You dont have javascript enabled! Please enable it! এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার বিয়ে-সংসার ও পেশাগত জীবন - সংগ্রামের নোটবুক

বিয়ে-সংসার ও পেশাগত জীবন

এএইচএম কামারুজ্জামান ১৯৫১ সালে বগুড়ার দুপচাচিয়া থানার চামরুল গ্রামে ঐহ্যিবাহী তালুকদার পরিবারে বিয়ে করেন। তার শ্বশুরের নাম আশরাফ উদ্দিন তালুকদার। স্ত্রীর নাম জাহানারা জামান। ডাক নাম লাইলি। দুপচাচিয়ার চামরুল হমের তালুকদার পরিবার ছিল সেই সময়ের অত্যন্ত বনেদী বংশ। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সরদার পরিবারের যােগ্যসন্তান এএইচএম কামারুজ্জামানের সঙ্গে বগুড়ার তালুকদার পরিবারের সুশ্রী সুকন্যা জাহানারা জামানের বিয়ে নিয়ে বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক গল্প প্রচলিত আছে। সরদার পরিবার ও তালুকদার পরিবারের এলাকা জুড়েই বেশ নাম যশ ও খ্যাতি ছিল। সেই সুবাদে দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠে আত্মীয়তার সম্পর্ক। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার পরিবারের উজ্জ্বল সন্তান এবং আধুনিক নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রেসিডেন্সি কলেজের ডিগ্রিধারী যুবক কামারুজ্জামান হেনার বিয়ে রাতিমতাে কৌতূহল জাগার বিষয়। সেই কৌতূহলী বিষয়টি স্পষ্ট না করলে কামারুজ্জামান হেনার জীবনের একটি অধ্যায় অজানা থেকে যায়। তাই তার শ্বশুরকুলের পরিচয়টিও জানা প্রয়ােজন।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, কামারুজ্জামান হেনার পরিবারের প্রধান পুরুষ ছিলেন হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার। আর জাহানারা কামারুজ্জামানের পরিবারের প্রধান পুরুষ ছিলেন আজিম উদ্দিন তালুকদার। আজিম উদ্দিন তালুকদার তকালীন বগুড়ার দুপচাচিয়ার জমিদার ক্ষীরােদ চন্দ্র চৌধুরী এবং আদমদিঘি থানার অঞ্জলি রানী চৌধুরীর জমিদারি এস্টেট থেকে প্রায় দেড় হাজার বিঘা তালুক ক্রয় করেন। সেই থেকে চামরুলের বিখ্যাত তালুকদার পরিবারের গােড়াপত্তন হয়। আজিম উদ্দিন তালুকদারের দুই পুত্র। বড়পুত্র আশরাফ উদ্দিন তালুকদার এবং ছােটপুত্র রইস উদ্দিন তালুকদার। আশরাফ উদ্দিন তালুকদারের তিন পুত্র ও তিন কন্যা। পুত্রদের নাম ডা. আজিজুল হক তালুকদার, মােফাজ্জল হােসেন তালুকদার এবং বেলাল হােসেন তালুকদার। তিন কন্যার নাম—লাইলি, শেফালি এবং হাসনা। জাহানারা জামান লাইলি আশরাফ উদ্দিন তালুকদারের বড়কন্যা। তালুকদার পরিবারের বড়কন্যা জাহানারা জামান লাইলি এবং সরদার পরিবারের বড়ছেলে কামারুজ্জামান হেনার বিয়েটি ছিল তাই মণিকাঞ্চন যােগের মতাে বিষয়।

তালুকদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ আজিম উদ্দিন তালুকদারও ছিলেন রাজনীতিসচেতন মানুষ। বলা যায়, স্থানীয় রাজনীতিতে তালুকদার পরিবারের প্রভাবের প্রায় শতবর্ষের ঐতিহ্য রয়েছে। চামরুল পঞ্চায়েত পরবর্তীতে ইউনিয়নে তালুকদার পরিবার থেকেই বরাবরই প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। বর্তমানেও এই ঐতিহ্য অক্ষুন্ন আছে। এই পরিবারের যােগ্যসন্তান হাসান আলী তালুকদার, শামসুল হক তালুকদার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর। বর্তমানেও এই পরিবারটি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বলাই বাহুল্য, আওয়ামী রাজনীতিসম্পৃক্ত থাকার কারণে ১৯৭১ সালে পাকসেনারা এই বাড়িতে ব্যাপক হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল। আরাে উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে, জাহানারা কামারুজ্জামান-এর ছােটবােন হােসনে আরা বেগম হাসনা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এ বি এম তাজুল ইসলামের স্ত্রী। অর্থাৎ এ বি এম তাজুল ইসলাম ও কামারুজ্জামান একই পরিবারের জামাতা। অপরদিকে, আশরাফ উদ্দিন তালুকদারের মেজমেয়ে শাহানারা বেগম শেফালির স্বামী লন্ডনপ্রবাসী একজন উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা।

তালুকদার পরিবারের পুত্রগণও শিক্ষিত ও স্বনামধন্য। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে চামরুল গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলেও তালুকদার পরিবার ছিল প্রগতিশীল রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে বেশ ঐতিহ্যসম্পন্ন। স্বভাবতই । তালুকদার পরিবারের সঙ্গে সরদার পরিবারের এই সম্পর্ক ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সম্মানজনক।

সরকারি চাকরিসূত্রে বগুড়ার দুপচাচিয়া থানায় প্রায় বছরদেড়েক আমার থাকার সুযােগ হয়েছিল। সেই সুবাদে তালুকদার পরিবারের বর্তমানে জীবিত সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষ আলহাজ্ব তাজুল ইসলাম মােহাম্মদ নূরুন্নবী তালুকদার আমাকে জানিয়েছিলেন—যে, হেনা ও লাইলির বিয়ে হয়েছিল নওগাঁর সিরাজ উদ্দিন দেওয়ানের ঘটকালিতেই। উল্লেখ্য, সিরাজ উদ্দিন দেওয়ান ছিলেন একজন পেশাদার ঘটক। সিরাজ উদ্দিন দেওয়ানের সঙ্গে নওগাঁ আত্রাইয়ের ঐতিহ্যবাহী মােল্লা পরিবারের যােগাযােগ ছিল। মােল্লা পরিবারের সঙ্গে রাজশাহীর নেতা আবদুল হামিদের (কামরুজ্জামানের পিতা) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই যােগসূত্রে নওগাঁ আত্রাই থানার মােল্লা পরিবারের ফজলু মােল্লা, আজাদ মােল্লার মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব আদান প্রদান ও বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। তার বর্ণনা মতে জানা যায়, সেইসময় রাজশাহী থেকে নওগাঁ ও দুপচাচিয়ার যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। কোন পাকা সড়কপথ ছিল না। একমাত্র ট্রেন যােগাযােগ ছিল। কিন্তু ট্রেনে তালােড়া রেলস্টেশন থেকে দুপচাচিয়া হয়ে চামরুলের দূরত্ব প্রায় ৩০ মাইল। এমনই অনুন্নত যােগাযােগব্যবস্থায় আট থেকে দশটি বাসযােগে মাটির রাস্তা দিয়েই রাজশাহী থেকে চামরুল গ্রামে বিয়ের বরযাত্রীগণ গিয়েছিলেন। প্রায় দেড়-দুইশ বরযাত্রী এবং এলাকার গণ্যমান্য অন্যান্য জোতদার আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে গ্রামেই এক হাজারেরও অধিক অতিথিকে আমন্ত্রণ ও আপ্যায়ন করা হয়। তালুকদারের বিভিন্ন তালুকের বড় বড় পুকুর ও দিঘি থেকে বড় বড় রুই-কাতল মাছ, গরু, খাসির মাংস দিয়ে সেই বিয়ে-সভার ভােজ দীর্ঘদিন এলাকার মানুষ মুখে মুখে আলােচনা করতেন। এতবড় বিয়ের আয়ােজন আর কখনাে ঐ এলাকায় হয়নি। তালুকদারবাড়ির বিশাল উঠোনেই সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ভােজসভার আয়ােজন করা হয়েছিল। এখনও সেই তালুকদারবাড়ি, বাগান, উঠোন রয়েছে। রয়েছে তালুকদার প্রাসাদটিও।

সেই সময় বিয়েবাড়িতে কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষের মধ্যে রেষারেষি কিংবা কটাক্ষ করার একধরনের গ্রাম্যসংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে বিয়ে বাড়িতেই বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হলে পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষকেই শান্ত করেন স্বয়ং বিয়ের আসরের বর কামারুজ্জামানই। তার উপস্থিতবুদ্ধি ও পরিস্থিতি শান্ত করার নেতৃত্বমূলক ভূমিকায় দুই পক্ষই শান্ত হয়। বিয়ের কাজ সম্পন্ন ও আপ্যায়নে অনেকটা বিলম্ব হলে কন্যাপক্ষ পথঘাটের বিপদের কথা বিবেচনা করে প্রায় দুইশত বরযাত্রীকে সেদিন রাতে ও সকালের আপ্যায়ন করে বিদায় দিয়েছিলেন। ১৯৫১ সাল থেকেই সহধর্মিণী জানাহারা কামারুজ্জামান লাইলির সঙ্গে শুরু হয় তার সংসার ও দাম্পত্য জীবন। এইসময় বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে সবচেয়ে ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি মােনায়েমবিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গনে। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে। সেই বছরই রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটির ওয়ার্ড কমিশনার পদে নির্বাচিত হন। একদিকে ওয়ার্ড কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে রাজশাহীর নাগরিক সুযােগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য জনসেবায় আত্মনিয়ােগ করেন; অন্যদিকে পেশাগতভাবে শুরু করেন আইন ব্যবসা। পৌরসভার দায়িত্ব পালনে তিনি জনগণের কাছাকাছি যান এবং পরিচিতি পান। পরিচিতি বিস্তৃত হতে থাকে একজন আইনজীবী হিসেবেও। 

ফলে একই সঙ্গে তার ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। সংসারজীবনে তিনি খুব কম সময় অতিবাহিত করেন। যদিও বিয়ের পর তিনি হাজী লাল মােহাম্মদ সরদারের জমিদারি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে রাজশাহী মালােপাড়ায় (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক) একটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করে পৃথকভাবে বসবাস শুরু করেন। এই বাড়িতেই তিনি সাধারণ মানুষকে আইনগত সহায়তা প্রদান করতেন। আইনজীবী হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তার আইনজীবীসত্তার বিকাশও ঘটেছিল সেই প্রিয় চাচার কাছেই। যে চাচা তাকে অ আ ক খ বর্ণমালা শিখেয়েছিলেন সেই চাচা আবদুস সামাদ সাহেব ঐ সময় রাজশাহী জজকোর্টের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রথম শ্রেণির বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে আবদুস সামাদ লিখেছেন :

তাকে আইনের ছাত্র হিসেবে ভর্তি করান হয়। সে যথা সময়ে আইন পাশ করে কিন্তু ওকালতী সত্য মিথ্যার অভ্যাস গড়ে তুলতে অনীহা প্রকাশ করে। আমার সহপাঠী আইনজীবী বীরেন্দ্রনাথ সরকার, আমি এবং অনেকেই উৎসাহ দিয়ে আইনজীবী হিসাবে কোর্টে ওকালতীতে উৎসাহ দেই। আমি তখন কোর্টে অবৈতনিক বিচারক ফলে আমার কোর্টেই হাতে খড়ি। শুরুতে পরিকল্পিতভাবে মামলায় একপক্ষে বীরেন আর একপক্ষে হেনা। এইভাবে বীরেন তার সংকোচ দ্বিধা কাটিয়ে তােলেন এবং অচিরকাল মধ্যেই সে আইনজীবী হিসেবে দ্রুত খ্যাতি অর্জন করে।২

তবে অচিরেই তিনি উপলব্ধি করলেন তার এই পেশায় আদর্শর্বাদ ও বাস্তবতার মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। তাই আবাল্য তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য তিনি মিথ্যার সঙ্গে আপােষ করতে পারতেন না। সত্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তার জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য। সুতরাং আইন পেশাকে তিনি মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারলেন না। বিশেষত ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির সমর্থক হয়ে উঠলেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তিনি রাজনীতিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন।

পেশা হিসেবে রাজনীতিই তাঁর মুখ্য ধ্যান ও জ্ঞান হলেও তা ছিল সর্বতােভাবে নির্মোহ, ছিল দেশপ্রেম ও বাংলার মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা। সঠিক অর্থেই মানুষকে ভালবেসে, মানুষের মুক্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাজনীতিতে যােগ দেন। উদারপন্থী এই রাজনীতিকের অবদান ও আত্মত্যাগ সত্যিই মহান দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তিনি সারা জীবনই ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে গিয়ে কখনই পরিবারকে বড় করে দেখেননি। বড় করেননি নিজের স্বার্থকে। তিনি বড় করে দেখেছেন সবার উপরে দেশকে, দেশের মানুষ ও মাতৃভাষাকে। এই নেতার এমন মহত্ত্বের পেছনে প্রেরণদাত্রী ছিলেন তার যােগ্য সহধর্মিণী বেগম জাহানারা কামারুজ্জামান। স্বামীর কর্তব্যবােধকেই আজীবন তিনি সম্মান করেছেন। তার প্রেরণা ও ত্যাগ ছাড়া কামারুজ্জামান রাজনীতিতে এমন গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা রাখতেন কিনা সন্দেহ। স্ত্রী হিসেবে তিনিও ত্যাগ করেছেন সারাজীবনই। মাত্র ২৫ বছরের সংসারজীবনে তিনি স্বামীকে খুব অল্প সময়ই পেয়েছেন। তিনি স্বামীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কখনই প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেননি। ফলে সন্তান-সন্ততিকে লেখাপড়া ও সমস্ত দায়িত্ব মা হিসেবে তাকেই পালন করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জীবনের চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় তিনি সন্তানদের নিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কলকাতায় স্বামীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য সঠিকভাবে সহযােগিতা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাই এইসব মায়েদের অবেদনার মূল্য অপরিসীম। ত্যাগ ও সাহস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা রচিত হতাে না। 

কামারুজ্জামান ও জাহানারা দম্পতির দুই পুত্র ও চার কন্যা। তাদের সন্তানগণ হলেন-ফেরদৌস মমতাজ পলি (১৯৫৩), দিলারা জুম্মা রিয়া (১৯৫৫), রওশন আক্তার রুমি (১৯৫৭), এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন (১৯৫৯), এএইচএম এহসানুজ্জামান স্বপন (১৯৬১) ও কবিতা সুলতানা চুমকি (১৯৬৪)। ছয় সন্তানকে নিয়ে জাহানারা কামারুজ্জামান গভীর সংকটের মধ্যেই দিনাতিপতি করেছেন। এএইচএম খায়রুজ্জামান পিতার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন :

বাবা বেশ ধর্মভীরু ছিলেন। ছােটবেলায় আমরা তাকে নিয়মিত নামাজ আদায় ও কোরআন তিলাওয়াত করতে দেখেছি। তিনি এত দ্রুত কোরআন তিলাওয়াত করতেন যে, তাকে কোরআনে হাফেজ বলে মনে হতাে। তবে পরের দিকে বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে আমরা তাকে বাসায় তেমন দেখতে পেতাম না। যতক্ষণ বাসায় থাকতেন সর্বক্ষণ নেতা কর্মীদের দ্বারা সন্নিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ফলে আমরা তেমন সঙ্গই পেতাম না। আমরা সব ভাইবােনই বেশ মিস করতাম তাঁকে।৩ স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে এএইচএম খায়রুজ্জামান আরাে লিখেছেন : বাবা অত্যন্ত নরম স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তাই বলে আমরা তাকে ভয় পেতাম না, এমন নয়। তার চোখের দিকে তাকানাের সাহস আমাদের ছিল না। কোনাে অপরাধ করলে শুধু নাম ধরে ডাকলেই সকলেরই আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। বাবার বড় ও ছােট মেয়ে খুব প্রিয় ছিল। বড় আপা পলিকে বাবা খুব ভালবাসতেন। তবে আমরা বাবার সঙ্গ খুব বেশি পাইনি। কেননা, রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় সব সময় নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে থাকত। তখন আমাদের বেশ রাগ হতাে। মা’র সংস্পর্শেই আমরা বড় হয়েছি। আমার মায়ের বেশ ধৈর্য ছিল। তিনি বাবার রাজনৈতিক সঙ্গীদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। মায়ের ওই উদারতা ও সহায়তা না থাকলে বাবার পক্ষে এত বড় নেতা হওয়া হয়তাে সম্ভব ছিল না। এ কারণেই কথায় বলে প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে কোনাে না কোনাে মহিলার হাত রয়েছে। এ কথাটা আমার মায়ের ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রযােজ্য বলে আমাদের মনে হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার ৯ মাস ছােট ছােট ছেলে-মেয়েসহ তিনি যে কষ্ট। স্বীকার করে দিন কাটিয়েছেন সেটি সম্ভব না হলে বাবার পক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব হতাে কিনা বলা মুশকিল।

( পরিশেষে বলা যায়, এএইচএম কামারুজ্জামান যেমন আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন নিরহঙ্কারী সাদামনের মানুষও। তার সহধর্মিণী মিসেস জাহানারা কামারুজ্জামান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—“তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। তিনি ত্যাগের মধ্যেই শান্তি খুঁজে পেতেন। কোন উচ্চাভিলাষ বা লােভ তার মধ্যে দেখিনি। ছিল তার অপরিসীম ধৈর্য আবার সাহসিকতাও।৬

এই সাহস ছিল তিমির হনন করে নতুন সূর্য ফোটাবার। হয়তাে জননী তাই সান্ত্বনা খুঁজেছিলেন এই ভেবে :

তােমার করতলে সূর্য ঘুরছে লাটিমের মতাে। তােমার দুচোখে অগণন নক্ষত্রপুঞ্জ ভীষণ অস্থির। বুকের ভেতর সমুদ্রের গর্জন তুমি ভালােবাসার জীন আবিষ্কার এবং পুনরুৎপাদনের প্রযুক্তি সন্ধানে লক্ষ লক্ষ প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয় ব্যবচ্ছেদে ক্লান্তহীন শল্যবিদ আমার দিকে তাকাবার ফুসরত কোথায় তােমার?

টীকা ও তথ্যসূত্র

১. তাজুল ইসলাম মােহাম্মদ নূরুন্নবী তালুকদার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে এই তথ্য

প্রদান করেন। এ-গ্রন্থের লেখক ‘৯০-এর দশকে সরকারি চাকরিসূত্রে দুপর্চাচিয়ায় অবস্থান করতেন। সেই থেকে এই এলাকার বিভিন্ন সুধীজনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথপােকথন হয়। একদা প্রসঙ্গক্রমে তালকুদার পরিবারে বর্তমানে জীবিত প্রবীণ ব্যক্তি আলহাজ্ব তাজুল ইসলাম মােহাম্মদ নূরুন্নবী তালুকদার উক্ত ঘটনার বিবরণ দেন। উল্লেখ্য যে, তালুকদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাপুরুষ হাজী আজিমউদ্দিন তালুকদার-এর পিতার নাম ছিল নিধি মােহাম্মদ। নিধি মােহাম্মদের অপর সন্তানের নাম হযরতুল্লাহ তালুকদার। হযরতুল্লাহ তালুকদারের ভাতুস্পুত্র হলেন তাজুল ইসলাম মােহাম্মদ নূরুন্নবী তালুকদার। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালে অর্থাৎ কামারুজ্জামান হেনা ও তালুকদার পরিবারের কন্যা জাহানারা জামান লাইলীর বিয়ের সময় (১৯৫১) তিনি ৮ বছরের কিশাের। সেই কিশােরজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি দুই পরিবারের আত্মীয়তার প্রসঙ্গে উক্ত বিবরণটি দিয়েছিলেন।

২. মুহম্মদ আব্দুস সামাদ, কামারুজ্জামান হেনার বাল্যজীবন, রক্তাক্ত বাংলা (পত্রিকা)

সম্পাদক গােলাম ফারুক বেলাল ও আকরুল হাসান মিল্লাত, ৩ নভেম্বর, ১৯৮৭ রাজশাহী, পৃ. ২১। এএইচএম খায়রুজ্জামান, স্মৃতির মণিকোঠায় এএইচএম কামারুজ্জামান, দৈনিক উত্তরা প্রতিদিন, রাজশাহী, ৩রা নভেম্বর ২০১৬, পৃ.

৩। ৪. এএইচএম খায়রুজ্জামান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩।

৫. সাইদ উদ্দীন আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান, রাজশাহী প্রতিভা, প্রথম খণ্ড,

রাজশাহী এসােসিয়েশন, ২০০০, পৃ. ৩৩২।

৬, জাহানারা কামারুজ্জামান, (সাক্ষাৎকার) কামারুজ্জামানের ডায়েরি আজও ফেরত

পাইনি, সাপ্তাহিক দুনিয়া, সম্পাদক আহমদ সফি উদ্দিন, রাজশাহী, ৩১ অক্টোবর-৬

নভেম্বর, ১৯৯৫, পৃ. ১।

৭. নূহ-উল আলম লেনিন, একাকী কলম্বাস, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ২৯।

৫০

Ref: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন