বরেন্দ্রবন্ধু আবুল হাসনাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামান হেনার শৈশব কৈশাের শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পিতা আবদুল হামিদ ও মাতা জেবুন নেসার আদরের সন্তান আবুল হাসনাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামান। পিতামাতার আট পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বড় সন্তানকে বড় আদর করে বাবা-মা ডাকতেন ‘হেনা’ বলে। ফুলেল সৌরভদীপ্ত নাম। সত্যিই যে এই নামের সৌরভ বাঙালিকে বিমােহিত করবে তা বুঝি তাঁর পিতামাতা জানতেন। শৈশব থেকেই তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন বিনয়ী ও মিষ্টভাষী। অনাড়ম্বর সহজ সুন্দর জীবনযাপনে ছিলেন অভ্যস্ত। শৈশব থেকেই আজীবন তিনি অত্যন্ত সাধারণত্বকেই গ্রহণ ও বরণ করে নিয়েছিলেন। সেইসময় থেকেই রাজশাহীর ক্রীড়াঙ্গন খুব মুখর ছিল। তিনি শৈশবে সাঁতার কাটতে, ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন। ফুল, পাখি আর প্রকৃতির প্রতি ছিল তার মুগ্ধবােধ। বড়শিতে মাছ শিকার ছিল তাঁর প্রিয় সখ। আবার কখনও কখনও স্কুল থেকে ফিরেই পুকুরপাড়ে বসে মুড়ি ছিটিয়ে মাছের খেলা দেখতে পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে ঘুড়ি উড়াতেও ভালবাসতেন। ভালবাসতেন সঙ্গীত ও কবিতা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল তাঁর আজীবনের অনুরাগের বিষয়। কিন্তু নজরুল ও সুকান্তের বিপ্লবী কবিতায় তিনি অনুপ্রাণিত হতেন। ছােটবেলা থেকেই তিনি ডাইনিং টেবিলের পরিবর্তে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে কাসাপিতলের থালা ও গ্লাসে খেতে ভালােবাসতেন। এমনকি মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি মেঝেতে বসে খেতেন। মাছ, ভাত ও দুধ ছিল তাঁর প্রিয় খাবার। একেবারে বাঙালি আটপৌরে জীবনে ছিলেন অভ্যস্ত। পােশাক-পরিচ্ছদেও ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির রুচি ও বৈভব। পরিবারের বাবা-মার মতাে অন্যান্য আত্মীয়স্বজন বিশেষ করে তার ফুফা (তাঁর নামও আবদুল হামিদ) ফুপু তাকে খুব স্নেহ করতেন। মাতা জেবুন নেসার অনেকগুলাে সন্তান থাকায় বড় সন্তান হেনা শৈশবে তার ফুপুর কাছেই লালিত-পালিত হয়েছিলেন। হেনাকে নিয়েই পরিবারে ছিল অনাবিল শান্তি ও মায়ার বাঁধন। তাঁর শৈশবের বন্ধুদের কাছে জানা যায়, তিনি সবসময়ই সত্য কথা বলতেন। কেউ মিথ্যা বললে তিনি খুবই অপছন্দ করতেন এবং স্বভাবসিদ্ধভাবে তাকে এড়িয়ে চলতেন। তবে সহসা কারাে সঙ্গে কোন বিরােধ বা তর্কে লিপ্ত হতেন না। বাহুল্য অপ্রয়ােজনীয় কথা শুনতে বা বলতে পছন্দ করতেন না। তবে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিকে হলাে, তিনি কাউকে কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা রক্ষা করতেন। কোন প্রকার ছলচাতুরি পছন্দ করতেন না। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে এমন পরিশীলিত রুচিবােধের পরিচয় পাওয়া যায়। বিনয়ী, ভদ্র ও নম্র স্বভাবের বলে শৈশবকাল থেকেই বন্ধুদের নিকট অন্যরকম সমীহ পেতেন। জমিদার বংশের সন্তান হলেও কোন অহংকার ছিল না। বরং সবার সে সহজাতভাবেই মেলামেশা করতেন। তাঁর কাছে ধনী-দরিদ্রের কিংবা হিন্দুমুসলমানের কোনাে প্রকার উঁচুনিচু ভেদ ছিল না। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সমীহবােধ থেকেই তিনি সকলের সমীহ অর্জন করতেন।
তাঁর বাল্যজীবনের আরাে পরিচয় পাওয়া যায় হাজী লাল মােহাম্মদ সরদারের আরেক সন্তান এবং কামারুজ্জামান-এর চাচা মুহম্মদ আবদুস সামাদ-এর লেখা যেকে। তাঁর বাল্যজীবন প্রসঙ্গে লিখেছেন :
শিশুকাল থেকেই পুস্তক নাড়াচাড়া ছবির বই দেখার প্রবণতা ছিল অত্যধিক; ফলে তাকে (হেনা) ও অন্য এক ভাইয়ের পুত্র বানি আমিনকে প্রথম পাঠাভ্যাস গড়ে তােলার দায়িত্ব ছিল আমারই উপর। কামারুজ্জামান আমাকে শুধু চাচা হিসাবে নয় গৃহশিক্ষক হিসেবেও যথেষ্ট সমাদর করতাে। তিনি ছােটবেলা থেকেই বেশ ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। সবার মধ্যে থেকেও যেন কোন গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতেন। সরল দীপ্ত চোখের মধ্যেই একধরনের পবিত্রতা ফুটে উঠতাে। মুখের আদলটাই ছিল নিস্পাপ শিশুসুলভ। মাঝে মাঝেই আত্মভােলা হয়ে যেতেন। ভাবনার আচ্ছন্নতায় হয়তাে কখনও কখনও অন্য কোন ভাইয়ের জামা কিংবা জুতাে পরে বেরিয়ে পড়তেন। স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে তাঁর চাচা। লিখেছেন :
হেনার বাল্যজীবন ও রাজনৈতিক জীবনের বিরাট পরিবর্তন আমরা দেখেছি। সে বাল্যকালে ছিল আত্মভােলা স্বভাব সুন্দর এক নিরীহ বালক। কোন জলসা, বৈঠক বা বাড়ির কোন ঘরে প্রবেশ করলে নিশ্চিন্তে অন্য কারাে জুতা পায়ে দিয়ে বের হয়ে যাবার ঘটনা ছিল প্রায় প্রতিদিনের। কারও জামা গায়ে জড়িয়ে, কারাে জুতা পায়ে পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়িয়েছে অথচ আত্মভােলা হয়তাে ঐ ভুলটি ধরার উৎসাহ আদৌ ছিল না, বা ভেবেও দেখতাে না। কামারুজ্জামানের বাল্যবন্ধু পরবর্তীতে বীর মুক্তিযােদ্ধা মুহম্মদ হায়দার আলী তাঁর স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন—হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার তাঁর বড় পুত্রের বড় সন্তান অর্থাৎ পৌত্রকে খুবই স্নেহ করতেন। ফলে হাজী সাহেবের অভ্যাসগুলাে হেনার মধ্যে শৈশব থেকেই গড়ে ওঠে। হাজী সাহেব ও তার স্ত্রী দুজনেই চা ও পান খেতে খুব ভালবাসতেন। ছােটবেলা থেকেই মুখ লাল করার জন্য হেনার মুখে পান তুলে দিতেন। তাই পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল শৈশব থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। এমনকি সারাদিন ভাত না হলেও চলতাে। এমনই ছিল চা ও পানের প্রতি নেশা।৩
মুখে পান আর ঠোটে মুচকি হাসি তার লেগেই থাকতাে। তাঁর এই সুন্দর স্বভাবসিদ্ধ হাসির জন্য সকলের প্রিয়পাত্রে পরিণত হতেন। শৈশবের এই অভ্যাস যে জীবনের শেষ দিনগুলােতেও ছিল এরকম একটি চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায়। কামারুজ্জামানের অন্যতম বন্ধু এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ-এর স্মৃতিচারণায়। কামারুজ্জামান : তাকে যেমন দেখেছি’ শীর্ষক লেখায় বন্ধুর স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে লিখেছেন :
কামারুজ্জামানের চারিত্রিক মাধুর্য ও বিশিষ্টতা ছিল উজ্জ্বল। আমি তাকে দেখেছি বহু লঘু ও গুরু পরিস্থিতিতে। তার বহু পুনরাবৃত্ত একটি আচরণের দৃষ্টান্ত এরকম—বঙ্গভবনের বাগানের পাশের রাস্তা দিয়ে আমার স্ত্রী এবং আমি একদিন হেঁটে যাচ্ছি—হঠাৎ পেছন থেকে একটি অনুচ্চ ডাক : ‘আপা। দুজনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কামারুজ্জামান। মুখে সলজ্জ দুষ্টহাসি। আমার স্ত্রীর সামনে বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হাত পেতে বললেন, ‘আপা, একটা টাকা দিন, পান ফুরিয়ে গেছে, পান কিনব।’ স্থানকাল চাওয়ার এবং দাবির পরিমাণ সবকিছু নিখাদ কৌতুকের। কামারুজ্জামান জলবায়ুর মতাে পান খেতেন। তাঁর পান ফুরাবার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিতভাবে পয়সাও ফুরিয়ে যেত এবং Deusexmachina-এর মতাে ঐ একটি টাকা যােগান দেয়ার জন্য আমাকে হাজির হতে হত। এ ঘটনাটি বারবার ঘটাতেন কামারুজ্জামান।
তিনি শৈশব ও কৈশাের জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন রুচিবান। সবার সঙ্গে হাস্যপরিহাস করে সময় কাটাতে ভালবাসতেন। আবার কোন একটি বিষয় বা সমস্যা নিয়ে কেউ সাহায্য চাইলে তা পূরণের জন্য তিনি উৎকণ্ঠিত ও ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। তাঁর শৈশবের অপর এক বন্ধু বলেছেন-“ছােট বনগাঁর হায়দার, মুরসইলের জলিল, গহমাপাড়ার রহিম, তালাইমারীর হুদা আরাে অনেকেই হেনার কাছ থেকে ছােটবেলায় নানারকম ফন্দিফিকির করে পয়সা আদায় করত। কেউ ফুটবল কেনার জন্য, কেউ বই কেনার জন্য, কেউ শুধুই খাওয়ার জন্য তার কাছে পয়সা নিত। যেহেতু হেনা বনেদী পরিবারের হাজী লাল মােহাম্মদের আদরের পৌত্র ছিলেন তাই দাদার কাছ থেকে সময় অসময়ে সব বায়না মেটাতে পারতেন। যেমন নিজের তেমনই বন্ধুদেরও। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্ব খুবই অটুট ছিল। তারা একে অপরকে জীবন দিয়ে ভালবাসতেন। বলাই বাহুল্য, তাঁরা কেউ আজ আর বেঁচে নেই। তবে বন্ধুত্বের বন্ধন থেকেই আদর্শিক বন্ধুত্বে তারা শেষ জীবন পর্যন্ত আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছিলেন। বঙ্গবন্ধুভক্তও। বঙ্গবন্ধুও রাজশাহীতে এলে তাদের খোঁজখবর নিতেন। অর্থাৎ কামারুজ্জামানের বাল্যবন্ধুরাও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে অতি প্রিয় অতি আপনজন।
তাই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী খােকা আর ১৯২৩ সালের ২৬ জুন নাটোরের নূরপুর গ্রামে জন্ম নেয়া ‘হেনা’ হৃদয়ের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন। তাদের আদর্শিক বন্ধুত্ব চিরঅম্লান। প্রসঙ্গত আর একটি মন্তব্য স্মরণীয় বঙ্গবন্ধু অনুরক্ত কামারুজ্জামান ছিলেন প্রাণােচ্ছল পুরুষ। রাজনীতিকে এত সহজভাবে নিতে কাউকে সচরাচর দেখা যায় না। বন্ধুরা তাে বটেই প্রতিপক্ষরা পর্যন্ত এই মানুষটিকে ভাল না বেসে পারেন নি। বয়সের কোন ভেদাভেদ ছিল না তার কাছে। সবার তিনি প্রিয় হেনা ভাই। পান চিবুচ্ছেন, মুখে গানের কলি, দুঠোটের ফাক দিয়ে মিটিমিটি হাসি–সে চেহারা যে দেখেছে সে আর জীবনেও ভুলতে পারবে না। এমন দরদী মনের মানুষ আবার রাজনৈতিক মত ও পথের ব্যাপারে একবারে নিরেট একরােখা।৫
তবে কামারুজ্জামান রাজশাহীর সন্তান হলেও জীবনের অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছে রাজশাহীর বাইরে। শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবনের ব্যস্ততায় তিনি রাজশাহীর মাটি ও রাজশাহীর মানুষ ভালবেসে, রাজশাহীর উন্নয়নের স্বার্থে, বাংলার মেহনতী মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে গিয়ে প্রিয় রাজশাহীতে জীবনের বেশি সময় কাটানাের সৌভাগ্য তার হয়নি। তাঁর শিশুশিক্ষা হয়েছিল চাচার কাছেই। পরিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁর চাচা আবদুস সামাদ তার বর্ণশিক্ষার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলে তার আপন ফুপা জনাব আবদুল হামিদ সাহেব শিক্ষকতা করতেন। ফলে ফুপার তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন। পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবার পরপরই বদলিসূত্রে জনাব আবদুর হামিদকে চলে যেতে হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। বাবা-মার আদরের সন্তান এবং হাজী সাহেবের নয়নমণি পৌত্র হেনাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুধুমাত্র তার ফুপুর অনুরােধে চলে যেতে হয় চট্টগ্রামে। তিনি ফুপু-ফুপার কাছে থেকেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ফুপুর কাছেই লালিত পালিত হন। ফলে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম গমন তার কৈশােরজীবনে নতুন এক অভিব্যক্তি তৈরি করে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গমন কিশাের কামারুজ্জামানের মনে দেশ-প্রকৃতির প্রতি দারুণ এক অনুরাগ সৃষ্টি করে। তার ভেতরের সৌন্দর্যবােধ ও প্রকৃতিপ্রেম যেন পুরােপুরি জেগে ওঠে। উত্তরবঙ্গের পদ্মাপারের সন্তান তিনি। আজন্ম দেখেছেন উত্তরবঙ্গের রূঢ় প্রকৃতি। মেঘহীন আকাশ। চট্টগ্রামে এসে কিশাের কামারুজ্জামান সমুদ্র, পাহাড়, মেঘলা আকাশ তথা প্রকৃতির পরিমণ্ডলে হৃদয়ে অনুভব করলেন নতুনের শিহরণ। তার মনের কবিত্ব জেগে ওঠে। এখানেই যে মাঝে মাঝে কবিতা লিখতেন তা অনেক পরে জানা যায়। এই সময়ে রচিত তার একটি কবিতা ছিল এরকম :
কি যেন সব নতুন আজ।
পাহাড় চূড়ায় সবুজ গাছ
মেঘের মিছিল, ঢেউয়ের দোলা
পথ হারায় আত্মভােলা
তবু আমি তাে নই একেলা
আকাশ মাথায় পথটি চলা।
ঢেউয়ের দোলায় কথা বলা
সমুদ্র আর পাহাড় ঘেরা
ওই আমার নতুন ডেরা
চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম।
মেধাবী ছাত্র হিসেবে অচিরেই তিনি শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র হয়ে যান। চট্টগ্রামের শিক্ষা-সংস্কৃতির আবহে কামারুজ্জামান নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য—সেই সময় চট্টগ্রামের অত্যন্ত সমৃদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। দুটো প্রতিষ্ঠানই ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ইংরেজি শিক্ষায় অধিক গুরুত্ব দেয়া হতাে। মেধাবী শিক্ষক ও মেধাবী শিক্ষার্থীর মেলবন্ধন ছিল এই স্কুল। ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে এই প্রতিষ্ঠানের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা সর্বজনবিদিত।” এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটিতে ছিল সমৃদ্ধ লাইব্রেরি । শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পঠনপাঠনের পাশাপাশি লাইব্রেরিতে নিয়মিত পাঠ গ্রহণের জন্য বাধ্যতামূলক কর্মসূচি ছিল। ছিল শিক্ষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও ছাত্রদের মূল্যায়ন। এমন শৃঙ্খলাপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে এএইচএম কামারুজ্জামান তাঁর শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ় করে নেন। এখানেই তিনি ইংরেজি, উর্দু, ও বাংলা তিনটি ভাষাতেই সমান দক্ষতা অর্জন করেন। প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে ঐতিহ্যের পরম্পরায় লক্ষণীয় এই প্রতিষ্ঠান থেকেই কবি নবীনচন্দ্র সেন, ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগির, নােবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস, লেখক ও অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ এই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন।
প্রাক্তন মন্ত্রীদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ হােসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ, ডা. আশরাফুল আমীন, এম মাের্শেদ খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হােসেন জিল্লুর রহমান, ইফতিখার উদ্দিন, রাষ্ট্রদূতগণের মধ্যে ডা. এএফএম ইউসুফ, লিয়াকত আলী চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল ইসলাম প্রমুখ। মুখ্যসচিবগণের মধ্যে আবদুল করিম, সৈয়দ হাসান আহমদ, সচিবগণের মধ্যে বােরহান সিদ্দিকী, সরদার রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। বিশিষ্ট প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রকৌশলী অশােক বড়ুয়া, ভৌতবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক, ড. দানীউল হক প্রমুখ লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সামরিক ও বেসামরিক জগৎবিখ্যাত বহু বাঙালি এই প্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। কামারুজ্জামান তাঁর শৈশবশিক্ষা পেয়েছিলেন এমনি একটি গৌরবমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানে। রাজশাহীর কৃতিসন্তান এএইচএম কামারুজ্জামানও প্রায় পাঁচ বছর এই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেন। স্বীকার্য যে, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল তার জীবনগঠন ও মেধাবিকাশে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। কারণ, একাডেমিক পঠনপাঠন ব্যতীত এই প্রতিষ্ঠানে ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ সহশিক্ষা কার্যক্রম। ফলে তার মত শিক্ষার্থীর মেধা ও মননের যথার্থ বিকাশ ঘটেছিল এখানেই। তাছাড়াও সমগ্র বাংলায় সবচেয়ে ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবীদের পীঠস্থান ছিল চট্টগ্রামই। তিনি যেহেতু একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, স্বভাবতই রাজনীতিতে তখনও সক্রিয় না হয়েও রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না। বিপ্লবের সূতিকাগার চট্টগ্রামের বীর সেনানী পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বপূর্ণ স্মৃতি ও ঘটনাপ্রবাহ তখন চট্টগ্রামের জনজীবনে ছিল বেশ আলােড়িত ঘটনা। সেসব উত্তুঙ্গ পরিস্থিতিতেই কামারুজ্জামানের চট্টগ্রামের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনা, অন্যদিকে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি কিশোর কামারুজ্জামানের মানসচেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে।
১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি ফিরে আসেন রাজশাহীতে। ১৯৪২ সালেই তিনি ব্রিটিশ বাংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে এই সময়টি ছিল ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভক্ষণ। রাজশাহী কলেজ ছিল সেইসব আন্দোলনের সূতিকাগার। ড. স্নেহময় দত্ত সে-সময় (১৯৪১ থেকে ১৯৪৫) রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এইসময় ব্রিটিশ সরকার বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় সার্জেন্ট রিপাের্ট প্রণয়ন করেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজসহ রাজশাহী কলেজের মত অন্যান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে তখন ইংল্যান্ডের শিক্ষার মানসম্মত পাঠ্যক্রম প্রবর্তনের চেষ্টা চলতে থাকে। তবে পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ব্রিটিশবিরােধী রাজনৈতিক তরঙ্গ সেই দিনগুলােকে যেমন অস্থির করেছিল, তেমনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবিনাশী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতি বাংলার মানুষের জীবনে বয়ে আনে দুর্ভোগ। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান কামারুজ্জামান স্বভাবতই রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালেই। জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। ১৯৪২ সালেই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক ও ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।৮ রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ও রাজনীতিতে সরাসরি অভিষেক ঘটে যায়।
১৯৪৪ সালে এএইচএম কামারুজ্জামান রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। উচ্চশিক্ষার জন্য আবারাে তাঁকে রাজশাহী ছেড়ে যেতে হয় কলকাতায়। ব্রিটিশ বাংলার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই সময়ও অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে কলকাতায় অবস্থান করলেও তিনি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।
তিনি মেধাবী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। মেট্রিকুলেশন ও আইএ পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করায় মেধাবী ছাত্র হিসেবেই কামারুজ্জামান তৎকালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। গৌরবমণ্ডিত এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও অধ্যয়নের সুবাদে এএইচএম কামারুজ্জামান তাঁর জীবন গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব অতিবাহিত করেন। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই যে, পূর্ববঙ্গের খুব অল্পসংখ্যক মুসলিম ছাত্র তখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নের সুযােগ পেতেন। কেবলমাত্র ধর্মীয় ও আদর্শিক ভিন্নতা নয়, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভিন্নচিত্রও ছিল বেশ স্পষ্ট। সার্বিক অর্থেই কলকাতার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তখন পর্যন্ত মফস্বলের জন্য পথ প্রশস্ত হয়নি। যদিও নবগঠিত কৃষক প্রজা পার্টির নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতার রাজনীতিতে প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন—তথাপি পূর্ববঙ্গ ছিল পশ্চাৎপদ ও উপেক্ষিত। পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ ভূমির মালিক ছিলেন কলকাতায় বসবাসরত কয়েকজন জমিদার। পূর্ববঙ্গের নানা স্থানে জোতদারবিরােধী কৃষক আন্দোলন তখন বেগবান। ফলে পূর্ববঙ্গে প্রজা-জমিদার, সুদ ব্যবসায়ী, ঋণ গ্রহীতা ও জোতদার বর্গাদারদের মধ্যকার বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা স্থানীয় পর্যায় ছেড়ে প্রাদেশিক রাজনীতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পূর্বেও জমিসংক্রান্ত বিরােধে কোন কোন এলাকায় মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানাে হতাে, এখন তা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাদেশিক রাজনীতির মেরুকরণে শক্তিশালী উপাদানে পরিণত হল।
শেরে বাংলা ফজলুল হকসহ অন্যান্য মুসলিম নেতার সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় প্রজাস্বত্ব আইন, মালিকানা স্বত্ব, সুদের হার ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিষয়গুলাের বিরুদ্ধে নতুন আইনসভায় বিল উত্থাপন ও অনুমােদন পেতে থাকে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জমিদারি পদ্ধতির হিন্দুমুসলিম সুবিধাভােগীরা বিশেষত হিন্দু জমিদাররা জোটবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। তাই জোটবাধার ক্ষেত্র ও বৈশিষ্ট্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্রমশ বেগবান করে তােলে।৯ একদিকে হিন্দুমুসলিম দূরত্ব, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের শরণার্থী-উদ্বাস্তু উনূল জীবন উপমহাদেশ জুড়ে গভীরতর সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির ছাত্র এএইচএম কামারুজ্জামানের চোখের সামনে ঘটে যেতে থাকে এইসব ঘটনা। কলকাতায় পা রেখেই তিনি দেখলেন কলকাতার ফুটপাতগুলাে উদ্বাস্তু-উন্মুল মানুষের দখলে। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ, অনাহার-অপুষ্টি আর বেদনার্ত মানুষের হাহাকার ভারী করে তুলেছে কলকাতার আকাশ-বাতাস। ভাতের জন্য সস্তায় সম্রম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রত্যক্ষ করলেন সেই মানবিক ক্ষয় ও বিনাশের কাল। মােঘল স্থাপত্য, ব্রিটিশ স্থাপত্য ও পূর্ব পশ্চিমবঙ্গের জমিদারদের অট্টালিকা, খান সাহেব ও মাড়ােয়ারীদের বিলাসবৈভবের নয়নাভিরাম কলকাতার ফুটপাতগুলােতে তখন ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কংকাল হেঁটে বেড়াচ্ছে।১০ ঘােড়াগাড়ি, মানুষটানা রিক্সায় চড়ে কিংবা তখন মুষ্টিমেয় মানুষ বাসে ট্রামে চেপে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাচ্ছে। সেই কলকাতায় পা রাখলেন কামারুজ্জামান। কামারুজ্জামান যে সময় কলকাতায় ছাত্রজীবন শুরু করেন তখনকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল তার ছােট একটি বিবরণ দেয়া যায়—এই দুর্ভিক্ষের সময় ধনী এবং দরিদ্রের, গ্রামের মানুষ এবং শহরের ভদ্রলােকের অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়ে দেখা দেয়। ফেনের আশায় ভিক্ষা করতে করতে শহরের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ মরে পড়ে থাকেন এবং এর মধ্যেই এক দল লােক আবার মুনাফায় ফেঁপে রাতারাতি ধনীতে পরিণত হন।১১
কামারুজ্জামানের পিতামহ হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের মতাে নেতারা তাে হতদরিদ্র মানুষের মুক্তি লক্ষ্যে প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তারপরও উপমহাদেশের দুই পুঁজিবাদী বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ ভােগবাদী ধনতান্ত্রিক পুঁজির বিকাশের স্বার্থে গণমানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করেননি। তবে এইসব অবক্ষয়ের ভেতরও ব্রিটিশবিরােধী রাজনৈতিক তৎপরতায় গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়াে আন্দোলন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই আন্দোলনের একপর্যায়ে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের মাধ্যমে ভারত স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হয়। এই সময় হিন্দুমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতা অখণ্ড বাংলার দাবি জানাতে থাকেন। আমাদের মহান জাতীয় নেতা এএইচএম কামরুজ্জামান এমন জটিল ঘূর্ণাবর্ত সময়ে কলকাতায় অধ্যয়নজীবনে বাংলা ও বাঙালির জীবনভাবনায় রাজনীতিকে মহানব্রত হিসেবে গ্রহণ করে নিতে উদ্বুদ্ধ হন। কারণ মননে তিনি মানবপ্রেমিক, চেতনায় অর্থনীতির অনুধ্যানী একজন ছাত্র। অর্থনীতির ছাত্রের দৃষ্টিতে তিনি দেখেছেন সংকটকাল। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি অনুসন্ধান করেছেন মানবমুক্তির উপায়। মানবমুক্তির জন্য সেতু ও নৌকা হতে চাওয়ায় জন্ম থেকেই তিনি দেখেছেন ব্রিটিশ স্বরাজ বাঙালি তথা সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতাে চেপে বসে আছে। তার নিচে আর্তনাদ করছে কোটি কোটি পরাধীন প্রাণ। তিনি দেখেছেন মুক্তির মন্দির সােপান তলে রক্ত দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ তরুণ। বাংলার যুবসমাজ সেই পাথর সরানাের সংকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পরাধীনতার শৃঙ্খল মােচনের জন্য প্রস্তুত। কারণ, প্রকট হয়ে উঠেছে বেঁচে থাকা। খুবই সত্য মনে হয়েছে—’Society is composed of two great classes, those who have more dinner than appatite and those who have more appatite than dinner.৯২ কলকাতাতেও এই অবস্থা বিরাজ করছে। এই অবস্থার। আরও একটি রূঢ়বাস্তব চিত্র পাওয়া বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে। তিনি কলকাতার দুর্ভিক্ষ এবং মুসলিম লীগের দ্বিচারী রাজনীতি প্রসঙ্গে লিখেছেন-
১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লােক মারা যাচ্ছে। এই সময় আমি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হই। জনাব আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সদস্য হন। তিনি সােহরাওয়ার্দী সাহেবের। মনােনীত ছিলেন। আর খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের মনােনীত প্রার্থী ছিলেন। খুলনার আবুল হাশিম সাহেব। হাশিম সাহেব তাকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক হন। …শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লােকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই। জমিদার জোতদার খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকে লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।১৩ শ্রেণী-রাজনীতিতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়ই ছিল পুঁজিবাদী সুবিধাভােগী শ্রেণীর দল। ফলে, মানবমুক্তির সঠিক আকাঙ্ক্ষা এই দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বশীল দুই দলেই ছিল অনুপস্থিত। যদিও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, তথাপি নব্যশিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে কংগ্রেস জনপ্রিয়তা পেলেও গণমানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ ছিল না। উপমহাদেশের এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই কলকাতায় বঙ্গবন্ধু ও কামারুজ্জামানের অবস্থান।
উভয়েই তখন ছাত্রজীবনের চূড়ান্ত ও পরিণতপর্বে লক্ষণীয়, এই সময় বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র এবং কামারুজ্জামান প্রেসিডেন্সির ছাত্র। কামারুজ্জামান তখনও প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের রাজশাহী জেলা শাখার সহসভাপতি। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু তখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য। তবে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের মুসলিম ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব তখনও বঙ্গবন্ধুর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য এবং মুসলিম ছাত্রদের রাজনীতির মধ্যমণি তখন বঙ্গবন্ধুই। সেই সময়ই বঙ্গবন্ধুর মনে বাঙালির মুক্তির বীজমন্ত্র রােপিত হয়। তিনি সকল স্বার্থ, দীনতার উর্ধ্বে বৃহৎ কল্যাণের কথা চিন্তা করতেন। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :
আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম, এই সকল জঘন্য নীচতা প্রথম দেখলাম, পরে যদিও অনেক দেখেছি, কিন্তু এই প্রথমবার। এই সমস্ত খানবাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজ তাড়ানাে যাবে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হতাে। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণীর লােকেরা। এদের দ্বারা কোনদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হত না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় করতে না পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণীকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু আধটু বাধা দিতে চেষ্টা করতাম কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে ক্ষমতা দখল করে ফেলল। সত্যিকার অর্থে মুসলিম ছাত্রলীগই ছিল মুসলিম লীগের মূল ভরসা। কারণ, মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের বিকাশ ও নেতৃত্ব এদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও তখন পর্যন্ত মুসলিম ছাত্রলীগের কোন নির্বাচন হয়নি। তবুও মুসলিম লীগের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে মুসলিম ছাত্রলীগও দুই অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশ সােহরাওয়ার্দীপন্থী অন্যটি খুলনার আবুল হাশিম তথা খাজা নাজিমুদ্দিনপন্থী। তবে বঙ্গবন্ধু ও কামারুজ্জামান রয়ে যান একই গ্রুপে অর্থাৎ সােহরাওয়ার্দীপন্থী মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন নবীন প্রজন্মের একটি রাজনৈতিক স্রোত সৃষ্টি করতে ছাত্রলীগের বিকল্প নেই। সেই স্রোতের নানামুখী প্রবাহের মধ্যে কামারুজ্জামানও ছিলেন একটি শক্তিশালী তরঙ্গ। যদিও আমাদের কাছে স্পষ্ট কোন তথ্য নেই যে, কলকাতায় অবস্থান কালে বঙ্গবন্ধু ও কামারুজ্জামানের মধ্যে কোন যােগসূত্র ছিল কিনা। কিংবা, মুসলিম ছাত্রলীগের হাজার হাজার কর্মীর মধ্যে কামারুজ্জামানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেছিল কিনা। তবে বঙ্গবন্ধুর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। তিনি সকলের নাম ও ঠিকানা মনে রাখতে পারতেন। কলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের একটি কাউন্সিলের বর্ণনা পাওয়া যায় তার আত্মজীবনীতে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্রলীগ ফেডারেশনের কাউন্সিলের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য এবার তুমুল হট্টগােল হয়েছিল। একজন যুবক সেই সময় সম্মেলনের হলরুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। সেই যুবকটি বঙ্গবন্ধুর প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :
এই সময় হলের উপর তলার বারান্দায় বাইরের ছাত্ররা অনেকে এসেছে, তারা দর্শক। একজন ছাত্র, হাফপ্যান্ট পরা চিৎকার করে বলছে, “আমি জানি, এরা অনেকেই ছাত্র না, বাইরের লােক। শাহ আজিজ দল বড় করার জন্য এদের এনেছে।’ পরে খবর নিয়ে জানলাম ছেলেটির নাম কামারুজ্জামান। পরে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলা পরিষদের সদস্য হয়েছিল।১৫
ধারণা করা যায়, সেটাই ছিল ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান খােকার সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার প্রথম সাক্ষাৎ। তখন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীপন্থী মুসলিম ছাত্রলীগের দুই তরুণ ছাত্রনেতা ছিলেন তাঁরা। সেই তাদের যােগাযােগ ও ঘনিষ্ঠতার যােগসূত্র সম্ভবত আরাে বিলম্বেই ঘটেছিল। সময় ও ঘটনা পারম্পৰ্যে ১৯৪৬ সালে এএইচএম কামারুজ্জামানের ছাত্রজীবন শেষ হয়। অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং রাজশাহীতে প্রত্যাবর্তন করেন। অপরদিকে, ইসলামিয়া কলেজ থেকে বঙ্গবন্ধু গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৪৭ সালে। দেশবিভাগের পর তিনি ফিরে আসেন এবং কলকাতাপর্ব উভয়েরই শেষ হয়।
১৯৪৭ সালেই বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন। কিন্তু, কামারুজ্জামান রাজশাহীতে প্রত্যাবর্তন করেই সরাসরি স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে তার নেতৃত্ব বিকশিত হতে থাকে এবং মানুষের নিকট আস্থাভাজন ও প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। তবে যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল—সেই স্বপ্ন ও মােহভঙ্গ হতে বাংলার জনগণের খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মানুষের মুক্তি ছিল একটি অলীক কল্পনাবিলাস মাত্র। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই পূর্ববঙ্গের মানুষের মনে দানা বাঁধতে থাকে স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। এই পর্বে এএইচএম কামারুজ্জামান ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঐ বছরই আইন বিভাগে ভর্তি হন।
এবং ১৯৫৬ সালে আইন বিষয়ে প্রথম শ্রেণি পেয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন :
কামারুজ্জামান বনেদী পরিবারের সন্তান। তিনি পড়াশােনা করেছেন কলকাতায়। ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। আইনে প্রথম শ্রেণীতে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।১৬
ছাত্রজীবনেই কামারুজ্জামানের সচেতনভাবে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং ছাত্ররাজনীতি থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তার জীবনকথার এই পর্বটিতে আমরা কেবলমাত্র একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎপর্বটি নিয়ে আলােচনা করেছি। তার ব্যক্তিগত জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শেষে রাজনৈতিক জীবনের মূল পর্ব আলােচিত হয়েছে।
সহায়ক তথ্যসূত্র
১. মুহম্মদ আবদুস সামাদ, কামারুজ্জামান হেনার বাল্যজীবন’ (নিবন্ধ), রক্তাক্ত কারাগার
(পত্রিকা) সম্পাদক : গােলাম ফারুক বেলাল, আবারুল হাসান মিল্লাত ও অন্যান্য,
৩ নভেম্বর ১৯৮৭, জেলহত্যা দিবস সংখ্যা, কামারুজ্জামান স্মৃতি সাহিত্য ও সংস্কৃতি
পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৮৭, পৃ. ২০।
২. মুহম্মদ আবদুস সামাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২।
৩. মুহম্মদ হায়দার আলী, রাজশাহীর বীর মুক্তিযােদ্ধা কামারুজ্জামানের স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে
অনানুষ্ঠানিক আলােচনা থেকে লেখক কর্তৃক সংগৃহীত অভিমত।
৪. খান সারওয়ার মুরশিদ, কামারুজ্জামান : তাঁকে যেমন দেখেছি’, উদ্ধৃত : মুহাম্মদ
হাবীবুর রহমান, জাতীয় চারনেতা ও জেলহত্যা, জয়প্রকাশ, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪, পৃ.
৪৬।
৫. শফিকুল আজিজ মুকুল, জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে কিছু লেখা’, রক্তাক্ত কারাগার
(পত্রিকা), পূর্বোক্ত, পৃ. ৪।
৬. মােঃ জাকির হােসেন, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল : সহপাঠক্রমিক কর্মকাণ্ড, স্থানীয়
ইতিহাস, সংখ্যা ১৩, ডিসেম্বর ২০১৪-জুন ২০১৫, সম্পাদক, প্রফেসর ড. আতফুল হাই
শিবলী, আরকাইভস অব বাংলাদেশ হিস্ট্রি ট্রাস্ট, পৃ. ৬৯-৭০।
৭. মুনতাসীর মামুন, আবুল হাসনাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামান, বাংলাপিডিয়া, ১ম খণ্ড
এশিয়াটিক সােসাইটি, ঢাকা ২০০৩, পৃ. ২১৯।
৮. সাদাত উল্লাহ খান, ‘চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল’ বাংলাপিডিয়া, খণ্ড ৪, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৫।
৯. জয়া চ্যাটার্জী, বাঙালা ভাগ হল, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিডেট, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ৮৭। ১০. গােলাম মুরশিদ, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, অবসর ঢাকা, ১ম মুদ্রণ, জুলাই।
২০১৪, পৃ. ৪০১-৪৪৪ দ্রষ্টব্য।
১১. গােলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৩।
১২. W. Chamfort, The 5 Minute Economist, Visit-www.5Minute
Economist.com
১৩. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৭।
১৪. শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫
১৫. শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১।
১৬. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, জাতীয় চারনেতা ও জেলহত্যা, জয় প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪,
পৃ. ৪৭।
৪২