You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.28 | মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের বেতার ভাষণ | ত্রিপুরা - সংগ্রামের নোটবুক

মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের বেতার ভাষণ

আগরতলা, ২২ এপ্রেল, ১৯৭১ ইং: অদ্য রাত্রি ৮ ঘটিকায় মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ আকাশবাণী আগরতলা কেন্দ্র হইতে যে ভাষণ দেন তাহা নিম্নে দেওয়া হইল:
ত্রিপুরাবাসী ভাই ও বােনেরা,
পূর্ব বাংলায় বর্তমানে যা ঘটছে তাতে প্রতিবেশী হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ নির্বিচার গণহত্যা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে সেখানকার জনজীবনে যে মর্মান্তিক অবস্থার সৃষ্টি করেছেন তার জন্য অপরিসীম কলঙ্কের বােঝা তাদের বহন করতে হবে। মনুষ্যত্বের এই নিদারুণ অবমাননার জন্য যারা ইতিহাসের এক ক্লেদাক্ত অধ্যায়ের নায়ক তাদের ভাগ্যে উত্তর-পুরুষগণের ঘৃণা ও ধিক্কার চিরকাল পুঞ্জীভূত হয়ে থাকবে।
পূর্ব বাংলায় মুক্তিকামী মানুষ রক্তের মূল্যে মানব জীবনের সর্বোত্তম অধিকার অর্জনে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। শােণিত অর্পণে শুদ্ধচিত্ত সাড়েসাত কোটি নরনারী আজ যে সঞ্জীবনী মন্ত্রে উদ্দীপ্ত সেই অপরাজেয় আদর্শের দুর্নিবার আকর্ষণে পৃথিবীর সকল দেশের সত্যাগ্রহী মানুষ প্রাত্যাহিক জীবনের নিশ্চিন্ত নির্ভরতার অন্তরঙ্গ বন্ধন ছিন্ন করে বার বার আত্মাহুতি দিয়েছেন মানুষের যা জন্মগত অধিকার সেই স্বাধীনতার মহৎ ও মৃত্যুঞ্জয়ী সাধনার পুণ্য সংকল্পে। পূর্ব বাংলায় মানুষের স্বাধীকার অর্জনের সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তঁাদের অমর আত্মার উদ্দেশ্যে আমি সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করছি।
সামরিক কর্তৃপক্ষের অত্যাচারে সহস্র সহস্র গৃহহীন নরনারী ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের প্রতি আমাদের অবশ্যই কর্তব্য রয়েছে। যারা স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত তাদের প্রতি মৌখিক সমর্থন জ্ঞাপন করেই আমরা নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারি না। পূর্ব বাংলায় যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছে তার ফলে একদিকে লক্ষ লক্ষ প্রাণ বলি হয়েছে এবং অপরদিকে যারা বেঁচে আছেন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে তারাও অপরিসীম বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন, এই বিড়ম্বনার প্রতিক্রিয়া পার্শ্ববর্তী রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে ত্রিপুরার জনজীবনেও অনিবার্যভাবেই দেখা দিয়েছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ত্রিপুরার প্রতিটি নাগরিক কঠিন আত্মপ্রতায় ও শৃঙ্খলাবােধ নিয়ে বর্তমান দুঃখজনক অবস্থার সম্মুখীন হবেন এবং জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যাতে কোনােভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।
ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতি আমার বিশেষ অনুরােধ, তারা যেন দ্রব্যমূল্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সর্বতােভাবে সরকারের সঙ্গে সহযােগিতা করেন। সাময়িক লােভ অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থে আমরা যেন এমন কিছু না করি যার ফলে শুধুমাত্র শরণার্থীদের ক্লেশই বাড়বে না- পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি আমাদের সাহায্য ব্যাহত হয়। যারা আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে ত্রিপুরায় এসেছেন তাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়ের লােকই আছেন। সামরিক শাসনের দুঃসহ অত্যাচার ও উৎপীড়ন সমানভাবে তাদের সকলকেই বিড়ম্বিত করেছে। তাই সমদৃষ্টি নিয়ে তাদের সকলের সেবায় এগিয়ে আসা আমাদের কর্তব্য। এই প্রসঙ্গে আমি সকলকেই এই কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পাকিস্তানের শাসকবর্গ পূর্ব বাংলায় নিজেদের অপকীর্তি ঢাকবার উদ্দেশে বহির্বিশ্বে যেমন ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে বিষােদগার করে চলেছেন তেমনি দেশের অভ্যন্তরে জনচিত্তকে বিভ্রান্ত করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়েছেন।
তাদের এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধারা নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেনসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন। ত্রিপুরায় সকল শ্রেণীর জনসাধারণের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরােধ তারা যেন সকল প্রকার উত্তেজনা ও প্ররােচনামূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক থাকেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস সাম্প্রদায়িক ঐক্য যাতে কোনােভাবেই ক্ষুন্ন না হয় তার জন্য ছাত্র ও যুবক বন্ধুরা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে অগ্রণী হবেন। এই উদ্দেশে প্রতি গ্রাম ও শহরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তােলা আশু প্রয়ােজন। এই স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজের ভার নেবেন এবং সেই সঙ্গে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাব্য সর্বপ্রকার অপ্রচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধারা রক্ত ও অশ্রুতে দেশপ্রেমের নতুন ইতিহাস রচনা করছেন। তাদের সংগ্রামে ত্রিপুরাবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে আমি এই আশাই করব, দুর্গত মানুষের সেবায় সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তার সঙ্গে ত্রিপুরাবাসী প্রতিটি নাগরিক সর্বতােভাবে সহযােগিতা করবেন এবং এখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যাতে কোনােভাবেই ক্ষুন্ন না হয় সেই উদ্দেশ সর্বপ্রকারে সচেষ্ট হবেন।

সূত্র: ত্রিপুরা
২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
১৪ বৈশাখ, ১৩৭৮