এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার পিতা আবদুল হামিদ মিয়ার বিস্তারিত
জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের পিতামহ হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার ছিলেন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম পুরুষ। প্রথম পুরুষের ঐহিহ্যের সরণিতে আরাে দীপ্ত উত্তরাধিকার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন কামারুজ্জামানের পিতা এবং হাজী লাল মােহাম্মদের পুত্র আবদুল হামিদ মিয়া। আবদুল হামিদ মিয়া ১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ছিলেন হাজী সাহেবের মতই প্রজাদরদী। যদিও লর্ড কর্ণেওয়ালিসের শাসনকালে বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা সেই সময় রহিত হয়েছিল তবুও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পত্তির বিশাল অংশ কাঁকনহাট, গােদাগাড়ি, সিতলাই অঞ্চলে থাকার সুবাদে আবদুল হামিদ মিয়া কৃষক-শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অন্যদিকে, শৈশব থেকেই আবদুল হামিদ বহু প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভের সুযােগ পান। বিশেষত, শরকুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ, শশধর রায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধা কোমল সিংহ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের এই পরিবারে আগমন উপলক্ষে আবদুল হামিদ তাঁদের স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেন। যা তার মানসগঠনে প্রভাব ফেলে। এইসব ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক প্রভাব আবদুল হামিদের মানসগঠনে ইতিবাচক ও কার্যকর হয়ে ওঠে। তিনিও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকালে হিন্দু-মুসলিম জনগােষ্ঠীর মধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতি বেশ সক্রিয় ছিল। স্বভাবতই আবদুল হামিদ মিয়া মুসলিম লীগের রাজনীতিতে অনুরক্ত হন। তিনি সরাসরি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। ১৯৩৬ সালে তাঁর পিতা হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার-এর মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৩৭ সালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এক রাজনৈতিক সফরে রাজশাহীতে আসেন। সফরটির উদ্দশ্য ছিল রাজশাহী অঞ্চলে মুসলিম লীগের একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তােলা। রাজশাহীতে আগমন উপলক্ষে সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করে নেন আবদুল হামিদ মিয়া। তাঁর রুচি, ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে মুগ্ধ করে। তিনি আবদুল হামিদের মধ্যেই এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির যােগ্য নেতৃত্বের গুণাবলি লক্ষ করেন। আশান্বিত হয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী আবদুল হামিদ মিয়াকে সভাপতি এবং রাজশাহীর অন্যতম কৃতিসন্তান মাদার বক্সকে সম্পাদক করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেন। সেই থেকে রাজশাহী অঞ্চলের মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। ব্রিটিশবিরােধী মনােভাব গড়ে ওঠে জনগণের মধ্যে। আবদুল হামিদ জনগণের মন এমনভাবে জয় করেছিলেন যে, দলের চেয়েও ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার আপন ও প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। প্রসঙ্গত স্মরণ করতেই হবে—পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ ততদিনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাদ গ্রহণের জন্য নানাভাবে প্রস্তুত হয়েছিল। জনগণকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হক বােঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হতে হলে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সামিল হতে হবে। রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের মনে এই জাগরণ সৃষ্টিতে আবদুল হামিদ একেবারে জনগণের দোরগােড়ায় পৌছে যেতেন। তার ব্যবহার ও শিক্ষিত-পরিশীলিত আচরণ দিয়ে সবার অন্তর জয় করে নিতেন। দীর্ঘদিন তিনি মুসলিম লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। সেই সূত্রে প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি জয়ী হতেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য (এমএলএ)-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
জাতীয় নেতা কামারুজ্জামানের পিতা আবদুল হামিদ ছিলেন শান্তিকামী এবং অহিংস মানুষ। এলাকায় শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে তৎপর থাকতেন। কোন প্রকার সহিংসতা বা উগ্রতাকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। বরং সমাজে কীভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা যায়, সেই চেষ্টা করতেন। ফলে, মুসলিম লীগের গোঁড়া ধ্যান-ধারণা তিনি পােষণ করতেন না। কারণ, তকালে মুসলিম লীগ গোঁড়া ইসলামপন্থী মাওলানা ও পাকিস্তানি উগ্র পুঁজিবাদী খানদের সংগঠনের রূপ লাভ করেছিল। ফলে, সােহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী কেউই মুসলিম লীগের এই প্রতিক্রিয়াশীলতা মেনে নিতে পারতেন না। তারা বরং সংশয়বাদী হয়ে উঠেছিলেন যে, এই মুসলিম লীগ দিয়ে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন সফল হবে না। লক্ষণীয়, আবদুল হামিদ মিয়াও সেইসব বিবেচনায় নিতেন। তাই তিনি সংঘাত ও সহিংসতার রাজনীতি-বিমুখ ছিলেন। যদিও সেই সময় এই অঞ্চলে বাঘা যতীন বারবার সফর করেছেন। রাজশাহীতে এসে বাঘা যতীন ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। বাঘা যতীনের নেতৃত্বে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় অনুশীলন সমিতি। রাজশাহী কলেজের হিন্দু হােস্টেলকে আখড়া করে সেই সময় জিতেশ লাহিড়ি ও সুশীল দাশ গুপ্তের নেতৃত্বে
26
সশস্ত্র সংগ্রামী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের জনগণের সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়। ক্রমশ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প তৈরি হতে থাকে। বাড়তে থাকে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক দূরত্ব। এই দূরবর্তী বলয়ের ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক সংগঠন CPI (Comunist party of India)। রাজশাহীতে অনুশীলন সমিতির পাশাপাশি সমাজ সেবক সংঘ নামে ছাত্রদের একটি পৃথক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল রাজশাহী কলেজ। অনুশীলন সমিতি’ ও ‘সমাজ সেবক সংঘ রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলসহ কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে একটি অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে। মূলত, ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগ্রামে এসব সংগঠন যখন অস্থির প্রেক্ষাপট তৈরি করে এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে, সমাজে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বাড়তে থাকে—সেই প্রেক্ষাপটে আবদুল হামিদ মিয়া রাজশাহীতে একজন শান্তিকামী সুবিবেচক রাজনীতিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহী অঞ্চলে সংঘাত বন্ধ করতে তিনি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং সফল হন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ঘােষণা দিলে সমগ্র উপমহাদেশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান সৃষ্টির লক্ষ্যে সর্বভারতীয় এই কর্মসূচি ঘােষণা করায় ভারতবর্ষে হিন্দুমুসলিম সংঘাত ও উত্তেজনা আরাে তীব্র হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে কলকাতা, নােয়াখালি, ঢাকা, বিহারসহ ভারতের নানা স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গায় বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম নিহত হয়। অসংখ্য মানুষ বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু হয়ে জীবনরক্ষায় দিকবিদিক ছুটে বেড়ায়। সেই তরঙ্গ এসে পড়ে রাজশাহীতেও। কিন্তু রাজশাহীর হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা আবদুল হামিদ অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেক পাড়ায় মহল্লায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সমর্থ হন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক এস এম আবদুল লতিফ লিখেছেন :
রাজশাহী শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সম্ভাবনা তীব্র হয়ে উঠলে মুসলিম লীগ নেতা আবদুল হামিদ এবং মাদার বশ হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা বন্ধ করার লক্ষ্যে ছুটে বেড়িয়েছেন মহল্লায় মহল্লায়। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় রাজশাহীতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আবদুল হামিদ ও মাদার বশ-এর পাশাপাশি এ সময়ে রাজশাহী শহরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে রাজশাহীর তকালীন প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, এ্যাডভােকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকার, কংগ্রেসের বিপ্লবীনেতা প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ি এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে মুহম্মদ একরামূল হক, আবুল কাশেম চৌধুরী, গােলাম রহমান, মােহাম্মদ সুলতান প্রমুখ স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন।
তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে মধ্যস্থতা ও আপােষ মীমাংসা সম্ভব হয়। ফলে রাজশাহী শহর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পায়।১০ এখানে প্রাসঙ্গিক কারণেই উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের স্ববিরােধিতার কথা উল্লেখ করতেই হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯১৬ সালে লখনৌতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে একটি মৈত্রীচুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির অধিবেশনে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা বালগঙ্গাধর তিলক ও মুসলিম লীগের সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রায় একই সুরে বলেছিলেন I have been a staunch congressman thoughout my life and have been no lover of sectarian cries. অর্থাৎ আমি আমার জীবনভর একনিষ্ঠ কংগ্রেসী ছিলাম এবং কখনাে সাম্প্রদায়িকতার হুংকার ভালবাসিনি। কিন্তু তাদের আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে কোন মেলবন্ধন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় উপমহাদেশের সমাজদেহে গড়ে ওঠে। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষ। এই বিষবৃক্ষের ভেতর দিয়েই বাংলার মানচিত্রে ফাটল ধরে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। সহায়সম্পদহীন ছিন্নমূল হয়। রাষ্ট্রহারা, জাতিহারা, ভাষা ও সংস্কৃতিহারা হয়ে মানুষ ভেসে যেতে থাকে। দেশ ভাগ হয়ে যায়। মুসলিম লীগ নেতা আবদুল হামিদ তার জীবন আদর্শ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে কোন মিল খুঁজে পান না। তিনি বিশেষ প্রেক্ষাপটে মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করেন।
Reference: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন