You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.05 | মুজিবকে মরতে দেওয়া যায় না | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিবকে মরতে দেওয়া যায় না

পাকিস্তানের জঙ্গী ডিকটেটর আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খা হয় ক্ষমতার গর্বে মত্ত হয়ে বুঝে উঠতে পারছেন না যে, তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, অথবা, সেকথা বুঝতে পেরেই তিনি মরিয়া হয়ে উঠছেন। তেহরানের সংবাদপত্র প্রতিনিধির সঙ্গে তিনি যেসব কথা বলেছেন সেগুলি থেকে এই দুই অনুমানই করা যায়। শেখ মুজিবর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে এবং তার পরমায়ুর আর মাস দুয়েক সময়ও অবশিষ্ট আছে কিনা। তা তিনি বলতে পারেন না যে সীমাহীন ঔদ্ধত্যের সঙ্গে নাদিরশাহের এই বংশধর কথাগুলি বলেছেন সেটা তার স্বভাবের প্রকাশও হতে পারে, অথবা আত্মপ্রবঞ্চনার একটা ভঙ্গীও হতে পারে। তিনি যে কতবড় শক্ত মানুষ সেকথা যদি তিনি পৃথিবীর মানুষকে বােঝাবার চেষ্টা করে থাকেন তাহলে তিনি নিতান্তই নির্বোধ। হিটলার মুসােলিনির মতাে শক্ত মানুষের পরিণতি যারা দেখেছেন তারা এই বাগড়াম্বর দিয়ে ইয়াহিয়া খার শক্তির যাচাই করবেন না। আর যদি তিনি নিজেকে শক্ত মানুষ বলে বলে জাহির করতে চেয়ে থাকেন তাহলে সেটা তার বৃথা চেষ্টা। একলা একলা শিস দিয়ে তিনি ভূতের ভয় তাড়াতে পারবেন না।
কিন্তু এই ঔদ্ধত্য ইয়াহিয়ার স্বভাবই হােক বা ভালই হােক, তার কথাগুলিকে নিতান্ত ফাঁকা বুলি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। লক্ষণ যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে মুজিবকে ফাঁসিতে ঝােলানই তার ইচ্ছা এবং সম্ভব তিনি তার জল্লাদবৃত্তির ষােলকলা পূর্ণে করতে চান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করে। রক্তলােলুপ স্বৈরচারীর সেই কূর ইচ্ছাকে প্রতিহত করতে পারে একমাত্র সারা পৃথিবীর জনমতের প্রচণ্ড চাপ। সেই চাপ সংগঠিত করার জন্য এখনই উঠে পড়ে লাগতে হবে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। ইয়াহিয়ার কারাগারে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বরেণ্য তম নেতা, তাদের নির্বাচিত নায়ক প্রতিদিন তার অমূল্য আয়ুখুইয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সেই বধ্যভূমি থেকে তাকে উদ্ধার করে আনতে হলে সমগ্র বিশ্বব্যাপী অভিযানের একটা প্রচণ্ড তুফান তুলতে হবে যাতে ইসলামাবাদের শাসকদের দিনের শান্তি ও রাত্রির নিদ্রা নষ্ট হয়ে যায়। আর তার জন্য বৃহত্তম উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ভারত সরকারকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বরণ সিং রাজ্যসভায় বলেছেন। যে, শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির প্রশ্ন নিয়ে ভারত সরকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। ভারত সরকার নাকি বলেছেন, শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের প্রহসন করলে সেটা এই পরিস্থিতির মােকাবিলা করার একটা সার্থক ও গঠনমূলক পথ হবে না। শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্ত করার জন্য ভারত সরকারে চেষ্টার নমুনা যদি এই হয় তাহলে বুঝতে হবে, এটা অত্যন্ত দুর্বল চেষ্টা। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদী একজন নেতার মাথার উপর যেখানে ফাঁসির দড়ি ঝুলছে সেখানে ‘সার্থক ও গঠনমূলক পথ নয়’ বলে মিনমিন করা, এর চেয়ে অর্থহীন ফাপা কথার নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভব্য, কূটনৈতিক শিষ্টাচারের রীতিসম্মত মিতকথনের এই কি উপযুক্ত উপলক্ষ? ভারত সরকার কেন অন্যান্য দেশকে একথা বলবেন না যে, শেখ মুজিবর রহমানের বিচার করার অধিকার ইয়াহিয়া চক্রের নেই? কেন তারা একথা বলবেন না যে মুজিবকে ফাঁসি দিলে ইয়াহিয়া দুনিয়ার সমস্ত গণতন্ত্রপ্রেমিক স্বাধীনতা প্রিয় ও সভ্য মানুষে তাঁর সেই কাজকে কার্যত একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করবেন? অস্ত্রবলে বলিয়ান একজন মিলিটারির ডিকটেটরের অন্ধাকার মৃত্যু ফাঁদ থেকে একজন গণতন্ত্রী নেতাকে বাচিঁয়ে আনার জন্য বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে হবে। ভারত সরকারকে সেই ভাষায় কথা বলতে হবে, সেই উদ্দেশ্যে উদ্যোগী হতে হবে। দেশে দেশে মুজিবকে মুক্ত কর কমিটি গড়ে উঠুক ভারতের চেষ্টায়। পৃথিবীর সব জায়গায় জনসভা থেকে, পার্লামেন্টে থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের কাছ থেকে আওয়াজ উঠুক, মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হােক। পাকিস্তানি দূতাবাস গুলিতে ও ইসলামাবাদে প্রতিনিয়ত পৌছে দেওয়া থােক সেই আওয়াজ। ইয়াহিয়া এমন শক্তিমান বা এমন মূখ নন যে, সেই দুনিয়াজোড়া গর্জন উপেক্ষা করবেন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৫ আগস্ট ১৯৭১