মনােহরদী থানা রেইড
যুদ্ধের স্থান
নরসিংদী জেলার সর্ব-উত্তরের থানা মনােহরদী। এ থানার উত্তরে কিশােরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানা। পশ্চিমে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানা এবং পূর্বে বেলাবাে থানা ও দক্ষিণে শিবপুর থানা। এ মনােহরদী থানায় ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশন চালিয়েছিল। যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর।
পটভূমি/পরিস্থিতি
সেপ্টেম্বর মাস থেকে সারা দেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের আনাচ-কানাচে খণ্ড খণ্ড অপারেশন তথা রেইড, অ্যামবুশ, রােড ব্লক ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে নাজেহাল করছিল। মুক্তিবাহিনীকে মােকাবিলার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন থানায় তাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা অক্টোবরের মধ্যে প্রতিটি থানার জনবল ১ কোম্পানিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনারা অপারেশনাল কর্মকাণ্ডে নিয়ােজিত থাকার কারণে প্রতিটি থানায় প্রয়ােজনীয় সৈন্য প্রেরণ সম্ভব ছিল না। এদিকে ২৫ মার্চ রাতে তারা ইপিআর এবং নিয়মিত বাহিনীর অনেক সৈন্যকে বন্দি করে এবং নির্যাতন করতে থাকে। অনেক সৈন্য এ নির্যাতনে মারা যায়। থানাগুলােতে জনবলের ঘাটতি পূরণে তাই পাকিস্তানি বাহিনী একটু ঝুঁকি নিয়ে বন্দি বাঙালি সৈন্যদের ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের নিশ্চিত মৃত্যু অথবা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের সুযোেগ (Option) দেওয়া হয়। আপাতত জীবন রক্ষা এবং পরবর্তী সময় সুযোেগ এলে প্রতিশােধ নেয়ার অব্যক্ত শপথে বাঙালি সৈন্যরা হানাদারদের আনুগত্য স্বীকার করে। এসব সৈনিকদের কাছ থেকে লিখিত আনুগত্য স্বীকারােক্তি নিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৪০জন বাঙালি ইপিআর সৈনিককে মনােহরদী থানায় পাঠানাে হয়। তারপর থেকে যুদ্ধের মাঠে অথবা রণকৌশলগত অপারেশনে ইপিআর ও বাঙালি সৈনিকদের সামনে রাখা হতাে।
যুদ্ধের বর্ণনা
৪০জন বাঙালি সৈনিককে মনােহরদী থানায় পাঠানাের পর থেকে তারা পাকিস্তানি সেনাদের উপর প্রতিশােধের সুযােগ খুঁজতে থাকে। ইতােমধ্যে মনােহরদী থানার মুক্তিবাহিনীও থানায় অবস্থানরত বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের সাথে গােপনে যােগাযােগ স্থাপন করে। সৈনিকেরা মুক্তিবাহিনীকে পূর্ণ সহযােগিতা করার অঙ্গীকার করে। সিদ্ধান্ত হয়, পাকিস্তানি অবস্থান আক্রমণ করার। আক্রমণের সময় থানায় অবস্থিত বাঙালি ইপিআর সৈনিকরাও মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে আক্রমণে যােগ দেবেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করবেন। ৪০জন বাঙালি সৈনিক ছাড়াও মনােহরদী থানায় আরও ৩৬জন পাকিস্তানি সেনা ছিল। | ঐ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক ছিলেন হাবিলদার আকমল। মুক্তিযােদ্ধারা ২১ অক্টোবর থানা এলাকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব প্রস্তুতি শেষে হাবিলদার আকমল প্রায় ১ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২১ অক্টোবর মনােহরদী থানা আক্রমণ করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইপিআর-এর ৪০জন বাঙালি সৈনিকের সবাই মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দেন। যুদ্ধের ভারসাম্য হঠাত্র স্পষ্টভাবে চলে আসে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় । কিন্তু ততক্ষণে প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তারা বাধ্য হয়ে রণে ভঙ্গ দেয় এবং তাদের পরাজয়ও নিশ্চিত হয়ে যায়।
যুদ্ধের ফলাফল
ক. কয়েক ঘন্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। তাদের মধ্যে ২৫জন নিহত হয় এবং ১১জন মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বন্দি ১১জনের মধ্যে ৭জনকে কুদ্ধ জনতা হত্যা করে। বাকি ৪জনকে পরে ৩ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন পালিয়ে গেলেও জনতার রােষানল থেকে তারা রক্ষা পায় নি। মুক্তিযােদ্ধারা সবাই অক্ষত থাকেন।
খ, এ অপারেশনের পূর্বের দিন এ ক্যাম্পেরই এক পাকিস্তানি জেসিও গ্রামের এক যুবককে ক্যাম্পে ডেকে এনে হত্যা করে। ঐ যুবকেরা বাবাও তাই একটা সুযোেগর অপেক্ষায় থাকেন। পরদিন (২১ অক্টোবর) আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে উক্ত জেসিওকে পেয়ে ঐ যুবকের বাবা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে তাঁর পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশােধ গ্রহণ করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড