জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য ও তৎকালীন বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সেনাবাহিনীর দায়
বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য/বর্ণনা
সে সময় প্রশাসন, DFI, NSI, SB তে কারা ছিলো?
পাল্টা অভ্যুত্থানকারীদের কি কোন দায় নেই?
ফারুক-রশিদ কি আগে থেকে টার্গেট করেছিলো?
আই জি ডিআইজির ভাষ্য কী?
লাশ কীভাবে সরানো হয়?
দেশত্যাগের আগে খুনি ফারুক ও রশীদ উপলব্ধি করলেন-যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর চার জাতীয় নেতা যেকোন মুহূর্তে কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারেন। খালেদ মােশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালে তারা ফিরে আসতে পারেন। খন্দকার মােশতাকও প্রমাদ গুণলেন। তাছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার গঠনের সময় থেকে পুরাতন বিরােধের একটি অপমানের প্রতিশােধ গ্রহণের মােক্ষম সুযােগ মনে করলেন তিনি ও তার সেনাদোসর ফারুক-রশীদ গং। এই বিষয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বিশ্লেষণ যথার্থ : খন্দকার মােশতাক ও ফারুক-রশিদ প্রমুখ ঘাতকেরা শেখ মুজিব-হত্যার সঙ্গে সঙ্গে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর ও সহকর্মী চার জাতীয় নেতাকে বশে আনা যাবে না এবং তারা বাইরে থাকলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। তাই তাদেরকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। অবশ্যই তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল। হয়তাে ভাবা হয়েছিল যে, ধীরে ধীরে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার চার্জ এনে বিচারের মাধ্যমে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। জেলখানায় হত্যা করার পরিকল্পনা হয়তাে ছিল না। থাকলে পূর্বেই সে কাজ সমাধা করা যেত। ২ নভেম্বর দিবাগত ৩ নভেম্বরের রাতে খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থানই তাদেরকে হত্যা করার আবশ্যকতা দেখা দিল। কেননা, খালেদ যদি ঐ চারনেতাকে জেলমুক্ত করে আনেন, তাহলে ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত হতে পারে। তাই বঙ্গভবনেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে যে, এখনই তাদের হত্যা করা আবশ্যক। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হলাে।’
ক্যান্টনমেন্টে খালেদ মােশাররফ যখন আর্মি অফিসার নিয়ে মুজিব হত্যাকারীদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করছেন এবং জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি রেখেছেন তখন সেনাবাহিনীর ভেতর বঙ্গবন্ধুর তকালীন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জাসদ-সমর্থিত কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে আর একটি পাল্টা কু করার পরিকল্পনা চলছিল। এ সুযােগে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর গভীর রাত্রিতে চারজন সশস্ত্র সেনাসদস্য কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌছে যায়। হত্যার পরিকল্পনায় তারা তখন জেলগেটের তালা খুলে দেয়ার দাবি জানায়। জেলার সাহেব অসম্মতি জানালে তর্ক-বিতর্ক ও ভয়ভীতি দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে জেলার সাহেবের টেলিফোনিক সংযােগ করা হয়। রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে জেলার জাতীয় নেতাকে হত্যার জন্য জেলখানার দরজা খুলে দিতে বাধ্য হন। হত্যাকারী রিসালদার মােসলেহ নিজ হাতে গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে চারনেতাকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের আনুপর্বিক বর্ণনা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বিবরণটি তুলে দেওয়া হলাে :
১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ২টায়, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে এসে পৌছলাে সেনাবাহিনীর একখানা জিপ । জিপ থেকে নামল চারজন সেনা। তাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র । এই দলের নেতৃত্ব ছিল রিসালদার মােসলেহ উদ্দিনের ওপর। তারা জেলগেটে প্রহরারত রক্ষীকে জেলখানার গেট খুলে দিতে বলল। কারারক্ষী জানালাে জেলার সাহেবের নির্দেশ ব্যতিরেকে তালা খুলে দেওয়া সম্ভব নয়। তখন জেলার সাহেবেকে সেখানে ডেকে আনা হলাে। জেলার সাহেবকে সেনারা জানালাে যে, আমরা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানকে নিয়ে যেতে এসেছি। তাদেরকে আমাদের সঙ্গে যেতে দিন। জেলার সাহেব বললেন : আপনারা বৈধ কাগজপত্র দেখান। যদি কোনাে ওয়ারেন্ট থাকে, আমি তা দেখতে চাই। সেনারা বললাে—কোনাে কাজগপত্র নেই। আমরা যা বলছি আপনাকে তাই মানতে হবে। জেলার সাহেব বললেন—আমি মানতে বাধ্য নই। মৌখিক কথায় কোনাে বন্দিকে কারাে কাছে হস্তান্তর করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেনারা তাকে ভয় দেখালেন। পরিণাম ভালাে হবে না বলে জানালেন। জেলার বললেন যাই ঘটুক না কেন, আমি আপনাদের কথামতাে কাজ করতে পারবাে না।
অতঃপর ঘাতকসেনারা বললেন যদি প্রেসিডেন্ট সাহেব বলেন, তাহলে দেবেন তাে? জেলার বললেন—প্রেসিডেন্টের আদেশ অমান্য করবাে কীভাবে। তিনি যে নির্দেশ দেবেন, আমি তা মানতে বাধ্য। তখন জেলারের অফিস থেকে প্রেসিডেন্ট মােস্তাকের কাছে বঙ্গভবনে টেলিফোন করা হলাে। মােস্তাক টেলিযােগে জেলারকে বললেন—আমি খন্দকার মােস্তাক বলছি। সেনাদের আমি পাঠিয়েছি। ওরা যা বলছে আপনি তাই করুন।
জেলারের অতঃপর আর কোনাে আপত্তি থাকলাে না। জেলের দরজা খুলে দেয়া হলাে। ভিতরে প্রবেশ করে ঘাতকেরা দেখলাে যে, চারনেতা তাদের নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে ঘুমিয়ে আছেন। তাদের জাগিয়ে তােলা হলাে। অতঃপর জেলরক্ষীদের দ্বারা তাদেরকে শনাক্ত করার পর তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হলাে। তারপরও মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বেয়নেট চার্জ করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জানার পর ঘাতক দল জেলখানা পরিত্যাগ করে।
হত্যার পূর্বমুহূর্তে কারা-অভ্যন্তরে কেমন অস্থির সময় কাটছিল কামারুজ্জামান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের তার বিবরণ পাওয়া যায় ঐসময় বন্দিদের সাক্ষাকার ও কথপােকথনে। রায়েরবাজার শাখা তৎকালীন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জনাব এএসএম মহসিন বুলবুল ঐ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেছেন : যে রাত্রিতে ঘটনা ঘটলাে তখন কামারুজ্জামান সাহেব ও আমি একসাথে ছিলাম। কামারুজ্জামান সাহেব সেদিন কিন্তু কোরআন শরিফ পড়তেছিলেন। যখন ওরা কামারুজ্জামান সাহেবকে ডাকলাে তখন বেচারা [কামারুজ্জামান সাহেব] কাপতেছিলেন। এমনভাবে যে পাঞ্জাবিটা হাতে দেবার পর পাঞ্জাবিটা হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি তখনই কেঁদে ফেললেন। কামারুজ্জামান সাহেব কেদে ফেললেন। ওখান থেকে নিয়ে তাজউদ্দিন ভাইয়ের রুমে নিয়ে গেল। তাজউদ্দিন সাহেবের রুমে আবার থাকতেন কোরবান আলী সাহেব, আর তাজউদ্দিন ভাই (আরাে অনেকেই)। তারপর তাে রাত্রে যখন গুলিটুলি হল তখনতাে আর্তনাদ আর চিৎকার। জীবনের প্রতি… (অস্পষ্ট) (শারমিন, ২০১৪, পৃ. ৮০)। হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়ে বি বি বিশ্বাস লিখেছেন : দুইনম্বর কামরার একজন বললেন যে জনাব কামারুজ্জামান সাহেব ঐদিন মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। বেশ কয়েকবার বলেছেন তাকে বােধহয় হত্যা করা হবে। জনাব তাজউদ্দিনের কাছে হত্যার কথা শােনার পর তিনি ঐ গুজবে সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন। চেয়ারম্যান জিন্নত আলীর গায়ের রং ছিল মিশমিশে কালাে। ঐ রাতে জনাব কামারুজ্জামান পাউডার দিয়ে চেয়ারম্যানকে সাজিয়ে অনেকক্ষণ ফুর্তি করেছিলেন। দুই নম্বর কামরায় আরাে একজনের কাছে শুনেছিলাম কালাে পােশাক পরিহিত লােকেরা স্টেনগান প্রস্তুত করে এক নম্বর কামরায় ঢুকলে তাজউদ্দিন সাহেব বলে উঠেছিলেন, এ কী করছেন! এ কী করছেন! (শারমিন, ২০১৪, পৃ. ১৩৩)।
জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পূর্বে পরিস্থিতিগুলাের বিশদ বিবরণ ঐসময় কারাবন্দি সঙ্গীরা তাদের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন। এই বর্ণনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। তবে সবচেয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য তুলে ধরেছেন মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সেক্রেটারি ও ১৫ই আগস্টের পর গ্রেপ্তারকৃত মুজিবসরকার প্রশাসনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মকর্তা জনাব এইচ টি ইমাম। তার বিবরণটি নিম্নরূপ :
৭৫-এর আগস্ট মাস থেকেই আমি জেলে অন্তরীণ । আমাকে প্রথমে Special Powers Act এবং Emergeny Act-এ গ্রেফতার করা হয়। পরে। নানাবিধ Martial Law Orders প্রয়ােগ করে কর্তৃপক্ষ। আমরা—অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সরকারের নেতৃবৃন্দ এবং শীর্ষস্থানীয় সরকারী কর্মকর্তারা অধিকাংশ থাকতাম নতুন জেলে এবং ২৬ সেলে। কেউ কেউ ১০ নম্বর সেলেও ছিলেন। ২৬ সেল সংলগ্ন জেলের বহিঃদেওয়ালের পরেই উর্দু রােড। সেখানকার বাড়িঘর, মসজিদ অনেকটা দেখা যায়। আওয়াজ পাওয়া যায়। ২৬ সেলের ভেতর অনেকটা জায়গা। নিজেদের রান্নাঘর-গােসলখানা। খােলা জায়গা। হাঁটার পর্যাপ্ত স্থান। শীতের দিনে ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা। ২৬ সেলে ১৩টি কামরা। প্রতি কামরায় ২ জন এ জন্যই ২৬ সেল। এই সেলে আমরা নানা ধরনের বন্দী। আমার সাথে প্রথম কামরায় নুরুদ্দীন সাহেব (প্রাক্তন বন-সচিব, প্রতিমন্ত্রী বদরুন্নেসার স্বামী)। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হত্যা মামলার আসামী রঞ্জু বিটু। তারপর ঐ মামলার কোরায়িশি ও বাবুল। এ পর জাসদের মেসবাহ ও একরাম। তারপর রাজাকার মাওলানা খালেক (শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যামামলার আসামী)। শ্রমিক লীগের মান্নান (লাল বাহিনী খ্যাত) এবং জাসদের রুহুল আমীন ভূইয়া। এদের সাথে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) জয়নাল আবেদীন, জাসদের চিত্ত বাবু, মাওপন্থী ইঞ্জিনিয়ার সােবহান ও আর এক ভদ্রলােক। আর ছিলেন নােয়াখালীর আওয়ামী লীগের নেতা নুরুল হক।
কিছুদিন পর যােগদান করলেন খায়রুল কবির (জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ মতিন চৌধুরী। ৭ই নভেম্বরের ঘটনার পর আমাদের সাথে আসেন কর্ণেল শাফায়াত জামিল, সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান জাসদের ডঃ আখলাকুর রহমান, মােস্তফা সারওয়ার।
৩রা নভেম্বরের কালাে রাত্রিতে আমি আর নুরুদ্দীন সাহেব একসাথে ছিলাম। আমরা দুজন একত্রে নামাজ পড়তাম। জোহর, আসর ও মাগরেবের নামাজ আমরা জামাতে আদায় করতাম। মাগরিব ও এশা জেল। কোঠার মধ্যে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই জেলের লক বন্ধ হয়ে যেত। ভারী লােহার গরাদ তখন তালা-বদ্ধ। আমাদের কিছুটা পর্দা দেবার জন্য লােহার গরাদে ভারি কম্বল (জেলের তৈরি) ঝুলানাে। রাতে পাহারাদার এলে আমরা অনেক সময় কথা বলতাম গল্প করতাম। তাছাড়া পাশাপাশি কোঠার কথা স্পষ্ট শােনা যেত; ওপর ছোট ফোকর ছিল, আর দরজা তাে নেই। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে কোন অসুবিধা হতাে না। পাশের সেলে রঞ্জু ভাল গান গাইত। ঘুমুতে যাবার আগে তার গান শুনতাম। নিজেদের মধ্যে অনেক রসিকতা হতাে। প্রধান আলােচ্য বিষয় প্রায়ই খন্দকার। মােশতাক আর জিয়া। মােশতাকের একটা নাম দেওয়া হয়েছিল : মুষিক। নামকরণ খায়রুল কবির সাহেবের। আমরা গবেষণা করতাম কবে ‘পুনঃমুষিক ভব’ দেখতে পাব।
আমাদের ২৬ সেল এবং পার্শ্ববর্তী নিউ জেলের ব্যবধান মাঝখানে উচু প্রাচীর, ২০-২৫ ফুটের দূরত্ব মােটে। তবুও দেখা সাক্ষাৎ তেমন হতাে না। যদিও জেল প্রহরীদের মাধ্যমে খবরাখবর সব সময়ই পেতাম। জেলখানায় আমার কিছু অতিরিক্ত সুযােগ-সুবিধা ছিল। অবশ্য অলিখিত। দীর্ঘকাল মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম বিধায় জেলখানায় আমার যাতায়াত ছিল এবং আই.জি, ডি.আই.জি., জেলের সবাই চিনতেন আগে থাকে। জেলার শামসুল হক আমার প্রাক্তন ছাত্র। এদের সুবাদে জেলের সুবেদার এবং ওয়ার্ডেনরা বেশ ভাল ব্যবহার করতেন। অন্যদিকে উপরের নির্দেশ যাই থাকুক না কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকর্মী এবং বন্ধু-বান্ধবরা যথেষ্ট সুযােগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতেন। আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং আত্মীয় স্বজন প্রতি সপ্তাহে ২/৩ দিন দেখা করতে আসতেন। বাড়ি থেকে আমার জন্য প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর খাবার আসত। আমার সেলের নুরুদ্দীন সাহেব এবং অন্যান্যদের সাথে বাড়ির খাবার খেতাম।
ঘন ঘন জেল গেটে যাওয়ার ফলে নেতৃবৃন্দ এবং সহকর্মীদের অনেকের সাথে দেখা হতাে। খবরাখবর আদান-প্রদান হতাে। কামারুজ্জামান সাহেব, আবদুস সামাদ আজাদ, শেখ আবদুল আজিজ এদের সাথে কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ এবং মনসুর আলী সাহেবের সাথে দেখা হয় অন্যভাবে। ১৯৭৫-এর অক্টোবর মাসে পবিত্র ঈদ উপলক্ষে জেলের অভ্যন্তরে যাতায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। জেলের ভিতর ঈদের জামায়াতও অনুষ্ঠিত হয়। ঐ জামায়াতে প্রায় সকলের সাথে কুশল বিনিময় হয়। পরে আমরা কয়েকজন নিউ জেলে যাই বিশেষ করে নেতাদের সাথে দেখা করার জন্য। আমাকে দেখে চার নেতাই খুব খুশী হন। অনেক আলাপ-আলােচনা হয়। তাজউদ্দিন সাহেবকে বেশ আশাবাদী দেখতে পাই। বাইরের অনেকের সাথে তার যােগাযােগ ছিল। খন্দকার মােশতাক এবং তার অনুচরেরা যে বেশিদিন টিকতে পারবে না, তাতে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। আমার চোখের সামনে এখনও তাদের সেই বড় কামরাটার ছবি ভেসে ওঠে। চৌকির ওপর বসে আলাপ করেছিলাম। একসাথে জর্দা-ফিনিও খেয়েছিলাম। সৈয়দ নজরুল এবং মনসুর আলী সাহেব আমাকে তুমি সম্বােধন করতেন। তাজউদ্দিন সাহেব সব সময় ইমাম সাহেব ডাকতেন। এঁদের কণ্ঠস্বর এখনও কানে বাজে। সেই ঈদের দিনের দৃশ্য আর আলাপচারিতা এখনও এত স্পষ্ট মনে পড়ে। মনে হয় এইতাে সেদিন। এরপর আরও দুয়েকবার যােগাযােগ হয়েছে নেতাদের সাথে, যদিও সরাসরি আলাপ আর হয়নি।
অক্টোবরের শেষ দিকে জেলখানায় কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল। সকলেই বেশ উৎকণ্ঠিত; কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ঢাকা সেনানিবাসে অসন্তোষ এবং সেই কারণে মােশতাক গংসহ বেশ বিপদগ্রস্ত এবং চিন্তান্বিত। নিজেদের অবস্থান সংহত করতে তারা তৎপর। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের বিরােধীদের। নানা দিকে তাদের তৎপরতা। অপতৎপরতা বলাই ভাল। এই কারণেই তাদের সৃষ্টি ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলের দিকে যেখানে আছেন প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ যারা সরকার গঠন এবং পরিচালনা করতে পারেন। তাদের সাথে আছি আমরাও মুক্তিযােদ্ধা বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। কয়েকবার কানাঘুষা শুনতে পেলাম যে জেলখানায় অভ্যন্তরে কোন একটা গােলমাল বাধিয়ে দিয়ে পাগলাঘণ্টা বাজানাে হবে এবং সেই সুযােগে আমাদের ওপর হামলা হবে। পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দাগী, খুনী-আসামীদের দিয়ে জেলখানায় অনেক সময়েই বিশেষ ব্যক্তিদের আক্রমণ করা হয়। নৃশংসভাবে মারধাের করে পঙ্গু করে দেবার ঘটনা অনেক আছে। সুযােগ পেলে প্রাণে মেরে ফেলাও বিচিত্র নয়। অক্টোবরের শেষে এই আশঙ্কা আমাদের বেশ পেয়ে বসেছিল।
এই সময়েই জেলে বহিরাগতদের আনাগােনা শুরু হয় প্রতি রাতেই আমরা বেশ কয়েকজন আগন্তকের আসা-যাওয়ার আওয়াজ পেতাম। জেল প্রহরীদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম এরা কারা। মেজর ডালিমে নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কয়েকজন প্রতি রাতেই রেকি (reconaissance) করতে আসত। রাতের অন্ধকারে এদের আনাগােনা মােটেও গােপন ছিলনা। নেতারা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে কোথায় এবং কেমন আছেন সেটা জানার জন্য দিনের বেলাই প্রশস্ত সময়। তানা করে রাতের বেলায় কেন এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে জাগে। তাছাড়া ডালিম এবং তার সঙ্গের লােকদের রূঢ় ও উদ্ধত আচরণ তাদেরকে মােটেও প্রিয় করেনি জেলের কর্মচারীদের কাছে। কথায় কথায় অনেক গােপন তথ্যই তাই ফাঁস হয়ে যায় জেলখানায়।
জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, শেখ আবদুল আজিজ ও নিউ জেলের অন্যান্য বন্দীরা প্রায় সকলেই তাদের স্মৃতিচারণে ৩রা নভেম্বর-এর অনেক আগে থেকেই জেলখানার অভ্যন্তরে ফারুক-রশিদ-ডালিম বাহিনীর অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করেছেন। অতএব এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে জেল হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে ঘটেনি, এতে কোন আকস্মিকতাও ছিলনা। সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফলেই এটি ঘটেছে। খালেদ মােশাররফ ও শাফায়াত জামিলদের পাল্টা অভ্যুত্থান না হলে হয়ত এই হত্যাকাণ্ড দেরিতে হতাে, অন্য কোন দিনক্ষণ খুনীরা বেছে নিত। বিশেষ বিমানে হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়া, বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়, প্রচুর অর্থ (বৈদেশিক মুদ্রায়) এবং পরবর্তীকালে ব্যবসা-চাকরি ইত্যাদির ব্যবস্থাদৃষ্টে অনুমান করা যায় ষড়যন্ত্রকারীদের বিদেশী বন্ধুদের সাথে আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল কোন অবস্থায় তারা কোন পদক্ষেপ নেবে।
সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তৎকালীন আইজি (প্রিজনস) নুরুজ্জামান সাহেব ও ডিআইজি জনাব আওয়ালের যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা বিশ্বাসযােগ্য এবং প্রকৃত তথ্যই তুলে ধরেছেন। অবশ্য তারা উভয়েই ৩রা নভেম্বর ও পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি দিয়েছেন। পটভূমি সম্পর্কে কিছু বলেন নি অথবা ডালিমের জেলখানায় যাতায়াত সম্পর্কে কিছু জানাননি। যাই হােক হারিয়ে যাওয়া নথি খুঁজে পাওয়া, বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বিবৃতি, নানাবিধ তথ্য উদঘাটনের মাধ্যমে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকারীদের বিচার হবে, যথােপযুক্ত এবং দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হবে এমন একটা সম্ভাবনার আলাে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
২ তারিখ রাতে আমরা সবাই একটা কানাঘুষা এবং অস্বস্তির মধ্যে ঘুমাতে গেছি। মধ্য রাতের পর আমি ও নুরুদ্দীন ভাই আমাদের অভ্যাসমত জেগে উঠে ওজু করলাম। ফজরের নামাজের আগে আমরা দুজন তাহাজ্জদের নামাজ পড়তাম। তারই প্রস্তুতিস্বরূপ জায়নামাজে দাঁড়াব এমন সময় অনেকগুলি পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে পেলাম। বুটের আওয়াজ বােঝাই যায়। সঙ্গে বেশ উঁচু কণ্ঠস্বর। কিছুক্ষণ পরেই জেল গেটের পাগলা ঘন্টা এবং সাইরেন বেজে উঠল। ততক্ষণ আমাদের ২৬ সেলের সকলেই জেগে গেছেন। আমরা কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। এই বুঝি এখনই আমাদের ওপর চড়াও হবে।
এই রকম মানসিক অবস্থায় নিজেদের শান্ত করার জন্য এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা উদ্দেশ্যে আমরা দু’জনেই জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবাদতের মাধ্যমে মানসিক শক্তি সঞ্চয় অনেক সহজ।
ঠিক এই সময়টায় শেষ রাত্রে নিউ জেলের ভিতরে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনলাম কয়েকজন লােককে। তার পরই অকস্মাৎ কর্ণবিদারী গুলির আওয়াজ; এক সঙ্গে অনেক অটোমেটিক অস্ত্রের। প্রথমে মনে হলাে যেন মেশিন গান। পরে বুঝলাম সাব-মেশিনগান। আওয়াজের সাথে সাথে আমি নুরুদ্দীন ভাই ছিটকে চলে গেলাম দেওয়ালের এক পাশে অনেকটা যেন আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতেই। এত কাছে এবং এত প্রচণ্ড আওয়াজ যে মনে হচ্ছিল আমাদের সেলের অভ্যন্তরেই গুলি চলছে। (পরে সম্বিত ফিরে এল বুঝেছি যে সেলের লােহার গরাদ বন্ধ থাকলেও চারদিকেই লােহার শিক এবং খােলা। বাইরে থেকে পুরাে কুঠরির ভিতরেই গুলি চালানাে যায়)। যেমন অকস্মাৎ গুলির আওয়াজ আরম্ভ হয়েছিল তেমনই হঠাৎ করে থেমে গেল। ততক্ষণে আমাদের প্রত্যেক কামরাতেই গুঞ্জন। কোথায় গুলি হলাে? আমরা সকলেই স্থির নিশ্চিত যে নিউ জেলেই গুলি করে জঘন্যতম একটা হত্যাকাণ্ড ঘটনাে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর সিপাইরা ডিউটিতে এলে সকলে এক সাথে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলাম তাদের। নিউ জেলে সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে এটা তারা বলতে পারল কিন্তু কি হয়েছে এবং কারা নিহত হয়েছেন সেটা বলতে পারল না। চারদিক তখনও নিস্তব্ধ; যেন কবরস্থানের নিঃশব্দতা।
আস্তে আস্তে পূর্ব আকাশে আলাে দেখা গেল। উদীয়মান সূর্যের ছটা আকাশের লাল আলােতে মনে হলাে যেন পুরাে জেলখানাই রক্তের রং-এ লাল। আমাদের কুঠরিটা ছিল পূর্ব দিকের শেষ সেল। যত বড় গরাদ, সে কালের জমিদার বাড়ির সদর দরজার মত বিশাল আয়তন। পার্থক্য এই যে। তাতে লােহার বড় বড় লম্বা শিক আর বের হবার পথ নেই কেউ খুলে না। দিলে। এই পূর্ব দিকের গরাদের ফাক দিয়ে আমরা অনেকটা জায়গা দেখতে পেতাম। সূর্যোদয় এবং মুক্তনীল আকাশ ভিতর থেকে দেখা যেত। কোন খবর এলে বা সিপাইরা চলাফেরা করলে কথাও বলতে পারতাম। এছাড়া ভিতরে লম্বা বারান্দার সাথ লােহার অর্গল বন্ধ দরজা তাতে বিরাট তালা। ৩রা নভেম্বর ভাের বেলায় অকাশে দেখলাম বিমান বাহিনীর কয়টি জঙ্গী বিমান। মনে হলাে আকাশে শকুন। সে দিন সকালে নিত্য দিনের মত আমাদের দরজা খােলা হলাে না। কোন পত্রিকাও পেলাম না। সকলেরই চেহারা গম্ভীর। এত বড় ঘটনার মধ্যেও খাওয়াতে বন্ধ থাকতে পারে না। তাই আমাদের মেসের ম্যানেজার মওলানা খালেকের দরজা খুলে সিপাইরা
১৮০
নিয়ে গেল প্রধান কিচেনে, যেখান থেকে সকল বন্দি কয়েদীকে দৈনিক রেশন দেওয়া হয়। ঘণ্টা খানেক পরে উনি ফিরে এলেন রেশন নিয়ে আরেকটা সাংঘাতিক খবর। কেন্দ্রীয় রেশন ভাণ্ডারে ঐ দিন আমাদের চার প্রাণপ্রিয় নেতার রেশন বরাদ্দ নেই, নেই তাদের নাম জেলের তালিকায়।
৩ তারিখ সারাদিন আমরা সেলে আবদ্ধ। তালা খােলা হলাে না। নিহত নেতাদের লাশ সারাদিন পড়ে আছে। এর মধ্যেই শুনতে পেলাম কিভাবে বর্বর সৈন্যরা ফিরে এসে আহত নেতাদের বেয়নেট চার্জে ক্ষত বিক্ষত করে। গুলিতে মারাত্মক আহত হবার পরেও নজরুল ইসলাম সাহেব, কামারুজ্জামান সাহেব ও মনসুর আলী সাহেব কাতরাচ্ছিলেন। পাশের কামরায় অনেকেই ‘পানি পানি’, আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল সকলেরই। সেই অবস্থায় নির্মমভাবে মনসুর আলী সাহেবকে বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করা হয়।
আমরা সকলেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, ভয়-ভীতিতে নির্বাক। এই অবস্থায় নিউ জেলে নিহতদের পাশের কামরায় অবস্থানকারী বন্দীদের মানসিক অবস্থা কি হতে পারে তা অনুমান করতে পারছিলাম। এরাও সকলে আমাদের ঘনিষ্ঠ, আপনজন। আবদুস সামাদ আজাদ সাহেব, শেখ আবদুল আজিজ, খন্দকার আসাদুজ্জামান, মাহবুব প্রমুখ। ৩রা নভেম্বর সারাদিন এই অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে কাটল। এর মধ্যে শহরে মােটামুটি প্রচার হয়েছে যে জেলের অভ্যন্তরে মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটেছে। বন্দীদের সকলেরই আত্মীয়-স্বজন উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে জেল গেটে ভিড় করেছেন। খবর দিতে। কেউই দেখা করতে পারেননি। দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। আমার বাড়ি থেকে খবর নিতে এসেছিলেন মেজর মান্নান। একজন মুক্তিযােদ্ধা এবং বেশ সাহসী ও স্মার্ট। তিনি সরাসরি ডিআইজি-র সাথে কথা বলে আমার কুশল জেনে নেন। আমাদের অন্যান্য সঙ্গীসাথীদেরও খবর বাড়িতে পৌছে যায় এইভাবেই।
৫ই নভেম্বর সকালের দিকে খবর এলাে আমার সাক্ষাৎকারের অনুমতি এসেছে। জেলগেটে আমরা স্ত্রী ও ছেলে অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি গেলাম। সব খবর আদান-প্রদান করা গেল। ওরা চলে যাবার পর আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ডিআইজি আওয়াল সাহেবের কামরায় গেলাম প্রকৃত তথ্য। জানার জন্য। খুবই বিমর্ষ হয়ে বসেছিলেন। সেদিন তিনি আমাকে যে তথ্য দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে এই বর্ণনা দিয়েছেন বিভিন্ন অনুসন্ধানে, তদন্ত কমিটির কাছে এবং পত্র-পত্রিকায়।
এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, বঙ্গভবন থেকেই হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। হত্যাকারীরা জেলগেটে যাবার আগে মেজর রশিদ আইজি এবং ডিআইজিকে নির্দেশ দেয় গেট খুলে দেওয়ার জন্য। সেখানে পৌছে বাধাপ্রাপ্ত হলে ঘাতক মােসলেম ডিআইজি আওয়াল এবং আইজি জামান সাহেবকে বাধ্য করে বঙ্গভবনে টেলিফোন করতে। বঙ্গভবন থেকে সেদিন সুস্পষ্টভাবে খন্দকার মােশতাক নির্দেশ দেয় ‘ওরা যা করতে চায় করতে দিন’। এবং ওরা পরিষ্কারভাবে বলেছিল যে চার নেতাকে হত্যা করতে চায়। সে দিন যদি জেলের কর্মকর্তারা ঘাবড়ে না গিয়ে জেল গেট বন্ধ রাখতেন এবং ওদের প্রবেশে বাধা দিতেন তাহলে ঘটনা অন্য রকম হতে পারত। শুধু তাই নয় ৩রা নভেম্বর রাতেই মােশতাক গ্রেফতার হয় এবং খুনীরা দেশত্যাগ করে। জেলহত্যা ছিল তাদের মরণ কামড়। নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না তাতে কি হয়েছে? তাদের মুরুব্বিদের হুকুম তামিল করে বাঙ্গালী জাতিকে তাে নেতৃত্বহীন করা গেল।
কয়েকটি চিন্তা এই সাথে এসে যায়। খালেদ মােশাররফ ও তাদের সহযােগীরা কি জানতেন না যে তাদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে সাথেই জেলখানায় অবস্থানরত নেতাদের জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে? নেতাদের নিরাপত্তা বিধান করা কি তাদের এক নম্বর দায়িত্ব ছিল না? ৪ঠা নভেম্বর যখন নেতাদের লাশ তাদের বাড়িতে নেওয়া হলাে তখন তাদের পরিবারবর্গের সাথে কি আচরণ করা হয়েছিল?
অপর চিন্তা হলাে ৭ই নভেম্বরের পরবর্তী তথাকথিত “বিপ্লবী সরকারের কর্মকাণ্ডে। তারা কি নিহত নেতাদের প্রতি কোন শ্রদ্ধা জানিয়েছিল? বরং তাদের পরিবার-পরিজনদের সাথে যে অপমানজনক ব্যবহার করেছে তাতে এ কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তারা খুনীদেরই অন্য দল। সেদিন মন্ত্রী পরিষদ সচিব ছিল কট্টর পাকিস্তানী শফিউল আজম। স্বরাষ্ট্র সচিব ছিল পাকিস্তানের এজেন্ট সালাউদ্দিন আহমেদ। ইতােমধ্যে DFI, NSI, SB এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বসে গিয়েছে পাকিস্তানিরা। এদের উপদেশ ও পরামর্শ মতই সেদিন জেল হত্যার সমস্ত তথ্যানুসন্ধান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সমস্ত নথি গায়েব হয়ে যায়। যেভাবে খন্দকার মােশতাক Indemnity Ordinance পাশ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে, তেমনই জিয়াউর রহমানের সরকারও জেলহত্যার তদন্ত এবং বিচারও স্তব্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, ঐ সব অধ্যাদেশ পরবর্তীকালে সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়। ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা ছিল তাদের পরবর্তীকালের কার্যকলাপেই তা সুস্পষ্ট।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ বন্ধ করার মধ্যে দিয়ে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের একটি রূপরেখা তারা প্রণয়ন করে। এদিকে জাতীয় চার নেতার মৃতদেহ তখন পর্যন্ত কারাগারেই পড়ে ছিল অযত্নে অবহেলায়। শেষে তাদের স্বজনগণ এসে লাশ গ্রহণ করেন। এএইচএম কামারুজ্জামানের মৃতদেহ তার স্ত্রী জাহানারা কামারুজ্জামানের ইচ্ছায় রাজশাহীতে দাফন করা হলেও এম
মনসুর আলী; তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ বনানী কবর স্থানেই দাফন করা হয়।
আইজি ও ডিআইজি প্রিয়জনের প্রতিবেদন দুটো নিম্নরূপ :
আইজি প্রিজন নুরুজ্জামানের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভাের ৩ টায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশীদের একটি ফোন পাই, তিনি আমার কাছে জানতে চান ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কোন সমস্যা আছে নাকি। আমি জানালাম ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা আমরা জানা নেই। এরপর তিনি আমাকে জানালের কয়েকজন বন্দিকে জোর করে নিয়ে যেতে কয়েকজন সেনাসদস্য যেতে পারে। আমি যেন জেল গার্ডদের সতর্ক করে দেই। সে অনুযায়ী সেন্ট্রাল জেলে ফোন করি এবং জেলগেটে দায়িত্বে থাকা গার্ডদেরকে ম্যাসেজটি পৌছে দিতে বলি যাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ৩/৪ মিনিট পর বঙ্গভবন থেকে আরেকজন আর্মি অফিসারের ফোন পাই। তিনি জানতে চান আমি ইতিমধ্যেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গার্ডদের সতর্ক করে দিয়েছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দেবার পর তিনি আমাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য জেলগেটে চলে যেতে বলেন। আমি তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ডি আই জি প্রিজনকে ফোন করি। খবরটা জানিয়ে আমি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জেল গেটে চলে যেতে বলি। দেরি না করে আমিও জেলগেটে চলে যাই এবং ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া জেলারকে গার্ডদের সতর্ক করে দিতে বলি। এরই মধ্যে ডিআইজিও জেল গেটে পৌছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া খবরটি আমি আবার তাকে জানাই। এরপরই মেজর রশীদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক রিসালদার মােসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামান চার বন্দিকে যেন তাকে দেখানাে হয়। এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশীদের নির্দেশ বুঝাতে পেরেছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি তা পালন করার আদেশ দেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালাে পােষাক পরা রিসালদার মােসলেম জেলগেটে পৌছেন : ডিআইজি প্রিজনের অফিস কক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বে উল্লেখিত বন্দিদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে। আমি তাকে বলি বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে এবং ডিআইজি প্রিজন ফোনে প্রেসিডেন্টের যােগাযােগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। সে সময়ে জেলারের ফোন বঙ্গভবন থেকে মেজর রশীদের আর একটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশীদ জানতে চান সিরালদার মােসলেম সেখানে পৌঁছেছেন কি না। আমি ইতিবাচক জনাব দেই এবং তাকে কি ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। তখন মেজর রশীদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে রিসালদারের বন্দিদের গুলি করার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন সে যা বলেছে তাই হবে। তখন আমরা আরাে উত্তেজিত হয়ে যাই। রিসালদার মােসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময়ে উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তারে সেখানে যাবার নির্দেশ দেয় যেখানে উল্লিখিত বন্দিদের রাখা হয়েছে। রিসালদার মােসলেম ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মত লাগছিল এবং আমাদের কারাে তাদের আদেশ অমান্য করার উপায় ছিল না। তার নির্দেশ অনুযায়ী পুর্বোল্লেখিত ৪ জনকে অন্যদের থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়। সেখানে জেলার তাঁদের সনাক্ত করেন। রিসালদার মােসলেম ও তার বাহিনী তখন বন্দিদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বের আর একটি সেনাদল সবাই মারা গেছেন কি না তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে।
নুরুজ্জামান।
মহা-কারা পরিদর্শক
৫.১১.১৯৭৫
ডিআইজি প্রিজন খন্দকার আব্দুল আওয়ালের প্রতিবেদন
১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর তখন কর্তব্যরত ডিআইজি প্রিজন খন্দকার আব্দুল আওয়াল আই জি প্রিজন বরাবরে ঘটনার বিবরণ সম্মলিত যে বিস্তারিত রিপাের্ট পেশ করেন তার পূর্ণ বিবরণ এখান বর্ণনা করা গেল ।
আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, গত ২ নভেম্বর ১৯৭৫ দিবাগত রাত ৩ ঘটিকায় আমি আমার বাসভবনে অবস্থান কালে জেল ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে আমাকে জেলগেটে যাওয়ার নির্দেশ সম্বলিত একটি ম্যাসেজ পাইনি আরাে জানান বঙ্গভবন থেকে প্রাপ্ত নির্দেশের ভিত্তিতে তিনি নিজেও জেলগেট অভিমুখে রওনা দিচ্ছে। আমাকে আরাে বলা হয়, এই মর্মে রিপাের্ট পাওয়া গেছে, কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেল গেটে আসতে পারেন এবং জোরপূর্বক কয়েকজন বন্দিকে নিয়ে যেতে পারেন। মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে আমি জেলগেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এবং রাত ৩টা ২০ মিনিট নাগাদ সেখানে পৌছলাম । জেলগেটে গিয়ে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিস কক্ষে গেলাম। একটু পরেই জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল একটি টেলিফোন কল রিসিভ করলেন। আমাকে বলা হয় তারা বঙ্গভবন থেকে এসেছে। এখানে বলা যেতে পারে এই টেলিফোন সংলাপে ইন্সপেকটর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পােষণ করেন। স্পষ্টতই তার অনুরােধ মেনে নেয়া হয়েছিল। কেননা আমি তাকে স্যার সম্বােধন করতে এবং ছালাম দিতে শুনলাম। টেলিফোন আলাপ সেরে ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাকে বলা হয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড নিয়ে রিসালদার মােসলেম জেলে আসবেন এবং তাকে ভিতরে নিয়ে যেতে হবে। তিনি যা করতে চান তাকে তাই করতে দিতে হবে এবং বন্দি সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনুসর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামান কারা তাকে তা চিনিয়ে দিতে হবে। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর জেনারেল বঙ্গভবন থেকে আর একটি টেলিফোন মেসেজ রিসিভ করলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল সব গার্ডকে ঠিকমত সতর্ক করা হয়েছে কি না। তিনি হ্যা বােধক উত্তর দিলেন এবং অতঃপর কর্মকর্তাসহ অন্যান্য স্টাফদের খুবই সমর্থক ও অতন্দ্র থাকার নির্দেশ দিলেন। ইন্সপেক্টরে জেনারেলের এ নির্দেশ পালন করা হলে কিছুক্ষণ পর স্টেনগান, এস এল আর ইত্যাদি সুসজ্জিত ৪ জন সশস্ত্র কর্মকর্তা সহযােগে ভীতিকর ভঙ্গিতে রিসালদার মােসলেম আমার অফিস কক্ষে এলেন এবং জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। নুরুজ্জামান কি না। তিনি হ্যা বােধক উত্তর দিলেন। এরপর তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করলেন কি করতে হবে? আমাদের ভয়ানক আতংকিত করে তিনি বললেন-তার কাছে পূর্বে যে ক’জনের নাম বলা হয়েছে তিনি তাদের গুলি করবেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন যে, তিনি পূর্বে এ জাতীয় কোন নির্দেশ পাননি এবং তাকে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলে নিতে হবে। আমার অফিসের টেলিফোনে কয়েকবার যােগাযােগের চেষ্টা করা হল কিন্তু গােলযােগের কারণে কথা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জানানাে হল যে জেলারের অফিসের টেলিফোন সেটে তার নামে বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন এসেছে। তিনি ফোন করার জন্য রওনা হলেন। আমি তাকে ফলাে করলাম। পেছন পেছন চললাে
১৮৫
সামরিক কর্মকর্তারা। টেলিফোনে তাকে বলতে শুনলাম-রিসালদার মােসলেম তাদের গুলি করবেন বলে বলেছেন। এরপর ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন রেখে দিলেন। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। রিসালদার মােসলেম তখন বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আমাদের তক্ষুনি পূর্বোক্ত বন্দিরা যেখানে আটক রয়েছে সেখানে যাওয়ার হুকুম দিলেন। | নির্দেশ মাফিক সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল রওনা হলেন। আমি জেলার ও অন্যান্য নির্বাহী স্টাফের সঙ্গে চললাম। পথিমধ্যে আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানালাম। রিসালদার হুমকির সুরে জিজ্ঞেস করলেন আপনি ভয় পাচ্ছেন? আমি বললাম, ভয়ের প্রশ্ন আসছে না, আমার ৩২ বছরের চাকরি জীবনে আমি এ জাতীয় ঘটনার কথা শুনিনি। তিনি ক্রোধান্বিত হলেন এবং একজন সামরিক কর্মকর্তা আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে চলে যেতে বললেন। এতে ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন না উনি থাকবেন। আতংক ছড়িয়ে দেয়া চোখে রিসালদার আমার দিকে তাকালেন। ইতিমধ্যে রিসালদার মােসলেমের নির্দেশে জেলার এবং অন্যান্য কয়েকজন নির্বাহী স্টাফ মিলে সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে অন্যান্য বন্দিদের থেকে আলাদা করলেন। তাদেরকে একটা ওয়ার্ডে জড়াে করা হল এবং ওয়ার্ডের অন্যান্য সদস্যদের সরিয়ে নেয়া হল। ইতিমধ্যে রিসালদার এ জাতীয় বিলম্বে বেশ কয়েকবার বিরক্তি প্রকাশ করে বলছিলেন শেখ মুজিবকে খতম করতে তার সময় মাত্র তিন মিনিট লেগেছিল। যখন তাদের জানানাে হল ৪ জন বন্দিকে একটি কক্ষে আনা হয়েছে। রিসালদার মােসলেম আর তার দল তাৎক্ষণিকভাবে সেইখানে রওনা হলেন। যে ওয়ার্ডে উক্ত বন্দিদের আটকে রাখা হয়েছে সেখানে চল্লিশ গজ দূরে আমি আর জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল দাঁড়িয়ে রইলাম। অচিরেই আমাদের কানে গুলি করার অবিরাম শব্দ ভেসে এলাে। তারা ফিরে এলেন আর তড়িঘড়ি জেলগেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরা তাদের অনুসরণ করলাম। রেকর্ড অনুসারে রিসালদার মােসলেম আর তার দল জেলগেটে ঢুকেছে ভাের ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে সশস্ত্র কর্মকর্তাদের আর একটি দল এলাে এবং গুলি করার জায়গাটা পরিদর্শন করে ভিকটিমদের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইল। তাদের নির্দেশও পালন করা হল। যেহেতু সে সময় আমি আমার অফিস কক্ষে ফজরের নামাজ পড়ছিলাম, আমি সেই দলটিকে স্বচক্ষে দেখিনি। নামাজ শেষ করে আমি ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে এ তথ্য পেলাম। তিনি তখনও তার অফিস কক্ষে ছিলেন। দলটি তাদের পরিদর্শন কথা শুনিনি। ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে এ তথ্য পেলাম। তিনি তখনও তার অফিস কক্ষে ছিলেন। দলটি তাদের পরিদর্শন শেষে ৫টা ৩৫ মিনিট জেল থেকে চলে যায়। এ দলটিও মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করেছিল বলে জানতে পারি। জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল ভাের ৫টা ৪৫ মিনিটে জেল ত্যাগ করেন এবং আমি ৭টা ৪০ মিনিটে আমার অফিস কক্ষ ত্যাগ করি। আমি আবার অফিসে ফিরে আসি ৯টা ৪০ মিনিটে। অফিসে এসে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে ফোন করি এবং মৃতদেহগুলি সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করতে অনুরােধ করেন। আমি তাকে অনুরােধ করি যাতে তিনি নিজেই মেজরের সাথে যােগাযােগ করেন। কিন্তু তিনি এ কাজটা আমাকেই করতে বলেন। আমার কিছু মন্তব্যের কারণে মােসলেমের বিরক্তভাজন হয়েছি বলে আমার ভয় ভয় করছিল। সকাল ১০টায় তবু আমি মেজর রশীদের সাথে ফোনে যােগাযােগ করলাম এবং মৃতদেহগুলাে কিভাবে সরানাে হবে তা জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে পুরােপুরি নিরব থাকতে বললেন এবং মৃতদেহগুলাে যেভাবে রয়েছে। সেভাবেই রাখার নির্দেশ দিলেন। ঐদিন দুপুর দুটোর দিকে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের অফিসে ঢুকে এ ঘটনায় আমাদের কি কি করণীয় তা পর্যালােচনা করলাম খানিকক্ষণ আলােচনার পর আমরা বিষয়টা সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রিপাের্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিকেলে আমরা সচিবের দপ্তরে গেলাম , এবং পুরাে ঘটনা তাকে জানালাম।
মৃতদেহগুলাে সরানাের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনরূপ নির্দেশের অভাব যেখানে হত্যা করা হয়েছে লাশগুলাে ৪ নভেম্বর ৭৫ সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সেখানে সেভাবেই পড়ে রইল। ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের তরফ থেকে নির্দেশ পাওয়া গেল। অচিরেই লাশগুলাের সুরতহাল সম্পর্কিত রিপাের্ট এবং দ্রুত ময়না তদন্তে র রিপাের্ট তৈরি করার ব্যবস্থা করতে বলা হল। নিহতদের পরিবার যাতে লাশগুলাে ফেরত পায় এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছি এবং ম্যাজিষ্ট্রেট ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে। পুলিশের ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ, এডিসি (জেনারেল) এবং বিপুল সংখ্যক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ঐ দিন রাত ১১টা পর্যন্ত জেলে থেকে ছে। ৪ নভেম্বর রাতে এই চার নেতার লাশ জেলগেটে তাদের আত্মীয়স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয় এবং প্রয়ােজনীয় পুলিশ প্রহরায় পুলিশের
ট্রাকে করে তাদের বাসায় লাশ পৌছে দেয়া হয়। এএইচএম কামারুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীর লাশ ৫ নভেম্বর ভােরে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা যেভাবে চেয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেভাবেই প্রহরা এবং গাড়ি দিয়ে লাশ বাসায় পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে।
কে এ আওয়াল
ডিআইজি প্রিজন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চারস্তম্ভ মহান এই চারনেতার জীবনাবসান হলাে নির্মমভাবে। রাতের অন্ধকারে জেলখানার অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যসন্তানদের এভাবেই হত্যা করে জাতির জীবনে আবারাে নেমে এলাে স্বৈরশাসনের এক অন্ধকার অধ্যায়। অন্ধকারশক্তির উত্থান হলাে—সংবিধান, সংস্কৃতি, রাজনীতি, রাজনীতির ওপর পাকিস্তানি প্রেতাত্মার কালাে ছায়া আবারাে বিস্তৃত হতে থাকলাে।
Reference: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন, pp. 173-188