You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.21 | কাবুলে ওয়ালী খান | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

কাবুলে ওয়ালী খান

কাবুলে আশ্রয় নিয়েছেন ওয়ালী খান। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া গরম। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে গণরােষ ঊর্ধ্বগামী। যে কোন সময় নির্যাতনের ষ্টীম রােলার নেমে আসতে পারে পখতুনীদের উপর। বাংলাদেশের মত স্বাধীনতা স্পৃহা তাদেরও প্রবল। ওয়ালী খানের ধারণা, স্বদেশে থাকলে তার গ্রেপ্তার অনিবার্য। তাই তিনি আগেভাগেই বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। হয়েছেন স্বনামধন্য পিতা খান আবদুল গফফর খানের সঙ্গী। সময় এলেই হয়ত ফিরবেন স্বদেশে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জাতীয় আওয়ামী লীগের(ওয়ালী খানের দল) প্রভাব প্রতিপত্তি একেবারে কম নয়। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে এ দল পেয়েছিলেন ছ’টি আসন প্রাদেশিক আইনসভায়ও তারা দখল করেছিলেন বারটি আসন। একক দল হিসাবে ওরাই বৃহত্তম। আদর্শে জাতীয় আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের মতই ওয়ালী খান জঙ্গীশাহী বিরােধ এবং স্বাতন্ত্রকামী। বর্তমান ডামালের মধ্যে এসব নেতার পাকিস্তানে অবস্থানের অর্থ নিঃশব্দে কারাবরণ। হয়ত সামনে পড়ে রয়েছে সংগ্রামের ময়দান। তার প্রস্তুতির জন্যই ওয়ালী খান নিয়েছেন কবুলের আশ্রয়।
ওয়ালী খানের মতামত খুবই স্পষ্ট। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অখণ্ড পাকিস্তানের ঘটেছে অপমৃত্যু। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম ঠেকাবার সাধ্য নেই জঙ্গীশাহীর। এ অঞ্চলের মুক্তি অনিবার্য। পশ্চিম এশিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির লেজুড়ে হিসাবে থাকতে হবে ইসলামাবাদকে। তা ছাড়া অন্য কোন পথ খােলা নেই তাদের সামনে। এ অবস্থায় কি করবে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ তা খােলসা করে বলেন নি ওয়ালী খান। কিন্তু এ অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামীদের মতিগতি সবার জানা। পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবীর অনেক আগেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ তুলেছিল পাখতুনীস্থানের দাবী। তার জন্য যথেষ্ট রক্তক্ষয় করেছেন সাধারন মানুষ। বাংলাদেশের লড়াই এর তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অশান্তি। পাক-সৈন্যবাহিনীতে দেখা দেবে চাঞ্চল্য। পাঠান ইয়াহিয়া খানের হাত পড়বে পাঠানের উপর। পশ্চিম পাঞ্জাবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পাক-জঙ্গীশাহী জানেন এই বিপদের কথা। ওরা এখান থেকে লােক ধরে পাঠাচ্ছেন বাংলাদেশে বাঙালী নিধনে। মারতে গিয়ে যখন এসেছে মরণের পালা তখনই দানা বেঁধে উঠছে অসন্তোষ। পাক-সৈন্যরা মানছে না নিয়ম-শৃঙ্খলা। পাঠান-পাঞ্জাবী বিরােধ সেখানে প্রবল। এর ঢেউ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পৌঁছতে বেশী দেরী নেই। ওয়ালী খানের দেশত্যাগ হয়ত তারই পূর্বাভাস।
এদিকে সিন্ধু প্রদেশও স্বাতন্ত্রেল দাবীদার। ইসলামাবাদের শাসনে সাধারণ মানুষ ত্যক্তবিরক্ত। বাংলাদেশের মতই তারা জঙ্গী চক্রের দ্বারা শােষিত। বড় বড় চাকরি থেকে সিন্ধিরা বঞ্চিত। প্রশাসনে তাদের স্থান নগণ্য। যত দিন যাচ্ছে তত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন ভুট্টো জঙ্গীশাহীর হাতের পুতুল তিনি সিন্ধিরা জানেন, তাঁদের স্বাধীনতার দাবী সােচ্চার হয়ে উঠলে সেখানেও বইবে রক্তস্রোত। ইসলামাবাদের নিরাপদ কোলে আশ্রয় নেবেন ভুট্টো। মরবেন জনতা। সবাই তাকিয়ে আছেন বাংলাদেশের দিকে। মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতির অর্থ ইসলামাবাদের সামরিক শক্তির অবক্ষয়। জঙ্গীশাহীর দুর্বল মুহূর্তে মাথা চাড়া দেবে সিন্ধপ্রদেশ। গণ-বিস্ফোরণের ভিত্তি সেখানে তৈরী। বেলুচিস্তানও অশান্ত। জনগণের এক প্রভাবশালী অংশ স্বাধীনতার দাবীতে সােচ্চার। জাতীয়তাবাদীদের গ্রেপ্তার সম্পূর্ণ। সামরিক শৃঙ্খল দেিয় ক’দিন বেঁধে রাখা যাবে অসন্তুষ্ট জনগণকে? বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের বদলে পাকিস্তানে গজিয়েছে আভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্যবাদ। শােষণ এবং শাসনের প্রধান ভূমিকা নিয়েছে পশ্চিম পাঞ্জাবের জঙ্গীশাহী। তার বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরেছে বাংলাদেশ। জোগাচ্ছে অন্যান্য শােষিত অঞ্চলের প্রেরণা। কোনদিক সামলাবেন ইয়াহিয়া খান? বাংলাদেশকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তিনি এনেছেন গােটা পাকিস্তানের ভাঙ্গন। ওয়ালী খানের ভাষায়—ভেঙ্গে পড়েছে গােয়ালার হাঁড়ি। মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে দুধ। ভাঙ্গা হাঁড়ির টুকরােগুলাে ঘিরে বসে আছেন জঙ্গী নায়কেরা। হাউ হাউ করে কাঁদছেন তারা। গােটা বিশ্ব শুনতে পাচ্ছে সে-কান্না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ আগস্ট ১৯৭১