You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.27 | চরম বিশ্বাসঘাতকতা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

চরম বিশ্বাসঘাতকতা

গুপ্তঘাতকের মতাে গণতন্ত্রের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করে বিশ্বাসহন্তা ইয়াহিয়া খান এগারাে দিন পরে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। একদিকে তিনি যখন ঢাকায় বসে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মুজিবর রহমানের সঙ্গে মীমাংসার আলােচনা চালাচ্ছিলেন অন্যদিকে তখন জাহাজ বােঝাই করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনাচ্ছিলেন। সুতরাং এই আলােচনার একমাত্র উদ্দেশ্য যে ছিল কালহরণ করা, এ কথা আজ আর ব্যাখ্যা করে বােঝাবার প্রয়ােজন নেই। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির শােণিতে পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলীর বক্ষ রঞ্জিত করার উদ্দেশে সাত জাহাজ বােঝাই হয়ে পাক সৈন্য এসে চট্টগ্রাম এবং খুলনায় পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াহিয়া খানের জল্লাদি মেজাজ চাঙ্গা হয়ে ওঠে ও গণতান্ত্রিক আদব সর্বতােভাবে পরিহার করে রণমূর্তি ধারণ করে। একে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কী বলা চলে!
যখন নানান মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছিল যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতার চারটি শর্ত নীতিগতভাবে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন এবং যে কোনাে মুহূর্তে তিনি পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশের) পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ঘােষণা করতে পারেন, ঠিক তখনই তার সৈন্যরা চট্টগ্রামে ও রংপুরে নিরস্ত্র বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করতে শুরু করে। আসলে আওয়ামী লীগ প্রবর্তিত অসহযােগ আন্দোলনকে মিলিটারির সাহায্যে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। জঙ্গি রাষ্ট্রপতির আসল অভিপ্রায় বুঝতে পেরেই জনাব মুজিবর রহমান এর মােকাবিলার জন্য তাঁর দেশবাসীকে আহ্বান করেন ও যে কোনাে অবস্থার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ শনিবার বাংলাদেশ’ বন্ধের ডাক দেন তিনি। সেই ডাকে সাড়া দেবার অবকাশ আর পায়নি বাঙালিরা; তার আগে ইয়াহিয়া খানের দোসর লে. জেনারেল টিক্কা খান জঙ্গি আইনের মুষলাঘাতে বাংলাদেশ’-এর মস্তকচূর্ণ করতে উদ্যত হয়েছেন। সমস্ত জনজীবনকে স্তব্ধ ক এক অন্ধকারের রাজত্ব সৃষ্টির জন্য জারি হয়েছে সর্বত্র সান্ধ্য আইন; শহরে শহরে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে মিলিটারি; রাস্তায় কেউ বেরুলেই দেখামাত্র গুলি করার আদেশ বেতার, সংবাদপত্র বা যে কোনাে প্রচারমাধ্যমের কণ্ঠরােধ; যে কোনাে প্রতিষ্ঠান বা বাড়িতে ঢুকে মিলিটারির সার্চ করার অধিকার; ব্যাঙ্কের যাবতীয় লেনদেন বন্ধ করার আদেশ; চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কাজে যােগ না দিলে শ্রমিকদের কোর্ট মার্শালে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের হুমকি; এমনকি বিদেশী সাংবাদিকদের পর্যন্ত নজরবন্দী করে রাখা এক কথায় এক বিভীষিকার রাজত্ব।
পূর্ববঙ্গের মানুষের অপরাধ? তারা চায় পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী-সামন্ততন্ত্রবাদী-জঙ্গিবাদী চক্রটির কবল থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দাবি তারা কখনাে তােলেনি। একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকারের অভ্যন্তরে শুধু স্বশাসিত রাজ্যের দাবি। এ গণতান্ত্রিক দাবি মােটেই অসঙ্গত নয় এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও অন্তত প্রকাশ্যে তেমন কথা কখনাে বলেননি। সর্বজনীন ভােটাধিকারে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাবার পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যখন প্রেসিডেন্ট সাংবিধানিক আলােচনায় অগ্রসর হয়েছেন তখন আলােচনার দ্বারাই মীমাংসার সূত্র আবিষ্কৃত হবে বলে সবাই আশা করেছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খান অস্ত্রাঘাতের দ্বারা সে পথ রুদ্ধ করে দিলেন। তার অর্থ জাতীয় পরিষদের উপরই খড়গাঘাত।
এই বিশ্বাসঘাতকতার কাছে পূর্ববঙ্গের সংগ্রামী মানুষ মাথা নােয়াতে পারেনি। তারা প্রতিরােধে নেমেছে। পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী ও পুলিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাবাহিনীর সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের সংঘর্ষ হচ্ছে। একদিকে সশস্ত্র জল্লাদ দলঅন্যদিকে প্রায় নিরস্ত্র জনতা। এর পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে? কিন্তু এ কথা নিশ্চয় যে, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ববাংলার সংগ্রামী জনতা বুক দিয়ে লড়বে ও অকাতরে শেষ রক্তবিন্দু পাত করবে। সর্বস্ব পণ করে প্রতিরােধের ডাক দিয়েছেন জনাব মুজিবর রহমান সবাইকে।
গণতন্ত্রকে জঙ্গি ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য পূর্ববাংলার মানুষের এই যে জীবনপণ সংগ্রাম তাকে অভিনন্দন জানাবে পৃথিবীর যে কোনাে গণতন্ত্রপ্রিয় জাতিই। গণতন্ত্রের উপর এই ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে ধিক্কার উঠবে সর্বত্র। বাংলারই অপরাংশে রক্তবন্যা বইয়ে দেবার জন্য এই যে চরম হিংস্রতা আত্মপ্রকাশ করেছে তাতে আমরা বিচলিত না হয়ে পারিনে। উদ্বিগ্ন হয়ে বিরােধী দলসমূহের সদস্যরা ভারত সরকারকে অনুরােধ করেছেন, এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। অবিলম্বে পূর্ববাংলায় জঙ্গি নৃশংসতা বন্ধ করে সেখানকার জনসাধারণকে শান্তিপূর্ণ পথে গণতান্ত্রিক অধিকার দেয়া হােক— এই দাবিতে আজ সারা ভারত সােচ্চার হয়ে উঠুক।

সূত্র: কালান্তর
২৭.৩.১৯৭১