ব্রিটিশ বাংলার ছাত্ররাজনীতি থেকে দেশবিভাগােত্তর আইন পরিষদের সদস্যপদ লাভ এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিসংগ্রামে এএইচএম কামারুজ্জামান (১৯৪২-১৯৭০)
এএইচএম কামারুজ্জামান জন্মসূত্রে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। সচেতনভাবেই পুরুষানুক্রমিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছেন। উপরন্তু সমকালটি এমনই অগ্নিগর্ভ ছিল যে, তিনি ইচ্ছে করলেও রাজনীতিবিমুখ থাকতে পারতেন না। শৈশবকালে পরিবারে দেখেছেন বড় বড় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমাগম। দেখেছেন রাজশাহীতে পিতামহ ও পিতার রাজনৈতিক ভূমিকা। গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে পূর্ববঙ্গে মুসলিম জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার ও শেরে বাংলা ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ভূমিকা তকালীন মুসলিম যুবমানসে চেতনাসঞ্চারী প্রেরণা যুগিয়েছিল। অপরদিকে, কলকাতাকেন্দ্রিক ব্রিটিশবিরােধী রাজনীতির তরঙ্গ সরাসরি রাজশাহীতেও পড়তাে। ফলে, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক তৎপরতা এখানে অব্যাহত ছিল। সেই উনিশ শতকের ফকির ও সন্ন্যাসীবিদ্রোহ থেকে শুরু করে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজশাহীর সম্পৃক্ততার ইতিহাস সুবিদিত।১ ব্রিটিশবিরােধী সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজশাহী শহরের জনগণের ভূমিকা মূল্যায়ন করে মন্তব্য করা হয়েছে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতাে রাজশাহীতেও এই আন্দোলনের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্য কথায় ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে প্রথম থেকেই রাজশাহীবাসী তৎপর থেকে সংগ্রামের গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল।২ এই শহরে ১৯০৯ সালে বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতি গঠন এবং রাজশাহী কলেজকে কেন্দ্র করে যুবশক্তির সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ঐতিহ্য ছিল উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ১৯০৯ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী কলেজকে কেন্দ্র করে অনুশীলন সমিতি সারা দেশে সহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এই আন্দোলনের মাত্রা ছিল সুতীব্র।৩ অনুশীলন সমিতির পাশাপাশি এই একই সময়ে মুসলিম যুব-মানসেও একদিকে যেমন ছিল ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সমর্থন তেমনি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমের জন্য গভীরতম আকাঙ্ক্ষা। ১৯০৬ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ও নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে রাজশাহীর স্থানীয় মুসলিমগণ কলকাতার আধিপত্যের বাইরে অবস্থানপূর্বক নিজেদের অবস্থার উন্নতির ক্ষীণ হলেও আশা পােষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা, স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলনে মুসলিম-বিরােধিতা, রাজশাহীর মুসলমানদের মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আসতে উৎসাহিত করে।৪ ফলে পূর্বে কংগ্রেসরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রাজশাহী অঞ্চলের অনেক মুসলিম জনগণ ও নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগে যােগদান করেন।৫ এই প্রসঙ্গে রাজশাহীর অবস্থান পর্যালােচনা করে গবেষক বলেছেন—১৯৪০-এর দশকে পাকিস্তান আন্দোলন রাজশাহীর যুবসমাজের মধ্যেও খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে ও গতিশীল হয়ে ওঠে।৬
এই ধরনের ঐতিহাসিক পটভূমিতে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান এএইচএম কামারুজ্জামান অবস্থান করছেন চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে মাধ্যমিকের ছাত্র হিসেবে। তিনি ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। সেই সময় রাজশাহীর মত চট্টগ্রামও ছিল ব্রিটিশবিরােধী এক অগ্নিগর্ভ নগর। চল্লিশের দশকে চট্টগ্রাম নগরীর রাজনৈতিক পরিস্থির একটি বিবরণে পাওয়া যায়,
চট্টগ্রাম বিদ্রোহের প্রধান স্থপতি সূর্যসেন ও একদল তরুণ। বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন স্কুল-কলেজের ছাত্র। ছাত্রদের বিদ্রোহ কোন ফ্যাশন ছিল না। এক সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতিতে তারা জীবনের সুখ আরাম বিসর্জন দিয়ে পথে নেমেছিলেন। যুব বিদ্রোহের কর্মীদের স্মৃতি ও মূল্যায়ন থেকে দেখি, তারুণ্যে ভরপুর এসব যুবক অস্ত্র পেলেই ঝাপিয়ে পড়বাে এমন চিন্তার অনুসারী ছিলেন না। লক্ষ্যে পৌছবার পশ্চাতে ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং সাংগঠনিক তৎপরতা। ৭
চট্টগ্রামের ঐ বিপ্লবী প্রহরের তরঙ্গ দীর্ঘদিন ছাত্রদের মনে ছিল। কামারুজ্জামান সেই তরঙ্গায়িত সময়ে বড় হয়েছেন। তবে সরাসরি সাংগঠনিকভাবে রাজনীতিতে কামারুজ্জামানের অভিষেক ঘটে রাজশাহী কলেজেই। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর ঐ বছরই রাজশাহী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ঐসময় রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ (১৯৪১-১৯৪৫) ছিলেন ড. স্নেহময় দত্ত। অধ্যক্ষ ছিলেন অত্যন্ত ছাত্রবান্ধব ও প্রগতিমনস্ক। তিনিও ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করতেন না। তবে ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শিক্ষা উন্নয়নমূলক সার্জেন্ট রিপাের্ট পেশ হয় এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম ভাষা বিশেষত মাতৃভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি এবং শরীরচর্চাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষার বুনিয়াদ হিসেবে সার্জেন্ট রিপাের্টের এই প্রভাব পড়ে সমস্ত শিক্ষা স্তরেই। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই ছাত্ররাজনীতির দিকটি বিকশিত হতে থাকে। এই সময়ই ১৯৪৪ সালে রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালে এএইচএম কামারুজ্জামানও ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন। কারণ তাদের কাছে ছাত্রজীবন শুধু ব্যক্তিগত জীবনই ছিল না, লক্ষ্য ছিল স্বদেশ সত্তার সঙ্গে যুক্ত করে নিজেদের জীবনকে গড়ে তােলা ও বিকশিত করা। স্বভাবতই উপমহাদেশের রাজনৈতিক এই পর্বে একজন আদর্শবাদী মুসলিম ছাত্র হিসেবে তিনি ১৯৪২ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজশাহী কলেজে তখনও অনুশীলন সমিতি ও সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠনের তৎপরতা ছিল। তথাপি একটি অভিন্ন লক্ষ্য স্থির করার জন্য তিনি ছাত্রদের মধ্যে কতকগুলাে আদর্শ প্রচার করেন। সেই আদর্শের মূল লক্ষ্যই ছিল ব্রিটিশ-শাসনের অবসান ও স্বাধীনতা অর্জন। কামারুজ্জামান মূলত তার এই রাজনৈতিক দীক্ষা পেয়েছিলেন পিতা আবদুল হামিদের কাছেই। কারণ, তার পিতা ও পিতামহ দুজনই ছিলেন রাজশাহীতে উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ। মুসলিম লীগের রাজনীতি করলেও সাম্প্রদায়িকতাকে তার পিতা স্থান দিতেন না। সেই আদর্শ ছিল তার পুত্র কামারুজ্জামানের মধ্যেও। ১৯৪২ সাল উপমহাদেশের রাজনীতিতে আরাে একটি কারণে বিখ্যাত যে, এই সময় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু প্রমুখ ব্রিটিশের সঙ্গে ক্রিপস মিশনের মাধ্যমে ভারতীয় স্বাধীনতার দাবির পক্ষে একটি প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে ‘ভারত ছাড়াে আন্দোলন যুগপৎ রূপ পায়। কাজেই কামারুজ্জামান যখন নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম লীগ রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন তখনই রাজনীতির একটি জটিল বাতাবরণ সৃষ্টি হয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটেই তিনি ছাত্র-যুবশক্তিকে অধিকার সচেতন, স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবােধের প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তােলেন। রাজশাহী কলেজে ১৯৪২ সালে তিনি নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ১৯৪৩-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সহ-সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। গড়ে তােলেন ছাত্র-রাজনীতির ঐক্য ও সংঘশক্তিও। বস্তুত, রাজশাহী কলেজেই আনুষ্ঠানিকভাবে তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিষেক ঘটে। তিনি ছাত্ররাজনীতির এক আদর্শ স্থানীয় প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।৮
১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণের পর কামারুজ্জামান সেই বছরই কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেই সময় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের প্রধান পুরুষ এবং হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দী-স্নেহধন্য শেখ মুজিবুর রহমানই নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন কালে এএইচএম কামারুজ্জামান রাজনীতিতে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন তার সুস্পষ্ট তথ্য উপাত্ত জানা যায় না। তবে তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকলেও জেলা শাখা রাজশাহীর সভাপতি ছিলেন ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।৯
১৯৪৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হলে তিনি পুনরায় রাজশাহীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই পর্বেই কামারুজ্জামানের রাজনৈতিক জীবনের একটি চূড়ান্ত পর্ব সূচিত হয়। বিষয়টি লক্ষণীয়, ১৯৪৬ সালে তার ছাত্রজীবনের সমাপ্তি এবং ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ ও ব্রিটিশ-শাসনের অবসান হয়। কামারুজ্জামানের রাজনীতি শেষ নয়, এটাই তার সূচনাপর্ব। প্রখ্যাত আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামী John Curran একসময় CIRCOR, Eternal vigilance is the Price of Liberty qelift কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে অধিক সত্য। দেশবিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরই বাংলার জাগ্রত জনতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বুঝলেন—’এ আজাদী ঝুটা’ মিথ্যে এই স্বাধীনতা। এই মিথ্যে স্বাধীনতা থেকে সত্যিকার স্বাধীনতার দিকে শুরু হয় অগ্রযাত্রা। এই অগ্রযাত্রায় কামারুজ্জামান ধীরে ধীরে বাংলার মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নিয়ামক নেতৃত্বের সারিতে উঠে আসেন।
পূর্বোক্ত অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে, তিনি স্থানীয় নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি রূপে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় তার শিক্ষাজীবন। ১৯৫৬ সালেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। বলাই বাহুল্য, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। তবে ১৯৫১ সালে রাজশাহীতে জেলা কমিটি গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু। এই সময় রাজশাহীর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন ক্যাপ্টেন শামসুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মিয়া মজিবুর রহমান। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৫৬ সালেই রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন এএইচএম কামারুজ্জামান। অপর একটি তথ্যে পাওয়া যায়, তিনি ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ছিলেন।১০
উল্লেখ্য, কামারুজ্জামান ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে এবং ১৯৬৫-র মার্চ মাসে দুইবার রাজশাহী থেকে মৌলিক গণতন্ত্র পন্থায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ এবং ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তখন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেন। পাকিস্তানি শােষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে হয়ে ওঠেন পূর্ববাংলার মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ও প্রকৃত মুক্তিকামী জাতীয়তাবাদী নেতা। এই সময়পর্বেই এএইচএম কামারুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর সতীর্থ সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন। এই ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকার বাইরে রাজশাহী কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। রাজশাহীতে এই আন্দোলনের প্রাণসঞ্চারীগণ ছিলেন যথাক্রমে—মাে. সুলতান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (পরবর্তীতে বিচারপতি), কাজী আবদুল মান্নান (পরবর্তীতে অধ্যাপক), এম এ লতিফ (পরবর্তীতে চিকিৎসক), মােহাম্মদ আনসার আলী (পরবর্তীতে বিচারপতি), আবুল কাশেম চৌধুরী (পরবর্তীতে অধ্যক্ষ), কসিম উদ্দিন আহমদ (কৃষকনেতা), গােলাম আরিফ টিপু (আইনজীবী), মমতাজ উদ্দিন আহমদ (অধ্যাপক, নাট্যকার, অভিনেতা), মাে. আব্বাস আলী (আইনজীবী), আবদুল মালেক খান (সঙ্গীত ওস্তাদ), আবুল কালাম চৌধুরী (আইনজীবী), লুৎফর রহমান মল্লিক ডলার (অধ্যাপক) এম এস আবদুল গাফফার (চিকিৎসক), মহসীন প্রামাণিক (আইনজীবী), এমএ সাইদ (ব্যাংকার), আহমদ উল্লাহ চৌধুরী (আইনজীবী), সাইদ উদ্দিন আহমদ (সাংবাদিক), সাইদুর রহমান (প্রকৌশলী), আজিজুল বারী চৌধুরী (চিকিৎসক), সৈয়দ আমির হােসেন (আইনজীবী), বেগম জাহান আরা (অধ্যাপক), বেগম মনােয়ারা রহমান (অধ্যাপক) প্রমুখ। এছাড়াও রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানবিরােধী আন্দোলনে কামারুজ্জামান-এর পিতা আবদুল হামিদ এবং মাদার বখশ-এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য ছাত্র-নেতৃবৃন্দের মধ্যে সরদার আমজাদ হােসেন, নূরুন্নবী চাঁদ, এমরান আলী সরকার প্রমুখ। এসব নেতৃত্ব ও সংগ্রামমুখর শহরে তবুও তৎপরতা লক্ষ করা গেছে আইয়ুব খানের অনুসারি ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর।১১ ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ এই দশ বছরে ঢাকার রাজনীতির পাশাপাশি রাজশাহীতেও পাকিস্তান এবং আইয়ুব খান-বিরােধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের রাজশাহীতে আগমন উপলক্ষে ছাত্রসমাজ প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলে। আইয়ুববিরােধী স্লোগান দিয়ে তার গাড়িবহরে হামলা চালানাে হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তান পুলিশ বাঙালি ছাত্রজনতাকে নিবৃত্ত করতে টিয়ারসেল নিক্ষেপ ও নির্মমভাবে লাঠিচার্জ করে। এই পুলিশী অ্যাকশনের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায় এনএসএফের গুণ্ডাবাহিনীও। তৎকালীন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল হাই-এর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও পৃষ্ঠপােষকতায় এনএসএফ রাজশাহীতে পাকিস্তানবিরােধী নেতৃত্বকে প্রতিহত করতে হামলা পরিচালনা করে। জানা যায়, তৌফিকুর রহমান শেলী, মুইদ ও শাকুর খানের নেতৃত্বে রাজশাহীতে এনএসএফ বাহিনী গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে হেতেম খাঁ মহল্লার মতিন খান, ইউনুস খান, পাঠানপাড়ার মন্টু সিং এবং দরগাপাড়ার ছাত্ৰনামধারী গুণ্ডাদের দৌরাত্মে রাজশাহী কলেজে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হয়।১২
লক্ষণীয় বিষয়, এএইচএম কামারুজ্জামান তখন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। এ সময় রাজশাহীতে এনএসএফ বাহিনী প্রায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে তৎপর। কামারুজ্জামান সেই তৎপরতা নস্যাৎ করতে কার্যকর উদ্যোগ নেন। তার একান্ত অনুরাগী ছিল রাজশাহী কোর্ট-কাঠালবাড়িয়া এলাকার সাহসী যুবক আবদুর রহিম। রহিম ছিলেন অত্যন্ত বঙ্গবন্ধুভক্ত এবং কামারুজ্জামানের বেসামরিক দেহরক্ষী। এনএসএফের শিরােমণি আয়েন উদ্দিন (এমপি)-কে একদিন সন্ধ্যায় জিন্নাহ হল (বর্তমানে মাদ্রাসা মাঠের লাইব্রেরি ভবন) থেকে সভা শেষে ফেরার পথে সােনাদিঘি মােড়ে অতর্কিতে হামলা করে রহিম বাহিনী। আয়েন উদ্দিন। মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলে কামারুজ্জামান সাহেব তাঁকে সৌজন্যবশত দেখতে যান এবং এনএসএফের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে রাজশাহীতে এনএস এফের কার্যক্রম শিথিল হতে থাকে। অপর দিকে, ১৯৬৩ সালে মােনায়েম খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যােগ দিতে আসেন। প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্রসমাজ। তৎকালীন রাকসুর সহসভাপতি ছাত্রলীগের মােজাহারুল হক বাকী এবং এসএম হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার আমজাদ হােসেনের নেতৃত্বে ছাত্ররা মােনায়েমবিরােধী স্লোগান দেন এবং তাঁর নিকট থেকে সনদ নিতে অস্বীকৃতি। জানান। ফলে হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। হাঙ্গামাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পুলিশি নির্যাতন। ছাত্রদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হলে শেষ পর্যন্ত সমাবর্তন অসফল হয়ে পড়ে এবং মােনায়েম খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই প্রতিহিংসা রয়ে যায় এনএসএফের মধ্যেও। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজশাহী সফর কর্মসূচি নির্ধারণ করেন এএইচএম কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর আগমনে রাজশাহীতে উৎসবের আমেজ ও সাড়া পড়ে যায়। রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র ভুবনমােহন পার্কে জনসভার আয়ােজন করা হয়। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের নেতাসহ এএইচএম কামারুজ্জামান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সভায় বক্তৃতা করেন। কামারুজ্জামান-এর বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুরু হয়। অতর্কিতে সভায় হামলা চালায় এনএসএফের গুণ্ডাবাহিনী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, শুধু রাজশাহীতেই নয়, পরিকল্পিতভাবে আইয়ুব খানের এই গুণ্ডারা সারাদেশে নৈরাজ্য ও ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করেছিল। সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘পূর্বপাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামে একটি প্রচারপত্র সারা দেশে প্রচার করেছিলেন। সেই প্রচারপত্রে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছিলেন—“পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের উপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমি পূর্ববাংলার সকল মানুষকে আহ্বান জানাইতেছি। প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করুন।” ১৩
সেই প্রতিরােধ ও জনসচেতনতার জন্য তিনি সারাদেশে সাংগঠনিক সফরে ব্যস্ত দিন কাটাতেন। রাজশাহীতে এমনই একটি রাজনৈতিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দানকালে। এনএসএফের গুণ্ডারা হামলা চালাবে তা ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। কামারুজ্জামান সাহেবের দেহরক্ষী আবদুর রহিমও বিষয়টি প্রথমে উপলব্ধি করতে পারেননি। তার আগেই হামলাকারীরা সভাস্থলে এসে সাধারণ কর্মীদের ওপর চড়াও হয় এবং কয়েকজনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। কেউ কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করতে থাকে, কেউ দৌড় দিয়ে পালাতে থাকে। এমনই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি লিখেছেন :
শেখ মুজিব সাধারণ বাঙালির চেয়ে লম্বা ছিলেন, চমকার দোহারা গড়ন। ব্যাক ব্রাশ করা চুল দুপাশে শৈল্পিকভাবে আছে। শেখ মুজিব যখন উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, তখন তাকে প্রকৃতই একজন বীরপুরুষের মতাে মনে হচ্ছিল। ঠিক তখনই এ জনসমাবেশে গণ্ডগোলের সূত্রপাত করা হয়। সরকারী মহল শেখ মুজিবের সভা পণ্ড করার জন্য গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়। কুখ্যাত গুণ্ডা হাতকাটা হেকিম (এর হাত কাটা ছিল) দরগাপাড়ার এতিম গুণ্ডা, ডালমন্ত্রী আমজাদ (ইনি কোন মন্ত্রী ছিলেন না, ডালের ব্যবসা করতেন বলে ঠাট্টা করে এই নামে তাকে ডাকত) ও শাহ আলম গুণ্ডা রামদা ও লাঠি নিয়ে আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণে লাঠির আঘাতে আওয়ামী লীগ কর্মী মাতবরের মাথা ফেটে যায়। ফলে জনসভা থেমে গেলে ভীত-সন্ত্রস্ত লােকজন তখন দৌড় দিতে শুরু করেছে, অনেকেই চিৎকার করছে। মাত্র কয়েক মিনিট …শেখ মুজিব তার পরিহিত পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে মঞ্চ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে গর্জন করে উঠলেন—কে আছিস আয়, আয় আমার সামনে, তােদের গুণ্ডামি কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় তা মজিবুরের জানা আছে। শেখ মুজিবের এই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের ফলে সরকারি গুণ্ডারা দ্রুত পলায়ন করল। শেখ মুজিব পুনরায় মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন এবং স্বভাবসিদ্ধ জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করলেন।১৪
ঐদিন কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু রাজশাহীর বেশ কয়েকটি স্থানে জনসভা ও জনসংযােগ করেন। সেইসব স্থানেও সরকারপন্থী এনএসএফ-এর গুণ্ডারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলেও কামারুজ্জামানের ভক্ত-শিষ্যরা তখন বঙ্গবন্ধুসহ সকলের নিরাপত্তাকে জোরদার করায় সন্ত্রাসীরা কাছে আসতে পারেনি। সারাদিন জনসংযােগ শেষে কামারুজ্জামানসহ রাজশাহীর ছাত্র-নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। মতবিনিময় সভায় ছাত্রনেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জনাব নুরুল আলম, সাইফুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু ও আরাে অনেকে। বঙ্গবন্ধু তখনও খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষত এনএসএফের ঔদ্ধত্য তাকে অত্যন্ত রাগান্বিত করেছিল। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন নির্বাচনের পর এইসব গুণ্ডাদের তিনি শায়েস্তা করবেন। নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এবং কামারুজ্জামানেরও প্রীতিধন্য। তাই স্নেহের অধিকার ও সাহস নিয়েই বঙ্গবন্ধু ও কামারুজ্জামানের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- আগামীতে আপনি তাে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হবেন এবং তখন সবাইকে ক্ষমা করে দেবেন। শেখ মুজিব নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডুর এই কথা শুনে হাে হাে করে হেসে ওঠে বললেন, ‘সবাইকে ক্ষমা করে দেবাে, শুধু মােনেম খান ক্ষমা পাবে না। উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।১৫
১৯৬৬ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক দলগুলাের সমন্বয়ে রাজনৈতিক কনফারেন্সে যােগদানের অনুরােধ জানান। কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধু ছয়দফা উত্থাপনের ক্ষেত্র পেয়ে যান।
১৯৬৫-৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার রাজশাহী, রংপুরসহ সারা উত্তরবঙ্গ সাংগঠনিক সফরে আসেন। কামারুজ্জামান সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এইসব সফরে সঙ্গী ছিলেন। রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে জেলায় জেলায় একটি আন্তঃসংযােগ গড়ে তােলার আহবান জানানাে হয়। এই সময় কামারুজ্জামান পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কামারুজ্জামান শুধু পূর্ববঙ্গেই নয় তখন সারা পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে তাঁর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সফর অব্যাহত রাখতেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি প্রতিনিধি হিসেবে কামারুজ্জামান তখন সারা পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের নিকট ছিলেন অতি পরিচিত একজন নেতা। যদিও আওয়ামী লীগের ভিত্তি ছিল প্রাদেশিক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই তবুও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তখন পূর্ববঙ্গের নেতৃবৃন্দের মধ্যে কামারুজ্জামানের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। তারও একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। কিভাবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গােড়াপত্তন হয়েছিল তার সঙ্গে কামারুজ্জামান কিভাবে যুক্ত হন সেই বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমন গুরুত্বসহ আলােচিত হয়নি। স্মরণ করতে হবে যে, দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ব্যাপকভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ গঠনের প্রস্তাব দেন যা সমগ্র পাকিস্তানের সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।১৬
১৯৪৯ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে যদিও সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক দর্শনগত পার্থক্য ছিল। তখনও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগের যােগসূত্র ছিল না বললেই চলে। কিংবা, ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগের অংশও ছিল না। ১৯৫১ সালের নভেম্বরডিসেম্বর মাসে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সংসদ নির্বাচনের পরই কেবল সােহরাওয়ার্দী রাজনৈতিকভাবে তাদের একত্রীকরণের সূচনা করেন। অবশ্য তার পূর্বেই ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহােরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনে সােহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘােষণা দেন।১৭
১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনের ঘােষণা দিয়ে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নাম ঘােষণা করে। এই সময়ই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন (১৯৫৪) ও জোটের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও ক্ষমতা স্থায়ী হয়নি। বিশেষত হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত নীতির বাস্তবায়ন বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভিন্নমত ছিল এবং বাহ্যত এইসব প্রশ্ন দেখা দেয়ায় ১৯৫৭ সালে দল বিভক্ত হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে স্বল্পসময়ের নােটিশে একটি নির্বাচনের ঘােষণা দেন। ঐ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের যথাক্রমে ৭৫ ও ১৫০ আসনের জন্য ১০০৫ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই প্রসঙ্গে জানা যায় :
পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত ৪৩ জন এমএনএ-এর সঙ্গে মুসলিম লীগের সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগ যারা করতেন তাদের কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচিত হন। এরা হলেন এমএনএ হিসেবে এএইচএম কামারুজ্জামান, মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন, বেগম রােকেয়া আনােয়ার ও মিজানুর রহমান চৌধুরী আর আবদুল মালেক উকিল ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম পি নির্বাচিত হন।১৯
কামারুজ্জামান এমএনএ নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান আইন পরিষদে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবাহে একটি বাধা সৃষ্টি হয়। তখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান তথা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৬৪ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে ও সভাপতিত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেই কমিটি সাংগঠনিক নির্বাচনগুলাের আয়ােজন করতে এবং একটি দলীয় ম্যানিফেস্টো রচনা করতে ব্যর্থ হয়।১৯ এই কমিটির ব্যর্থতার জন্য বারবার সমালােচিত ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে বারবার সাধারণ সম্পাদকের পদটি পরিবর্তিত হয়। প্রথমত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুল হক উসমানী। উসমানী ছিলেন ইসলামী রক্ষণশীল এবং আইয়ুব খানের রীতি ও আদর্শ অনুসারী। ফলে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহর সঙ্গে মতপার্থক্য ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে নীতিগত অমিল থাকায় তাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়ােগ দেওয়া হয় মােহাম্মদ জহির উদ্দিনকে। জহির উদ্দিনও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঐকমত্যে উপনীত হতে পারেননি। মূল আদর্শিক দ্বন্দ্বগুলাে ছিল পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে। তাছাড়া তখন জাতীয় রাজনীতিতে বিরাজ করছিল শাসনতান্ত্রিক সংকটও। শাসনতান্ত্রিক সংকটের মূল ভিত্তিগুলাে ছিল—১. কেন্দ্রীয় আইন সভায় জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তি, ২. প্রদেশগুলােকে প্রদেয় স্বায়ত্তশাসনের পরিমাণ এবং ৩. পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত প্রদেশগুলাের পদমর্যাদা অর্থাৎ সেগুলাে কি পৃথক প্রদেশ হিসেবে নাকি সবগুলাে একটি ইউনিটে সমন্বিত হবে। আবার প্রতিনিধিত্ব আঞ্চলিক ভিত্তিতে নাকি জনসংখ্যার ভিত্তিতে হবে সেটাই ছিল বিতর্কের মূল বিষয়। তাই পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশসহ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দাবির প্রেক্ষিতে পাঞ্জাবের ক্ষমতাবান কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত চাপের মধ্যেই ছিল।২০ ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯৬৫ সালের ৩ এপ্রিল ওয়ার্কিং কমিটির সভায় একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের কাঠামাের মধ্যেই গণতন্ত্রায়নের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।২১ লাহাের প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার বীজমন্ত্র । কিন্তু লাহাের প্রস্তাবের সুবিধাভােগী ছিল বাংলার প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী হিন্দু সম্প্রদায়, তারা দ্রুত অখণ্ড ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। অপরদিকে, মুসলিমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যার ফলে লাহাের প্রস্তাবের মধ্যে স্বতন্ত্র বাংলা রাষ্ট্রের ভাবনা হারিয়ে যায়।২২ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের উদ্ভট তত্ত্ব দিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের একটি উক্তি বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন :
The only result of the creation of pakistan was to weaken the position of the Muslims in the subcontinent of India. The 45 Milion Muslims who have remained in India have been weakened.২৩
মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু যে সে-কথা অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে উপলব্ধি করেই প্রথম থেকেই বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য রাজনৈতিক প্রস্তাব উত্থাপন করতে থাকেন। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের সঙ্গে ১৯৬৬
৬০
সালের ৬ দফার মধ্যে মূলত পাকিস্তান গড়ার ও পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এই বাণী উচ্চারিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার দুই বাঙালির লাহাের যাত্রা শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন :
এক বাঙালি প্রস্তাব করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার, আরেক বাঙালি পাকিস্তান ভাঙার । একই শহরে সময়ের কিছুটা ব্যবধানে। দু’জনের প্রস্তাবই কার্যকর হয়েছিল। লাহােরে উত্থাপিত এক প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরেক প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভেঙে চুরমার হয়েছে।২৪
১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে লাহােরে এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা সম্বলিত প্রচারপত্র আমাদের বাঁচার অধিকার’ শীর্ষক নামক্রমে সভাস্থলে বিতরণ করেন, যা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রকাশিত ও প্রচারিত। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই ঢাকায় এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেছিলেন যে, ছয়দফা এখন জনগণের সম্পত্তি এবং ছয়দফা প্রশ্নে আপােসের কোন ক্ষমতা তার নেই।২৫ তিনি ঐ জনসভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সকল আওয়ামী লীগ সদস্যকে শপথ পাঠ করিয়েছিলেন যে, ছয়দফার প্রশ্নে তারা কেউ আপােষ করবেন না। এই প্রসঙ্গে ড. কামাল হােসেন লিখেছেন :
শেখ মুজিব ও তার শীর্ষ স্থানীয় সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন। আহমদ, মনসুর আলী, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামারুজ্জামানের সঙ্গে ইয়াহিয়া বৈঠক করলেন। তারা ছয়দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করলেন। তারা সরকারকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন যে, ছয়দফা কর্মসূচি কার্যে পরিণত করার উপযােগী এবং তা এমনভাবে করা হবে যাতে শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে অনুযায়ী কেন্দ্রের হাতে যে সীমিত ক্ষমতা ও দায়িত্ব থাকবে সেই দায়িত্ব পালনের জন্যে কেন্দ্রকে প্রয়ােজনীয় সম্পদের নিশ্চয়তা দেয়া হবে।২৬
৬ দফার প্রশ্নে শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, তৎকালীন আইন পরিষদের সদস্য এএইচএম কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রাদেশিক বিরােধী দলগুলাের সঙ্গে ঐকমত্য গড়ে তুলতে গুরুত্বারােপ করেন। বঙ্গবন্ধুর। পরামর্শক্রমে জনমত গঠন ও আলােচনার জন্য আওয়ামী নেতৃবৃন্দ তৎপর হন। এই প্রসঙ্গে ড. কামাল হােসেন বলেন :
এই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন শীর্ষ নেতাদের মধ্যে জে রহিম, শেখ আবদুর রশিদ, হানিফ র্যামে, আবদুল হাফিজ পীরজাদা ও রফি রাজা। আওয়ামী লীগের পক্ষে আলােচনাকারী দলটি ছিলাে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান ও আমাকে নিয়ে। দলগত বৈঠকে আওয়ামী লীগ সদস্যদের ধারণা ছিলাে যে ছয়দফা কর্মসূচির মর্মবস্তুর উপর আলােকপাত করেই আলােচনা চলবে।২৭
ছয়দফার আলােকে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রশ্নে দমনপীড়ন অব্যাহত থাকে, আলােচনা দীর্ঘায়িত হতে থাকে। কিন্তু ক্রমাগতভাবে জানুয়ারি মাসের পর শেখ মুজিব বারবার এই উপেক্ষিত ইস্যু নিয়ে আর বিলম্ব করতে চাননি। ফলে তিনি বিষয়টি প্রাদেশিক কমিটিতে অনুমােদন করিয়ে নেন। এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য স্মরণীয় :
লাহােরে অনুষ্ঠিত পাঁচ দলীয় জাতীয় সম্মেলনে গুরুত্ব না পাওয়ায় শেখ মুজিব ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে ছয়দফা অনুমােদন করিয়ে নেন। পরের মাসে ১৯ মার্চ থেকে ৩ দিনব্যাপী প্রাদেশিক কমিটির কাউন্সিল অধিবেশনেও ছয়দফা অনুমােদিত হয়ে যায়। প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ অসুস্থ থাকায় কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রাদেশিক কমিটির সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কাউন্সিল অধিবেশনে ছয়দফা অনুমােদিত হয়ে যাবার পর থেকেই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দুই টুকরাে হয়ে যায়।২৮
পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ছয়দফার আলােকে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, পররাষ্ট্রনীতি ও প্রফেসর রেহমান সােবহান কর্তৃক প্রণীত Two Economy Theory ইত্যাদি প্রশ্নে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ক্রমেই বিরােধ বিতর্কে দ্বিধান্বিত হতে থাকেন এবং ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এই বিষয়ে সমালােচনামুখর হয়ে ওঠেন। শুধু সমালােচনা নয়, শেখ মুজিবের সুনামহানিতেও পাকিস্তান সরকারের প্রশাসন তলে তলে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অন্যদিকে, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিভক্তির ফলে উদ্ভূত হয় নতুন পরিস্থিতি। পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানা যায়:
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা ছিলেন ছয়দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে। এর প্রথম সমালােচনাকারীদের মধ্যে ছিলেন সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এভাবে অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানি কর্মসূচীর সমর্থন ও পশ্চিম পাকিস্তান বিরােধিতা করায় আওয়ামী লীগে অঞ্চলভিত্তিক ভাঙনের সূত্রপাত ঘটে। শেষপর্যন্ত নসরুল্লাহ খান আওয়ামী লীগের সংস্পর্শ ছেড়ে ১৯৬৭ সালের মে মাসে নতুন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক মুভমেন্ট গঠন করেন এবং দেশে গণতন্ত্র পুনর্বহালের দাবি জানান।২৯
১৯৬৭ সালের মে মাসে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলে ঐ বছরই ১৮ সেপ্টেম্বর এএইচএম কামারুজ্জামান ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়ােজন করেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ব্যানারেই এএইচএম কামারুজ্জামান এই সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে। তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৪৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ঘােষণা দেন। কমিটিতে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও এএইচএম কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দিন আহমেদ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন এএইচএম কামারুজ্জামান। সাংবাদিক সম্মেলনে কামারুজ্জামান বলেন :
করাচি, সিন্ধু ও বেলচিস্তান আওয়ামী লীগ এই নতুন কমিটি সমর্থন জানিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তারাও কোনভাবেই নসরুল্লাহ খানের নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। সিন্ধুতে নতুন সাংগঠনিক কমিটির পক্ষে বেশ ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তবে পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ অদ্যাবধি তাদের কোন আনুষ্ঠানিক অভিমতের কথা জানাননি। পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ করে পাঞ্জাবে নসরুল্লাহ খান ও গােলাম জিলানী ছয়দফা বিরােধী প্রচারণা চালিয়েছেন। সাংগঠনিক কমিটির ২৪ জন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মালিক হামিদ সরফরাজ, চৌধুরী নাজিরুদ্দিন, সৈয়দ শাহ বােখারি ও মােহাম্মদ মােরতুজা।৩০
কামারুজ্জামান ছিলেন অত্যন্ত যুক্তিবাদী ও বাস্তবতাবােধ সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। তাই তিনি এতদিন যাবৎ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার দিকগুলাে চিহ্নিত করে সাহসী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনিই প্রথম নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি ম্যানিফেস্টো রচনা করেন। তিনি সেই ম্যানিফেস্টোর মুখবন্ধে লিখেছেন—১৯৬৯ সালের ৯ আগস্ট করাচিতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটির এক বৈঠকে ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন উপকমিটি গঠিত হয়। ঐ উপকমিটি দলের বিভিন্ন ইউনিট থেকে বিভিন্ন। প্রস্তাব আহ্বান করে তারপর এই খসড়াটির চূড়ান্ত আকার দিয়ে তা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে পেশ করেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অধিবেশন ১৯৭০ সালের ৬ জুন সর্বসম্মতিক্রমে ম্যানিফেস্টোটি গ্রহণ করে। কিন্তু ৬ দফা আন্দোলনের পূর্বে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত রাখার অভিযােগ তােলা হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। কেন্দ্রীয় সরকার ও বশংবদ আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী আগরতলা মিথ্যা মামলায় অবরুদ্ধ ও বিচারাধীন রাখা হলে কামারুজ্জামান ও অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বিশেষত ছাত্রনেতৃবৃন্দ স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। অপরদিকে, ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের ন্যাক্কারজনক পরিণতিতে তাসখন্দ চুক্তি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য চরম অবমাননাকর ব্যাপার। যার ফলে পাকিস্তানি সেনাশিবিরে ভেতরে ভেতরে আইয়ুববিরােধী অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। অন্যান্য প্রদেশেও আইয়ুববিরােধী জনমত গড়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামেগঞ্জে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির সর্বাধিক আস্থা, বিশ্বাস ও জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে আলােচনায় বসতে বাধ্য হয়। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে এটি ছিল একটি অভূতপূর্ব সাফল্য।
মুক্তি-আন্দোলনের এই বিশেষ ক্ষণে কামারুজ্জামান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে যুগপৎ চেতনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশে ঘােষণা করেন—দুই পাকিস্তানের সম্পর্ক নির্ভর করবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিতে। তিনি মনে করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা অভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের চলতি পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করে এই মর্মে ঘােষণা দেন যে, ‘আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে শ্রেণীহীন সমাজ’ ও ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ চায়।৩৩
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যুগপৎ চেতনার সঙ্গে অভিন্ন দাবি নিয়ে সেই সময় বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণও উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। তন্মধ্যে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে বাধা দানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও কামারুজ্জামান ছিলেন পুরােধাপুরুষদের একজন। এই সম্পর্কিত একটি তথ্যে পাওয়া যায় :
১৯৬৫ সালে রাজশাহীর আর এক কৃতী সন্তান এডভােকেট মুজিবুর রহমান চৌধুরী নওগাঁ থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের মার্শাল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও তার তাবেদাররা সে সময় পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র রচনাবলি নিষিদ্ধ ঘােষণা করার পাঁয়তারা করছিল। এর বিরুদ্ধে মুজিবুর রহমান চৌধুরী পার্লামেন্টে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানান। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের এমএনএ হিসেবে সহকর্মীর বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে এএইচএম কামারুজ্জামান সরকারের রবীন্দ্রবিরােধী কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালােচনা করেন এবং রবীন্দ্র রচনাবলী নিষিদ্ধ করার তীব্র প্রতিবাদ জানান। রাজশাহীর দুই কৃতী সন্তান কামারুজ্জামান ও মুজিবুর রহমান চৌধুরী একসাথে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র রচনাবলি নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে রাওয়ালপিণ্ডিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ (পার্লামেন্টে) প্রতিবাদের ঝড় তােলেন। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র রচনাবলি নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে দেশে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ করা যায়নি। বরং ১০ দিন ব্যাপী রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হয়েছিল।৩৪
পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এমনই উত্তুঙ্গ পরিস্থিতিতে আইয়ুব খানের ওপর আরাে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করেছিল। বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজও। এই সময় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সােবহান ও প্রফেসর ড. আনিসুর রহমান প্রণয়ন করেন Two Economy Theory। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার সঙ্গে অভিন্ন ও সমার্থক। ইতিহাসের বাস্তবতায় এই গৌরবের অংশীদার রাজশাহীর মানুষও। কেননা, অধ্যাপক রেহমান সােবহান এই চেতনায় বুদ্ধিজীবী সমাজকে উজ্জীবিত করেছিলেন কামারুজ্জামানের জন্মশহর রাজশাহীতে এসেই। ১৯৫৬ সালের ১৮ থেকে ২১ ডিসেম্বর রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ইকোনমিক এসােসিয়েশনের সম্মেলন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাঙালি অর্থনীতিবিদগণের গবেষণায় ওঠে আসে দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়গুলাে। এই সম্মেলনেই বাঙালি অর্থনীতিবিদগণ বাস্তবতার তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করে দুই পাকিস্তানের জন্য দুইটি আলাদা অর্থনৈতিক পলিসি গ্রহণের প্রস্তাব ও যুক্তি পেশ করেন। তারই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুই অর্থনীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
This twoness so far it is cognial to the whole gamut of economic life৩৫
প্রফেসর রেহমান সােবহান তার Two Economic Theory-তে দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যসমূহ স্পষ্ট করে তােলেন। প্রসঙ্গত, স্মরণীয়, বিশিষ্ট। অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আনিসুর রহমানও এই ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন।৩৬ ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক মন্দা লাঘব করার জন্যই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের শােষণ ও বৈষম্যমূলক নীতি প্রকট হয়ে ওঠে। এই বক্তব্যই পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে কামারুজ্জামানের ভাষণে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে যা ছিল পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির জন্য অবশ্যম্ভাবী। শুধু পূর্ববাংলায় নয়, পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের নেতৃবৃন্দও কেন্দ্রীয় সরকারেরর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের নেতা খান ওয়ালী খান প্রাদেশিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্য নীতির সমালােচনা করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের বক্তব্য সমর্থন করেন। অন্যান্য প্রদেশের নেতৃবৃন্দও কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সমালােচনা করে নিজ নিজ প্রদেশের স্বার্থে একটি বৃহত্তর বিরােধী ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। এই লক্ষ্যে কামারুজ্জামান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধুর বিভিন্ন বড় বড় শহরে জনসভা করে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। আরও একটি কারণে পাঞ্জাবে তখন অসন্তোষ বিরাজ করছিল। সেটা হলাে সােভিয়েত রাশিয়ার চাপের মুখে পাকিস্তান যে ভারতের সঙ্গে তাসখন্দ চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল এটা পাঞ্জাবের জনগণ মেনে নিতে পারে নি। কারণ, ঐ যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের অনেকেই ছিল পাঞ্জাবের সন্তান। সেজন্য পাঞ্জাবের নেতারা যেমন তাসখন্দ চুক্তি মানতে পারেননি, তেমনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশও ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো ও আইয়ুব খানের বিরােধী। তাই পাঞ্জাবি নেতারা আইয়ুব খানের কাছে একটি জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে বিরােধী ঐক্যের ডাক দেন। তবে পাঞ্জাবের জনগণ তাসখন্দ চুক্তির বিরােধী হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এই চুক্তিকে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে, তাসখন্দ ঘােষণা পূর্ববাংলার কাছে ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হয়। ১৯৬৬ সালের গােড়ার দিকে লাহােরে বিরােধী দলীয় পাঞ্জাবি নেতাদের সঙ্গে একটি গােল টেবিল সভায় যােগ দেয়ার জন্য দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া বঙ্গবন্ধুকে আগ্রহী করার চেষ্টা করেন। অবশেষে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহােরে বিরােধী নেতাদের সঙ্গে একটি জাতীয় সম্মেলনে যােগ দেন। এই লাহাের সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু দ্বিঅর্থনীতির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ৬ দফা পেশ করেন। এই প্রসঙ্গে ড. কামাল হােসেন লিখেছেন :
লাহাের সম্মেলনে শেখ মুজিব তার ছয়দফা উত্থাপনের চেষ্টা করেন তখন সম্মেলনের সভাপতি চৌধুরী মােহাম্মদ আলী তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি এমনকি সম্মেলনের আলােচ্যসূচিতে তা অন্তর্ভুক্ত করতেও অস্বীকৃতি জানান। সম্মেলনে জোরালাে গুঞ্জন শুরু হয়—শেখ মুজিবের ছয়দফা কর্মসূচি হলাে আসলে বিরােধী ঐক্য প্রতিহত করা এবং সরকারের প্ররােচনায় শেখ মুজিব উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন।৩৬
এমন পরিস্থিতিতে অযৌক্তিকভাবেই বিরােধীরা ভুল বুঝলেও শেখ মুজিব অনড় অবস্থান ব্যক্ত করে জানিয়ে দেন যে, ছয়দফা ও স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা ব্যতীত কোন ঐক্যে তিনি যােগ দেবেন না। পাঞ্জাবি নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের এই বিরােধ সরকার দ্রুত উপলব্ধি করে। বিলম্ব না করে আইয়ুব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, এম এম জাফর জনগণকে বিভ্রান্ত করতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ শেখ মুজিব ৬ দফা মুদ্রিত করে প্রকাশ করলে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি ও হত্যার রাজনীতি শুরু করেন। ৬ দফাকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ভারতীয় চক্রান্ত বলে ঘােষণা করেন। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন—প্রয়ােজনে অস্ত্রের ভাষায় তিনি এর জবাব দেবেন।৩৮
১৯৬৬ সালের ১৮ এপ্রিল ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস’ ক্ষমতা বলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবার পর থেকেই পূর্ববাংলায় শুরু হয় অসহযােগ ও বিক্ষোভবিদ্রোহ। ৭ জুন ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ দিবসের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন কয়েকজন এবং আহত ও গ্রেফতার হন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। নিষিদ্ধ করা হয় “দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা। দমননীতির পাশাপাশি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের সিনিয়র বাঙালি কর্মকর্তা ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্স খান, শামসুর রহমানসহ সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার গ্রেফতার হন। মামলাটি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেছেন :
১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল এক নােটিফিকেশনে স্পেশাল ট্রাইবুনাল অর্ডিনেন্স অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে পাকিস্তান সরকার যে বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণােদিত এবং তথাকথিত আইন ও বিচারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তোষ ও উত্থানকে প্রশমিত করার আয়ােজন। অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজনকে উত্থাপিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে প্রাণদণ্ডের ষড়যন্ত্র ছিল এই মামলায়। আর সেই ষড়যন্ত্রের প্রধান শিকার ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও লেফটেনেন্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন। …প্রয়ােজনে ফাসি নিশ্চিত করার জন্য সরকার দুশােজন সরকারপক্ষের সাক্ষীর নাম মামলায় মুদ্রিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন। …প্রথম চিন্তায় ভারতকে জড়িত করতে চেয়েছিলেন এবং সেইভাবে মামলার নামকরণ করারও আয়ােজন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু সর্বশেষ চিন্তায় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ভারতকে সরাসরি মামলায় জড়ানাে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার ভয়ে অন্য নাম বেছে নেন। …বিশেষ ট্রাইবুনালে উত্থাপিত মামলার প্রকৃত নাম হচ্ছে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। পঁয়ত্রিশ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ’ নামক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিযােগ আনা হয়।৩৯
কিন্তু সাড়ে সাতকোটি বাঙালির নয়নমণি শেখ মুজিব সম্পর্কে এই অভিযােগ প্রত্যাখ্যাত হয়। বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এমনই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে
৬৭
এএইচএম কামারুজ্জামান অত্যন্ত সুবিবেচকের মতই তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি বিরােধীদলের সদস্য হিসেবে আইন সভায় ছয়দফার পক্ষে জোরালাে ভূমিকা পালন করেন। সরকারের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযােগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত দুরভিসন্ধিকে জাতির সামনে স্পষ্ট করে দেন। বিশেষত, পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক আয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয়ের পরিসংখ্যান, বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলাের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্প যতটা তুলে ধরা হতাে, পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ছিল নিষ্ক্রিয় আমলাতান্ত্রিক কুটিলতা, পশ্চিমাঞ্চলের সেচ, কৃষি ও শিল্পে বিনিয়ােগবৈষম্য ইত্যাদি প্রসঙ্গে তিনি তুলে ধরেন এবং আইয়ুব সরকারের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, বৈষম্য নিরসনের জন্য তিনি কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণের জোর দাবি উত্থাপন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বারােপ করে সমাজে সাম্য ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা, সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য জোরালাে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি পাকিস্তানের আইন পরিষদে বারবার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের নানা চিত্র তুলে ধরেন ও নিরসনের প্রস্তাব দেন। বিশেষত, পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সাহায্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বারােপ করতেন। পাকিস্তান আইন পরিষদে তাঁর সামগ্রিক ভূমিকা মূল্যায়ন করে ভাষা সৈনিক সাইদ উদদীন আহমদ লিখেছেন :
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শাসনামলে জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি বাঙালিদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পূর্ব পাকিস্তান বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জনগণের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে পার্লামেন্টে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। মেডিক্যাল কলেজগুলােতে ছাত্র ভর্তি, ডাকঘর স্থাপন, ডাক পিয়নদের বেতন বৃদ্ধি, পূর্ব-পশ্চিম রেলের যাত্রী সুবিধার বৈষম্য, যােগাযােগ ও সড়কপথের বৈষম্য তথা নিম্নমানসম্পন্নসহ অপ্রতুলতার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি গুরুত্বারােপ করেন উদ্বাস্তু সমস্যার বিষয়েও। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিনা বিচারে আটক রাখার নিন্দা জানান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের দাবি জানান। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান কেন পিছিয়ে আছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন তােলেন। রাজশাহী বিভাগসহ। অন্যান্য বিভাগে একটি করে ইপিজেড স্থাপনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন সরকারী কার্যালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ দাবি করেন। আনুপাতিক হারে সরকারি উচ্চপদে বাঙালি অফিসার নিয়ােগের ক্ষেত্রে অনীহা ও বৈদেশিক চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালি অফিসার নিয়ােগে বিমাতাসুলভ আচরণ ত্যাগের আহ্বান জানান। বিশেষত, পাকিস্তানি আমলাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের সমালােচনা করেন ও ক্ষমতা খর্ব করার দাবি তােলেন। বাঙালিদের বিচারপতি পদে নিয়ােগের ক্ষেত্রে বৈষম্যনীতির নিরসন চান। এছাড়াও বৈষম্যমূলক জাতীয় বাজেটের তীব্র সমালােচনা করে শােষণের ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ বক্তব্য পেশ করেন। চলচ্চিত্রশিল্পে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার নিন্দা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে পৃথক সেন্সর বাের্ড স্থাপনের দাবি করেন। করাচি থেকে ইসলামাবাদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে রাজধানী স্থানান্তরের কারণ জানতে চান। পশ্চিম পাকিস্তানের মত জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানে বেতার কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানান। পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে তিনি দরিদ্র শ্রমিকদের দৈনন্দিন আয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন। এভাবে তিনি বাঙালির স্বার্থরক্ষার জন্য সর্বদা সােচ্চার ছিলেন।৪০
এএইচএম কামারুজ্জামান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি ও বিশ্লেষণে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন বলেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হয়েছিলেন। ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যায়, তিনি বারবার রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতিতে বাস্তবাচিত ভূমিকা পালন করেছেন। তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বিচার করলে দেখা যায়, তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত ছয়দফা ও আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ মুখপাত্র হিসেবে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আইন পরিষদে যেমন গঠনমূলক সমালােচনা করেছেন, তেমনি উন্নয়ন প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার রাজনৈতিক অঙ্গনেও জনগণের অধিকার আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে যুগপৎ দায়িত্ব পালন করেছেন। যেহেতু উর্দু, ইংরেজি, পশতু, হিন্দি ভাষাতে তিনি দক্ষ ছিলেন তাই জনসংযােগের ক্ষেত্রেও তার বক্তব্য ছিল লক্ষ্যভেদী এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফার নীতিনির্ধারকগণের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। যেহেতু তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু সভাপতি ছিলেন, স্বভাবতই তাঁর বক্তব্য হতাে দলীয় মুখপাত্রের বক্তব্যই। ফলে দলের নিকট তিনি যেমন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক নেতা ছিলেন, তেমনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের প্রগতিমনস্ক জনগণের নিকট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি জাতীয় উন্নয়নের পাশাপাশি তাঁর জন্মশহর রাজশাহী ও সমগ্র উত্তরজনপদের অবহেলিত মানুষের ভাগ্য-উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন, কর্মপরিকল্পনা করতেন। তিনি সে ক্ষেত্রে প্রথমেই উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রতি বেশি গুরুত্ব আরােপ করতেন। তার ভাবনাতেই প্রথম যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানা যায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনগণের দল আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রতীক নৌকা। নদীমাতৃক বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে তাই নদীর ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তাও তিনি উপলব্ধি করতেন। বাংলার নদীগুলােকে রক্ষা করতে হবে। বন্যা ও নদী ভাঙনের হাত থেকে জনজীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য নদীতে বাঁধ নির্মাণ, সেতু নির্মাণকে তিনি সার্বিক গুরুত্ব দিতেন। যােগাযােগের উন্নয়ন ব্যতীত দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, অর্থনীতির ছাত্র কামারুজ্জামান এ-কথা খুব ভালােই জানতেন। জাতির আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে তিনি অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতেন। লক্ষণীয় ১৯৬৭ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলী অব পাকিস্তান ডিবেটস-এ তিনি জোরালাে ভাষায় তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। যমুনা। নদীতে ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেন –
I submit that the government should immediately make sufficiently grant-us-aid to the government of East Pakistan at least a bridge over Jumuna is immediately constructed.৪১
কামারুজ্জামান পাকিস্তানের আইন পরিষদে উন্নয়ন ভাবনা ও গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বলেছেন। পাশাপাশি তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংযােগ অব্যাহত রেখেছেন। ১৯৬৮ সালে সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমেদ-এর নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি। এবং ৬ দফা দাবির প্রেক্ষিতে পূর্ববঙ্গের গণআন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। আইয়ুব খানের দমনপীড়ন অত্যাচারের মাত্রাও ভয়াবহ রূপ পায়। এমতাবস্থায় ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি অভিন্ন ঐক্য গড়ে তুলে কামারুজ্জামান দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এই পর্বেও তিনি তার সঠিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। ১৯৬৯ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ঘনীভূত হলে তিনি ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এমএনএ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত ছাত্রদের মাঝে অভিনন্দিত হয়।৪২ কামারুজ্জামানের পদত্যাগের মাত্র এক সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা অমান্য করে বিক্ষোভ মিছিলে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করতে থাকে। ঐ দিনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক ও রীডার ড. শামসুজ্জোহা বিক্ষোভ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ইতােপূর্বে ঢাকায় গণআন্দোলনে শহীদ হন আসাদ, শহীদ হন সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ আরাে অনেকেই। বস্তুত, এইসব শহীদের আত্মত্যাগ বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নজিরবিহীন শক্তি ও প্রেরণা যােগায় এবং গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করে।৪৩ উত্তপ্ত এই পরিস্থিতিতে কামারুজ্জামান সামিল হন সংগ্রামী জনতার মিছিলের কাতারে। তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতাে মন্ত্রিত্বের আসনের চেয়ে জনতার মিছিলে শরিক হওয়াকেই শ্রেয় মনে করতেন। লক্ষ করা যায়, কামারুজ্জামান জনস্বার্থে, দেশের স্বার্থে মন্ত্রিত্বকে বারবার তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। দেশের কল্যাণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এমন দৃষ্টান্ত তিনি বারবার দিয়েছেন। তিনি আইন সভার সদস্যপদ ত্যাগ করেই জনতার সঙ্গে সামিল হয়ে গড়ে তােলেন তীব্র আন্দোলন ও জনমত। এই প্রসঙ্গে ড. শ্যামলী ঘােষ লিখেছেন :
এই প্রেক্ষিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও মুজিবকে আসামী করায় কামারুজ্জামান ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গড়ে তােলেন জনমত। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কামারুজ্জামান এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জনমত সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।৪৪
অবশেষে তীব্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হন আইয়ুব সরকার। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এ রেসকোর্স ময়দানে প্রিয় নেতাকে সংবর্ধনা দানের জন্য স্মরণকালের সর্ববৃহৎ প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটে। এই সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।৪৫ ইতােমধ্যে আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের জন্য তিনি ঘােষণা দিয়ে বলেন-“আজ থেকে আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারাে দফা সমন্বিত কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হল। সমন্বিত কর্মসূচি বাস্তবায়নই আমার রাজনৈতিক অঙ্গীকার।’ বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে তিনি শাসনতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাসী, গােলটেবিলে সেই বিশ্বাস ভঙ্গ হলে তিনি আলােচনা সভা বর্জন করবেন। এই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তার সতীর্থ এএইচএম কামারুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও ড. কামাল হােসেনকে নিয়ে একটি হাই কমান্ড গঠন করেন।৪৬ দলীয় হাইকমান্ড নিয়ে বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানের গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দেন। এই প্রসঙ্গে মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি লিখেছেন :
শেখ মুজিব প্রস্তাবিত গােল টেবিলে যােগদান করেন। মাওলানা ভাসানী ও ভুট্টো যােগদান থেকে বিরত থাকেন। শেখ মুজিব গােল টেবিলে ছয়দফা ও ১১ দফা ব্যাখ্যা করে ভাষণ দেন। আইয়ুব খান জিজ্ঞাসা করেন, এইসব দাবি মানার পরে পাকিস্তান কি ফেডারেশন থাকবে, না কনফেডারেশনে পরিণত হবে? শেখ দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দেন ফেডারেশন তবে সুবিচারের সাথে (Federation with Justice)। শেখ মুজিবের জবাব শুনে আইয়ুব খান প্রমাদ গুনলেন। গােলটেবিল বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। ১৪ মার্চ (১৯৬৯) শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ ডাক-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ২১ মার্চ মােমন খান পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। গভর্ণর দায়িত্ব পালন করেন ড. এমএ হুদা। আইয়ুব খান ২৪ মার্চ প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে চিরবিদায় নিলেন।৪৭
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে দুঃশাসন আইয়ুব শাহীর পতন হলাে নির্মম ও করুণভাবেই। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরকালে যে পদত্যাগপত্র লিখেছিলেন তার বাংলা তরজমাটি নিম্নরূপ :
“প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে, দেশের সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানেও উদ্বেগজনক অবস্থার অবনতি যদি আরও অব্যাহত থাকে, সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক জীবনধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় ক্ষমতার আসন থেকে নেমে যাওয়া ব্যতিরেকে আমি অন্য কোন গত্যন্তর দেখছি না।
তাই আমি পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর হাতে পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করে যাওয়া সাব্যস্ত করেছি। কেননা, সামরিক বাহিনীই এই সময় দেশের একমাত্র কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।
প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মােহাম্মদ আইয়ুব খান
২৪ মার্চ, ১৯৬৯
প্রেসিডেন্ট হাউস, রাউয়ালপিন্ডি।৪৮
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আবারাে দেশব্যাপী জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করলেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র নামক অদ্ভুত শাসনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেল।
দেশের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর তিনি নিষেধাজ্ঞা ঘােষণা করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন অচিরেই নির্বাচন দেবেন। তার এই তৎপরতার বর্ণনায় বলা হয়েছে :
Immediately afterwards, Martial law was promulgated throughout Pakistan and all political activities were banned. It seemed that the Pakistan army had taken a lease to rule the country forever. Yahya Khan announced that he would hold general elections in he country and handover power to the elected representatives of the people.৪৯
আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রকে পাঞ্জাব, বেলুচি ও সিন্ধিদের অনেকেই মেনে না নিয়ে একটি জোট গঠন করে চাপ অব্যাহত রেখেছিল।
অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে উত্তাল বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী ঐক্যেরও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন চালিয়ে যাওয়া ইয়াহিয়া খানের পক্ষে সম্ভব হবে না—সেটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ড. কামাল হােসেনের বিশ্লেষণ :
ইয়াহিয়া উপলব্ধি করলেন যে, জনগণের বিক্ষোভের মুখে অনির্দিষ্টকালের জন্য নগ্ন সামরিক শাসন চালানাে যাবে না। অতএব দেশের উভয় অংশের চাপ মােকাবিলা ও নিজের শাসনকে বৈধতা দিতে কোনাে না কোনাে ভিত্তি খুঁজে পাওয়া ইয়াহিয়ার জন্য জরুরী হয়ে পড়লাে। ইয়াহিয়ার আসল দুশ্চিন্তার বিষয় ছিলাে পূর্বাঞ্চল, যেখানে উত্তাল বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমগ্র জনগণকে একক এক নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেছে। শেখ মুজিব পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অথবা কোনাে ফরমান বলে চাপিয়ে দেয়া যেকোন শাসনতন্ত্রই বাঙালি জনগণ পুরােপুরি প্রত্যাখ্যান করবে।৫০
এই প্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খান চতুরতার সঙ্গে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক বা আইনগত রূপরেখা প্রণয়ন করে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বিরােধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঐক্যে ফাটল ধরালেন। আইন পরিষদের আসন বণ্টন করে মােট ৩১৩ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে ১৬৯টি আসন দেয়ার ঘােষণা দিলেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে চললেন। ঐ সময় ঘূর্ণিঝড়-দুর্গত অঞ্চলের ১৭টি আসনের নির্বাচন স্থগিত করে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে। ফলাফলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭ আসনে বিজয়ী হলাে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪ আসনের মধ্যে পিপিপি অর্থাৎ ভুট্টোর দল ৮৩টি আসনে জয়ী হয়ে কেবল সিন্ধু ও পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলাে। মাত্র ৮৩টি আসনে জয়ী হয়ে ভুট্টো সাহেব ঘােষণা দিলেন পিপল পার্টির সম্মতি ছাড়া কোন শাসনতন্ত্র তৈরি হতে তিনি দেবেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা ও নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সামরিক শাসন প্রত্যাহারপূর্বক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানালেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ভুট্টোর সঙ্গে হাত মেলালেন। জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান থেকে বিরত থাকলেন। প্রকারন্তরে জানিয়ে দিলেন যে, শাসনতন্ত্র তৈরিতে ক্ষমতাসীন সংখ্যালঘু গােষ্ঠীর ভেটো ক্ষমতা থাকবে এবং তাদের সঙ্গে সমঝােতা ব্যতীত তিনি বৈঠক ডাকবেন না। এটিই ছিল ইতিহাসের একটি নির্মম মুহূর্ত। এই মুহূর্তটি হলাে বাঙালি জাতি ও জাতির নেতার প্রতি চরমতম অপমান। ১ মার্চ ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খানের ঘােষণা শােনার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সকল পরিষদের সদস্যদের বিকেল তিনটায় হােটেল পূর্বাণীতে উপস্থিত হবার নির্দেশ দিলেন। দলীয় নেতৃবৃন্দের মাঝে বিকেল ৩.২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু এসে উপস্থিত হন। তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি শত শত সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘােষণা দিলেন :
কেবল সংখ্যালঘু দলের ভিন্নমতের কারণে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া হয়েছে এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমরা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধি এবং আমরা বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে পারি না।’ এরই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। পরবর্তী ছয় দিনের কর্মসূচি ঘােষণা করলেন। ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল, ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল, এবং ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা।৫১
ইতিহাসের বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেননা, ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাস ইয়াহিয়া খান নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, প্রথমত ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সঙ্গে সমঝােতার ভূমিকা দেখালেও তিনি শাসনতন্ত্র ও আইনের নানা জটিলতার অজুহাত তুলে বলেন আইন পরিষদের উপদেষ্টা বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য সময়ের প্রয়ােজন। দ্বিতীয়ত, ভুট্টো ও শেখ মুজিব কয়েক দফা আলােচনাতেও অংশ নেন। আলােচনায় অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খােন্দকার মুশতাক আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হােসেন। ভুট্টোর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পিপলস পার্টির জে রাইস, শেখ আবদুর রশীদ, আবদুল হাফিজ পীরজাদা ও রফি রাজা। কিন্তু সেই আলােচনাও নিষ্ফল হয়। তৃতীয়ত, জানুয়ারির শেষ নাগাদ ভুট্টো আবারও ঢাকায় এসে বললেন—’গণপরিষদে প্রবেশের আগে সমঝােতার প্রয়ােজন নেই, কারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালেও আলােচনা চলতে পারে।৫২ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীতে চিরকালের বেঈমানির নজির আবারও দেখা দেয়। পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের কেউ কেউ ইয়াহিয়া খানের চেয়ে তলে তলে ভুট্টোর সঙ্গে হাত মেলায়। ইয়াহিয়া এই সংকট বুঝতে পেরে মার্চের ১ তারিখে এই ঘােষণা দিলে পরিস্থিতি ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক মুক্তিসংগ্রামে লড়াকু বাংলার বিপ্লবীরা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এই প্রসঙ্গেও ড. কামাল হােসেনের বিশ্লেষণ অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি লিখেছেন :
সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করছিল শেখ মুজিবের ওপর। তিনি শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতৃবৃন্দ তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের পরামর্শ চাইলেন। আমাকেও তাদের সঙ্গে যােগ দিতে বলা হলাে। খােলাখুলি স্বাধীনতা ঘােষণার ফলাফল সতর্কতার সঙ্গে হিসেব করে দেখা হলাে। সেনাবাহিনী একটি সামরিক হামলা চালানাের সুযােগ খুঁজছিলাে এবং এ ধরনের কোন ঘােষণা যে তাদেরকে সেই সুযােগটিই যােগাবে তা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিল।৫৩
বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সারাদেশে সজাগ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন—দেশে ক্রমেই ছাত্র জনতা, কৃষকশ্রমিক, মাঝি-মাল্লার গণমিছিলে শরিক হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। এমন সময় দেশব্যাপী হরতাল চলাকালে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। সময়টির বর্ণনা দিয়ে এম এ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন :
ক্রমেই ছাত্রজনতার আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ইপিআর ও পুলিশের গুলিতে অনেক ছাত্র-জনতা মৃত্যুবরণ করেন। ৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত করে একই সঙ্গে তার নিকট পূর্ব পাকিস্তানের Zonal Martial Law Administrator-এর ক্ষমতা অর্জন করেন। টিক্কা খান ঢাকায় পৌছান ৫ মার্চ। তার শপথ গ্রহণ করার কথা ৬ মার্চ। কিন্তু গণআন্দোলনের তীব্রতা ও আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন লক্ষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে গভর্ণর পদে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান। ৫ মার্চ রেডিওতে ঘােষণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ বিকেল ৫ টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ঐদিন বিকেল ৫ টার দিকে বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল হােসেন সাহেবদের সঙ্গে তার বেডরুমে বসে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা করছিলেন। আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।৫৪
৬ মার্চ বিকেলের বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দিলেন—টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের মার্শাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং তার নির্বাহী আদেশেই প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। এর পাশাপাশি তিনি ১০ মার্চ আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনা টেবিলে বসার আহ্বান জানান। তাৎক্ষণিকভাবে এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সভায় বসেন এবং বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে ওয়াজেদ মিয়ার বিবরণটি নিম্নরূপ :
৬ মার্চ বিকেলে ইয়াহিয়ার ভাষণ শােনার পর ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু তার হাইকমান্ড এএইচএম কামারুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, ড. কামাল হােসেন ও অন্যান্যদের নিয়ে সভা করেন। সভায় তিনি বলেন, ১০ মার্চ তারিখে প্রস্তাবিত গােলটেবিলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানী করে মুজিবুর রহমান অংশ নেবেন না।৫৫
সেই রাতে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং ড. কামাল হােসেনকে নিয়ে আলােচনা অব্যাহত রাখেন। তাঁরা স্থির করেন রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ও ভবিষ্যত করণীয় দিকগুলাে নিয়ে। কারণ, রাত পােহালেই সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও জনতার স্রোত নেমে আসবে রেসকোর্সের জনসভায়। সভায় বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সারা দেশের মুক্তিকামী জনতা। দুঃশাসনের পদতল থেকে বেরিয়ে আসতে বিপ্লবী জনতাকে বঙ্গবন্ধু কী নির্দেশ দেবেন—তার উত্তেজনায় যেন বাংলার সারা মানচিত্র কেঁপে উঠেছে। সেই সময়টি যে কী উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যে ভরা ছিল প্রতিটি মুহূর্ত তার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় কর্ণেল শাফায়াত জামিলের বর্ণনায় :
৩ মার্চ থেকে দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তাল ও জঙ্গী হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি ক্রমেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে সময়ে রেডিওতে একটা দেশাত্মবােধক গানের (পূর্বের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলােয় আলােক রাঙা) সুর কিছুক্ষণ পরপর বাজানাে হতাে, যার আবেদন আমার মত অনেকের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিতে। চারদিকে তখন বিভিন্ন শ্লোগানে মুখর। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তােমার আমার ঠিকানা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর—রক্ত গরম করা সব শ্লোগান। বাংলাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব তখন ক্যান্টনমেন্ট এলাকার চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ। সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে জনতার এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে না পারলেও আমরা বাঙালি অফিসার ও সাধারণ সৈন্যরা চলমান ঘটনাপ্রবাহে প্রভাবিত ও আলােড়িত হচ্ছিলাম।৫৬
বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তার গ্রন্থ থেকে বােঝা যায়, ভেতরে ভেতরে একটি প্রস্তুতি বাঙালি সেনাবাহিনীর মধ্যেও ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের নানা সংকেত আদান-প্রদান হতাে। সামরিক গােয়েন্দা সূত্রে বঙ্গবন্ধু জানতে পেরেছিলেন যে, স্বাধীন কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ বাঙালি অফিসার ও সৈন্যকে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির পাঁয়তারা করছে। বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যান্য কর্মকর্তা-সদস্যরা সন্দেহ করতাে এটা পরস্পরের মধ্যে প্রায় প্রকাশ হয়ে পড়েছিল।৫৭ বিশেষত, আগরতলা মামলার সময় অভিযুক্ত আসামী লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন সামরিক ও ফজলুর রহমান বেসামরিক আমলার ভূমিকায় বিশেষ পাকিস্তানি গােয়েন্দা খুব সতর্ক ছিল। ঐ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মানচিত্রও এঁকে দেয়। বাঙালি সামরিক অফিসারগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে মওদুদ আহমেদ লিখেছেন :
‘মুজিবের ওপর চারদিক থেকে এককভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল। সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারগণও সৈন্য, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস সকলেই এসময় মুজিবকে জানান যে, এ ধরনের ঘােষণা দিলে তারা মুজিবকে সমর্থন দেবেন। ঢাকায় নিয়ােজিত বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনা অফিসারকে তাদের ডিউটি থেকে অব্যাহত দিলেও যশাের, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য এলাকার বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা তখনও স্বপদে বহাল ছিলেন। বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে আসা তথ্য থেকে বােঝা যাচ্ছিল সেটা স্বাধীনতা ঘােষণার উপযুক্ত সময়।৫৮
আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ইতােমধ্যে দেশের বিভাগীয় শহরগুলােতে কর্মী সম্মেলন করে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাজশাহী বিভাগের নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান ১৯৭১-এর জানুয়ারিতে অর্থাৎ ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এক জনসভায় ভাষণদানকালে বলেছিলেন—প্রয়ােজনে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘােষণা করা হবে। গবেষকের মন্তব্য :
কামারুজ্জামান তার নিজ জেলা রাজশাহীতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে এক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ছয়দফা ও ১১ দফা প্রত্যাখ্যান করলে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘােষণা করা হবে। সভায় আওয়ামী লীগের সক্রিয় প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।৫৯
এইসব প্রেক্ষাপট থেকে বােঝা যায়, ছাত্রজনতা সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি গণমাধ্যম পর্যন্ত তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে অধীর আগ্রহে পরবর্তী কিছু নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু উগ্রবাদী কোন রাজনৈতিক অপশক্তি যেন নৈরাজ্যের সুযােগ না নিতে পারে বঙ্গবন্ধু সে ব্যাপারেও ছিলেন অত্যন্ত সজাগ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।৬০
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন এবং সুনির্দিষ্টভাবেই স্বাধীনতার ঘােষণা আসবে এটা ছাত্রজনতার মত সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদেরও প্রত্যাশা ছিল। ঐদিনের সকালবেলার বর্ণনা দিয়ে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন :
৭ মার্চ সকালে ৩২ নম্বরে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও নেতাকর্মীতে ভরে যায়। বঙ্গবন্ধু তার লাইব্রেরী রুমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমেদ ও ড. কামাল হােসেনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার মিটিং করেন। দুপুরের দিকে সকল নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ বাসায় আহারের জন্যে চলে যান কেবল ড. কামাল হােসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়ে যান।৬১
যদিও তখন পর্যন্ত হাইকমান্ড ব্যতীত কেউ জানতেন না যে বঙ্গবন্ধু বিকেলের রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় কী ঘােষণা দিতে যাচ্ছেন। তবে ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানের গােয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি পূর্বেই অনুমান করে নিয়েছিলেন যে শেখ মুজিব ৭ মার্চের সভায় চূড়ান্ত একটি ঘােষণা দিতে যাচ্ছেন আর সেই ঘােষণাটি হবে পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার। যার ফলে ইয়াহিয়া খান বারকয়েক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করেন এবং বার্তা পাঠান। এই প্রসঙ্গে সিদ্দিক সালেক লিখেছেন :
The meeting was adjourned at midnight without decision, It was to meet again eraly next morning, meanwhile, two important development took place, President Yahya Khan had a long telephone conversation with Mujib on 6 March perruading him not to take a step from which there would be no return. Later, he sent a teleprinter message for Mujib.৬২
কিন্তু বাংলার জনগণ তথা আওয়ামী কর্মীরা তখন ঢাকা শহরকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। মূলত, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্বই ছিল না। সেই দিনের ঢাকা শহরের বর্ণনা দিয়ে সিদ্দিক সালেক আরাে লিখেছেন :
The Awami League volunteers established check points on all major routes leading to the airport to stop the out flow of Bangladesh wealth’. The strongest picket was at the Farm Gate on the city airport road.৬৩
বিশেষত, ছাত্রজনতার এক উত্তাল তরঙ্গ ৭ মার্চ ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচিছল সকাল থেকেই। পাকিস্তানি জেনারেলদের ভাষ্য থেকেই সেই চিত্রটি সুন্দর ফুটে ওঠে। এই প্রসঙ্গে রাও ফরমান আলী খান তার গ্রন্থে রেসকোর্সের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন :
আমরা যখন ৭ মার্চ ঢাকায় নামছিলাম, মুজিব তখন সাত লাখ মানুষের বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বিমানটি নিচু হয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আমরা সবাই এক জনসমুদ্র দেখলাম।৬৪
বিমানে তখন মার্শাল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী পাকিস্তান থেকে বাংলার মাটিতে নামছিলেন। তিনি প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার করার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন।৬৫ কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তাে আরাে
৭৮
প্রকট হয়েছিল। ৭ মার্চ থেকে সরকারের সকল সংস্থাই শেখ মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অসহায়ত্ব সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার হয়ে পড়েছিল; তথাপি পতনােন্মুখ পরিস্থিতির জন্য যথােপযুক্ত কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ রাওয়ালপিণ্ডি থেকে নেয়া হয়নি।৬৬ পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে কোন দেশপ্রেম ও মানবতাবােধ ছিল না। ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের নেতৃবৃন্দও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাগত জানান ও সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :
পাকিস্তানের সচেতন জনসাধারণের মনে কোনাে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই যে, কুচক্রী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল তাদের দোসররা জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র অনুমােদন ও তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল করার জন্য বেপােরােয়া শেষ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তাদের এই বেপরােয়াভাব এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তারা পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি নিয়ে উদ্বিগ্নতার ভান করলেও আসলে তারা পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়ে জুয়া খেলায় বাজি ধরতেও তৈরি। ওরা হলাে সেই মহল যারা পাকিস্তানের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একসাথে থাকার এক ভিত্তি বের করার জন্য পাকিস্তানি জনগণের শেষ সুযােগকেও হাতছাড়া করেছে।৬৭
৭ মার্চের পর প্রতিদিনের চিত্র তুলে ধরে A Tale of Millions গ্রন্থে মেজর রফিকুল ইসলাম ধারবাহিকভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। তার ভাষ্য নিম্নরূপ :
- On march 15, Yahya Arrived in Dhaka for further discussion with Sheikh Mujibur Rahman. A Member of generals also arrived in Dhaka with Yahya to give final touches to the armys action plan.৬৭
- On March 17, Sheikh Mujib held a meeting with Yahya Khan. At the end of the meeting that latest only an hour, he briefly told the waiting journalists that the discussion would continue. It was apparent that no progress was made in the meeting.৬৮
আলােচনার প্রহসন চালিয়ে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগ করে চিরতরে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। এমতাবস্থায় ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার দলীয় হাই কমান্ডকে নিয়ে ৩২ নম্বরে আলােচনায় বসেন। শেষ পর্যন্ত ৪র্থ দফায় মিলিত হন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। এম এ ওয়াজেদ মিয়া জানিয়েছেন :
২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলী, তাজউদ্দিন, ইয়াহিয়া ও তার সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৈঠক অমীমাংসিত রয়ে যায়।৬৯
তারপর আলােচনা অব্যাহত রেখে শেষপর্যন্ত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানাের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যথাক্রমে কামারুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যান্যরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ২৪ মার্চ সরাদিনই আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তথা আলােচক দল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায়, তারা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন পাকিস্তানি শাসকদল সামরিক সমাধানের দিকে এগিয়ে চলেছে। ২৫ মার্চ সন্ধে সাতটার আগেই একে একে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য অঙ্গদলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তার নির্দেশে নিজ নিজ অবস্থানে চলে যান। সন্ধ্যায় আসে ছাত্র-নেতৃবৃন্দ। রাত আটটায় এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর শেষ মেসেজ লেখা হয়ে যায়।৭০
২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় গণহত্যা। রাত ১২.২০ মি.-এ ইপিআর, পুলিশের ওয়ারলেস-এ ছড়িয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর শেষ বার্তা :
This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on untill the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.৭১
সারাদেশ জুড়ে রাতের অন্ধকারে গণহত্যার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডি ৩২। থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে।
ঘটনার আলেখ্যে দেখা যায়, ২৫ মার্চ রাতে এএইচএম কামারুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। সেই ভয়াল রাতে তিনি ঢাকা থেকে আত্মরক্ষা করে গােপনে নাটোর হয়ে রাজশাহী ও পরবর্তীকালে ৩ এপ্রিল বগুড়ায় আওয়ামী লীগ। নেতা ফেরদৌস জামান মুকুল ও গাজীউল হক সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাতের সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতৃবৃন্দও তার সঙ্গে ছিলেন। তাদের সঙ্গে প্রাথমিক প্রতিরােধযুদ্ধের পরিকল্পনা ও বিভিন্ন অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দেবার জন্য দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি গঠনমূলক আলােচনা ও প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত বগুড়ায়, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চল ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে।
তিনি প্রাথমিক প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে সাংগঠনিক ও প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দিকনির্দেশনা দিয়ে ৪ এপ্রিল ১৯৭১এ হিলি সীমান্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে যান। সেখান থেকে বিএসএফ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তিনি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন। | তবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা যে তার প্রতি ছিল সেটা বােঝা যায় তার কলকাতাপর্বে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্ব পালনের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর তাে নানা স্তরে ইনার সার্কেল ছিল। আমরা জানি না কামারুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর তথা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকের বাইরেও একটি গেরিলাযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি ভেতরে ভেতরে নিয়েছিলেন কিনা। তা না হলে তাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব কেন গ্রহণের জন্য বিবেচনা করা হয়েছিল! ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু হয়ে যায় ছাত্রজনতা, পুলিশ, ইপিআর ও বাঙালি সেনাবাহিনীর প্রতিরােধযুদ্ধ। যুদ্ধ সংগঠনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এএইচএম কামারুজ্জামান।
সহায়ক তথ্যসূত্র-
১. ড. নূরুল হােসেন চৌধুরী, রাজশাহীতে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের আদিপর্ব : বরেন্দ্রের বাতিঘর; সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা ও আবারুল হাসান মিল্লাত, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, রাজশাহী, ২০১৩, পৃ. ১২২।
২. ড. নূরুল হােসেন চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৩।
৩, ড, গৌতম বসু, রাজশাহীতে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা : ১৯০৯-১৯১৫, রাজশাহী
মহানগরীর অতীত ও বর্তমান’, সম্পাদক : মাে. মাহবুবুর রহমান, আইবিএস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, ২০১২, পৃ. ৩৬৮-৩৭৭ দ্রষ্টব্য।
৪. ড. এ এফ এম শামসুর রহমান, রাজশাহীতে পাকিস্তান আন্দোলন ১৯০৬-১৯৪৭, একটি ঐতিহাসিক পর্যালােচনা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭৯।
৫. ড. এ এফ এম শামসুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮৩।
৬. ড. এ এফ এম শামসুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮৫।
৭. মহিবুল আজিজ, চট্টগ্রামের যুববিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের তারুণ্য, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ,
ঢাকা, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯।
৮. ড, তসিকুল ইসলাম রাজা, বাংলাদেশে চার পুরুষের রাজনীতি : হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার, আবদুল হামিদ, শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান এবং এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী মহানগরী : অতীত ও বর্তমান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৩১।
৯. সাইদ উদ্দিন আহমদ, রাজশাহীর প্রতিভা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৬।
১০. মাহবুব জামান ভুলু, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৫০ বছর পূর্তি স্মারকপত্র, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ, রাজশাহী।
১১. ড. তসিকুল ইসলাম রাজা, রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন, গতিধারা, ২য় সংস্করণ, ঢাকা, ২০০৯।
১২. মেজর রফিকুল ইসরাম পিএসসি, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা,
শিখা প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৯, পৃ. ৭০-৭১। ১৩. . শেখ হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট, জোনাকী প্রকাশনী, ঢাকা,
১৯৯৮, পৃ. ১১৮। ১৪. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭২। ১৫. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৩। ১৬. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৩-৭৪। ১৭. শ্যামলী ঘােষ, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ৭। ১৮. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৬-৬৭। ১৯. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫১। ২০. মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, ইউপিএল, ঢাকা, চতুর্থ
মুদ্রণ, ২০১০, পৃ. ১৫। ২১. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১২। ২২. ড. হারুন অর রশিদ, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, আগামী
প্রকাশনী, ঢাকা, ২য় মুদ্রণ, ২০১৫, পৃ. ১৫। 30. Moulana Abul Kalam Azad, India Wins Freedom, New Delhi, India,
1996, p. 246. ২৪. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দুই বাঙালির লাহাের যাত্রা, আফসার ব্ৰাদ্রার্স, ঢাকা, দ্বিতীয়
মুদ্রণ, ২০১০, পৃ. ৮। ২৫. ড. কামাল হােসেন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা ১৯৬৬-১৯৭১, অঙ্কুর প্রকাশনী,
ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৫, পৃ. ৪৭। ২৬. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮। ২৭. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯। ২৮. মাহমুদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সিআইএ, প্রচিন্তা প্রকাশনী, ঢাকা,
চতুর্থ সংস্করণ, ২০১০, পৃ. ২৯। ২৯. মওদুদ আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৯। ৩০. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫২। ৩১. ম্যানিফেস্টোতে ২৬টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। তন্মধ্যে : ১. সার্বজনীন ভােটাধিকার,
২. নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, ৩. গ্রেফতার আইন ও দণ্ড বিধান, ৪. নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, ৫. আইন পরিষদের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব, ৬. যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ ও সড়ক যােগাযােগ উন্নয়ন, ৭. মাদ্রাসা শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার সমন্বয়, ৮, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, ৯. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক
শিক্ষা, ১০. রাজবন্দি ও জেলকোডের সংস্কার ইত্যাদি অন্যতম। ৩২. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৭। ৩৩. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৫। ৩৪, সাইদ উদ্দিন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান (প্রবন্ধ), রাজশাহী প্রতিভা, ১ম খ-,
রাজশাহী এসােসিয়েশন, ২০০০, পৃ. ৩২২।
৩৫. ড. কামাল হােসেন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা ১৯৬৬-১৯৭১, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ১৬।
৩৬. রেহমান সােবহান, বাংলাদেশের অভ্যুদয় : একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, মাওলা ব্রাদার্স,
৪র্থ মুদ্রণ, পৃ. ৩৪। ৩৭. । ড. আনিসুর রহমান, ইস্ট ওয়েস্ট পাকিস্তান ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি অব রিজিওনাল
প্ল্যানিং, ক্যাম্ব্রিজ সেন্টার ফর ইন্টার ন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি,
১৯৬৮, পৃ. ১২। ৩৮. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১।
ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭। ৪০. ফয়েজ আহমদ, আগরতলা মামলা : শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ, সাহিত্য প্রকাশ, | ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০৬, পৃ. ১১-১২। ৪১. সাইদ উদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২১। ৪২. National Assembly of Pakistan Debates offical report, Tuesday, The
27 June, 1967, p. 2194. ৪৩. সাইদ উদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৩। ৪৪. মওদুদ আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৬। ৪৫. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৯। ৪৬. মওদুদ আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৭। 89. Firoz Mahamad, Tatthermichil, firogmahamud71@gmail.com.
- 221. ৪৮, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪২। ৪৯, শেখ হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট, জোনাকী প্রকাশনী, ঢাকা,
পঞ্চম সংস্করণ, ২০১৪, পৃ. ২২৪। 20. Rafiqul Islam, A Tale of Millions, Bangladesh Liberation war 1971,
Ananya, Dhaka, Third edition, 2005, p. 88-89. ৫১. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২। ৫২. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০-৬১। ৫৩. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০। ৫৪. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭। ৫৫. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ,
ইউপিএল, ঢাকা, ৪র্থ সংস্করণ, ২০০০, পৃ, ৭৩। ৫৬. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৪। ৫৭. কর্ণেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময়
নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ষষ্ঠ মুদ্রণ, ২০১৬, পৃ. ১৪। ৫৮. কর্ণেল শাফায়াত জামিল, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি ব্রিগেডিয়ার গিয়াস উদ্দিন
আহমদ চৌধুরী বীর বিএম, মেজর রফিকুল ইসলাম ভূইয়া, এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, মেজর জেনারেল সাফিউল্লাহর গ্রন্থসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ সিরিজগুলােতে একইরূপ তথ্য পাওয়া যায়। বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈন্যগণের অধিকাংশের মধ্যেই এমন প্রস্তুতি থাকায় প্রাথমিক প্রতিরােধযুদ্ধে তড়িৎগতিতে লিপ্ত হওয়া সম্ভব হয়েছিল এবং দেশের (পরবর্তীতে বিভাজিত) সেক্টরগুলােতেই প্রাথমিক প্রতিরােধে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ইপিআরসহ সর্বস্তরের জনতা এককাতারে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গােপন দলিলেও অনুরূপ বিবরণ পাওয়া যায়। ৫৯. রাও ফরমান আলী খান, বাংলাদেশের জন্ম (অনূদিত), ইউপিএল, ঢাকা, ২০১৪,
পৃ. ২২। ৬০. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৮। ৬১. রাও ফরমান আলী খান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩। ৬২. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৫। yo. Siddik Salik, Witness to Surrender, UPL, Dhaka, 1997, p. 52. 18. Siddik Salik, Ibid, p. 51. ৬৫. রাও ফরমান আলী খান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৯। by. Siddik Salik, Ibid, p. 53. ৬৭. রাও ফরমান আলী খান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৯। ৬৮. শ্যামলী ঘােষ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪২। ৬৯. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮১। ৭০. ড. কামাল হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮২। ৭১. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৩-৮৪। ৭২. আলতাফ পারভেজ, মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ইতিহাসের পুনর্পাঠ, ঐতিহ্য,
ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৫৫।
৮৪
Reference: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন