বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওসমানী
বঙ্গভবনের হল রুমে খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের আগে ভারপ্রাপ্ত MS (P) লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমিন আহমেদ চৌধুরী আমাকে বললেন যে, জেনারেল ওসমানী আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি ফোন ধরার সাথে সাথে জেনারেল ওসমানী আমাকে অভিনন্দন জ্ঞ্যাপন করলেন। তিনি আমার কাজে সন্তুষ্টিজ্ঞ্যাপন করলেন এবং সাহস হারাতে নিষেধ করলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় তিনি আমাকে প্রশংসা করলেন। আমি তার প্রশংসায় বিব্রতবোধ করলাম। কারণ সেই পরিস্থিতিতে আমি কারো প্রশংসা আশা করিনি, অন্ততপক্ষে জেনারেল ওসমানীর থেকে। যখন তিনি আমাকে এত প্রশংসা করছিলেন, আমি ভাবলাম তিনি হয়ত উপহাস করছেন। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আমি কি এই প্রশংসার যোগ্য?” তিনি বললেন, “ওল্ড বয়, তুমি কি জানোনা তুমি দেশকে কী ভয়ানক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছ।” আমি জেনারেল ওসমানীর রহস্যময় মন্তব্য বুঝতে পারলাম না, তবে আমি চুপ থাকলাম।
আমি এখনো পর্যন্ত জানিনা যে সেদিন জেনারেল ওসমানী কেন সমাদর করলেন অথবা তিনি অন্য কিছু বুঝিয়েছিলেন কিনা। আমি এও জানতাম যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে তার অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) তিনি অনেক শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করেছেন কিনা বা কোন অসন্মান দেখিয়েছেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তার (ওসমানীর) এই প্রশংসা যে আসল নয় সেটি যদি আমি বলি, তাহলে হয়ত অন্যায় করা হবে। তাই ভালোটা ধরে নিলে বলাই যায় যে তিনি যা বলেছেন সেটাই বুঝিয়েছেন। সেই খারাপ সময়ে একজন সিনিয়র হিসেবে জেনারেল ওসমানী কর্তৃক আমাকে আশ্বস্ত করাটা হয়ত আমাকে উৎসাহিত করেছে। সৈন্যদের মধ্যে রক্তারক্তি ঘটানোর মত সম্ভবনাগুলো প্রতিহত করতে পেরেছি বলে তিনি হয়ত আমাকে অভিনন্দিত করেছেন। পরিস্থিতি যে উচ্চতায় গিয়েছিলো তাতে গৃহযুদ্ধ বাধার সমূহ সম্ভবনা ছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেই এত দ্রুত (২৪ আগস্ট ‘৭৫) তিনি খন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার হিসেবে যোগ দেয়ায় আমি বিরক্ত হয়েছি। তিনি কেন এত দ্রুত খন্দকার মোশতাকের সাথে যোগ দিলেন? এখানে তাঁর বাধ্যবাধকতা কী ছিলো?
… ক্ষমতায় এসে একদিকে খোন্দকার মোশতাক পশ্চিম জার্মানী থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাওয়াবকে আনতে মেজর রশিদকে পাঠাল, আরেকদিকে, জেনারেল ওসমানীকে ডেকে পাঠাল। এর আগেই একটি কথা শোনা যেতে লাগলো যে তাকে (ওসমানী) খোন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার করা হবে। ২৪ আগস্ট ‘৭৫ ছিলো রবিবার। আমি সংবাদ শোনার জন্য রেডিওর নব ঘোরাচ্ছিলাম। মাত্র ৫ মিনিটের একটা বুলেটিন শোনানো হল। অন্যান্য খবরের সাথে এটাও জানানো হল যে জেনারেল ওসমানীকে খন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার করা হয়েছে। বুলেটিন শেষ হবার সাথে সাথে আমার লাল টেলিফোন বেজে উঠলো। ওপাশে খোন্দকার মোশতাক। জিজ্ঞেস করলেন আমি রেডিও শুনেছি কিনা। আমি সম্মতি জানাতেই সে জিজ্ঞেস করল নিয়োগ আমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি কী জবাব দেব? জেনারেল ওসমানীকে নিয়োগ তো দিয়েই ফেলেছেন, এখন তো কারো মত জানার দরকার নাই। তাই আমি বললাম, হ্যা এটা আমার পছন্দ হয়েছে। এরপর সে বলল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবন আসতে। কথামত আমি বিকেলে বঙ্গভবন গেলাম তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর আগে MS (P) আমাকে জানালো খন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করার আগে জেনারেল ওসমানী আমার সাথে দেখা করতে চায়। ততোক্ষণে, জেনারেল ওসমানীকে বঙ্গভবনে একটি অফিস দেয়া হয়েছে। তাই প্রথমে আমি জেনারেল ওসমানীর কার্যালয়ে গেলাম। বঙ্গভবন যাবার সময় দেখতে পেলাম জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খলিল খুব তাড়াহুড়া করে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মনে হল তাদেরকে কোন কাজ দেয়া হয়েছে যার জন্য তাদের এত তাড়া। আমি যখন জেনারেল ওসমানীর রুমে গেলাম তখন মনে হল তিনি খুব উদ্বেগের সাথে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
অফিসে ঢোকার সাথে সাথে জেনারেল ওসমানী আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন। এবং বসতে বললেন। বসার সাথে সাথে তিনি বলতে শুরু করলেন, “শফিউল্লাহ, সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে আর্মি চিফ হিসেবে তোমার অবদান বিশাল। শূন্য থেকে তুমি এটাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছ। আমি জানি তোমার জন্য আমি কী রেখে এসেছিলাম, আর আজ তুমি নিখুঁত একটি সেনাবাহিনী তৈরি করেছো। তুমি এর জন্য গর্ব করতে পারো।” আমি বললাম, “স্যার, আপনার প্রশাংশার জন্য ধন্যবাদ। স্যার, আমি শুধু গর্ব বোধ করিনা, আমি নিজেকে এর অংশ মনে করি। আমি এই সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করেছি।” এরপর তিনি ধীরে ধীরে মূল কথায় আসলেন। আমি ভাবতে পারিনি যে তিনি এরকম কিছু বলবেন। আমি বুঝতেই পারিনি যে জেনারেল ওসমানী আমাকে বিদায়ী ভাষণ দিয়েছেন। আমি ভেবেছি ডিফেন্স এডভাইজার হিসেবে জেনারেল ওসমানী আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করতে আর্মি চিফ হিসেবে আমাকে কিছুটা প্রশংসা করছিলেন। আমার কমান্ড যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং আমাকে শেষ করে দেয়া হয়েছে আমি ধরতেই পারিনি।
এরপর হঠাৎ করে তিনি মূল বিষয়ে আসলেন। বললেন, “শফিউল্লাহ, এই দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরবর্তীকালীন সময়ে তোমার অবদান অপরিসীম। এখন দেশের জন্য বিদেশেও তোমার সার্ভিস দরকার। প্রেসিডেন্ট চান তুমি দেশের এম্বাসেডর হও। পৃথিবীর যে কোন দেশের, যেটা তোমার ইচ্ছা।” আমার জন্য এটা ছিলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। আমি শূন্যতা নিয়ে তার দিকে তাকালাম। আমি এটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমার স্থানে কে আসছে?” তিনি বললেন, “জিয়া।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সে কী জানে?” তিনি বললেন, “হ্যা, তাকে বলা হয়েছে।” এরপর আর আমি কী বলতে পারি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কবে থেকে শুরু হবে?” তিনি বললেন, “এটা আজকে থেকে এবং এই মুহূর্ত থেকে শুরু হবে।” তখন আমি বললাম, “খোন্দকার মোশতাক তার সাথে দেখা করার জন্য আমাকে ডেকেছেন।”
এমন সময় একজন এসে আমাকে বলল খন্দকার মোশতাক আমাকে ডেকেছেন। যখন আমি উঠে দাঁড়ালাম জেনারেল ওসমানী আমার সাথে আসতে শুরু করলেন। আমাকে দেখে খন্দকার মোশতাক তার সহজাত ভদ্রতা দেখালেন। এবং আমাক বসতে বললেন। এরপর তিনি জেনারেল ওসমানীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু জানতে চাইলেন। সম্ভবত এটা যে আমাকে জানানো হয়েছে কিনা। জেনারেল ওসমানী হা সূচক মাথা নাড়লেন। খোন্দকার মোশতাক একই বিষয়ে কথা শুরু করলেন। তিনিও আমাকে অনেক উৎসাহজনক বাণী দিতে লাগলেন। জেনারেল ওসমানীর মত তিনিও আমার অবদানের কথা বললেন। আমি জানি, খোন্দকার মোশতাক যা কিছু বলছেন সবই মুখের কথা। এর কোন আলাদা অর্থ নেই। বস্তুত আমাকে খালাস করে দেয়া হয়েছে এবং দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনি আমার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন।
খন্দকার মোশতাকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমি বললাম, এই মুহূর্তে বিদেশে কোন এসাইনমেন্টে যাবার ইচ্ছা আমার নেই। তিনি সম্ভবত আমার কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করেননি। এই মন্তব্যে তার আচরণ ছিলো কিছুটা রুক্ষ। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তোমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবনা? তুমি কি দেখোনা শেখ মুজিবের পরিবারের অবস্থা কী হয়েছে?” তিনি বললেন যে তিনি এই প্রস্তাব করেছেন আমার ও আমার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য। আমি তখন যুবক এবং বয়স খুব বেশী হলে চল্লিশ। তার এই হুমকিতে আমার প্রেশার বেড়ে গেল। আমি বললাম, আমি অদৃষ্টে বিশ্বাসী। স্রস্টার উপর আমার দৃঢ় আস্থা রয়েছে। একথা বলতে বলতে আমি আমার তর্জনি আকাশের দিকে নির্দেশ করে বললাম, যুদ্ধের সময় তিনি (সৃস্টা) আমাকে ও আমার পরিবারকে দেখে রেখেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি এখনো সেখানে আছেন এবং একমাত্র তিনিই আমাকে ও আমার পরিবারকে দেখবেন। আর কেউ নয়। একথা বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। খন্দকার মোশতাক কৌশলে আমাকে সরিয়ে দিলো যাতে আমি ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কোন একশন না নিতে পারি।
খোন্দকার মোশতাক জানতো যে আমি তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেইনি। এবং সেভাবে তাকে কোনোদিন এড্রেস করিনি। সে তার নিজের পরিকল্পনামাফিক যত দ্রুত সম্ভব আমাকে সরিয়েছে। কারণ আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর নিয়োগ করা চিফ। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার উপর তার কোন বিশ্বাস নেই। আমার বিরুদ্ধে একশন নেবার জন্য সে নিশ্চই সুযোগ খুঁজছিল। বঙ্গভবন থেকে আর্মার ও আর্টিলারি সরানোর জন্য আমি যে চেষ্টা করে যাচ্ছি সেটা টের পেয়েই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব আমাকে সরানো দরকার। এই সিদ্ধান্তে নিশ্চই মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম ও দলের অন্যান্যদের মত ছিলো। তারা নিশ্চই তাগাদা দিয়েছে যাতে করে তাদেরকে তুলে না নেয়া হয়।
জেনারেল ওসমানী আমাকে বলেছিলেন যে জেনারেল জিয়া আমার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। তার উপরে ২৪ আগস্ট ‘৭৫ চিফ ডিফেন্স স্টাফ (CDS) নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং বিডিআর এর ডিজি ব্রিগেডিয়ার খলিলকে সেই পদে আনা হয়েছে। একই দিনে তাকে প্রোমোশন দিয়ে র্যাংক মেজর জেনারেল করা হয়েছে। এই পদ সৃষ্টির বিষয়টা অবশ্যই জেনারেল ওসমানীর মস্তিষ্কপ্রসূত। স্বাধীনতার পর সেক্টর কমান্ডারদের প্রথম কনফারেন্সে জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনীর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ সম্পর্কে সূক্ষ্ম ধারণা দেন। তারা ধারণামতে CDS পদটি তিন বাহিনী প্রধানের উপরের একটি পদ। এবং এই পদের ব্যক্তি তিনবাহিনী প্রধানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আমরা এটার বিরোধিতা করেছিলাম। তাই এটা নিয়ে তিনি তখন কোন বাড়াবাড়ি করেননি। কিন্তু যখন জেনারেল ওসমানী ডিফেন্স এডভাইজার হলেন, তখন তিনি সেই সুযোগ ও ক্ষমতা পেলেন। সময় নষ্ট না করে তিনি সেই পদটি তৈরি করলেন। পরবর্তীতে দেখা গেল আমাদের কথা সত্য এবং জেনারেল খলিলকে CDS হিসেবে দেখা গেল।
সেদিনের প্রোমোশনতালিকা পড়ে দেখলাম তাদের সবাই রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার। ব্রিগেডিয়ার খলিলউড় রহমানকে মেজর জেনারেল করা হয়েছে। এবং CDS হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদ (সে ‘ndc’ কোর্সে ভারত যাচ্ছিলো) কে মেজর জেনারেল করে তাকে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়েছে। এবং ব্রিগেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগীরকে মেজর জেনারেল করে বিডিআর এর ডিজি করা হয়েছে। সবগুলো প্রোমোশন ও নিয়োগ ২৪ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে করা হয়। এবং একই দিন থেকে কার্যকর ধরা হয়। সবগুলো নিয়োগের মধ্যে জেনারেল এরশাদের ডেপুটি চিফ হিসেবে নিয়োগ পাওয়াটা ছিলো সবচেয়ে অবাক করার মত। কোন ধরণের কমান্ডিং অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে ডেপুটি চিফ করা হল।
খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আমাকে খালাস করে বিদেশে এসাইনমেন্টে পাঠানোর সংবাদ মাথায় করে বিষণ্ণ চিত্তে আমি বাসায় ফিরে আসলাম। সেদিন বাসায় আসার আগেই আমি খবর পেলাম যে জেনারেল জিয়া অলরেডি চিফ হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেছে। তার তাড়া ছিলো। যখন আমি বঙ্গভবনে পৌঁছেছিলাম, তখন সে দ্রুত আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছায়। এবং নতুন চিফ হিসেবে অফিসারদের সামনে এড্রেস করে। জেনারেল জিয়াকে দায়িত্ব হস্তান্তরের কোন সুযোগ আমি পাইনি। এবং আমার বাহিনীর সৈন্যদেরকে বিদায় জানানোর একটা সুযোগও পাইনি। বাসায় পৌঁছানোর পর আমাকে জানানো হয় আমি যেন সেনাভবন থেকে বের না হই। একই রাতে মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স থেকে আমি একটা চিঠি আমার কাছে পাঠানো হয়। সেটা আমাকে অপসারণের অর্ডার। খোন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতা গ্রহণের নবম দিনে আমাকে অপসারণ করার সিদ্ধান নিল। সেই দিন পর্যন্ত আমিই একমাত্র ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বাকিদের প্রোমোশন ও উচ্চপদে পদায়ন করেছে।
পরের দিন, ২৫ আগস্ট ‘৭৫ জেনারেল ওসমানী আমাকে ফোন করে স্বান্তনা দিলেন এবং বললেন আমি যেন ফরেন এসাইনমেন্টের প্রস্তাব ফিরিয়ে না দেই। আমি জানি জেনারেল ওসমানীর কল এমনি এমনি আসেনি। তবু আমি তাকে জানালাম আমি কোথাও যাচ্ছিনা। তিনি আমাকে “না” বলতে নিষেধ করলেন এবং আরেকটু ভাবতে বললেন। এরপর প্রায়ই জেনারেল ওসমানী আমাকে ফোন করতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন আমি মত পাল্টেছি কিনা। আমি প্রতিবারই “না” বলেছি, কিন্তু একদিন একটা সময়ে আমি “হ্যা” বলি। ৩ নভেম্বর ‘৭৫ এর ঘটনার পর আমি আমার মত পাল্টাই। যখন চার জাতীয় নেতা (জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব মনসুর আলী এবং জনাব কাম্রুজ্জামান) কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরকারী নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চাকরী থেকে অপসারণের পর থেকে আমাকে সেনাভবন থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। আমাকে অপসারণের আদেশটি জনসাধারণকে জানানো হয়নি। এমনকি সৈন্যরা জানতোনা যে আমাকে অপসারণ করা হয়েছে। এই খবরটা কাউকে বলতে আমি অত্যন্ত বিব্রতবোধ করতাম। সৈন্যরা সম্ভবত জানতো যে আমি ফরেন এসাইনমেন্টে যাচ্ছি।
সরকারী চাকরী থেকে অপসারণের পরেও আমি আর্মি চিফের অফিসিয়াল বাসভদন ‘সেনাভবন’ এ থাকছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিলো আমি মুক্ত। কিন্তু মূলত আমি ছিলাম নিরাপত্তা হেফাজতে (প্রটেক্টিভ কাস্টডি)। আমার অবস্থা জেলের চার নেতার চেয়ে ভালো কিছু ছিলো না। পাঠককে মনে করিয়ে দেই, ২৪ আগস্ট ‘৭৫ যখন আমি খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আমাকে বিদেশে এসাইনমেন্টের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, সে তখন আমাকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর আমি দেখলাম, আমাদের জাতীয় চার নেতাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হল। ৩ নভেম্বর ‘৭৫ এর ধারাবাহিকতায় ফরেন এসাইনমেন্টে যাবার মত দেয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলোনা। কেউ কেউ আমাকে ভীতু বলতে পারেন – সেক্ষেত্রে আমি জানতে চাইব এরকম পদক্ষেপ কয়জন নিয়েছে? সেই মুহূর্তে আমার পরিবারের নিরাপত্তাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে জোর করা হয়েছে। এবং আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেটা করেছি।
আমার বিদেশ যেতে রাজি হবার সিদ্ধান্তে মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স দুটো চিঠি ইস্যু করে। প্রথমটি হচ্ছে অপসারণের অর্ডারটি বাতিলকরণ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমাকে ওএসডি (OSD – On Special Duty) করার আদেশ।এরপর আত্তীকরণের জন্য এবং বৈদেশিক এসাইনমেন্টে পাঠানোর জন্য আমার সার্ভিস এফেয়ার্স পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় পাঠানোর এগ্রিমেন্ট করে। এটি পাবার পর আমাকে বাইরে যেতে দেবার অনুমতি দেয়া হয় এবং আমার সৈন্যদের থেকে বিদায় নেবার সুযোগ দেয়া হয়। পাহারা সহ কিছু দ্রুত ভিজিটের আয়োজন করা হয় এবং দুই দিনে আমি হেলিকপ্টারে করে চারটি ক্যান্টনমেন্টের সবগুলোতে ভিজিট শেষ করি। এরপর আমি ৩ জানুয়ারি ‘৭৬ কুয়ালালামপুরের উদেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। এবং ১৯৯১ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের বাইরে ছিলাম। ফরেন সার্ভিসে যোগদানের এক বছর পর আমাকে ফরেন সার্ভিস ক্যাডারে আত্তীকরণ করে নেয়া হয়। [1]
References:
[1] Major Gen K M Safiullah BU PSC, 15th August: A national Tragedy, 1st ed. Agamee Prakashani, 2014.