You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.15 | বাংলাদেশের স্বীকৃতির দিন কি পিছিয়ে গেল? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বীকৃতির দিন কি পিছিয়ে গেল?

সংসদের বাজেট অধিবেশন সমাপ্ত। শেষের দিনগুলাে নাটকীয় উত্তেজনায় ভরা। সংবিধান সংশােধন বিল এবং ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি পেয়েছে সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থন। এ দুটি দলিল জাতির জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি দুর করবে সমাজতান্ত্রিক অগ্রগমনের পথে আইনগত বাধা। দ্বিতীয়টি বাড়বে ভারতের নিরাপত্তাবােধ। কেন্দ্রীয় সরকার যদি নিতে না পারেন পরিবর্তিত অবস্থার সুযােগ ভেবে সে-দোষ তাঁদের। ব্যর্থতার কোন অজুহাত মানবেন না দেশবাসী। নয়াদিল্লী যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। এখন এসেছে এগিয়ে যাবার সুবর্ণ সুযােগ। কিন্তু সবার উপরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। শরণার্থী সমস্যার আশু সমাধান না হলে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলাের উপর চলবে অস্ত্রোপচার। কেন্দ্রীয় সরকারের চারদিকে জমা হবে। বিরুপ সমালােচনার পাহাড়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ সম্পর্কে সচেতন। খােলাখুলিই বলেছেন তিনি—সংবিধান সংশােধন সামনে পদক্ষেপের সূচনা, শেষ নয়। জাতি মেনে নিয়েছেন তার কথা। সরকারের কর্মফল দেখতে অধীর আগ্রহে তারা অপেক্ষমান। অনেক কথা শুনেছেন জনসাধারণ। এখন তাঁরা চান কাজ। কাজের স্বারাই প্রমান হবে শ্রীমতী গান্ধীর কর্মতৎপরতা। তাঁর নেতৃত্বের স্থায়ী বনিয়াদ তৈরীর উপযুক্ত ক্ষেত্র এখানেই।
সবার আশা ছিল, সংসদের সাম্প্রতিক অধিবেশনে স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু নিরাশ করেছেন নয়াদিল্লী। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মিলছে না কোন হদিশ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের বিরােধী তিনি নন। শুধুমাত্র উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। গত একত্রিশে মার্চ মুক্তিসংগ্রামীদের সমর্থনে সংসদ দিয়েছিলেন সর্বসম্মত প্রস্তাব। তাদের বিজয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের ছিল না কোন সংশয়। তারপর সঙ্গত কারণেই চারদিক থেকে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের দাবী। ওটা নিঃসন্দেহে সংসদীয় প্রস্তাবের পরবর্তী পর্যায়। দীর্ঘ সাড়ে চার মাস ধরে নয়াদিল্লী দেখিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের যুক্তি। তাতে বন্ধ হয় নি গণদাবী। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আশা তলিয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের শবের স্তুপে। ইয়াহিয়া দমেন নি একটুকু। তিনি বারে বারে দিচ্ছেন রণ হঙ্কার। অনেকেই মনে করতেন—বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র দ্বিগুণ দূরত্ব বেঁধে যাবে পাক-ভারত লড়াই। এখন সে-সম্ভাবনা কম। ভারতসােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি বন্ধু বাজদের সামনে চরম হুশিয়ারী। কিন্তু এই চুক্তিতেই রয়েছে একটা বিরাট বাধা। যুক্ত ইস্তাহারে ভারত-সােভিয়েট সমভাবেই চেয়েছে বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। কিন্তু এই সমাধান এবং তার উপর অস্পষ্ট। এখন যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হােক না তা অবশ্যই সােভিয়েট রাশিয়ার সমর্থন এবং অনুমােদন সাপেক্ষ। তাতে হয়ত পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সময়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং আশ্বাস দিয়েছেন লােকসভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার হারায় নি ভারত। মস্কোর অনুমােদন না পেলে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতখানি সম্ভব সে-সম্পর্কে বির্তক থামবে না সহজে। যদি এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নেবার সাহস থাকত নয়াদিল্লীর তবে প্রয়ােজন হত না ভারত-সােভিয়েট চুক্তির। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে রূঢ় বাস্তব স্কার করাই যুক্তিযুক্ত। জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার খাতিরেই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তে সােভিয়েট রাশিয়াকে করতে হবে সহযােগী। মস্কো যদি দিতে চান ইয়াহিয়ার উপরে চাপ, ক্ষতি নেই। যে চেষ্টার নয়াদিল্লী হয়েছেন ব্যর্থ, তাতে মস্কো যদি হন সফল তবে সবাই তাদের জানাবেন অভিনন্দন। কিন্তু ভারতের মূল্যায়ন মিলছে না সােভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে। তার কাছে অখণ্ড পাকিস্তান মৃত। ওকে বাঁচিয়ে তােলার সম্ভাবনা কম। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী ভাঙ্গবেন, মচকাবেন না। বিলম্বের সময় নেই। ভারতের অর্থভাণ্ডারের উপর শরণার্থীর চাপ সাংঘাতিক। ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা বলুন মস্কো। দেখুন পান কিনা কোন সাড়া। কিন্তু দরকার একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ। নয়াদিল্লীর উচিত পাল্টা চাপ সৃষ্টি সােভিয়েট রাশিয়ার উপর। বাংলাদেশের স্বীকৃতিদান আশু প্রয়ােজন। জনসংঘের আন্দোলন সঙ্কীর্ণ বললে ভুল করা হবে। এ দলের উপর হয়ত আস্থা নেই অনেকের। কিন্তু যে দাবী নিয়ে তারা করছেন আন্দোলন তাতে মৌন এবং সক্রিয় সমর্থন আছে। জনসাধারণের একটা বড় অংশের। এ সত্য অস্বীকার করার অর্থ বাস্তব অবস্থায় মােকাবিলায় অনিচ্ছা।
আজ স্বাধীনতা দিবসের পূণ্য প্রভাতে আজ জাতিধর্ম ও মতপথ-নির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসী আমরা জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানাচ্ছি। এই পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে উঠল্ট কণ্ঠে ঘােষণা করছি, এই পতাকার সম্মান আমরা অক্ষুন্ন রাখব। এর গৌরব অব্যাহত রাখার জন্যে প্রয়ােজন হলে হাসিমুখে প্রাণ দোব। বহু সাধকের তপস্যায়, বহু সৈনিকের রক্তদানে যে স্বাধীনতা লাভ করেছি আমরা, তাকে সর্বশক্তি দিয়েই রক্ষা করব আমরা। দেশ ও মানুষের মঙ্গলে আত্মনিয়ােগ করে সেই স্বাধীনতার মহিমান্বিত রুপটিকে আরাে উজ্জ্বল করব। বাইরের সমস্ত বৈরিতা, ভিতরের সমস্ত বিরােধ জয় করে আনন্দময় সুন্দর করব আমরা আমাদের দেশকে, আজকের শুভ মূহূর্তে এই হক আমাদের একমাত্র ঐকান্তিক কামনা ও সংকল্প।
১৭৫৭ সালে পলাশীর কপট লড়াইয়ে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী পূর্ব ভারতের মাটিতে কিভাবে চেপে বসে, সে-কাহিনী সবাই জানেন। কিভাবে কোম্পানী বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী দখল করে এবং বৃটিশ পার্লামেন্ট এক সনদ জারী করে তাকে ভারত শাসনের অধিকার দেন, সে-কাহিনীও অবিদিত নয় কারাে। আর কিভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা থেকেই তা উচ্ছিন্ন করার জন্যে ভারতের জনগণ একের পর এক বিদ্রোহ করেন, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ওহাবী বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, কত অভ্যুত্থান হয়েছে, কত রক্ত দিয়েছেন দেশের মানুষ, সে কাহিনী ত সােনার অক্ষরেই লেখা আছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, আগস্ট বিদ্রোহ, আজাদ হিন্দ পর্যন্ত চলেছে তারই জের। আবার এরই পাশাপাশি চলেছে স্বদেশী আন্দোলন, গান্ধী আন্দোলন ইত্যাদিও। এসবেরই সম্মিলিত সাফল্য দেখা দেয় ১৯৪৭ সালে।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ ভারত ছাড়ে এবং সেখানেই শেষ হয় আমাদের ১৯০ বছরব্যাপী পরাধীনতার। তাই এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে সত্যিকার একটি আনন্দোজ্জ্বল লাল হরফের দিন। আবার এদিন অসীম দুঃখের দিনও, কারণ আমাদের ধ্যানী পূর্বাচার্যেরা, বরণীয় কবি, ভাবুক ও নায়কেরা যে অখণ্ড ভারতের মুক্তির জন্যে প্রয়াস করেছিলেন, তা ভেঙে যায় এখানেই এবং ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি বৃহৎ অংশ মাতৃভূমি থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র দেশরুপে আত্মপ্রকাশ করে এই দিনই। পাকিস্তান নামে পরিচিত সেই নতুন দেশ থেকে উৎখাত হয়ে হিন্দুরা অনেকেই সর্বস্ব খুইয়ে চলে এসেছেন আদি মাতৃভূমি ভারতবর্ষে। সেই প্রভূত পরিমাণ উদ্বাস্তুর ভার ভারতের সামাজিক ও অর্থনীতিক মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। ইতিমধ্যে হয়েছে পটভূমিতে আবার অনেক পরিবর্তনের সূচনা। পূর্ব বাংলায় সুরু হয়েছে সংগ্রাম এবং পাকিস্তানের তাবেদারী ঝেড়ে তারা হতে চাইছেন স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত। সে-হতে ভবিষ্যৎ এখনাে অজ্ঞাত। তবে ৭৫ লক্ষ শরণার্থী ফলে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে।
কিন্তু পুরান উদ্বাস্তু এবং নতুন শরণার্থীর চাপই ভারতের একমাত্র সমস্যা নয়। যে দুই শতাধিক কাল। ভারতবর্ষ বৃটিশ শাসনাধীন থেকেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় চরমােন্নতির অধ্যায়। ইউরােপ আমেরিকার একালীন অভ্যুদয় হয়েছে এই সময়ের মধ্যেই। কিন্তু পরাধীন ভারতকে ইংরেজরা ফেলে রেখেছিলেন অনগ্রসর মধ্যযুগের অন্ধকারেই এবং এখান থেকে কাঁচা মাল সস্তা দামে সংগ্রহ করা ও আপন দেশের কারখানার বাজারেই চড়া দামে বেচা এই ছিল তাঁদের কাজ। এই প্রয়ােজনেই তৈরী হয়েছিল। কিছু নগর-বন্দর এবং বসেছিল কিছু কল-কারখানা। আর এই বাণিজ্যের ও তার সহায়ক সাম্রাজ্যের কারবার চালু রাখার জন্যেই স্কুল-কলেজ ও তৈরি করেছিলেন কিছু তাঁরা। ফলে ক্রমবর্ধমানশীল জনসংখ্যার অনুপাতে জীবিকার ব্যবস্থাপনা হয়নি দেশে। কৃষি ও কুটির শিল্পে আশ্রয় করেই কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন দেশের মানুষ। অর্থনীতির সেই শােচনীয় পটভূমিতেই স্বাধীনতা এসেছে। তাই তা আদৌ শান্তি বা সমৃদ্ধির পরিপােষক হয়নি।
তা ছাড়া অনভিজ্ঞতার জন্যে হক, আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে হক, আমরা ইংরেজ-সৃষ্ট পুরান ছক অব্যাহত রেখেই স্বাধীন ভারতের বার্তাবরণ ফেদেছি। পুরান প্রাসাদের ওপরই নতুন নামের পােস্তারা চাপিয়েছি। ফলে সেই সাবেকী সরকারি মহলই ক্ষমতায় বহাল থেকেছেন, সেই কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূদের প্রভুত্বই অব্যাহত থেকেছে। এরা সম্পদশালী বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্রের আদর্শে দেশে মাথাভারী প্রশাসন কাঠামাে জইয়ে রেখে নিজেরা সুখে থাকার কথাই ভেবেছেন খালি। দেশজোড়া রিক্ততা, দৈন্য ও অসন্তোষ তাই ২৪ বছরে স্বাধীনতার স্বাদ দেশবাসীর রসনায় তিক্ত করে ফেলেছে। অনিবার্য ভাবেই মাথা তুলেছে রকমারি বিরােধ, বিক্ষোভ ও অসন্তোষ, যা নিরস্ত না হলে কোন কল্যাণের আশা নেই। ভিতর থেকেও হঠাৎ বিস্ফোরন হতে পারে, বাইরে থেকেও হামলা আসতে পারে এই ভাঙনের সুযােগে। এই জন্যেই সর্বাগ্রে চাই বেকারীর নিরসন, চাই শিক্ষার বিকিরণ এবং একচেটিয়া শােষণের অবসান। স্বাধীনতার প্রভাতে আমাদের সংহত চেষ্টা গেন শুভ সম্ভাবনীতার স্মারক উন্মত্ত করুক। মাটির স্বাধীনতা মানুষের সামুগ্রিক মঙ্গলেই ‘মূর্ত’ হক। জয় হিন্দ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ আগস্ট ১৯৭১