You dont have javascript enabled! Please enable it!

রক্তঝরা সংগ্রামের পথে স্বাধীন বাঙলা
বিবেকানন্দ মুখােপাধ্যায়

গত ২৬ মার্চ শুক্রবার সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করিয়াছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১০/১১ দিন ধরিয়া ঢাকা শহরে শেখ মুজিবর ও আওয়ামী লীগের সংঙ্গে আপােস মীমাংসার নাম করিয়া দলে দলে পশ্চিম থেকে সৈন্য ও সমরসম্ভার আনাইতেছিলেন এবং এই সামরিক শক্তি (তিন ডিভিসন বা ৬০ হাজার সৈন্য) গড়িয়া তােলার পর ইয়াহিয়া ও তাঁর সহচর ভুট্টো বিমানযােগে রাত্রিবেলা পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়া পড়িয়াছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙলাদেশের ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িয়াছে-সাত কোটি বাঙালির রক্তপানের জন্ম। ঘটনাটা স্মরণ করাইয়া দিবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটি কলঙ্ককাহিনিকে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজধানী ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও মি. কর্ডেল হামের সঙ্গে টোকিও থেকে প্রেরিত বিশেষ দূত মি. কুরােসে ও আমেরিকার মধ্যে বিরােধের বিষয়গুলাে মীমাংসার জন্য যখন আলােচনা চালিয়েযেতেছিলেন, তখন হঠাৎ ৭ ডিসেম্বর শেষ রাতে জাপানী বিমানবহর ও নৌবহর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের বিখ্যাত মার্কিন নৌঘাটি পার্ল হারবারের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিইয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, এই আকস্মিক আক্রমণে মার্কিন নৌঘাটির প্রচণ্ড ক্ষতি হইয়াছিল। কূটনৈতিক আচরণের ইতিহাসে এই ঘটনা জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতারূপে চিহ্নিত হইয়া আছে। এবার মার্চ মাসে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নির্বাচনে জয়ী এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের সর্বজনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলােচনার নাম করিয়া যে জঘন্য আচরণ করিয়াছেন, তা ১৯৪১ সালের জাপানীদের বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গেই তুলনীয়। অথচ এই ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ ও রক্তঝরা লড়াই ডাকিয়া আনার কোনই প্রয়ােজন ছিল না। কারণ, কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের আইনসভার নিরঙ্কুশ মেজরিটির অধিকারী এবং পূর্ব বাঙলার বিধানসভায় অবিসম্বাদী নেতা শেখ মুজিবর রহমানের হাতে যদি পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারি ক্ষমতা তুলিয়া দেওয়া হইত এবং গণ-পরিষদের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্ম নতুন সংবিধান রচনার সুযােগ দেওয়া হইত, তবে এই রক্তারক্তি এবং এই গৃহযুদ্ধের কোনই কোনই প্রয়ােজন হইত না। অবশ্য বাঙলাদেশের স্বাতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করতেই হইবে। কারণ, গত ২২ বছর ধরিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক অত্যাচার এবং পাঞ্জাবী শাসন, শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে এটাই ছিল পূর্ব বাঙলার সাত কোটি মানুষের মুল দাবি। কিন্তু এই দাবি শান্তিপূর্ণ ভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বীকার করিয়া নিলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাঙলার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিত না। কারণ, আওয়ামী লীগ ও মুজিবর রহমান কেন্দ্রীয় পাক সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা- এই তিনটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় ছাড়িয়া দিতেই রাজী ছিলেন। বাকি সমস্ত ক্ষমতা অবশ্য বাঙলাদেশের হাতে হস্তান্তর করিতে হইত। এটা অসশ্যই কোন অসম্ভব, অবাস্তব বা অযৌক্তিক দাবি ছিল না। জাতি গােষ্ঠি হিসাবে বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানিদের তুলনায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ভাষা, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বৈদেশিক ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত্বের বিচারে পূর্ব বাঙলার বাঙালিদের সঙ্গে পাঞ্জাবী, সিদ্ধ বা পাঠান প্রভৃতির কোন মিল নাই। একমতে ইসলাম ধর্মের মিল ছাড়া, আর কোন মিলের সন্ধান পাওয়া যায়।
কিন্তু সেই হিসাবে মালয় উপদ্বীপের বাসিন্দারা তাে মুসলমান, তারা কি তবে পাকিস্তানি বলিয়া অভিহত হইবেন? তারপর পাকিস্তান এক আজব রাষ্ট্র, কারণ, এর এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের কোন যােগ নাই। করাচীর সঙ্গে ঢাকার অন্তত: হাজার মাইলের তফাৎ। অর্থাৎ মাঝখানে বিরাট ফাঁক। ভৌগােলিক বিচারে পৃথিবীতে এমন আজগুবী রাষ্ট্র আর তথাপি গত ২০/২২ বছর ধরিয়া একটা গণতান্ত্রিক ও মানবিক শাসন প্রবর্তনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে প্রভুত জন-আন্দোলন অনুষ্ঠিত হইয়াছে কেন্দ্রীয় শাসনের নামে পাঞ্জাবী অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অজস্র মানুষ নানাভাবে অপরিসীম নির্যাতন বরণ করিয়াছেন এবং গুলীতে ও অত্যাচারে প্রাণ হারাইয়াছেন বহু মানুষ মাতৃভাষা বাঙলাকে কেন্দ্র করিয়া যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে প্রথম যে জাগরণের জোয়ার আনিয়াছিল, সেই জোয়ার সারা পূর্ব বাঙলায় সমগ্র সমাজ জীবনকে প্লাবিত করিয়াছে এবং এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণই বাঙালিকে স্বাধীনতা ঘােষণার পথে নিয়া গিয়াছে। কেন? কারণ, পার্টিশানের ফলে নীতি হিসাবে বাঙালির নিজস্ব সত্তা নষ্ট হইতে বসিয়াছিল। তার জীবন ও জাতীয়তা একেবরে পঙ্গু হইয়া গিয়াছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বগ্রাসী প্রভুত্ব বাঙালির জাতীয় সত্তার টুটি চাপিয়া ধরিয়াছিল। এই লৌহ মুষ্টির পাষাণরূপ বাঙালি বাঁচিয়া থাকিতে পারিত না। সুতরাং আত্মরক্ষার স্বাভাবিক তাগিদেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাকে প্রত্যাঘাত হানিতে হইয়াছে। অথচ আইনের দিক থেকে বিচার করিলে দেখা যাবে যে, পূর্ব বাঙলার অধিবাসীরা সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি-মােট ১২ কোটি ৩০ লক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানেও চারটি অংশে বিভক্ত- পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। কিন্তু মেজরিটির অংশ পূর্ববঙ্গ এক ও অবিচ্ছিন্ন। সুতরাং আইনের দিক থেকে প্রশ্ন উঠিতেছে মেজরিটি কি মাইনরিটির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হইতেছে, কিংবা মাইনরিটিই সরিয়া যাইতেছে? – যেমন একদা মুসলিম প্রসঙ্গেই আবার প্রশ্ন উঠিতে পারে সদ্য স্বাধীন বাঙলাদেশে পাকিস্তানি শত্রুরা যে গণহত্যা চালাইতেছে তা প্রতিরােধ করিবার জন্য ভারত সরকার অগ্রসর হইবেন না কেন? আন্তর্জাতিক আইনেই বিধান আছে যে, কোনাে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে যদি অমানুষিক গণহত্যা চলিতে থাকে তবে মানবতার খাতিরে সেই বর্বরতা বন্ধ করিবার জন্য উপদ্রবকারী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা অবলম্বন করা যাইতে পারে। ইসলামাবাদের হিংস্র ফ্যাসিস্ট শক্তি পূর্ব বাঙলায় ক্রুর বীভৎসতায় মাতিয়াছে। ট্যাঙ্ক, বন্দুক, মেশিনগান, রকেট ও বােমা, অর্থাৎ আধুনিক মারণাস্ত্রের দ্বারা প্রায় নিরস্ত্র একটি স্বাধীনতাকামী জাতিকে সাবাড় করিতে উদ্যত হইয়াছে। সুতরাং ভারতবাসীকে, বিশেষভাবে পশ্চিম বাঙলার চার কোটি মানুষকে এর প্রতিবিধানের জন্য অগ্রসর হইতে হইবে। বাঙলাদেশের বিপন্ন মানুষকে ডাক দিয়া বলিতে হইবে- “আমরা আছি, তােমাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য তৈয়ার হয়ে আছি। তােমাদের জন্য অস্ত্র, গােলা, বারুদ এবং অন্যান্য সমর সম্ভার পাঠাচ্ছি।” | আইন কানুনের আক্ষরিক নিয়মের জন্য আমাদের সাহায্য ও সহযােগিতা যেন আটকা পড়িয়া না থাকে। কারণ, স্বাধীনতা ও বৈপ্লবিক যুদ্ধ প্রচলিত আইনকানুন ধরিয়া চলে না। আর অনুমান করিতেছি বাঙলাদেশের এই যুদ্ধ চলিবে দীর্ঘকাল। যদিও প্রচলিত এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক অর্থে একে ‘গৃহযুদ্ধ – বা সিভিল ওয়ার, বলিয়া বর্ণনা করা হইতেছে, প্রকৃত পক্ষে এটা গৃহযুদ্ধ নয়। কেননা, বাঙলা রাষ্ট্রের নিজেদের মধ্যে এই লড়াই নয়- এই লড়াই বহিরাগত শত্রুর বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে। সুতরাং এটা একান্তরূপে এবং নিশ্চিতরূপেই স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিঃসন্দেহে শত্রুপক্ষ অত্যন্ত বলশালী, তার মডার্ণ দ্বিতীয়টি নাই। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের মর্যাদা ও প্রভুত্ব দাবি করা হয়, সেখানে অন্ততঃ বাষ্ট্রের ভৌমিক অখণ্ডতা বজায় থাকে। পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্রে তাই আছে। সুতরাং এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম এই প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্ট পাঁচ পাওয়ালা জন্তুর মতাে, বাস্তব ক্ষেত্রে তা বেশি দিন টিকতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান পশ্চিম এশিয়াই সীমান্তবর্তী এবং পূর্ব বাঙলা কার্যত পূর্ব এশিয়ার সীমানার মুখে দণ্ডায়মান। অতএব, এই দুই বিপরীত অংশের মধ্যে কোন স্থায়ী রাষ্ট্রীক বন্ধন গড়িয়া উঠিতে পারে না – বিশেষত: যেখানে এই বন্ধন ঔপনিবেশিক পরাধীনতার নামান্তর মাত্র। লীগের পাল্লায় পড়িয়া মাইনরিটি মুসলমানেরা মেজরিটি হিন্দু ভারত থেকে আলাদা হইয়া গিয়াছিলেন? তারপর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান যখন ভারতবর্ষ থেকে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হইয়াছিল, তখন আইন ও সংবিধানের মাধ্যমেই তা করা হইয়াছিল। পাকিস্তানি সৈন্য বা মিলিটারির কোনাে ভূমিকা তাতে ছিল না। পরলােকগত জিন্না এবং মুস নে গণতান্তিক সুশাসন প্রবর্তনে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। সুতরাং আজ যে মিলিটারি দৈত্যের দাপাদাপি চলিতেছে পাকিস্তানে সেই মিলিটারি রাজকে ভারত সরকার বিধিসঙ্গত বলিয়া মানিয়া নিবেন কেন? এই আর্মি ও মডার্ণ অস্ত্রশস্ত্র রহিয়াছে এবং সে সুসজ্জিত। আর বাঙলাদেশের বাঙালিরা প্রায় নিরস্ত্র, অতএব এটা অসম যুদ্ধ সন্দেহ নাই। কিন্তু সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের কাছে পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ত আক্রমণ একদিন পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হইবে। আর এই লড়াই চলিবে গেরিলা কায়দায়-নদী নালা-খালবিল ও বনজঙ্গলের দেশ পূর্ববঙ্গ, নতুন বাঙলাদেশ, যেটা বিপ্লবী সূর্য সেনের দেশ নামে খ্যাত, পূর্ব বাঙলার চট্টগ্রামের সেই বিপ্লবী ঐতিহ্য- যেখানে ব্রিটিশপক্ষ ছিল প্রবলতম, আর সূর্য সেনের দলে ছিল মুষ্টিমেয় সশস্ত্র যুবক, তবু তারা সেদিন সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন-এই মহিমামণ্ডিত দৃষ্টান্ত এবং আত্মােৎসর্গকারী শহিদদের পুণ্যস্মৃতি আজিকার বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ নওজোয়ানকে অনুপ্রাণিত করিবে।
স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে সােভিয়েত রাশিয়া সাহায্য দিয়েছিলেন। ইদানীং ইস্রায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে সংযুক্ত আরব রাজ্যকে সােভিয়েত গভর্নমেন্ট উদার হস্তে মিলিটারি সাহায্য দিয়েছেন এবং এই পর্যন্ত অনেক দুর্গত জাতিকে তারা সহায়তা করিয়াছেন। কমিউনিজমের এই মহৎ আদর্শ দেশদেশান্তরে গভীর রেখাপাত করিয়াছে। কিন্তু আজ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সােভিয়েত রাশিয়া কি উদাসিন থাকিবেন? তারা কি তাদের বিপুল শক্তি ও মানবিক আদর্শের সম্পদ নিয়া সাত কোটি বিপন্ন। মানুষের মুক্তির জন্য আগাইয়া আসিবেন না? – এই প্রশ্ন আজ সর্বাগ্রে। কারণ, আমেরিকা ও চীনের নিকট আমরা এটা প্রত্যাশা করি না। কারণ, তারা ইসলামাবাদের ক্রুর ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ইয়াহিয়া খানের নগ্ন মিলিটারি-জুন্তাকেই পৃষ্ঠপােষকতা করিতেছেন। সুতরাং আমাদের দৃষ্টি যেমন ভারত সরকারের দিকে, তেমনি সােভিয়েত রাশিয়ার দিকে-বাইরের সাহায্য ছাড়া একক নিরস্ত্র বাঙলাদেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল এই সংগ্রাম চালানাে কঠিন।

সূত্র: সপ্তাহ, ২ এপ্রিল, ১৯৭১

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!