You dont have javascript enabled! Please enable it! গলেয়ার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
গলেয়া আক্রমণ
পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে উত্তরে গলেয়া নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল শত্রু ঘাঁটির পূর্ব দিকে ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়ি সাকাতি বিওপি থেকে দক্ষিণ-পূর্বে । পানিমাছ ঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনী পেয়াদাপাড়ার বিপরীতে গলেয়া বাজারে ঘাঁটি স্থাপন করে। তালমা ব্রিজ পেরিয়ে জেলা বাের্ডের উচু রাস্তার সরাসরি যােগাযােগ রয়েছে গলেয়া বাজারের সাথে। হাঁড়িভাসা বাজার যেমন বেরুবাড়ি শরণার্থীশিবিরের উলটা দিকে, তেমনি সাকাতি শরণার্থীশিবিরের উলটা দিকে গলেয়া বাজারের অবস্থান। উত্তর পাশ থেকে পঞ্চগড় গ্যারিসনের আক্রমণ ঠেকানাের জন্য শত্রুরা পানিমাছ ও গলেয়া বাজারের অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তারা পানিমাছ থেকে যেমন নিয়মিত হাঁড়িভাসার দিকে অভিযান চালিয়ে বেরুবাড়ি শরণার্থীশিবিরের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে রেখেছে, তেমনি গলেয়া শত্রু ঘাটি সাকাতি শরণার্থীশিবিরের জন্য প্রচণ্ড রকমের হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। গলেয়া ঘাটিতে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী মােটামুটি শক্তভাবে গেড়ে বসেছে এবং আশপাশের এলাকায় অত্যাচার চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। পেয়াদাপাড়ার মুক্তিযােদ্ধা দল মূলত এদের সাথেই সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। এর আগেও তারা ২-৩ বার গলেয়া শত্রুর ঘাটিতে আঘাত হেনেছে, বিচ্ছিন্নভাবে এ ঘাঁটির সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু গলেয়ায় শত্রু এত শক্তভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে যে, তাদের উৎখাত করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার কারণেই এলাকায় তাদের এ শক্তিবৃদ্ধি। আর তাদের মদদ দিয়ে চলেছে কয়েকজন প্রভাবশালী স্থানীয় জোতদার শ্রেণির মানুষ। তাই গলেয়া শত্রু ঘাটিকে ঠান্ডা করার জন্য। তাদের উপর জোরালাে আঘাত হানা জরুরি হয়ে পড়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি স্কোয়াডের সম্মিলিত শক্তি গলেয়া আক্রমণ করবে।
সারাদিন ধরে চিন্তা করে রাত ৯টায় গলেয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।  ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর রাতে গলেয়া পাকিস্তানি ঘাটিতে আক্রমণ করা হয়। গত রাতের মণ্ডলেরহাট আক্রমণের অনুরূপ ধারাতেই এই অভিযানে দলবলসহ রাত ৮টার দিকে রওনা দেয় মুক্তিযােদ্ধা দল। পেয়াদাপাড়ায় দলকে সমবেত করে চূড়ান্ত ব্রিফিং শেষে রওনা দেয়। অতিক্রম করতে হয় অনেকটা দূরের পথ। সিদ্ধান্ত হয়, ৩ স্কোয়াডের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে যে করেই হােক গলেয়া ঘাঁটি থেকে শত্রুপক্ষকে উৎখাত করতে হবে। গলেয়া শত্রু ঘাটি অভিমুখে মুক্তিযােদ্ধারা তিন দিক দিয়ে এগিয়ে চলেন। ৩টি দলের যুগপৎ আক্রমণে ঘায়েল করতে হবে শত্রুকে। মুক্তিযােদ্ধাদের গোলাগুলির মুখে প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে শত্রু অবশ্যই পালটা আক্রমণ চালিয়ে যাবে তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর চাপ অব্যাহত রাখবেন সমভাবে। সর্বাত্মক চেষ্টা চালানাে হবে শক্রর প্রতিরক্ষা লাইনে ফাটল ধরানাের জন্য। যুদ্ধাবস্থায় শক্রর যে জায়গাটি দুর্বল। প্রতিপন্ন হবে, সে দিকেই প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করতে হবে। আর এটা করতে পারলে শত্রু তাদের অবস্থান ছাড়তে বাধ্য হবে। তারপরই সম্মিলিতভাবে ঝড়ের বেগে ঝাপিয়ে পড়ে শক্রর ঘাঁটি দখলে নিয়ে বাদবাকি কাজগুলাে করতে হবে। অধিনায়ক মাহাবুবের অবস্থান বামে, মাঝখানে আহিদার, ডানে বদিউজ্জামান, খলিল-মতিয়ারসহ পুরােনাে কয়েকজন সাথী রয়েছে তার সাথে।
শত্রু ঘাটির পিছনের দিকে অর্থাৎ পঞ্চগড়গামী রাস্তাটা। লক্ষ্য করে এগােচ্ছেন তাঁরা। উদ্দেশ্য, রাস্তার দুই দিক দিয়ে শত্রুর পিছনে আঘাত হানা এবং রাস্তাটাকেও যাতে কভার দেওয়া যায়। এ অবস্থায় পঞ্চগড় থেকে দ্রুত আগত সাহায্যকারী শত্রুকে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে। পিছন থেকে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা তাদের মনােবল এ পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়তে বাধ্য। ৩টি দলের সাথেই মর্টার রয়েছে, এলএমজি রয়েছে মােট ৫টি, এসএলআর আনা হয়েছে বেশি সংখ্যায়। প্রত্যেক অধিনায়কের কাছে রয়েছে। স্টেনগান। গ্রেনেড দেওয়া হয়েছে প্রত্যেককে ২টি করে। রােমার চার্জ আনা। হয়েছে বাংকারসহ অন্যান্য স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মােট ৪৫জন। মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করছেন এই যুদ্ধে। গাইড হিসেবে এবং গােলাবারুদসহ। অন্যান্য জিনিসপত্র বহন করার জন্য আরও ৮-১০জন স্থানীয় লােক এসেছে। আজকের দলটি সত্যিই ভারি আর দক্ষ। যুদ্ধের সময় প্রতিটি স্কোয়াডের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি দলের লক্ষ্য থাকবে একটাই – অপারেশনে সফলতা অর্জন। অবস্থা বেগতিক দেখলে কিংবা সিদ্ধান্ত হীনতার কারণে কোনাে দলই ভয় পেয়ে অন্যদের ফেলে পালিয়ে যাবে না। পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যৌথভাবে। আর সেটা অপারেশন সফল বা বিফল যাই হােক না কেন। প্রায় ৩০০ গজ দূরে থাকতেই গুলি শুরু করে মাঝখানে থাকা দলটি। আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যেত। এ অবস্থায় নিজের অবস্থানের দিকে দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনাে গত্যন্তর থাকে না। তাই দৌড়েই উঁচু রাস্তাটা লক্ষ্য করে চলে দলটি। ডান দিকের দল থেকেও গুলি বর্ষণ শুরু হয়ে যায় তার পর পরই।
কিন্তু তাদের অবস্থান আরও পিছনে। পরিকল্পনা মাফিক ওরা আক্রমণ শুরু করে। এগিয়ে না এসে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে গােলাগুলি চালিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। আকাশে ফিকে চাদের আলাে মাথায় করে তাই মুক্তিযােদ্ধারা দৌড়ে চলেন পানি-কাদায় একাকার ক্ষেত-বাড়ি ভেঙে রাস্তার ঢাল বেয়ে শত্রুপক্ষের অবস্থানের ১০০ গজের কাছাকাছি এলাকা দিয়ে। এ সময় শক্ত ঘাঁটি থেকে চিৎকার করে কাউকে নির্দেশ দেওয়ার শব্দ শােনা যায়। তাদের ঘাঁটির বাম দিকে ৪০-৫০ গজের ভিতর মর্টারের ২টি শেল এসে পড়ে। আরও ২টি শেল উড়ে এসে সশব্দে বিস্ফোরিত হয় শত্রু ঘাটির কাছাকাছি। তারা এবার মহা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পালটা আক্রমণ শুরু করে। গুলির স্রোত বয়ে চলে সামনে গােলাগুলিরত মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি দলের উদ্দেশ্যে। শত্রুর আক্রমণের মুখে মুক্তিযােদ্ধারাও জবাব দিয়ে চলেন সাধ্যমতাে বাংকার ও ট্রেঞ্চে সুরক্ষিত শক্রর অবস্থানে। তাদের বিরতিহীন গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। বােঝা যায় যে, রাজাকারের দল এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রু ঘাটির মােটামুটি পিছনে এসেই অবস্থান নিয়েছেন। চলতে থাকে আক্রমণ ও পালটা আক্রমণের তাণ্ডবলীলা। আরও ২-৩টি মটারের শেল উড়ে আসে কানে তালা ধরানাে শব্দে। এদের ভিতর থেকে ১টি বিস্ফোরিত হয় শত্রু ঘাটির ডান দিকে, অন্য ২টি সামনে। বােঝা যায়, মর্টারের শেল শত্রু ঘাটির মাঝামাঝি জায়গায় আঘাত করতে পারছে না। ওদের ঘাটিতে লক্ষ্যভেদী মর্টারের শেল ফেলতে পারলে তাদের অবস্থা সঙ্গীন করে ফেলা যেত। একসঙ্গে ৩ দলেরই আক্রমণের কথা থাকলেও এখন গুলি বর্ষণ থেকে বিরত রয়েছে তৃতীয় দলটি। আর সেটা এ কারণে যে, মুক্তিযােদ্ধারা এখনই গুলি বর্ষণ শুরু করলে শত্রু তাদের অবস্থান বুঝে ফেলবে।
ফলে তারা অল রাউন্ড ডিফেন্স কায়দায় অবস্থান নিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা লাইনের মজবুত খােলসে কাছিমের মুখের মতাে গুটিয়ে নেবে, যেটা ব্রেক থ্রো করা বা ভেঙে ফেলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকে এ স্ট্রাটেজি গ্রহণ করার ফলে শত্রুপক্ষের পিছনের দিকটা খােলা রয়েছে, ওরা এখন সামনের দিক নিয়েই ব্যস্ত। পিছন দিকের খােলা অরক্ষিত জায়গাটাই হচ্ছে এখন তাদের দুর্বলতম দিক। চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে সেদিক দিয়েই। সামনের স্কোয়াডগুলাের মুখে এগিয়ে আসার ব্যাপারে ততটা সুবিধা করতে না পারলেও বিরতিহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধারায় যুদ্ধ ওরা চালিয়েই যাবে। মুক্তিযােদ্ধা শম্ভু, মালেক, মজিদ আর খলিলকে দিয়ে এবার ১টি কমান্ডাে দলের মতাে গঠন করা হয়। প্রত্যেকের কোমরে আরও ২টি করে গ্রেনেড গুজে দেওয়া হয়। খলিল আর শঙ্কুকে তাদের হাতিয়ার ও ২টি স্টেনগান নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে বলা হয় রাস্তার ঢাল দিয়ে। শত্রু ঘাটির ভিতরে ঢুকে গ্রেনেড হামলা চালাবেন ওঁরা এবং সম্ভব হলে স্টেনগানের ফায়ারের সাহায্যে মেশিনগান বসানাে ২টি বাংকারের দখল নেবেন। খলিল তার দল নিয়ে এগিয়ে যান,  মাহাবুব দ্রুত অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে কভার দিতে দিতে এগােতে থাকেন। তিনি প্রায় ৫০ গজের ভিতর এসে মাটিতে বুক লাগিয়ে অবস্থান নেন। একরামুলকে ডানে রেখে। মধুসূদন তার এলএমজি থেকে গুলি ছােড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। মতিয়ার মাহাবুবের পাশ ঘেঁষে তার এসএলআর নিয়ে সতর্ক থাকেন। চাদ মিয়া ঠিক মাহাবুবের পিছনে। তার অবস্থানটা এ রকম যেন যুদ্ধ। নয়, অন্যদের কভার দেওয়া নয়, তার প্রধানতম কাজ হচ্ছে একমাত্র মাহাবুবকে কভার দিয়ে শত্রুর হাত থেকে বাচিয়ে রাখা। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাটম্যানদের নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তাদের অফিসার বা উর্ধ্বতনের জীবন রক্ষা করার অপূর্ব। সব আত্মত্যাগের ঘটনা রয়েছে। চাদ মিয়ার বিশ্বস্ততা বর্তমানে সে পর্যায়েই পৌছেছে।
বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে আধা শােয়া অবস্থায় রেখে তার হাতিয়ার মাহাবুবের মাথার উপর দিয়ে তাক করে ধরে থাকেন সামনের দিকে। দারুণ অস্থিরতা সবার মধ্যে ১০-১৫ মিনিটের অপেক্ষা, তারপর সামনের দিকে হঠাৎ করে ঝলসে ওঠে নীল আর সবুজ আলাে এবং শুরু হয় খলিলের দলের গ্রেনেড হামলার বিস্ফোরণ। আরও ২টি মর্টারের শেল উড়ে এসে শত্রু ঘাটির একেবারে সামনে বিস্ফোরিত হয়। তীব্র আলাের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে গগনবিদারী শব্দ, ধোয়া, বালু, কাদা ও পােড়া বারুদের গন্ধ, মাথার উপর দিয়ে বাতাস কেটে গুলির ছােটাছুটি – সবকিছু মিলিয়ে একটা নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর এর মধ্যেই মাহাবুবের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘চার্জ’। শব্দটা উচ্চারণ করেই উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্রগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যান। খলিলের দল তাদের অবস্থান থেকে উঠে এসে মাহাবুবের সাথে যােগ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বাজারের ভিতরকার রাস্তাটার উপর অবস্থান নেয় এবং অদৃশ্য শত্রুর ঘাটি লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে সবাই। এ অবস্থাতেই প্রায় ৫-৭ মিনিট কেটে যায়। আর তারপরই হঠাৎ করে শক্রর গুলি বর্ষণ থেমে যায় । চিকার, হুড়ােহুড়ি আর সােরগােল তুলে পালাতে থাকে শত্রুপক্ষ বাজারের অপর দিকের খােলা মাঠের দিকে শত্রু পালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর পরই মুক্তিযােদ্ধাদের দোকান ও বাজারের ভিটি এসবের আড়াল নিয়ে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন অধিনায়ক। তবে মুক্তিযােদ্ধাদের তরফ থেকে গুলি বর্ষণের চাপ অব্যাহত থাকে। মতিয়ার, খলিল, শম্বুর হাত থেকেও সামনের দিকে একইভাবে গ্রেনেড ছুটে যায়, বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ ।
তারপর সামনের দিকে ছুটে গিয়ে শুরু হয় শত্রুর বাংকার দখলের পালা। খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বাংকার দখল করে নেন মুক্তিযােদ্ধারা। আর ঘটনার পর পরই কয়েকজন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ওঠে। অল্পক্ষণের মধ্যেই জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে দখল করা শত্রু ঘাটি গলেয়া বাজার। দূরে সামনের দিক -(অসপষ্ট) -: দিনে যুদ্ধ : দুই দলের মুক্তিযােদ্ধারাও জয় বাংলা স্লোগান -(অসপষ্ট) থাকেন তাঁরা গলেয়ার দিকে। প্রতিটি বাংকার ও ট্রেঞ্চ চার্জরত মুক্তিযােদ্ধার। একটা ট্রেঞ্চ থেকে ২জন রাজাকারকে ট্যানেহঁচড়ে বের করে আনেন। রাইফেলসহ ধরা পড়ে ২জন রাজাকার। তারা পালানাের ফুরসত পায় নি। কিছু বলার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় রাজাকার ২জনের শরীর। মুক্তিযােদ্ধারা সম্মিলিতভাবে শক্ত ঘাঁটিগুলাে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। বাংকারগুলাে উড়িয়ে দেওয়া হয় চার্জ লাগিয়ে লাগিয়ে। দোকানের চালাগুলােয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। একটা বড়োসড়াে চালা যেটা সম্ভবত তাদের মূল আশ্রয় কেন্দ্র ছিল, সেটাও চার্জ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বেশিক্ষণ সময় লাগে না এসব করতে। দূর থেকে অর্থাৎ তালমা, পানিমাছ থেকে তখন শক্রর গুলি বর্ষণ শুরু হয়। সম্ভবত গলেয়া ঘাঁটি ধ্বংসের ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে নিজেদের ঘাঁটি রক্ষার কারণেই তারা গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটা বিরাট বিজয় অর্জিত হয় পরিকল্পিত আক্রমণ, দৃঢ় মনােবল আর সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার কল্যাণে। এ সময় হঠাৎ মুক্তিযােদ্ধা মতিয়ারকে বসে পড়তে দেখা যায়। তার উরুর সামনের দিকে স্প্রিন্টারের আঘাত লেগেছে। লড়াইয়ের উন্মাদনায় সেটা তিনি বুঝতেই পারেন নি। মধুও আঘাত পেয়েছেন পিঠের দিকে, মজিদ মিয়ার মুখ বেয়ে রক্ত ঝরছে। ওঁর মাথায় আঘাত লেগেছে। তবে কোনােটাই গুলির নয়, শেলের ও গ্রেনেডের ছিটকে আসা প্লিন্টারের। আফতাবের বাম হাতের বেশ খানিকটা পুড়ে গেছে। ঝটপট তাদের ক্ষতস্থানগুলাে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। গােলাবারুদসহ বেশ কিছু কাপড়চোপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্র পাওয়া যায়।
তবে মৃত রাজাকার ২জনের রাইফেল ২টি ছাড়া আর কোনাে হাতিয়ার পাওয়া যায় নি। পলায়নমান শত্রুপক্ষ তাদের হাতিয়ারগুলাে সব নিয়ে যেতে পেরেছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধরেন আবার একজন, এবার সমস্বরে সবাই তার প্রতিধ্বনি করে। বিধ্বস্ত শক্ত ঘাঁটি, বাতাসে পােড়া বারুদের গন্ধ, ধোয়া। দোকানের চালার দাউ দাউ আগুনের মধ্যে সম্মিলিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত পরিবেশ। বিজয় আর সাফল্য আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয় সবার মধ্যে। এবার ফল ব্যাক অর্থাৎ ফিরতি যাত্রা। নিজেদের আস্তানায় ফিরতে ফিরতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসে। ক্লান্ত। পদক্ষেপে হেঁটে চলেন সবাই। ভােরের নরম কোমল বাতাসের স্পর্শে রাতের লড়াইয়ের সমস্ত ক্লান্তি-শ্রান্তি ধুয়ে মুছে যেতে থাকে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড