লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আব্দুর রকীবের প্রতিবেদন
২৫শে মার্চ ১৯৭১। সকাল ৯টা কি ১০টার দিকে বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবার আমাকে আমার অফিস থেকে (আমি তখন ঢাকাতে ৩২ নং ব্যাটালিয়ন পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সি-ও ছিলাম) ডেকে হুকুম করলেন যে তোমাকে সেকেণ্ড ইস্ট বেঙ্গলের সি-ও নিযুক্ত করা হল, কর্নেল মাসুদকে অপসারণ করা হয়েছে। ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বিগ্রেডিয়ার মজুমদার (তদানীন্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার কমাণ্ডার, যাকে আগের দিন অর্থাৎ ২৪ শে মার্চ চিটাগং থেকে আনা হয়েছিল) তোমাকে ব্যাটালিয়নের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। কর্নেল মাসুদ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে যাবেন না।
ঐ হুকুম অনুযায়ী আনুমানিক বিকাল ৩টা থেকে ৪টার কোন সময় বিগ্রেডিয়ার মজুমদারের সঙ্গে জয়দেবপুরে যাই এবং ব্যাটালিয়নের সঙ্গে পরিচিত হই এবং দায়িত্বভার গ্রহণ করি। ঐসময় ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন কোম্পানী এবং প্লাটুনের অবস্থান নিম্নরূপ ছিলঃ
(১) এক কোম্পানী ময়মনসিংহে-কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নুরুল ইসলাম (পরে মেজর জেনারেল এবং অবসরপ্রাপ্ত)।
(২) এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে-কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর কাজেম কামাল,অবাঙালি।
(৩) এক প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এমুনিশন ডিপোতে-গার্ড হিসাবে।
(৪) এক প্লাটুন গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে-গার্ড বা প্রহরী হিসাবে।
(৫) ব্যাটালিয়নের অবশিষ্টাংশ জয়দেবপুরে। ঐ সময় জয়দেবপুরে নিম্নোক্ত অফিসারদেরকে পাইঃ
(ক)মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) শফিউল্লাহ, সেকণ্ড ইন কমাণ্ড।
(খ)মেজর (বর্তমানে মৃত)আসজাদ লতিফ, কোম্পানী কমাণ্ডার-অবাঙালি।
(গ)মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল হাসান, কোম্পানী কমাণ্ডার।
(ঘ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) আজিজুল রহমান, এ্যাডজুট্যান্ট।
(ঙ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে কর্নেল) এজাজ আহমদ, কিউ, এম।
(চ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) মোহাম্মদ নাসিম, কোম্পানী অফিসার।
(ছ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মৃত) মোহাম্মদ রিয়াজ, কোম্পানী অফিসার-অবাঙালি।
(জ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বোধ হয় পাকিস্তানে) নকভী, কোম্পানী অফিসার-অবাঙালি।
(ঝ)সেঃ লেঃ(বর্তমানে কর্নেল) মোরশেদ, কোম্পানী অফিসার।
(ঞ)সেঃ লেঃ (বর্তমানে কর্নেল) ইব্রাহিম, কোম্পানি অফিসার, সিগন্যাল অফিসার।
(ট)একজন ডাক্তার-বাঙালি।
(৬) এই ব্যাটালিয়নের সাথে জড়িত ২০/২৫ জন অবাঙালি ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি একটু বলতে চাই, ১৯৫১ সালে কমিশন পাওয়ার পরে পাঞ্জাব রেজিমেন্টে পোস্টিং পাই, এবং তার পর থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে কয়েক বৎসর তদানীন্তন ইপিয়ার-এ এবং অন্যান্য স্টপ জবে চাকুরী করি। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে চাকুরীর অভিজ্ঞতা বা সম্যক পরিচয় ছিল না। ব্যাটালিয়নের লোকজনের ভিতর আমার কিছুমাত্র পূর্ব পরিচয় ছিল মেজর শফিউউলাহ এবং মেজর কাজেম কামালের (অবাঙালী অফিসার) সঙ্গে। আর আমি যখন ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাই তখন আমার পাক সামরিক বাহনীর প্ল্যান সম্বন্ধে কোন ধারাণা ছিল না। ঐ দিন গভীর রাত্রে তদানীন্তন ইস্টার্ণ কমাণ্ডের কমাণ্ডার জেঃ টিক্কা খান আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ঐ অঞ্চলের বিশেষ করে গাজীপুরের খবরাখবর কি। আমি উত্তরে জানাই যে অস্বাভাবিক কিছু পরিলক্ষিত হয় নাই। তিনি হুকুম করলেন গাজীপুরে ফ্যাক্টরীতে আমাদের সৈন্যসংখ্যা পুরো কোম্পানীতে উন্নীত করতে এবং অন্য কোম্পানীতে তৈরী অবস্থায় থাকতে। তদনুযায়ী, যেহেতু মেজর আসজাদ লতিফের কোম্পানীর এক প্লাটুন গাজীপুরে ছিল, তাকে তার কোম্পানীর অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ, দুই প্লাটুন গাজীপুরে পাঠিয়ে দিই এবং মেজর মইনের কোম্পানীর জন্য কোন হুকুমের জন্য তৈরী থাকতে বলে দিই। অবশ্য পরে তাঁদের সম্বন্ধে আর কোন হুকুম আসে নাই। এ সময় আমার বা আমাদের কোন ধারণা ছিল না ঢাকা শহরে কি হচ্ছে। অবশ্য সন্ধ্যার দিকে আমার বাসা থেকে (আমার ফ্যামিলির সবাই তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ২৬/২ নং তোফায়েল কলোনী, বর্তমানে আজিজ পল্লীতে) কয়েকবার টেলিফোনে কোন অজানা লোক তাদেরকে বিরক্তিপূর্ণ টেলিফোন করে উত্যক্ত করছে বলে খবর আসে।
২৬শে মার্চ ১৯৭১: ঐদিন সকালে রেডিওর খবরে জানতে পারি যে, ঢাকা শহরে “অনির্ধারিত সময়ের জন্যে” কারফিউ দেয়া হয়েছে, এবং বিভিন্ন মার্শাল ল’ নির্দেশবলী রেডিও মারফত শুনলাম। ঐ সব খবরে আমাদের নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া হলেও সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব ছিল না, কেননা তখনও আমরা নিয়মতান্ত্রিক সৈনিক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমি অয়ারলেস সেট এর কাছে গিয়ে দেখি যে, আমাদের সেটের ফ্রিকোয়েন্সি শুধুমাত্র ঢাকা কন্ট্রোল জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ আছে। আমাদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর অবাঙালি অপারেটর দেয়না। ঐ সময় আমি ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে অয়ারলেসে কথা বলে অবস্থা আঁচ করতে চাই। কিন্তু তিনি কোন মন্তব্য না করে এড়িয়ে গেলেন এবং বললেন যে, যখন দরকার হবে তখন তোমাদেরকে কাজের জন্য ডাকা হবে। ঐদিন ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ সবার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সমষ্টিগতভাবে কিছু প্রকাশ পায়না। যাহোক, ঐ দিন সকালে এবং বিকালে জয়দেবপুর সমস্ত অফিসার, জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকদেরকে একত্রীভূত করে তাদেরকে সামরিক শৃংখলা রাখার উপর গুরুত্ব দেই এবং বলি যে, অনেক সময় নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতির উর্ধ্বে উঠে সামরিক ডিউটি পালন করতে হয়। ঐদিন দুপুরের পর থেকে লোক মারফত ঢাকার ঘটনার কিছু কিছু আমাদের কানে এসে পৌঁছায়। তাছাড়া, বিবিসি এবং আকাশবাণী খবরে আমাদের ভিতরে কিছু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং সেই সময় আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। এক কথায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঐ দিন বিকালে কিছু অফিসার জেসিওদের সঙ্গে কথা বলার সময়- বিশেষ করে সুবেদার নুরুল হক (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর পরে অনারারী ক্যাপ্টেন হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন- স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বীরপ্রতীক পদক পান) সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐ দিনই সন্ধ্যায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলা করার মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিকসংখ্যক প্রহরী নিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থা করি। সন্ধ্যার দিকে আমরা অয়ারলেসে খবর পাই যে, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে এবং আরও সৈন্য পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের দিন কাটে।
২৭শে মার্চ ১৯৭১: ঐ দিন শেষ রাত্রে আনুমানিক ভোর তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ আমার কামরায় একজন এনসি ও এবং একজন সিপাহী নিয়ে আসে, বলে যে, তারা আমাদের যে প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে ডিউটিতে আছে সেই প্লাটুনের লোক। তাদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানীরা অতর্কিতভাবে আমাদের প্লাটুনের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে এবং শুধুমাত্র তারা দুজনই জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাদেরকে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও তাদের বক্তব্য সম্বন্ধে আমি সন্দিহান হয়ে উঠলাম। আমি স্থির করলাম যে, ঐ ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করা প্রয়োজন। আমি সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ডকে বললাম ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন পাঠিয়ে ঐ ঘটনার তদন্ত করতে এবং সঙ্গে ঐ লোক দুটোকে পাঠাতে। তখন উপস্থিত সকলের একটু ইতস্ততঃ ভাব দেখলাম। এবং মেজর শফিউল্লাহ আমাকে বললেন যে, আমরা হয়তো পর্যবেক্ষণের ভিতরে আছি, রাত্রে বেশ প্লেন চলাচল করেছে। দিনের আলো না বেরোন পর্যন্ত কিছু ‘মুভ’ করলে দুর্ঘটনা হতে পারে। তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বের প্লাটুন একটু পরে রওয়ানা হয়ে টঙ্গী-জয়দেবপুর রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি নিজে ফজরের নামাজের পর ঐ জায়গায় গিয়ে প্লাটুনের সঙ্গে মিলিত হবো এবং ঘটনার তদন্তে উপস্থিত থাকবো। ঐ মত আমি প্লাটুন নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে সকাল ৭-৮টার দিকে পৌঁছাই। রীতি পালন করে ভিতরে গিয়ে দেখি আমাদী প্লাটুন বহাল তবিয়তে আছে এবং শুধু ঐ দুজন ই কোন ভয়ে পালিয়ে গেছে। ঐখানে পাক বাহিনীর আরও দুটি প্লাটুন ডিউটিতে আছে। যাহোক, ওখানে যাওয়ার পরেই ঢাকার আর্মি একশনের হিংস্রতা এবং নগ্নতা কিছু আন্দাজ করতে পারলাম। প্লাটুন কমান্ডার আমাকে জানালেন, গত দুই রাত এবং দিনে সমানভাবে হেলিকপ্টারযোগে গোলাবারুদ, এমনকি ১০৬ মিঃ মিঃ এন্টিট্যাঙ্ক গান এবং আর্টিলারীর গোলাবারুদ গেছে। আমরা ঐ অঞ্চলে উপস্থিত থাকতেই দেখলাম যে, একটি হেলিকপ্টার এতে নামল এবং তাতে গোলাবারুদ উঠানো হচ্ছে। ঐ ঘটনা আমার মনে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমার মনে হল, পাকিস্তানীরা মিলিটারী একশনে অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনছেনা বরং মরণযজ্ঞে নেমেছে, কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অতিরিক্ত গোলাবারুদ সৈন্যদের প্রয়োজনে আসেনা বা আসার কথা না। ১৯৫৩ সালে লাহোরের মার্শাল ল’এ আমাদের “ফার্সট লাইন বা “পাউচ এম্যুনিশন ই” খরচ হয়েছিল না। মনের ভাব মনে চেপে রেখেই সঙ্গে নেওয়া প্লাটুন সমেত ওখান থেকে চলে আসলাম। ফেরার পথে ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে প্লাটুনকে জয়দেবপুর যাওয়ার নির্দেশ দিলাম এবং আমি গাজীপুর অর্ডন্যানস ডিপোতে আমার কোম্পানীকে দেখতে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম যে ঐ কোম্পানীও বেশ কিছু শংকাজনিত চিত্তে রয়েছে। এদের কাছে অস্ত্র আছে এবং দুই-তিন সপ্তাহের স্বল্প সামরিক শিক্ষা এরা পেয়েছে। এরা সবাই বাঙালি। ওখানে সবাইকে দেখে, কিছু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, কিছু গতানুগতিক ভাষণ দিয়ে বেলা এগার সাড়ে এগারটার দিকে জয়দেবপুরে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে আসলাম। রাস্তাঘাট, বাজার প্রায় জনশূন্য ছিল এবং সকলের ভিতরে একটা ভীতিজনক ভাব ছিল।
হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের অবস্থার আরও অবনতির কথা জানতে পারলাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের কথাবার্তাও কানে আসতে থাকল। যেহেতু তখন পর্যন্ত ঐ এলাকার কোন অঘটনা বা দূর্ঘটনা ঘটে নাই, আমি অফিসে এসে বসলাম। অফিসে বসার পর সুবেদার নুরুল হক প্রথামত ওখানকার সৈন্যদের সম্বন্ধে সমস্ত খবর দিলেন এবং অন্য দুই জায়গার খবর আমাকে দিলেন। সকলের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ও আমাকে জানালেন। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার অফিসে এসে বললেন, “আমাদের নিরস্ত্র ভাইয়েরা গুলি খেয়ে শেয়াল কুকুরের মত মরবে আর আমরা হাতিয়ার হাতে থাকা সত্ত্বেও নীরব দর্শক হয়ে থাকবো?” আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম এই যে, ধৈর্যহীন হয়ো না, সময়মত সবকিছুই করা হবে। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে মেজর মইন আমার অফিস কামরায় ঢুকে এক ই ধরনের অভিব্যক্তি করলে আমি তাকে এক ই ধরনের কথা বলি। এর কিছুক্ষণ পরে মেজর শফিউল্লাহকে আমার অফিস কামরায় ডাকি এবং একথা সেকথার পরে তাকে বলি যে আমাদের ‘ইয়ং ব্লাড’ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে এবং এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে। তিনি আমাকে বললেন যে আমাদের উত্তেজিত হওয়া শোভা পায় না; সবকিছু একটু ভেবেচিন্তে করতে হবে। (প্রসঙ্গত এটুকু বলছি যে, আমাদের উপরোক্ত কথোপকথন প্রচলিত ইংরেজী এবং বাংলা দুই ভাষাতে হয়েছে। কথোপকথনের বাংলা অনুবাদ যা দাড়ায় তা লিখেছি). ঐ অবস্থায় দুপুর গড়িয়ে গেল। ঢাকার সঙ্গে কোন সংযোগ নাই বললেই চলে। আনুমানিক তিনটা সাড়ে তিনটার সময় অয়ারলেসে ব্রিগেড কমান্ডার আমার সাথে কথা বললেন। প্রথমে জানতে চাইলেন যে আমাদের এদিকের অবস্থা কি। আমি উত্তরে জানালাম যে আমার নিকটবর্তী এলাকায় কোন অঘটন ঘটে নাই। তবে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে অবস্থার যথেষ্ট অবনতির খবর পাচ্ছি এবং সেখানকার কোম্পানী কমান্ডাররা আরও সৈন্য চাচ্ছেন তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য। তিনি বললেন যে ওখানে সৈন্য পাঠানোর দরকার নেই, তারা ঐদিকটা দেখবেন। তিনি আরও বললেন যে, “দুষ্কৃতকারীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে” টঙ্গী ব্রিজ বিনষ্ট করে ফেলেছে। ঐ দিন সন্ধ্যায় টঙ্গী এলাকা আর্মী অপারেশন করবে; এক কোম্পানী প্রস্তুত থাকবে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে উত্তর দিক থেকে এসে অপারেশনে সহায়তা করবে। এই খবর দেওয়ার পর যথেষ্ট সংশয় এবং শঙ্কার সৃষ্টি হয়। উদ্বেগাকুল চিত্তে আমারা সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকি।
ঐ দিন সন্ধ্যায় দূর থেকে অর্থাৎ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গীতে আর্মি একশনের প্রচণ্ডতায় আমি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। গুলি এবং তোপের আওয়াজ এবং গোলাগুলির শলাকা দেখে আমার মনে হয় পাক আর্মি আইন শৃংখলা উন্নতির জন্য সরকারকে সাহায্য করছে না, বরং পুরোপুরি বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। সারাদিনে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর মিলিয়ে দেখলাম একই দিক নির্ণয় করছে। মনে হল আমরা বোধ হয় হব পরবর্তী টার্গেট এবং এ অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক আনুগত্য নিরর্থক। টঙ্গীর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজির মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নুরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। (এই সঙ্গে জয়দেবপুরের অবস্থা সম্পর্কে একটু বলা দরকার যাতে সবাই জিনিসটা ভালভাবে বুঝতে পারেন। পুরো ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরের জমিদার বা রাজবাড়ীতে। প্রকাণ্ড চত্বরের ভিতরে অনেকগুলো বড় বড় দোতলা বিল্ডিং এর সমষ্টি। বর্তমানে এগুলো মহকুমা প্রশাসক এবং মহকুমা পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দক্ষিণে স্বল্প উঁচু পাঁচিল ও গেট। এই গেট দিয়ে ঢুকলে গোটা দুয়েক বাস্কেট বল/ভলিবল গ্রাউণ্ড সাইজের মাঠ। মাঠের পরেই বড় উঁচু দোতলা পুরানো কালের বিল্ডিং, নীচে অফিসের মেস এবং জুনিয়র অফিসারদের থাকার জায়গা। দোতলা মেসের ড্রয়িংরুম। পুবের দিকে টু-আই-সি এবং অন্য একজন মেজর থাকতেন। পশ্চিমের দিকে কামরা ছিল সিও’র জন্য। এ বিল্ডিং সংলগ্ন পশ্চিম এবং উত্তর কোনা থেকে শুরু করে উত্তর দিকে বিস্তৃত আর একটি বড় দোতলা বিল্ডিং ‘এল’- এর মত দেখতে। ব্যাটালিয়নের সমস্ত অফিস এই বিল্ডিং-এ ছিল। প্রথম বিল্ডিং-এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিল্ডিং এর সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। নীচে নেমে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে হত। ঐ দ্বিতীয় বিল্ডিং এর উত্তরে আরও একটি বড় দোতলা বিল্ডিং পূবের দিকে বিস্তৃত ছিল। সেটা চিল ট্রপস এর বসবাসস্থান। পূবের দিকেও দেওয়াল এবং কিছু বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা ছিল।) তারা এসে পৌঁছাতেই আমি বললাম যে, পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ কোন উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। আমার মনে চিন্তা খেলে গেল যে আমাদের ক্ষুদ্র এবং বিভক্ত শক্তি নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল এবং আমাদের প্রয়োজন সমস্ত ব্যাটালিয়নকে এক জায়গায় একত্রীভূত করা এবং সেটা ময়মনসিংহেই সম্ভব। এ ছাড়া জয়দেবপুর রাজবাড়ীর পিছনে কিছু সরকারী কোয়ার্টারে আমাদের কিছু সংখ্যক জেসিও এবং এনসিও এবং সেপাইদের ফ্যামিলি আছে এবং আমার মনে হল যে, আমরা চলে যাওয়ার পর পাক বাহিনীর প্রথম আক্রোশ ঐসব পরিবারবর্গের উপর পরবে। সেইজন্যে আমি সুবেদার নুরুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইসব ফ্যামিলির কি হবে?” তিনি তার উত্তরে বললেন যে, তাদের জন্য আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা তাদেরকে আশেপাশের গ্রামে পাঠিয়ে দেব, এবং সেখানকার পাবলিক তাদের দেখাশুনা করবে। তখন আমি তাকে বললাম যে, পরের দিনের ভিতরেই যেন এ বন্দোবস্ত হয়ে যায়। তারপর আমি ক্যাপ্টেন আজিজকে (এডজুটেন্ট) গাড়ীর ‘এভাইলিবিলিটি’ অর্থাৎ কয়টা জীপ, ডজ, লরী চালি অবস্থায় আছে জানতে চাউলাম। তিনি যে পরিসংখ্যান দিলেন, তাতে আমি আন্দাজ করতে পারলাম মর্টার প্লাটুন এবং কিছু সৈন্য আন্দাজ এক রাইফেল প্লাটুন (২৫/৩০) নিজেদের হাতিয়ার এবং গোলাবারুদসহ উঠানো সম্ভব হবে। তখন একটা প্রশ্ন থেকে গেল যে, অবশিষ্ট লোকজন এবং গাজীপুরে যারা আছেন তাদেরকে কি করে নেওয়া যাবে। তখন মেজর মইন স্বেচ্ছাকৃতভাবে বললেন যে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে ‘ক্রস-কান্ট্রি’ পায়ে হেঁটে গফরগাঁও হয়ে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ত্ব দেবেন। তখন আমি প্লান করে ফেললাম, আগামীকাল সকালে এক পার্টি গাড়ীতে টাঙ্গাইলে হয়ে ময়মনসিংহ যাবে এবং বাকীরা আগামীকাল সন্ধ্যায় রওনা হবে। গাড়ীর জন্য চেষ্টা করা হবে এবং যদি সম্ভব না হয় তাহলে পায়ে হেঁটে রওনা হবে। এটা স্থির করার পর, আমি তদানীন্তন মেজর শফিউল্লাহকে এই নির্দেশ দেই, যেহেতু তোমার ফ্যামিলি এখন ঢাকাতে নাই (তারা তখন কুমিল্লাতে তার শ্বশুরালয়ে ছিল), তোমার সমস্যা একটু কম। আগামীকাল সকালে অর্থাৎ ২৮শে মার্চে মর্টার প্লাটুন এবং এক রাইফেল প্লাটুন নিয়ে টাঙ্গাইল র ওনা হয়ে যাবে। রাস্তায় যদি কোন রোড ব্লক পাও সেগুলো সাফ করবে। সেখানকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ‘কনট্যাক্ট’ করে বলে যাবে ঐগুলো খোলা রাখতে এবং রাত্রে আমাদের অবশিষ্ট লোক চলে যাওয়ার পর ঐগুলো বন্ধ করে দিতে। টাঙ্গাইল পৌছে সেখানকার কোম্পানীর দায়িত্বভার বা অধিনায়কত্ব নিয়ে নিবে এবং ঐ কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহয়ে একত্রীভূত হবে। আমরা সবাই আগামীকাল, অর্থাৎ ২৮শে মার্চ’৭১, সন্ধ্যার পর এখান থেকে রওনা হব।”
মেজর মঈন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হককে স্ব স্ব দায়িত্বের কাজের নির্দেশ দিয়ে দিলাম। তাদের সবাইকে বলা হলো যে, আমাদের এই প্ল্যানের গোপনীয়তা যেন বজায় থাকে। নেহায়েত প্রয়োজনীয় এবং নূন্যতম লোককে বলবে। কোনোক্রমেই যেনো অবাঙালিরা (২০/২৫ জন, যারা তখনো আমাদের সঙ্গে ছিলো) যেনো জানতে না পারে, কারণ কারণ গোপনীয়তাই হবে আমাদের আপাতত কার্যসিদ্ধির একমাত্র পথ। এবং তাদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য আগামীকাল ২৮শে মার্চ সকালে সব ট্রুপসকে একত্রীভূত করবে যেখানে, আমি সমস্ত্র পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য আমার টুআইসি মেজর শফিউল্লাহকে মর্টার প্লাটুন এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে সেখানে পাঠাচ্ছি।
এইসব কাজ করার পরে আমার নিজের ফ্যামিলির সম্বন্ধে একটু চিন্তা হলো। তারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। চিন্তা করলাম যে কোনোরকমে ঢাকা গিয়ে তাদেরকে এদিকে নিয়ে আসা বা ছাউনী থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় কিনা। সেজন্যই পরেরদিন স্বল্পক্ষণের জন্য ঢাকাতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে এবং টঙ্গী ব্রিজে একটা জীপ রাখতে অনুরোধ করে অয়ারলেস সেটে একটা মেসেজ পাঠালাম। শেষক্ষণ পর্যন্ত কোনো উত্তর আসে নাই।
ঐ রাতে নতুন আর কোনো ঘটনা ঐ অঞ্চলে ঘটে নাই। অবশ্য দেশের বিশেষ করে ঢাকার ঘটনাবলীর বিভিন্ন বিবরণ বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে থাকায় সৈনিকদের মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিলো। বিশেষ করে ঐ দিন আমাদের ব্যাটালিয়নের একটা গাড়ীর ড্রাইভারের (গাড়ীটা কিছুদিন আগে মেরামতের জন্য ঢাকা ওয়ার্কশপে ছিলো এবং সে ঢাকাতে আটকা পড়েছিলো। ২৭ মার্চ স্বল্পকালীন কারফিউ বিরতির সময় তাকে ওয়ার্কশপের কেউ হুকুম দেয় গাড়ীটা নিয়ে ইউনিটে চলে যেতে। গাড়ী নিয়ে আসার সময় আসার সময় টঙ্গী ব্রিজের ব্লকের জন্যে আটকে যায় এবং সেখানে আর্মি এ্যাকশন শুরু হয়ে যাওয়াতে গাড়ী ফেলে পায়ে হেঁটে জয়দেবপুরে এসে পৌঁছাই।) আর্মি এ্যাকশনের প্রাথমিক বিবরণের যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে থাকে।
২৮শে মার্চ ১৯৭১: পূর্বপরিক্লপনা অনুযায়ী আমি আনুমানিক সকাল সাড়ে আট বা নয়টার সময় জয়দেবপুরের সমস্ত র্যাংকের ট্রুপসকে (বাঙালি অবাঙালি সব) এক জায়গায় করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি এবং জানাই যে, মেজর শফিউল্লাহ সাহেবকে মর্টার এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে টাঙ্গাইলে অবস্থার উন্নতির জন্য পাঠাচ্ছি।
আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে যখন মেজর শফিউল্লাহ প্রায় তৈরী হয়ে গিয়েছেন রওয়ানা হবার জন্য, মনে হলো যে, গাড়ীর বন্দোবস্ত না হলে রাত্রে সিও হিসেবে ট্রুপসের সঙ্গে পায়ে হেটে রওয়ানা হতে হবে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অতিরিক্ত ইউনিফর্ম নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই মেজর শফিউল্লাহকে ডেকে তার স্যূটকেসে আমার দুই সেট ইউনিফর্ম দিয়ে দেই। ঐ সময় সেখানে লেঃ মোর্শেদ উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় অন্যান্য কাজের ভিতরেও টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের খবরের জন্য যথেষ্ট উৎকন্ঠিত ছিলাম। সকাল থেকেই ময়মনসিংহের সঙ্গে অয়ারলেস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
প্রায় সাড়ে দশটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ তার পার্টি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ওদের যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে তাদের উৎসাহিত করছিলো। আমার ধারণা হলো যে, আমাদের প্ল্যান স্থানীয় লোকেরা জেনেছে এবং এই অবস্থায় আমাদের ট্রুপস গেলে অবাঙালিরা যারা তখনো আমাদের সঙ্গে আছে তারা মনে করবে যে আমাদের টাঙ্গাইল রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠানো একটা ভাওতা মাত্র। সেজন্যই সাধারণ পাবলিককে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেওয়া এবং ভয় দেখানোর একটা নাটকের অভিনয়ের মতো করতে হলো। ওদের রওয়ানা হয়ে যাওয়ার কিছু পরে সরকারীভাবে আমি ব্রিগেড লিখিত মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম এই বলে যে, টাঙ্গাইলের অবস্থার উন্নতিয় সাধনকল্পে আমি মেজর শফিউল্লাকে উপরোল্লিখিত সৈন্যসহ পাঠিয়েছি। এইজন্য করলাম যে, কোনো সন্দেহ যাতে আমাদের উপর না আসে।
এরপর আমার চিন্তা হল গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে কিভাবে “কো-অর্ডিনেন্ট ” করা যায়। আনুমানিক সাড়ে এগারটা-বারটার দিকেঐ কোম্পানী সুবেদার চাঁদ মিয়া একটা গাড়ী নিয়ে আসলেন -দুই রাত্রি আগে যে দুই পলাটুন জয়দেবপুর থেকে ওখানে যায় তাদের বিচানা নিয়ে যেতে। ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হক তাকে আমার কাছে নিয়ে আসলেন। আমি তাদেরকে বললাম যে,ওকে (চাঁদ মিয়াকে) প্লান বলে দিন। তাদের কিছুক্ষন কথা বলার পর আমি সুবেদার চাঁদ মিয়াকে নির্দেশের সারাংশ এইভাবে বলিঃ
(১) সন্ধ্যার সময় থেকে তার কাছে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারেরসঙ্গে যে অয়ারলেস সেটের সংযোগ আসে সেটা খুলে রাখতে।যখন সংকেত যাবে “এখন সাড়ে সাতটা বাজে” তখন থেকে তোমরা রওনা হবার এ্যাকশন শুরু করবে।
(২) এ্যাকশন শুরুর প্রথম কাজ হবে অর্ডন্যান্স ডিপোতে যে অয়ারলেস সেটের ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে তাকে নষ্ট করে দেওয়া যাতে আমাদের খবর ঢাকা অথরিটি সঙ্গে সঙ্গে না পায়।
(৩) অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে যত গাড়ী আছে এবং আশেপাশে যতটা সম্ভব গাড়ী দখল করে নিতে এবং ঐ গাড়ীসমূহ নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে ‘মুভ’ করতে।
(৪) ‘মুভের’ সময় অর্ডন্যান্স ডিপোতে রক্ষিত ব্যাটালিয়নের পুরানো হাতিয়ারসমূহ এবং গোলাবারুদ যতটা সম্ভব নিয়ে যেতে।
(৫) এম,ও,ডি,সি’র লোক যতটা সম্ভব নিয়ে যেতে এবং যারা যেতে পারবে না তাদেরকে দিতে যে ঐ ডিপো থেকে দূরে সরে যেতে,কারণ পরে আর্মি এ্যাকশনের শিকার হবে।
সুবেদার চাঁদ মিয়া চলে যাওয়ার পর আমার খেয়াল হল মেজর আসজাদ লতিফ তার অবাঙালী কোম্পানী কমান্ডারকে ওখানে থেকে সরিয়ে আনার দরকার যাতে চাঁদ মিয়া নিরুপ দ্রবে তৈরী করতে পারেন। তাই আমি তাকে আমার সঙ্গে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে লাঞ্চ করার জন্য ডেকে পাঠালাম। জয়দেবপুরস্থ সমস্ত বাঙালী অফিসার এবং জেসিওরা যে যার দায়িত্বমত প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছিল,এবং আইরের ভাবখানা ছিল যে সবকিছুই নর্মাল বা সাধারণভাবে চলছে। আমি মোটামুটিভাবে অবাঙালী অফিসারদেরকে গল্পচ্ছালে আমার আশেপাশে রাখছিলাম, যাতে তারা এ ব্যাপার আঁচ করতে না পারে। আমি অবশ্য মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে যেয়ে ছোটখাট নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাকে বলে সামরিক ভাষায়,”টাইং আপ।” আমার নিজস্ব যথেষ্ট চিন্তা ছিল -অন্য জায়গায় কি হচ্ছে বা না হচ্ছে তা সঠিক জানা ছিল না – এই বিদ্রোহের পরণতি কি হবে কে জানে, যদি সফল না হয় তাহলে নিজের ফ্যামিলি এবং ছেলেরা ক্যান্টনমেন্টে, তাদের পরিণতি কি হবে, ইত্যাদি।
(আজ ১২/১৩ বৎসর পরে ঐ দিনের কথা চিন্তা করলেও যথেষ্ট আতংকিত হয়ে পড়ি। ঐ দিনে ভবিষ্যৎ ছিল অজানা-দেশাত্মবোধই ছিল একমাত্র প্রেরণা।)
এসব ছাড়াও আমার জানা প্রয়োজন ছিল যে, গতকাল রাত্রে টঙ্গীতে ‘আর্মি এ্যাকশনের’ পর কত সৈন্য আছে, কারা আছে, পজিশন তারা কতদূর পর্যন্ত নিয়েছে এবং আমাদের ‘মুভ’-এর সময় তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কতদূর আছে।দুপুরে খাওয়ার পরে আমি নিজেই যাবার মনস্থ করেছিলাম, কিন্তুক্যাপ্টেন আজিজের ইশারায় এবং পরামর্শে মেজর আসজাদ লতিফকে কিছু সৈন্য ‘এসকর্ট’ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাকে বলে দেওয়া হল যে,টঙ্গীতে যেসব সৈন্য। পৌছে গিয়েছে তার সঙ্গে ‘মিলাপ’ করে এসো এবং বিশেষ আগের রাতে আমাদের ব্যাটালিয়নের একখানা ডজ গাড়ী যেটা টঙ্গী ব্রীজের কাছে ড্রাইভার ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল,সেটা কি অবস্থায় আছে দেখবার জন্যে এবং সম্ভব হলে ‘রিকভার’ করার ব্যবস্থা করে আসতে। এই ব্যবস্থায় আমাদের দুইটা সুবিধা হল। প্রথমত এই অবাঙালি অফিসারকে কার কোম্পানী থেকে অধিক সময়সরিয়ে রাখা এবং টঙ্গীতে যদি কোন অঘটন ঘটে তা হলে প্রথম চোটটা অবাঙালি অফিসারের উপর দিয়ে যাবে।এ অফিসার বেলা দুটো-আড়াইটার দিকে এবং সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। সে জানায় যে, টঙ্গীতে পাক আর্মি তাকে বিশ্বাসই করতে চায় না, তাকে এবং তার সঙ্গের সবাইকে ‘ডিস আর্ম’ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এমনকি তার পাঞ্জাবীতে কথা বলার উপরে সন্দেহ প্রকাশ করে।
যাই হোক, ঐ অফিসার জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী রওনা হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম নিতে উপরে নিজের কামরায় গেলাম। কিছু সময় পরে মেজর মইন আমার কামরায় এসে বলেন যে, আমাদের প্লান নাকি পাঞ্জাবী এবং অবাঙালীদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছে, অথবা তারা আঁচ পেয়ে গিয়েছে।কারণ হিসেবে বলল যে, আমাদের কোন সেপাই ক্যান্টিনের কিছু পাঠান সিভিলিয়ানকে প্রকারান্তরে বলে ফেলেছে ঐ রাত্রে সাবধান থাকতে, এবং আমি ভাবছি এ ব্যাপারে কি করা যায়। এর কিছুক্ষন পরে ক্যাপ্টেন আজিজ আমাকে এসে বললেন যে,একজন স্থানীয় ছাত্রনেতা আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চায় এবং দেখা করতে চায়। আমি অল্পক্ষন পরেই আসছি বলে দিতে বললাম(প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে,যদিও ঢাকার সঙ্গে আমাদের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তবুও জয়দেবপুর স্থানীয় এক্সচেন্জ কাজ করছিল এবং গাজীপুর ফ্যাক্টরী পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিল) এই মনে করে যে ছাত্রনেতার সঙ্গে ‘ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা করা হয়ত ঠিক হবে না এবং আমাদের ভিতরকার অবাঙালীদেরকে প্রকারন্তরে ভাব দেখানো যে কোন কিছু অঘটন ঘটতে যাচ্ছে না, আমি ‘ইউনিফর্ম’ না পরে একটা প্রাইভেট শার্ট এবং প্যান্ট পরে নীচে নেমে আসলাম। ঐ ছাত্রনেতার (তার নাম আমার এখন মনে নাই) সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে সন্ধ্যার সময় গেটের সামনে দেখাকরার সময় দিলাম। নীচে নেমে আসার পর থেকে প্রাইভেট পোশাকেই সুবেদার নূরুল হক এবং অন্যান্য সকলের সঙ্গে ‘ডিটেলস টাই আপ’ অর্থাৎ খুঁটিনাটি বিষয়ে নির্দেশাদি দিতে ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তকুল এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণসমূহ ছিলঃ
(১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছেছেন কিনা এবং আগে কি করেছেন তার তখন পর্যন্ত পাই নাই,
(২) ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে সকাল থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন,
(৩) আমাদের প্লান যদি খোদা-না-খাস্তা সফল না হয় তাহলে পরিণতি কি,
(৪)বিদ্রোহেরভবিষ্যৎ কি, এবং
(৫) আমার ফ্যামিলি এবং ছেলেরা যারা ক্যান্টনমেন্ট আছে তাদের ভাগ্যে আগামীকাল কি পরণতি ইত্যাদি।
আমার এই চিন্তাযুক্ত ভাব দেখে হয়ত কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেন আমি তাদের সঙ্গে যাব কিনা। আমি তাদেরকে উত্তরে বললাম যে, সব কিছু প্ল্যান করে তো পিছিয়ে থাকা যায় না, কারণ পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। যাক, বেলা প্রায় ৪টার দিকে খবর পাওয়া গেল যে, মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল অতিক্রম করে ওখানকার কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহের পথে রয়েছেন। কিছু আশ্বস্ত হওয়া গেল।
এখন আসাদের খেয়াল ‘লাষ্ট মিনিট কো-অর্ডিনেশন,’ বিশেষ করে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুন এবং গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন আজিজ যথেষ্ট জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুনকে বলে আসলেন সন্ধ্যার সময় তাদের অয়ারলেস খুলে রাখতে এবং ‘সাংকেতিক বাক্য’ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা সেখানকার তার ডিঙ্গিয়ে নিজের বন্দোবস্তে বেড়িয়ে পড়েন। এম্যুনিশন ডিপোতে ঢোকার উপর সব সময় কড়াকড়ি, এবংঐ সময়ে খুব বেশী ছিল। ঐ জায়গার ও-সি বা অধিনায়ক ছিলেন এক অবাঙালী। ক্যাপ্টেন আজিজ তাকে যেয়ে বললেন যে, তিনি এসেছেন ‘সামারি অব এভিডেন্স’ রেকর্ড করতে। দুই রাত আগে যে দুইজন লোক আমাদের প্লাটুন থেকে পালিয়ে ছিল, তাদেরকে এ্যারেষ্ট করে রাখা হয়েছে এবং সি-ও সাহেব আগামীকাল তাদের ‘সামারী কোর্ট মার্শাল’ করবেন। ভিতরে ঢুকবার অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আজিজের উপর স্টেনগান তাক করা ছিল। এইসব ঘটনাপ্রবাহে ঐ তিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অফিসাররা উতলা হয়ে ওঠেন যাওয়ার সময় সংকেত দেওয়ার জন্যে। সন্ধ্যার সময় বা কিছু আগে খবর পেলাম আমাদের ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে অয়ারলেস সংযোগ স্থাপন হয়েছে। ঐ কোম্পানী কমান্ডারকে নিজে সাংকেতিকভাবে জানিয়ে দিলাম যে মেজর শফিউল্লাহ তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য টাঙ্গাইল ছেড়ে আরও এগিয়ে গেছেন, এবং আমরাও রওনা হচ্ছি। আমি সন্ধ্যাটা একটু গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে ঐ অঞ্চলে কারেন্ট ছিল না, অতএব ছিল গাঢ় অন্ধকার। (পরে জেনেছিলামযে, টঙ্গী থেকে আর্মি ইলেকট্রিক কানেকশন অফ করে দিয়েছিল-বোধ হয় পরের দিন আমাদের উপর অপারেশন চালানোর জন্যে, এবং অবশ্য আমরাও লাইন কেটে দিয়েছিলাম।) দিনের ভিতর মেজর মইন, অন্যান্য অফিসার এবং জেসিও’রা মিলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমাদের সকলের উঠানোর জন্যে গাড়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছলেন। যাই হোক,রাত্রি আটটার সময় প্রয়োজনীয় লোকদেরকে আমার অফিসে একত্রিভূত করি-মিলিটারী ভাষায় যাকে বলে ‘ও’গ্রুপ। আমি রাত ৮-৩০মিঃ সময় নির্দেশ করি অর্থাৎ ঐ সময় থেকেআমাদের ‘মুভ’-এর কার্যাবলী শুরু হবে। কিন্তু ঐ সময় আমাদের কোন একজন বলে উঠলেন সময়টা একটু পিছিয়ে দিতে, কেননা তার উপর যে একটা অর্পিত দায়িত্ব ছিল তার প্রস্তুতির জন্যে আর একটু সময়ের প্রয়োজন। আমি তখন রাত ৮টা ৪৫ মিঃ সময় নির্ধারণ করে দিলাম।
এর আগে ক্যাপ্টেন আজিজে একটা নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, আমি আমাদের ‘মুভ’-এর অর্থাৎ যাত্রা শুরুর সময় দেওয়ার পর পরই তিনিএক সেকশন (দুটি)মেশিনগান এবং এক সেকশন (দুটি) রিকয়েললেস এ্যান্টি-ট্যাংকগান নিয়ে জয়দেবপুরের চৌরাস্তায় গিয়ে টঙ্গীর দিকে তাক রেখে রোড ব্লক সৃষ্টি করেন,যাতে আমাদের মুভের সময় টঙ্গীর দিক থেকে পাক আর্মি কোন গণ্ডগোল করতে না পারে এবং বাধা পায়। আমার ‘অর্ডার’ শেষ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার নিজের কাজে চলে গেলেন। বলাবাহুল্য যে, ঐ সময় পর্যন্ত দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়কার প্রাইভেট জামাকাপড় পরিহিত অবস্থায় ছিলাম। অর্ডার শেষ করার পর নীচের মেসে এসে দেখি যে, অবাঙালী দু’জন অফিসার-ক্যাপ্টেন রিয়াজ এবং নকভী খাওয়ার টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমিও তাদের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খেলাম এবং তাদেরকে কিছু কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখলাম। বুঝলাম যে,আমাদের প্ল্যান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং আমাকে সিভিল কাপড়ে দেখে উৎকন্ঠা যদিও কিছু হয়ে থাকে-সরে গেল।
৮টা ৪০মিঃ কি ৮টা ৪২মিঃ -এর দিকে আমি উপরে নিজের কামরায় উঠে গেলাম পোশাক পরে তৈরি হবার জন্যে। উপরে অন্ধকার ছিল। নীচে মেসের গ্যাসের আলো থেকে উপরে উঠে অন্ধকপরটা আরও বেশী লাগছিল। আমি মনে করলাম যে, একটু অপেক্ষা করি। কেননা একটু পরেই’এ্যাকশন’ শুরু হবে এবং অবাঙালীদের নিরস্ত্র বা কিছু করার পর আমার কাছে কেউ নিশ্চয় আসবে। তখন আমি তৈরি হয়ে নেব। আমাদের প্লান ছিল যে সঙ্গেকার পাকিস্তানীদেরকে নিরস্ত্র করব, এবং যদি তারা বাধা দেয় তখর গুলি চালাতে হবে, তবে গুলি চালানো হবে যথাসম্ভব স্বল্প এবং ক্ষিপ্ত -ভবিষ্যতের জন্য গোলাগুলি বাঁচাতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে বা ঐ সময়ের ৫-১০ সেকেণ্ড আহে নীচে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে এবং প্রচণ্ডতা বেশ বেড়ে গেল। আমি তখন উপরের তলায় একটু সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার কাছে কোন হাতিয়ার ছিল না। অল্প কিছুক্ষন পরেই বুঝতে পারলাম যে কোন লোক সন্ত্রস্তভাবে অথচ তাড়াতাড়ি পা টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠে আসল। আমি একটু আশান্বিত হলাম আমাদের কেউ হবে। কিন্তু সিঁড়ি শেষ হওয়ায়তার পায়ের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। সংশয় বেড়ে গেল। কিছুক্ষন পরে আওয়াজ পেলাম আর একজন লোকের জোর কদমে উঠে আসার। শেষোক্ত লোকটা যখন মাঝসিঁড়িতে তখন প্রথমোক্ত লোকটা তার উপর টর্চ লাইটের আলো ফেলে। নীচের লোকটি তখন জিজ্ঞেস করে ওঠে “কৌন হ্যায়।” উপরের লোকটি বলে,”আমি ক্যাপ্টেন নকভী, কেন?” নীচের লোকটি বলে ওঠে, এ্যা, নকভী বেঁচে, তারপরই সে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে গেল। আমি অনুভব করলাম যে,আগের লোকটা, অর্থাৎ যে উপরের তলায় রয়ে গিয়েছে, সে হল ক্যাপ্টেন নকভী-অবাঙালী এবং সশস্ত্র। এত কিছু করার পরেও নিজের জন্যে ভরাডুবি। পরিণতি কি আল্লাহ জানে। হঠাৎ খেয়াল হল, এমনিও শেষ, ওমনিও শেষ, ঘটনা অজানার একটু ভান করে দেখা যাক না। একটু সতর্ক থেকে, পিলারের আড়াল থেকে নকভীর সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞাসা করলাম “ব্যাপার কি, নীচে গোলাগুলি চলছে কেন?” সে বলল, “জানি না স্যার, ওরা আমাদের উপর গুলি করছে, দেখেন আপনি টেলিফোনে এ্যাডজুটেন্ট পান কিনা।” বুঝলাম তার বিশ্বাস যে সমস্ত ঘটনা আমার অজ্ঞাতে। তার বিশ্বাসটা আর একটু পাকা করার জন্যে আমার নিজের কামড়ায় রাখা পল্টনের এক্সচেঞ্জের টেলিফোন ঘোড়ালাম। জানতাম কেউ জবাব দেবে না। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম যে, নীচের থেকে সবাই চলে যাচ্ছে কিন্তু আমি যেতে পারছি না, আটকা পড়ে গেছি ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে। ঐ অবস্থায় রাত কাটল।
২৯শে মার্চ ১৯৭১: সকালে দেখলাম বহু লোকজন বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার নিয়ে রাজবাড়ী ঘিরে রেখেছে। আমাদের উপর কড়া প্রহরা। লোকজনও বদলি হতে থাকল, আমিও চিন্তা করতে থাকলাম কিভাবে ফন্দি বের করা যায় এখান থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দিন বেড়ে চলছিল। প্রায় সাড়ে এগারটার দিকে প্লেনের আওয়াজ পেলাম। কিছুক্ষন পড়ে দেখলাম যে, দু’টো এফ-৮৬প্লেন রাজবাড়ীর যে অংশে সৈন্যরা থাকত এবং আমাদের গাড়ীসমূহ থাকত, সেই অঞ্চলে স্টার্ফিং করছে। বুঝলাম ঢাকায় সব খবর হয়ে গিয়েছে এবং আর্মি শিগগিরই আসছে। বেলা দুটা-আড়াইটার দিকে দেখলাম রাজবাড়ীর সম্মুখ অংশ সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে এবং পোর্টেবল মাইকে ঘোষনা করা হচ্ছে,”সেকেণ্ড বেঙ্গলের যারা যারা আছো, সারেন্ডার কর।”আমারনাম ধরেও একই ঘোষনা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের মুখে দিয়ে শুনলাম। তখন ক্যাপ্টেন নকভী আগে এবং আমি পিছনে সারেন্ডার করতে বাধ্য হলাম। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব, ব্রিগেডিয়ার হাসানের সঙ্গে ৮-বেলুচ রেজিমেন্ট ছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমি কোন বিদ্বেষ নিয়ে লিখি নাই। আমার বর্ণিত কোন ঘটনা কেও যদি অসত্য বলে প্রমান করতে পারেন তাহলে আমি মিথ্যাচারীর কালিমা নেব।
আব্দুর রকীব
লেঃ কর্ণেল (অবঃ)
Ref: ‘বিচিত্রা’ ১৩মে ১৯৮৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড