বাংলাদেশে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় এসেছে
বাংলাদেশে সমস্ত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্ট গঠন করবার যে প্রস্তার করা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মুজাফফর আমেদ গােষ্ঠী) পক্ষ থেকে জাতীয় ফ্রন্টের জন্যে অনেক আগেই আবেদন জানানাে হয়েছিল। কিন্তু যে কারণেই হােক, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সেই সময় এই আবেদনকে গ্রাহ্য করা প্রয়ােজন মনে করেন নি। একটু দেরীতে হলেও এখন যে প্রস্তাবটি সরকারিভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, এটা একটা সুলক্ষণ, কেননা বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্টকে অত্যাবশ্যক করে তুলেছে।
যদি আর সমস্ত বিবেচনা ছেড়েও দেওয়া যায়, তাহলেও একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্ট প্রয়ােজন নিত্যন্ত সামরিক প্রয়ােজনেই। বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখন একটা আকর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এখন নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সন্ত্রস্ত এবং আত্মরক্ষার জন্যে উদ্বিগ্ন। তাদের পােষ্য মুশ্লিম লীগ, জামাতে ইসলামীর দালালরা এবং রাজাকারেরা এখন গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিবাহিনী এখন দেশের বিভিন্ন অংশে বিস্তীর্ণ এলাকাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামঞ্চলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রাথমিক ভয় আর আশংকা কাটিয়ে উঠে এখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এসে দাড়িয়েছে। এই সময় যদি সমস্ত সামরিক কার্যকলাপকে একটি কেন্দ্রীয় রণনীতির অন্তভূক্ত করা না যায় যদি প্রত্যেকটি গােষ্ঠী প্রধানতঃ নিজস্ব উদ্যোগে নিজের নিজের সুযােগ ও সুবিধা মতাে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকে, এবং যদি অনেক ক্ষেত্রে একই লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে পরস্পরের বিরক্তির ও বিরাগের কারণ ঘটায় (এরকম কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে) তাহলে মুক্তিবাহিনীর সমর প্রয়াস ব্যাহত হতে বাধ্য। সংগ্রামের প্রথম দিকে এই সমন্বয়ের অভাবই নিঃসন্দেহে যথেষ্ট দুর্বলতার সঞ্চার করেছিল। এই ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটাই বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সামনে এই সংগ্রামের কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক পরিচয় নেই। এই সংগ্রাম তাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এটাই তাদের কাছে প্রথম ও শেষ কথা। এ কথা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মুক্তি সেনানীদের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাপ নিয়ে চলতে অনিচ্ছুক। তাদের প্রধান চিন্তা হলাে সম্মিলিত প্রয়াসের স্বারা আগে দেশকে স্বাধীন করা। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তি সেনানীরা অসহযােগ আন্দোলনের সময় গঠিত যুক্ত সংগ্রাম পরিষদের পতাকাতলে সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। বরিশালের পিরােজপুর মহকুমায় গত জুন মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির একটি সম্মিলিত সরকারও পরিচালিত হয়েছিল। সুতরাং এই মনােভাবকে সন্তুষ্ট করার ও একটা স্থায়ী রুপ দেবার জন্যে জাতীয় পর্যায়ে একটা সর্বদলীয় ঐক্য স্থাপন করা একান্তই দরকার। কেননা এর বিকল্প হলাে মুক্তি সংগ্রামীদের নিজেদের মধ্যে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি, যা এই অবস্থায় মারাত্মক। এটা কোনাে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কাম্য হতে পারে না।
একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্টের রাজনৈতিক মূল্যও উপেক্ষণীয় নয়। জাতীয় মুক্তির কোনাে সংগ্রামই যুক্তফ্রন্ট ছাড়া সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে একটি যুক্তফ্রন্ট আরাে প্রাসঙ্গিক, কেননা ইয়াহিয়া খাঁর অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ধোঁকাবাজির উত্তরে যদি একটা প্রবল, বলিষ্ঠ সংহতির নিদর্শন স্থাপন করা যায়, তাহলে শুধু বিশ্বের দ্বিধাগ্রস্ত রাষ্ট্রমতকে প্রভাবিত করাই সহজ হবে তাই নয়, অনেক রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভবত নিঃসংশয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সুবিধে করে দেওয়া হবে। এই সংহতি কার্যত স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং একে একটা আনুষ্ঠানিক রুপ দিতে না পারার কোনাে কারণ নেই। বিশেষ করে প্রস্তাবিত জাতীয় ফ্রন্ট যখন মূলত একটি উপদেষ্টা সংস্থা হবে এবং যখন আওয়ামী লীগ সরকারের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি একথা স্পষ্ট করেই ঘােষণা করেছে যে, যে-কোনাে যুক্তফ্রন্টে তারা আওয়ামী লীগকে মুখ্য ভূমিকা দিতে সম্মত।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১