রাষ্ট্রসঙ্ঘে পাকিস্তানের নতুন অভিসন্ধি
একটি ইংরেজী সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীস্বরণ সিংহের একটি ছবি বেরিয়েছে যাতে দেখান হয়েছে, তিনি নিশ্চিন্ত মনে একটি ঝুলায় দোল খাচ্ছেন। সিংজীর চলা—বল থেকে তার চরিত্র সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা হয় তার সঙ্গে ছবিটির বিলক্ষণ মিল আছে। লােকসভায় গত অধিবেশনে বিভিন্ন সময়ে তিনি যেসব বিবৃতি দিয়েছেন তাতেও দেখা গেছে আমাদের এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহােদয় কখনই উত্তেজিত হন না। পাছে কোন কড়া কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় সে বিষয়ে তিনি খুবই সতর্ক। তার মিতকথনের জন্য তিনি সম্প্রতি দুয়েকবার সংসদ সদস্যদের ভৎসনাও শুনেছেন। ভিয়েতনামে যা চলছে সেটা তার কাছে যুদ্ধ-তুল্য পরিস্থিতির বেশী আর কিছু নয়। তাঁর দপ্তর গােড়ার দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে “এটা সমস্যা সমাধানের গঠনমূলক পথ নয়” এর চেয়ে কঠোরতর আর কোন মন্তব্য করতে পারেন নি।
কিন্তু এহেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সম্ভবত নিজেরই অজ্ঞতিসারে, সম্প্রতি ভারত-সােভিয়েট চুক্তির সমর্থনে ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিভাষা ধার করেছেন। এই পরিভাষায় আমরা ইংরেজী “ডেটারেন্স” শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সাধারণত বৃহৎ শক্তিগুলি নিজেদের সমরসজ্জাকে এই নামের আড়ালে ঢাকার চেষ্টা করে। যুক্তিটা হচ্ছে এই যে, যে সমরসজ্জা প্রতিপক্ষের যুদ্ধলিঙ্গাকে দমিয়ে দেয় সেটা শান্তিরই সহায়ক। ঠাণ্ডা যুদ্ধের ভাবানুষঙ্গে কথাটার যে কিছু বাকা অর্থ দাড়িয়ে গেছে সেটা অবশ্য শ্রীস্বরণ সিংহের দোষ নয়। কিন্তু যুক্তিটা প্রায় সমান্ত রাল। যেহেতু ভারত-সােভিয়েট চুক্তি ভারতের উপর সম্ভাব্য আক্রমণকারীদের আগ্রাসী মনােভাব নিবৃত্ত করবে সেহেতু এই চুক্তি শান্তির চুক্তি, যুদ্ধের নয়। তফাৎ এই যে বৃহৎ শক্তিগুলি যখন নিজেদের সমরসজ্জার একটা কৈফিয়ৎ খাড়া করার জন্য কথাটা ব্যবহার করে, স্বরণ সিং মহাশয় তখন ঐ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন দুটি দেশের মধ্যে একটা সীমাবদ্ধ পারস্পরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যাখ্যা করার জন্য।
কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, এই চুক্তি পাকিস্তানকে হঠকারিতা থেকে নিবৃত্ত করবে, এটা তাে একটা আশা মাত্র। এই আশা সফল হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? ভারত-সােভিয়েট চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এক সপ্তাহের বেশী সময় কেটে গেছে। এর মধ্যে ইসলামাবাদের তরফ থেকে এমন কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি যে তারা এই চুক্তির হুশিয়ারিটা উপলব্ধি করেছেন। সীমান্তে পাকিস্তান ক্রমাগত প্ররােচনার সৃষ্টি করে যাচ্ছে। উত্তর সীমান্ত রেলপথের চারগােলা রেল ষ্টেশনের কাছে যেভাবে পাকিস্তানি নাশকতা চালান হয়েছে, ত্রিপুরার জলিলপুর শরণার্থী শিবিরে অনুপ্রবেশ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা যেভাবে ১১ জনকে হত্যা করেছে তাতেই পরিষ্কার যে, পাকিস্তান সব রকম ঝুঁকি নিয়েও সীমান্ত উত্তেজনা জইয়ে রাখতে উৎসুক। আসলে একটা রাষ্ট্র সাধারণত নিজের ভালমন্দ বুঝে যে সতর্ক বিবেচনা নিয়ে চলে, পাকিস্তানের কাছ থেকে এখন সেই ধরনের কোন যুক্তিপূর্ণ আচরণ আশা করাই বৃথা। ইসলামাবাদের শাসকরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। একটা ভুলের জট ছাড়াতে গিয়ে তারা আর একটা ভুলের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন। এই অবস্থায় তারা আপন স্বার্থও ঠিকমতাে বুঝে উঠতে পারবেন না, এটাই তাে প্রত্যাশিত।
পাকিস্তান যখন একদিকে এইভাবে ক্রমাগত সীমান্তে উত্তেজনা যুগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তখন সে সেই উত্তেজনা প্রশমনের নামে সীমান্তে রাষ্ট্রসঙ্গের প্রহরী মােতায়েন করতে চাইছে। এর আগে তবু একটু নৈচার আড়াল দিয়ে বলা হচ্ছিল, রাষ্ট্রসঙ্রে পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক নয়, রিলিফের তত্ত্ববধায়ক পাঠান হােক। এখন পাকিস্তান সরাসরি নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের আমদানি করতে চাইছে ইসলামাবাদের আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সীমান্তের এপারে-ওপারে মুক্তিবাহিনীর সহজ গতায়াত তারা বন্ধ করতে চায়, শুধু সীমান্তের ওপার থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের পাঠিয়ে সেখানকার গতিবিধি একমুখী করতে চায়। সেদেশের জঙ্গী শাসকরা জানেন, তাদের একার শক্তি নেই সীমান্ত বন্ধ করার, সেইজন্য তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘকে আনতে চাইছেন। তাদের পিছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ থেকে পাওয়া সর্বশেষ খবর হচ্ছে, পাকিস্তানের এই চেষ্টা সফল হয় নি। তাহলেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই ধরনের চেষ্টা চলতেই থাকবে।
এই অবস্থায় ভারত কি করবে? তাকে পাকিস্তানের ও তার মিত্রদের যে কোন হঠকারিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, নিরবছিন্ন আশ্রয়প্রার্থীদেরস্রোত সামলাতে হবে, বাংলাদেশের প্রশ্নটিকে আন্তর্জাতিক প্রশ্নে পরিণত করার জন্য প্রচণ্ড কূটনৈতিক চাপের মােকাবেলা করতে হবে। ভারত সরকারের সামনে অত্যন্ত কঠিন সময়। শুধু সােভিয়েট-ভারত চুক্তির উপর ভরসা করে থাকলে চলবে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ আগস্ট ১৯৭১