহাই তিনি ব্যাখ্যা করিয়াছেন- তবু ‘জাতীয় সম্মেলন প্রভৃতি কয়েকটী আপত্তিকর শব্দ নিতান্ত অনাবশ্যকভাবে তাহাতে স্থান পাইয়াছে।…

গতকাল বাঙ্গলার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ পরলােকগত বিপিনচন্দ্র পালের নবম মৃত্যুবার্ষিকী কলিকাতায় উদযাপিত হইয়া গিয়াছে। বাঙ্গলার রাজনীতিতে বিপিনচন্দ্রের দান ছিল অপরিমেয়, একথা তাঁর শত্রু-মিত্র সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। শুধু বাঙ্গলাই বা কেন, সারা ভারতে যে কয়জন মেধাবী জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সর্বপ্রথম সঞ্চারিত করিয়াছেন, তাঁদের সকলের নামের সঙ্গে বিপিন চন্দ্রের নামও স্থান পাইবে, একথা অস্বীকার করার উপায় নাই।

২১ মে ১৯৪১, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮, সম্পাদকীয়-৩য়, পৃষ্ঠা-৪