ঝিকুরা অপারেশন
ভূমিকা
কসবা থানাধীন ঝিকুরা গ্রাম। গ্রামটি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান সড়ক থেকে সামান্য পূর্ব পাশে অবস্থিত। জুলাই মাসের ১০ তারিখে এ গ্রামের কাছে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির ৭ নম্বর প্লাটুন কর্তৃক পরিচালিত এ অভিযানটি চালানাে হয়। এ অভিযানে ১২জন আরােহীসহ (এদের মধ্যে ৮জন অফিসার) পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি স্পিডবােট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। সহজ পরিকল্পনা, নিজেদের মধ্যে সমঝােতা ও সমন্বয় সাধন এবং উদ্দেশ্য কার্যকর করার মনােবল থাকলে দিনের বেলায়ও যে অ্যামবুশ/অপারেশন পরিচালনা করা সম্ভব, এটা তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।
পটভূমি
মে-জুন মাসে শত্রু কসবা থানার শালদা নদী, মন্দভাগবাজার কামালপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। সুবেদার ওহাব ও মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে উপর্যুপরি কয়েকটি অপারেশন পরিচালনার ফলে শত্রু রেললাইন ধরে চলাচল বন্ধ করে দেয়। এসব এলাকায় যােগাযােগের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তারা কুমিল্লা থেকে সিঅ্যান্ডবি সড়কযােগে কালামুড়িয়া ব্রিজ পর্যন্ত আসার পর সেখান থেকে উল্লিখিত স্থানগুলােয় রসদ গােলাবারুদ ও সৈন্য পাঠানাের জন্য নদীপথ ব্যবহার করতে শুরু করে। শত্রুকে এ জলপথে অবাধে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্য নদীপথে অ্যামবুশ করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। যুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা এ সময় সুবেদার ওহাবের প্লাটুন কোনাবন ক্যাম্পে অবস্থানরত ছিল। সুবেদার ওহাব নদীপথে শত্রুর ওপর অ্যামবুশ করার অনুমতি চাইলে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফার তাতে সম্মতি দেন।
সম্মতি পেয়েই সুবেদার ওহাব ৩৫জনের ১টি সেনাদলকে প্রস্তুত করেন। এ অপারেশনের সহ-অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেন নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে কোনাবন থেকে কালতাদিঘির পাড় হয়ে নাপতার বাজার এলাকায় পৌঁছেন। নাপতারবাজার ছিল ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের রাস্তার ওপর ১টি গ্রাম্য হাট। এ ডিবি রােড হয়ে নাপতার বাজার থেকে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত ছােট ছােট বাস চলাচল করতাে। এ সড়কপথে কামালপুর ব্রিজ এলাকায় হাবিলদার মােসলেমের নেতৃত্বে ১টি মেশিনগান, ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ১টি সেমি অটোমেটিক রাইফেলসহ ৪জনের একটি প্রটেকশন পার্টি উত্তর দিকে মুখ করে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য, পেছনে কসবা থেকে এসে শক্র যাতে সুবেদার ওহাবের মূল অ্যামবুশ পাটির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে না পারে। এরপর নাপতার বাজার থেকে প্রায় আধা মাইল দক্ষিণে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি এবং ১টি সেমি অটোম্যাটিক রাইফেলসহ ৩ সদস্যের আরেকটি প্রটেকশন পার্টি মােতায়েন করেন। শত্রু যাতে মূল অ্যামবুশ এলাকার পেছনে কোনাে অপারেশন করতে না পারে। অ্যামবুশ স্থান থেকে নাপতার বাজার প্রায় আড়াই মাইল পূর্ব দিকে অবস্থিত। প্রােটেকশন পার্টি ২টির অবস্থান নিশ্চিত করে বাকি সৈন্যরা মঈনপুর গ্রামে গিয়ে পৌছে। মঈনপুর গ্রামে পৌছেই সুবেদার ওহাব সেখানে উত্তরে গােবিন্দপুর গ্রামের দিকে মুখ করে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ১টি সেমি অটোম্যাটিক রাইফেলসহ ৩জনের একটি দলকে রিয়ার প্রটেকশন পার্টি হিসেবে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন।
মঈনপুর গ্রামের দক্ষিণে মন্দভাগ গ্রাম এবং বাজার এলাকার দিকে মুখ করে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি এবং ১টি সেমি অটোমেটিক রাইফেলসহ তিন সদস্যের আরেকটি রিয়ার প্রটেকশন পার্টিকে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। মন্দভাগ গ্রামটি পাকিস্তানি বাহিনীর শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে প্রায় দেড় মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। মন্দভাগ রেল স্টেশনটি যে স্থানে অবস্থিত ছিল, সেই গ্রামটির নাম ছিল চানখােলা গ্রাম। প্রটেকশন পার্টিগুলাের অবস্থান এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝিয়ে দিয়ে সুবেদার ওহাব মঈনপুর গ্রামের পশ্চিম সীমানায় গিয়ে পৌঁছেন। এখানে পৌছেই সুবেদার ওহাব দেখতে পেলেন যে পাকিস্তানিরা উত্তর দিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও রেশন বােঝাই ৬-৭টি বড়াে বড়াে নৌকা এবং ১টি স্পিডবােটসহ অগ্রসর হচ্ছে। নদীর পূর্ব তীর ধরে কিছুসংখ্যক সৈন্য ঐ নৌকাগুলােকে প্রটেকশন দিয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে। প্রতিটি নৌকার ছইয়ের ওপর এমজি। স্পিডবােটটি সামনে পেছনে আসা যাওয়া করে নৌকাগুলােকে গাইড করছিল।
নদীর তীর ধরে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনারা নৌকাগুলাের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছিল। নদীর দুই তীর ধরেই ছিল উঁচুনীচু জায়গা। কোথাও পানি আবার কোথাও শুকনাে। নদীর দুই তীর ধরে আশপাশে কোনাে বাড়িঘর ছিল না। মঈনপুর গ্রাম থেকে আনুমানিক ১,৩০০ থেকে ১,৫০০ গজ পশ্চিমে বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল শালদা নদী। অ্যামবুশ স্থাপনের সময় পেলেন সুবেদার ওহাব। শক্র তাদের শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে চলে গেল কিন্তু সুবেদার ওহাবের বিশ্বাস ছিল শত্রুর ১টি দল শালদা নদী অবস্থানে। অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ এবং রেশনসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে অবশ্যই ফিরে আসবে। আর এ অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই তিনি প্রটেকশন পার্টির সদস্যদের নিজ নিজ অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিলেন। অ্যামবুশ পার্টির সদস্যদের মঈনপুর গ্রামে বিশ্রাম নিতে বলে সুবেদার ওহাব ১টি অ্যামবুশের স্থান রেকি করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। বিস্তৃত মাঠভর্তি ছিল তখন ধান ও পাটগাছ। মাঠে দেড় থেকে ২ ফুট পানি ছিল। ধান ও পাটগাছগুলাে পানির ওপর আড়াই থেকে ৩ ফুট উঁচু ছিল। ধান ও পাটগাছের। আড়ালে আত্মগােপন করে থাকার জন্য পুরাে এলাকাটা ছিল খুবই উপযুক্ত। নদীর পাড়ে গিয়ে সুবেদার ওহাব অ্যামবুশের স্থান বেছে নিলেন। জায়গাটি ঝিকুরা নামে পরিচিত। শত্রুকে নদীর তীরে অতি কাছ থেকে আক্রমণ করার মতােই ছিল ঐ স্থানটি। বিশেষ করে পাটক্ষেতের কারণে শক্র খুব কাছে না আসা পর্যন্ত আত্মগােপন করে থাকার মতাে ছিল ঐ জায়গাটি। পশ্চাদপসরণের রাস্তাঘাটগুলােও দেখে নিলেন সুবেদার ওহাব। রেকির কাজ শেষে মঈনপুরে ফিরে আসতেই সুবেদার ওহাব দেখতে পেলেন, লােকজন গ্রামের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। সুবেদার ওহাবের বাহিনীর কথা তখন কসবা থানা এলাকার সর্বস্তরের। জনগণের কাছে জানা ছিল।
এ বাহিনী কোনাে এলাকায় আসার অর্থই ছিল পাকিস্তানির সাথে যুদ্ধ বেধে যাওয়া। সুবেদার ওহাব স্থানীয় গাইডদের। সহায়তায় গ্রামবাসীকে নিশ্চয়তা দিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে না যাওয়ার জন্য অনুরােধ জানালেন। অপারেশনের আগেই লােকজন এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করলে অপারেশনের গােপনীয়তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। গ্রামবাসী তার অনুরােধে নিজ নিজ বাড়িঘরেই থেকে গেল। অভিযান পরিচালনা প্রটেকশন পার্টির সদস্যদের নিজ নিজ অবস্থানে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে সুবেদার ওহাব ২২জন সৈনিক নিয়ে ঝিকুরার উদ্দেশ্যে মঈনপুর গ্রামের অবস্থান ত্যাগ করলেন। বেলা ১১টার দিকে ৫টি ছােট নৌকায় করে সুবেদার ওহাব তার অ্যামবুশ পার্টি নিয়ে ঝিকুরা এলাকায় পৌছে গেলেন। নৌকাগুলােকে পাটক্ষেতের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হলাে। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার নেতৃত্বে ৩টি এলএমজিসহ ১টি দল নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থান গ্রহণ করলাে।
সুবেদার ওহাব নদীর পূর্ব তীরে ১টি বটগাছের নিচে তার নিত্যদিনের সঙ্গী এলএমজিটিসহ অবস্থান নিলেন। সুবেদার ওহাবের অবস্থানের একটু দক্ষিণে খুব কাছাকাছি ১টি স্থানে নদীর তীর ঘেঁষে পাটক্ষেতের ভেতর ২টি এলএমজিসহ ৪জনের ১টি দল অবস্থান নিলাে। ল্যান্স নায়েক সামছুল হকের নেতৃত্বে ১টি এলএমজি ও ১টি এসএমজিসহ ৩জনের আরেকটি দল কিছু দক্ষিণে নদীর তীরের ধানক্ষেতে অবস্থান নিল। শত্রু যখন অ্যামবুশ এলাকার পাশাপাশি পৌছে যাবে, তখনই সবাইকে পানির ওপরে মাথা ও ঘাড় রেখে নদীর তীরে এসে সুবেদার ওহাবের ভেরি লাইট পিস্তল থেকে ১টি গুলি নিক্ষেপের পরই একযােগে সব অস্ত্র থেকেই গুলি নিক্ষেপ শুরু হবে বলে জানানাে হলাে। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দল সময় ও সুযােগ বুঝে সুবেদার ওহাবের সাথে বিল এলাকায় একত্র হয়ে মঈনপুরে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। আর এরই মধ্যে মঈনপুরে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়ে নিলে মঈনপুরকে বাদ দিয়ে পুরাে দলের সদস্যরা কোনাবরের উদ্দেশ্যে চলে যাবে। অ্যামবুশ পার্টির সদস্যদের অপারেশনটির সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে ব্রিফিং দেওয়ার পর পরই পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৭০জনের ১টি দলকে কালামুড়িয়া ব্রিজ এলাকা থেকে নদীর উত্তর-পূর্ব তীর ধরে অ্যামবুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। এদের দেখার পর অ্যামবুশ পার্টির সদস্যরা ঘাবড়িয়ে যান। সুবেদার ওহাব প্রতিটি দলের অধিনায়ককে ডেকে এ ব্যাপারে কোনােপ্রকার চিন্তা না করে নিজ নিজ অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেন। কেননা এরই মধ্যে দুপুর ১২টা বেজে গেছে।
বেলা ২টা থেকে ৩টার মধ্যে শত্রু অবশ্যই কালামুড়িয়া ব্রিজ অবস্থানে পৌছার জন্য শালদা নদীর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে ফেরত আসবে। তাই বেলা ১টার মধ্যেই সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে পৌছে প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিরক্ষায় থাকতে হবে। শক্র মঈনপুর পৌছে গেলেও অ্যামবুশ অপারেশন পরিচালনায় কোনাে পরিবর্তন ঘটবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। দুপুর আনুমানিক ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ঐ দলটিকে মঈনপুর গ্রামের দিকে নদীর তীরের পায়ে হাঁটা পথ ধরে অগ্রসর থেকে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর মঈনপুর গ্রাম থেকে গাইড এসে জানান যে কসবা থেকেও পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল ডিবি রােড ধরে কামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কামালপুর ব্রিজ এলাকায় অবস্থানকারী হাবিলদার মােসলেমের প্রটেকশন পার্টির সৈনিকেরা অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি দলের ওপর কিছুক্ষণ গুলি নিক্ষেপ করে অবস্থান ছেড়ে নাপতার বাজারের পেছনে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। কামালপুর এলাকায় গােলাগুলির আওয়াজ শুনে ‘সি’ কোম্পানির ৯। প্লাটুনের প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার শহিদ তার প্লাটুনটি নিয়ে কামালপুরের দিকে অগ্রসর হন।
সুবেদার শহিদ নাপতার বাজারে পৌছালে হাবিলদার মােসলেমের সাথে দেখা হয়। সুবেদার শহিদ সুবেদার ওহাবের অবস্থান জানতে চাইলে হাবিলদার মােসলেম মঈনপুর এলাকার কথা বলেন। এ সংবাদে সুবেদার শহিদ সুবেদার ওহাবের মঈনপুর অবস্থান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কেননা হাবিলদার মােসলেম তার কামালপুরের ব্রিজ অবস্থান ছেড়ে আসার ফলে মঈনপুরে পাকিস্তানি সেনারা পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করে বসতে পারে। সুবেদার শহিদ তাৎক্ষণিকভাবে হাবিলদার মােসলেমকে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। হাবিলদার মােসলেম কামালপুর ব্রিজ এলাকায় গিয়ে পুনরায় অবস্থান নেন। ততক্ষণে পাকিস্তানি প্যাট্রল পাটি কসবার দিকে পিছু হটে গিয়েছিল। হাবিলদার মােসলেমকে পাঠিয়ে দিয়ে সুবেদার শহিদ তার প্লাটুন নিয়ে সুবেদার ওহাবকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে মঈনপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সুবেদার শহিদ এসে জানতে পারেন যে, সুবেদার ওহাব শালদা নদী অপারেশন পরিচালনার জন্য সকালেই ঐ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। সুবেদার শহিদ মঈনপুরে অবস্থান করে সেখানে অবস্থানরত সুবেদার ওহাবের রিয়ার প্রটেকশন পার্টি ২টির শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নেন। শত্রুর প্যাট্রল পার্টি মঈনপুরের দিকে অগ্রসর হলে অ্যামবুশ এলাকায় অবস্থানকারী দলগুলাে আপাতত শত্রুর মুখােমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পেল। অবশেষে আসে প্রতীক্ষিত সময়টি। তখন বেলা ২টার মতাে হবে। পাকিস্তানি সেনারা শালদা নদী এবং মন্দভাগ ক্যাম্পে নৌকায় করে বহন করা সমরাস্ত্র, গােলাবারুদ ও রেশনসামগ্রী নামিয়ে দিয়ে শুধু স্পিডবােট নিয়ে ফিরে আসছিল। নৌকাগুলাে তারা মন্দভাগ ক্যাম্প এলাকায় রেখে এসেছিল। স্পিডবােট আরােহীদের মাথার ওপরে ৪টি ছাতা দেখা গেল। সম্ভবত দুপুরের কড়া রােদের তাপ থেকে বাচার জন্য এগুলাে ব্যবহার করেছিল।
স্পিডবােট আরােহীদের সংখ্যা ছিল ১২জন। স্পিডবােটের পেছনে কোনাে নৌকা দেখা গেল না। তা ছাড়া নদীর দুই তীর ধরেও পাকিস্তানিদের কাউকে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হতে দেখা গেল না। বাতাসে ছাতা উড়ে যেতে পারে, সে জন্য স্পিডবােটের গতিও তেমন ছিল না। ২-৩জনকে বাইনােকুলার হাতে নদীর তীর পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেল। সুবেদার ওহাবের নির্দেশমতাে অ্যামবুশ পার্টির সৈন্যরা ধান ও পাটক্ষেতে শুধু মাথা ওপরে রেখে অবস্থান নিয়েছিল।
কাজেই শক্রর বাইনােকুলারে সম্ভবত অ্যামবুশ পার্টির কাউকে দেখা যায়নি। শক্রর স্পিডবােটটি যখন সুবেদার ওহাবের অবস্থানের ২৫ গজের মধ্যে এসে পৌছালাে, তখনই সুবেদার ওহাব শরীরটা পানির ভেতর থেকে কিছুটা উঁচু করে তার এলএমজি থেকে ফায়ার করলেন। সাথে সাথে সব কটি অস্ত্র শত্রুর স্পিডবােটকে লক্ষ্য করে গুলি ছােড়া শুরু করলাে। স্পিডবােটের কয়েকজন আরােহী ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেডিক্যাল কোরের ১জন বাঙালি ক্যাপ্টেন ছাড়া অন্য কাউকে ভেসে উঠতে দেখা গেল না। বাঙালি ক্যাপ্টেন পানির ওপরে ভেসে দুই হাত ওপরে তুলে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দেয় এবং তাকে প্রাণে বাঁচানাের জন্য বাংলা ভাষায় চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু এরই মাঝে অনেক গুলি তাকে আঁঝরা করে ফেললে তার দেহটি ডুবে যায়। ব্যাপক গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া স্পিডবােটটি ততক্ষণে নদীর দখিণা বাতাসে নদীর পশ্চিম তীরে গিয়ে ভিড়ে। নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থানকারী নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে সুবেদার ওহাব চিৎকার করে কিছু লােক দিয়ে স্পিডবােটটিকে পূর্ব তীরে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেন। নির্দেশমতাে নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া ও তার লােকেরা সাঁতার দিয়ে স্পিডবােটটিকে নদীর পূর্ব তীরে ভেড়ান।
স্পিডবােটটিতে শক্রর ১টি বড়াে ধরনের অপারেশন ম্যাপ পাওয়া গেল। পলিথিন পেপারে মােড়ানাে ঐ। ম্যাপটিতে সিলেটের জৈন্তাপুর থেকে কুমিল্লার বিবির বাজার পর্যন্ত শক্রর প্রতিটি অবস্থানই সহজ সিগনেচার কলমে মার্কিং করা ছিল। লাল কালিতে মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি ক্যাম্প ও অবস্থান মার্কিং করা ছিল। ম্যাপটিতে পাকিস্তানিদের আর্টিলারি ইউনিটগুলাের অবস্থান এবং ঐসব গান কতদূর পর্যন্ত ফায়ার কভার দিতে সক্ষম, তাও মার্কিং করা ছিল। এ ছাড়া স্পিডবােটে পাওয়া গেল ১টি ওয়্যারলেস সেট, ১টি এলএমজি, কয়েকটি এসএমজি এবং কিছু গােলাবারুদ। সুবেদার ওহাব স্পিডবােটের ইঞ্জিনটি খুলে নিতে নির্দেশ দিলেন। ওয়্যারলেস সেটে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে শক্রর স্পিডবোেটটিকে খুঁজে বের করার জন্য অন্য স্পিড ‘ট নিয়ে যে-কোনাে সময় চলে আসার সম্ভাবনা ছিল। তাই অভিজ্ঞ সুবেদার ওহাব অ্যামবুশ স্থলে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শক্রর মৃত লাশগুলাে ভেসে উঠলাে। মুক্তিযােদ্ধারা এদের টেনে হিচড়ে তীরে আনলেন। স্পিডবােটের ওপর মৃত অবস্থায় পড়েছিল কুখ্যাত আর্টিলারি অফিসার ক্যাপ্টেন বােখারীর লাশটি। একাত্তরে বৃহত্তর কুমিল্লাবাসীর মধ্যে এমন কেউ নেই, যে ক্যাপ্টেন বােখারীর নাম জানতাে না। এ অত্যাচারী পাকিস্তানি অফিসারটি নিরস্ত্র মানুষকে পাখির মতাে হত্যা করতাে।
যুদ্ধের ফলাফল
সুবেদার ওহাবের এ অ্যামবুশ অপারেশনে শত্রুর ২জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ২জন মেজর, ৩জন ক্যাপ্টেন, ১জন সুবেদার মেজর, ১জন সৈনিক, ১জন সিভিল পােশাকের ইঞ্জিনিয়ার, ১জন ব্যবসায়ী ও স্পিডবােটের অপারেটরসহ মােট ১২জন নিহত হয়। স্পিডবােটের কেউ জীবিত ছিল না। সুবেদার মেজরটি ছিল ৩৩ বালুচের সুবেদার মেজর গজনওয়াব আলী টিকে। ২জন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মধ্যে ১জন ছিলেন ৩৩ বালুচের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাজহারুল কাইয়ুম। ১২জন নিহত শত্রুসেনার মধ্যে ৭জন ছিল কমিশন্ড অফিসার এবং ১জন ছিল জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। এ অভিযানে পাকিস্তানিদের স্পিডবােট থেকে ১টি এলএমজি, ১টি জি-৩, ১টি এসএমজি ও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল ম্যাপ উদ্ধার করা হয়। এ ম্যাপে প্রাপ্ত তথ্যাদি পরবর্তী সময় ব্যবহার করা হয়। ঝিকুরা অপারেশনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এ অপারেশনের ফলে দখলদার বাহিনীর নির্বিঘ্নে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল হুমকির সম্মুখীন হয়। ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে তাদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ১টি অপারেশনে এতসংখ্যক পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসারের নিহত হওয়ার আর কোনাে নজির নেই। অভিযানের মূল্যায়ন অভিজ্ঞ সুবেদার ওহাব অ্যামবুশ স্থান নির্বাচনে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সুবেদার ওহাব তার অ্যামবুশ পার্টির সদস্যদের গােপনীয়তা রক্ষা করে অ্যামবুশ এলাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দিনদুপুরে এ কাজটি সম্পন্ন করা ছিল খুবই বিপদসংকুল। অ্যামবুশ পার্টির সদস্যরাও অ্যামবুশ স্থানে না পৌছা পর্যন্ত কোথায় যাচ্ছে, তা জানতেন না। সুবেদার ওহাব অ্যামবুশ পার্টিকে বিভিন্ন ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত করে নিজ কমান্ডে রেখে অবস্থান নির্ধারণ করেছিলেন। প্রতিটি দলই তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল। উচ্চ স্বরে কমান্ড দিলে এঁরা প্রত্যেকেই শ্রবণসীমার মধ্যে ছিলেন। সুবেদার ওহাব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে স্বল্পতম দূরত্ব থেকে অধিকসংখ্যক অস্ত্র দ্বারা কার্যকর ফায়ার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। শত্রু ভাবতেও পারেনি যে, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা হাঁটু বা বুকসমান পানিতে দাঁড়িয়ে ধান ও পাটগাছের আড়াল নিয়ে এমন ১টি আত্মঘাতী অপারেশন চালাতে পারে। সমরশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী, এ ধরনের অ্যামবুশ অপারেশনের জন্য প্রয়ােজন ছিল শুষ্ক স্থানে বাংকার খননের মাধ্যমে অবস্থান নেওয়া। তা ছাড়া অস্ত্র চালানাের জন্যও প্রয়ােজন ছিল সঠিক স্থাপনার । মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজের দেহকেই ঐ স্থাপনা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। অ্যামবুশ পার্টির সদস্যরা বুকসমান পানিতে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ কাঁধকেই অস্ত্র চালানাের সাপাের্ট হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
বেলা ১১টার দিকে শত্রুর ১টি বিশাল বাহিনী অ্যামবুশ এলাকা হয়ে তাদের শালদা নদী এবং মন্দভাগ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে গমন করেছিল। তখন অ্যামবুশ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কোনাে অস্তিত্বই তারা লক্ষ্য করেনি। মাত্র ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে মুক্তিবাহিনীর ঐ একই স্থানে এত বড়াে ১টি অ্যামবুশ অপারেশন পরিচালনা ছিল শক্রর জন্য কল্পনাতীত বিষয়। অপারেশনটি সমরশাস্ত্রের প্রচলিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। আর সে কারণেই শত্রুকে সর্বাধিক চমক দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
উপসংহার
৭ নম্বর প্লাটুন কর্তৃক পরিচালিত অ্যামবুশগুলাের মধ্যে কিকুরা অ্যামবুশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহজ পরিকল্পনার মাধ্যমে দিনের বেলায় পরিচালিত এ অ্যামবুশ নদীপথে চলাচলে পাকস্তানিদের মনে ভীতি সঞ্চার করে, যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এ অপারেশনে কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বােখারীসহ ৯জন পাকিস্তানি অফিসার নিহত হয়, যা পাকস্তানিদের মনােবলে আঘাত হানে। এ কারণে ঝিকুরা অপারেশন গুরুত্বপূর্ণ।
(ঝিকুরা অপারেশনের নকশাটি দেখুন ৮৬১ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড