You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.23 | এবার আঘাত হানলেন মােমেন | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

এবার আঘাত হানলেন মেমান [মােমেন]

ইয়াহিয়ার দিনকাল বড় খারাপ। বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলােতে লেগেছে বাংলাদেশের ঢেউ। ধ্বসে পড়ছে। এক একটি স্তম্ভ। এবার ইরাকের পাক দূতাবাদের পালা। রাষ্ট্রদূত আবদুল ফতে মেমান ছেড়েছেন ইসলামাবাদের চাকরি। নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্যে। একটি ভাড়াটে ট্যাক্সীতে চেপে সাড়ে ন’শ কিলােমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন তিনি কুয়ায়েটে। সেখান থেকে বিমানে পৌছেছেন লণ্ডনে। তারপর ঘােষণা করেছেন তার পরিবর্তনের কথা। মেমানের আগে অনেক পাক-কূটনৈতিক কর্মী নিয়েছেন বাংলাদেশের আনুগত্যের শপথ। কিন্তু আবদুল ফতে মেমানের সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি ছিলেন রাষ্ট্রদূত। পাকিস্তানের হাঁড়ির খবর অবশ্যই রাখেন তিনি। আপােষ আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কোন সম্ভবনা যদি থাকত তবে হয়ত মেমান করতেন না আনুগত্য বদল। তিনি নিজেই বলেছেন, পাক সৈন্যদের সীমাহীন বর্বরতা মিথ্যার প্রলেপে ঢাকতে চাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। কোন বিবেকমান মানুষ সহ্য করতে পারেন না এই অত্যাচার। জঙ্গী শাসকদের মনে যদি জাগত অনুশােচনা এবং মুজিবর রহমানের সঙ্গে চালাতেন যদি আলােচনা তবে হয়ত শেষরক্ষা করতে পারতেন তারা। তার ধার-কাছ দিয়ে যান নি মানবদ্রোহী ইসলামাবাদের শাসক গােষ্ঠী। ওরা করছেন শেখ মুজিবরের বিচার। বাংলাদেশের সঙ্গে আপােষের শেষ সূত্রটুকু ছিড়ে ফেলেছেন জঙ্গী-চক্রীর দল। ডুবন্ত নৌকা থেকে নেমে পড়েছেন মেমান। বেছে নিয়েছেন বাঁচাবার সংগ্রামী পথ।
বাংলাদেশে বাড়ছে মুক্তি বাহিনীর কর্মতৎপরতা। ব্যতিব্যস্ত দখলদার পাক সৈন্যরা। রাশি রাশি শব এবং আহতদের নিয়ে হামেশাই যাত্রীবাহী পাক বিমান যাচ্ছে করাচীতে। ওদের আত্মীয়-স্বজনরা ভেঙ্গে পড়ছে কান্নায়। পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলাের উপর বসেছে কড়া সেন্সরশীপ। আসল খবর ছাপতে পারেন না তারা। যারা চোখে দেখছেন শবের মিছিল এবং শুনছেনি আহতের আর্তনাদ, তাদের মনে দানা বেঁধে উঠছে বিক্ষোভ। ধরা পড়ছে জঙ্গী নায়কদের হিসাব-নিকাশের ভুল। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাঙ্গালী বিদ্রোহ খতম করার পরিকল্পনা এটেছিলেন তাঁরা। কেটে গেছে প্রায় পাঁচ মাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন আগের চেয়ে বেশী জোরদার এবং বেশী বাস্তব। নরম মাটি পেরিয়ে শক্ত মাটিতে ঢুকে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শিকড়। পশ্চিম পাকিস্তানের গায়ে বিধছে আর্থিক দুর্গতির কাঁটা। জনগণের চোখের সামনে নেমে আসছে ক্রমবর্ধমান বেকারীর বিভীষিকা। পূর্ব বাংলার কামধেনু আর জোগায় না পশ্চিম পাকিস্ত েিনর দুধ খেতে চায় সে পাক-দুশমনদের রক্ত। পাঁচ মাস আগেও এ ধরনের অনাসৃষ্টির কল্পনাও করেন নি। কেউ। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বিপদ যত বাড়ছে সিন্ধু এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতারা তত মুখ খুলছেন। আবদুল গফফর খানের পুত্র ওয়ালী খান আশ্রয় নিয়েছেন কাবুলে। জাতীয় আওয়ামী লীগের এই আদর্শনিষ্ঠা নেতা বলেছেন, অখণ্ড পাকিস্তানের অপমৃত্যু সম্পূর্ণ বাংলাদেশকে আর ফিরে পাবেন না। ইসলামাবাদ। জঙ্গী নেতারা ধ্বংস করছেন পাকিস্তান। তাঁদের শাসনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছেন সিন্ধুর মুসলিম লীগ নেতা খুরাে। সাফ কথা বেরিয়েছেন তার মুখ থেকে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ছিল সরকার গঠনের সত্যিকারের অধিকারী। বিরােধী দলের আসনে স্থান নেওয়া উচিত ছিল ভুট্টোর। বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তার জন্য ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টোর পিপলস পার্টি সমভাবে দায়ী।
সামরিক শাসনের কড়াকড়ি চেপে রাখতে পারছে না পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের একটা প্রভাবশালী অংশের অসন্তোষ। বােবাদের মুখে ফুটছে প্রতিবাদের ভাষা। ওদের মুখে নতুন করে কুলুপ আঁটার সাহস নেই জঙ্গীচক্রের। আজ যা বলছেন খুরাে তিন মাস আগে এমন কথা বললে হয়ত তার স্থান হত কারাগারে। পাল্টে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের হাওয়া। ওখানেও জমা হচ্ছে অসন্তুষ্টির বারুদ। ভুট্টো নিজে বেসামাল। বাঘের পিঠে চেপে সওয়ার হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি ক্ষমতা শিকারে। শিকার মেলে নি। সেদিনের ধূর্ত বাহন তাঁর দিকে চেয়ে করছে মুখব্যাদন। বেশী বাড়াবাড়ির দুঃসাহস দেখলেই এই সিন্ধি সওয়ারের ঘাড়ে পড়বে থাবা। কি করবেন এখন ভুট্টো-ইয়াহিয়া? বাক্যবাগীশ ভুট্টোর খেল অচল। ইয়াহিয়ার অন্তরে লেগেছে কাঁপুনি। বাইরে চলছে বীরত্বের অভিনয়। কলমের খােচায় পাইকারী হারে তিনি নাকচ করেছেন অস্তিত্বহীন জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক আইনসভা আওয়ামী লীগের আসনগুলাে। ঢাকায় বসেছে টিক্কা খানের আদালত। ওখানে চলবে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিচার। এদিকে রাষ্ট্রদ্রোহীরা মুক্তাঞ্চলে গড়ে তুলেছেন জাতীয়তাবাদী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ওদের ধরতে গিয়ে নিজেরাই ধরা পড়ছে এবং প্রাণ হারাচ্ছে টিক্কার অনুচররা। পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের কাছ থেকে এতদিন ইয়াহিয়া পাচ্ছিলেন নীরব সান্তনা। ওখানে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছেন প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূত মেমান। তাঁর আনুগত্যের পরিবর্তনে অবশ্যই বুঝবে ইরাক এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্র–পূর্ব পাকিস্তান মুছে যাচ্ছে। সেখানে জন্ম নিচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। একথাই জানিয়ে দিলেন ইরাকের প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূত আবদুল ফতে মেমান।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৩ আগস্ট ১৯৭১