You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.05 | মুখের উপর জবাব | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মুখের উপর জবাব

মায়ের চেয়ে মাসি বেশি দরদ দেখালে লােকে তাতে সন্দেহ করে। ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সরাসরি সমর্থন নেই অজুহাতে আমাদের দেশে যারা মুচ্ছ হয়ে সােভিয়েত বিদ্বেষ উদগীরণে মত্ত হয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে ধরণী ভাসাচ্ছে। তাদের আসল মতলব সম্পর্কে লােকের মনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। এই মায়াকান্নার পেছনে যে দুরভিসন্ধি কাজ করছে তার একটা লক্ষ্য সামরিক চাপে নিপীড়িত বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি সােভিয়েত সমর্থন ও সহানুভূতিকে হেয় প্রতিপন্ন করা, অন্য লক্ষ্য বাংলাদেশ প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত দেশ ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাের ভূমিকা এক বন্ধনীতে সমপর্যায়ে ফেলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ও তাদের মনে হতাশা এনে দেয়া। প্রকারান্তরে এর দ্বারা পাকিস্তানি সামরিক জুন্টা ও তার সমর্থক সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্য করা হয়।
যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার কোনাে একটি জাদরেল ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ফলাও করে প্রচার করে যে, এই বিবৃতির বয়ান গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ ও নেতৃবর্গকে হতাশ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে আরাে কয়েকটি পত্রিকা এই যুক্ত বিবৃতির নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে এবং তারস্বরে এই বলে চিৎকার শুরু করে যে, প্রধানমন্ত্রীর সােভিয়েত সফর সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং সােভিয়েত দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের কিছু পাবার আশা নেই। এসব পত্রিকা এবং কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দলের নেতারা এমন কথাও বলেন যে, সােভিয়েত চাপে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের প্রতি নৈতিক সমর্থনের অবস্থান থেকেও দূরে সরে যাচ্ছেন।
পেচকের স্বভাব দিনের আলােতে চোখ বুজে থাকা। তেমন প্রবৃত্তি যাদের তারা ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সম্বন্ধে ইতিবাচক কিছুই খুঁজে পান নি। যারা চক্ষুস্মান তারা কিন্তু এই যুক্ত বিবৃতিকে বাংলাদেশের অনুকূলে সদর্থকরূপেই দেখতে পেয়েছেন। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদও এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকূল কোনাে উপাদান খুঁজে পাননি। বরং তারা এটিকে স্বাগতই জানিয়েছেন। মুজিবনগর থেকে মন্ত্রিপরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে : ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও সােভিয়েত নেতৃবৃন্দের যুক্ত বিবৃতি ক্রেমলিনে বাংলাদেশ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির প্রতিফলন।
বাংলাদেশ সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে যারা কর্ণপটাহবিদারী চিৎকার শুরু করেছেন, এটা তাদের মুখের উপর সমুচিত জবাব নয় কি? বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা যুক্ত বিবৃতিতে উক্ত রাজনৈতিক সমাধান-এরও অপব্যাখ্যা করেননি বা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পথে অন্তরায় হবার মতাে কোনাে উপাদানও খুঁজে পাননি। রাজনৈতিক সমাধান বলতে পূর্ববঙ্গের জনগণের আকাঙ্ক্ষা, অবিচ্ছেদ্য অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের উপর জোর থাকায় বিবৃতি বরং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার অনুকূলই হয়েছে। তাই মন্ত্রিপরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে : বাংলাদেশের যে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালি প্রতি মুহুর্তে রক্তক্ষয় করছে, উক্ত তিনটি মূল নীতি তারই সমর্থনে যেতে পারে।’
শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতির বক্তব্য সম্বন্ধে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ বলেছেন যে, শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের তেমন অনুকূল অবস্থা একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে যারা মুক্তিসংগ্রাম করছেন, শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত অবস্থা নিরূপণের প্রধান দায়িত্ব তাঁদেরই। তিনটি মূল নীতির দ্বারা তাদের সেই অধিকার স্বীকৃত। সুতরাং ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আকাক্ষার অসঙ্গতি বা তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থে হস্তক্ষেপই বা কোথায়? যুক্ত বিবৃতির দ্বারা কার্যত বাংলাদেশের জনগণের নিজেদের ভাগ্য নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণের অধিকারই স্বীকৃত হয়েছে।
অত্যাচারী ইয়াহিয়ার কাছেই রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে যারা সমালােচনার ঝড় তুলেছেন, সত্যকে বিকৃত করে তারা নিজেদেরই রাজনৈতিক অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন। আগ্রাসনকে যখন আগ্রাসন বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে বলা হয় তখন সেটা আবেদন হয় না, সেটা হয় দাবি বা পরােয়ানা। ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ করাে’ বললে সেটা কি আমেরিকার কাছে অনুরােধ বা আবেদন বােঝায়? আগ্রাসক মার্কিন শাসকদের হাত চেপে ধরার জন্য সেটা বিশ্ব জনমতের দাবি। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে আগ্রাসন বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে দাবি করার অর্থ তার উপর পরােয়ানা জারিরই সামিল। অতিবিপ্লবী সি পি এম নেতৃত্বের মগজে না ঢুকলেও বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ এর তাৎপর্য ধরতে ভুল করেন নি।
ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে পাক জঙ্গিশাহীকে আগ্রাসকরূপে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। কেবল তাই নয়, সােভিয়েত ট্রেড ইউনিয়ন, সােভিয়েত শান্তি কমিটি, সােভিয়েত আফ্রোএশীয় সংহতি কমিটি প্রভৃতি গণসংস্থাগুলােও পাক জঙ্গিশাহীকে সমভাবেই আগ্রাসকরূপে চিহ্নিত করে অবিলম্বে বাংলাদেশে নৃশংসতা ও নরহত্যা বন্ধ করতে বলেছে। সুতরাং আজ এটা দিবালােকের মতােই স্পষ্ট যে, সােভিয়েত জনগণের কাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ধিক্কার আর কাদের প্রতি সহানুভূতি। বাংলাদেশের আক্রান্ত জনগণ ও তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি সােভিয়েত দেশের এই সমবেদনা ও সহানুভূতি সম্পর্কে এর পরও যদি কারাে সন্দেহ বা কুৎসার প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে ওঠে তবে বলতে হবে, কপট হিতৈষী সেজে আসলে সে বাংলাদেশের অহিতই ডেকে আনতে চায়।

সূত্র: কালান্তর
৫.১০.১৯৭১