পাঁচদোনা ব্রিজে প্রথম ও দ্বিতীয় রেইড
সাধারণ
নরসিংদী সদর থানাস্থ পাচদোনা ব্রিজটি ছিল রণকৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। ঢাকা ও নরসিংদীর পার্শ্ববর্তী সব এলাকার সাথে নরসিংদী সদর থানার একমাত্র সড়কের উপর ব্রিজটি অবস্থিত। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযােদ্ধারা পাঁচদোনা ব্রিজটি দখলের চেষ্টা চালান অত্র এলাকায় নিজস্ব প্রাধান্য বিস্তারের জন্য।
উদ্দেশ্য
পাঁচদোনা ব্রিজটি দখল এবং পরবর্তী সময় ধ্বংসের মাধ্যমে এলাকাতে প্রাধান্য বিস্তার তথা নরসিংদী শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের যােগাযােগের মাধ্যম সম্পূর্ণভাবে বিকল করে দেওয়াই ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের মূল উদ্দেশ্য।
যুদ্ধের স্থান ও সময়
পাঁচদোনা ব্রিজে রেইডটি প্রথম বার ১২ আগস্ট আনুমানিক বিকাল ৪টার সময় এবং পরবর্তী সময় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে শবেবরাত রাতে অর্থাৎ ৭ অক্টোবর আনুমানিক ৩টা ৫ মিনিটের সময় পরিচালনা করা হয়। ঐ ব্রিজটি নরসিংদী বাসস্ট্যান্ড থেকে ৫ কিলােমিটার পশ্চিমে এবং ঘােড়াশাল ফেরিঘাট থেকে ৮ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। ঐ সময়ে ব্রিজটির দুই পাশে লােহার রেলিং বিদ্যমান ছিল।
পরিস্থিতি
বরাবরই পাঁচদোনা ব্রিজ এলাকায় রণকৌশলগতভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিল। সে অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজটিকে যে-কোনাে ধরনের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল।
যুদ্ধের বর্ণনা
পাঁচদোনা ব্রিজটি রাস্তাসহ আশপাশের সমতল ভূমি থেকে ২৫-৩০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ব্রিজটির নিচে প্রবাহিত নদীটি উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ দিকে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ব্রিজটির উচ্চতার জন্য ঐ অবস্থান থেকে আশপাশের এলাকা পরিষ্কার পর্যবেক্ষণ ও সহজেই প্রাধান্য বিস্তার করা যায়। ব্রিজটি নিরাপত্তার জন্য এর উভয় পাশে এবং রাস্তার দুই পাশে (নকশা। মােতাবেক) লম্বা বাংকার ছিল এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ভাষ্য মতে সব সময় ৪০৫০জন পাকিস্তানি সেনা ঐ ব্রিজটির দুই পাশে মােতায়েন থাকত।
প্রথম রেইডটি নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে ১২ আগস্ট আনুমানিক বিকাল ৪টার সময় শুরু হয়। ঐ রেইডটিতে মােট ২০-২৫জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযােদ্ধারা ২টি দলে বিভক্ত হয়ে পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক ১টি দল নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে ব্রিজের উত্তর দিকে বিদ্যমান শ্মশানখােলা থেকে এবং অপর দলটি মাে. সুলতানের নেতৃত্বে ব্রিজের পশ্চিম দিকে বিদ্যমান কে জি গুপ্ত স্কুল থেকে আক্রমণ শুরু করে। দুই দলের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয় এবং পরিশেষে আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টার দিকে শত্রুর প্রচণ্ড চাপে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পাঁচদোনা ব্রিজের দ্বিতীয় রেইডটি নরসিংদী সদর থানায় সংঘটিত সব খণ্ড অথবা ছােটো-বড়াে যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে বড়াে এবং সুপরিকল্পিত উপায়ে পরিচালিত যুদ্ধ। ঐ রেইডটির পরিকল্পনা মূলত ২ নম্বর সেক্টরের মেজর হায়দারের আদেশক্রমে নেভাল সিরাজই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য উল্লিখিত দিনে খন্দকার গুলজার হােসেন রেইডটিতে নেতৃত্ব প্রদান করেন। পাঁচদোনা ব্রিজ রেইডে মােটামুটি সদর থানার সব মুক্তিযােদ্ধাই (আনুমানিক ৫০-৬০জন) ৬টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। ৬ অক্টোবর সকাল আনুমানিক ৫টা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ১জন-২জন করে। (নকশা অনুযায়ী) ব্রিজের চারদিকে ছদ্মবেশে ধীরে ধীরে অবস্থান নিতে থাকেন।
পরবর্তী সময় চূড়ান্তভাবে রাত ১২টার সময় সবাই যার যার অবস্থান গ্রহণ করেন। রেইডের পূর্বে ‘মামা সিরাজের বাড়িতে (যা কিনা ডাঙা বাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত) এক গােপন বৈঠকে নিমােক্ত সিদ্ধান্তগুলাে সকলকে অবগত করা হয়: ১. রেইড করার সময়: সাড়ে ৭টায় ।। ২. ফায়ার করার সময় সংকেত: পর পর ২ রাউন্ড করে ৩ বার ফায়ার। ৩. নিরাপত্তার নিমিত্তে ছাড়শব্দ বা পাসওয়ার্ড ছিল অরেঞ্জ (ORANGE)। ৪. নির্দেশ ছিল খুব কম সংখ্যক গুলি খরচ করা পাঁচদোনা ব্রিজটিকে নকশা অনুযায়ী মােট ৬টি উপদলে নিমােক্তভাবে ঘিরে রাখা হয়: ১. ১ম দলের স্থান: দক্ষিণ দিকে ইটের ভাটা এবং অধিনায়ক: তােরাব মাস্টার। ২. ২য় দলের স্থান: দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কে জি গুপ্ত স্কুল এবং অধিনায়ক: ইমাম উদ্দিন। ৩, ৩য় দলের স্থান: শীলমন্দি যাওয়ার পূর্ব পাশে এবং অধিনায়ক: | মতিউর রহমান। ৪. ৪র্থ দলের স্থান: ব্রিজের উত্তর পাশে শুশানখােলা এবং অধিনায়ক গােলজার হােসেন। ৫. ৫ম দলের স্থান: সরাসরি পশ্চিম দিকে ভাঙা রাস্তার মােড়ে এবং অধিনায়ক: মােহন কষ্টা। ৬. ৬ষ্ঠ দলের স্থান: ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম দিকে ঘােড়াশাল রাস্তার মােড়ে এবং অধিনায়ক: মাে. সােলায়মান। আনুমানিক রাত ৩টা ৫ মিনিটের সময় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অতর্কিতভাবে ব্রিজের চতুর্দিক থেকে ব্রিজের উপর ফায়ার শুরু করা হয়।
ঐ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে কোনােভাবেই পাকিস্তানি সেনারা টিকে থাকতে পারছিল না। আনুমানিক দুপুর আড়াইটার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর কাছাকাছি। চলে আসেন। এমতাবস্থায় বিকাল আনুমানিক ৪টার সময় ২টি এফ-৮৬ স্যাবর জেট ব্রিজ এলাকায় এর্সে সরাসরি মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আঘাত হানে। মােট সাড়ে ১৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর বিকেল সাড়ে ৪টার সময় মুক্তিযোদ্ধারা আস্তে আস্তে রণকৌশলগত পুনঃ মােতায়েন শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধা অহিবুর রহমানের জানা মতে অহিবুর রহমান, সুলতান উদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুর রশিদ ভূইয়া, মাে. হান্নান, মতি, আব্দুর রশিদ, আমজাদ হােসেন, শাহজাহান মােল্লা, শহিদ আলম, আনােয়ার, জামাল উদ্দিন, রশিদ, অলিউল্লাহ, নুরুল ইসলাম, মােহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন পাঠান, আব্দুল মান্নান এবং নুরে আলম, এ ১৯জন যােদ্ধাসহ মােট ৫০-৬০জনের ১টি দল ঐ রেইডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। कनांकन প্রথম রেইডটিতে কোনাে পক্ষেরই কোনােরূপ হতাহত হয় নি, তবে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। কিন্তু ২য় রেইডটিতে পাকিস্তানি সেনাদের ১৫-১৬জন নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয় (মুক্তিযােদ্ধাদের ভাষ্য মতে)। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর হারুনুর রশীদ ভূঁইয়া, আবদুল মােতালেব, সরাফত আলীসহ মােট ৩জন শহিদ হন। এখানে উল্লেখ্য যে, শহিদ হারুনুর রশীদ ভূঁইয়া এ খণ্ডযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। এ জন্য এলাকাবাসী তাঁর স্মরণে এলাকায় ১টি শহিদ স্মারক স্থাপন করেন। তােরাব মাস্টার, উমেদ আলী, ড. তােফাজ্জল হােসেন, শাহজাহান ও নুরুল ইসলামসহ মােট ৫জন আহত হন। অপারেশনের শেষ পর্যায়ে ঐ শেষের রেইডটিতে চূড়ান্ত ভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ২টি যুদ্ধেই পাকিস্তানি বাহিনীর অপেক্ষাকৃত উঁচু অবস্থান, শক্ত অবস্থান (বাংকার) এবং দ্রুত বর্ধিত সেনা সাহায্য (Reinforcement) পাবার জন্য চতুর্দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ করা সত্ত্বেও তারা নিজ অবস্থানে থেকেই সব আক্রমণ প্রতিহত করে। এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটাতে বাধ্য করে।
খ. মুক্তিবাহিনী: ২য় রেইডটিতে অসীম সাহসিকতা, সঠিক ও সুপরিকল্পনার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও শক্রর। বিমান আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড