গণতন্ত্রের ঘাড়ে কোপ
অবশেষে পাকিস্তানের জঙ্গি রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর সংখ্যালঘু দলের মর্জি রক্ষা করে গণতন্ত্রের ঘাড়ে সরাসরি কোপ মেরেছেন। ৩ মার্চ ঢাকায় নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবার কথা। আওয়ামী লীগ সংবিধানের খসড়া নিয়ে প্রস্তুত। ভুট্টোর পিপলস পার্টি ও খান আবদুল কাইয়ুম খানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুসলিম লীগের ভগ্নাংশ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের বাকি সব সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য ঢাকায় উপস্থিত। অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আয়ােজন যখন সম্পূর্ণ তখনই ঠিক দু’দিন আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখে গণতন্ত্রের অগ্রগতির পথ রােধ করে দাঁড়ালেন।
জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সামনে রেখে এতদিন তিনি নেপথ্যে যে খেলা খেলছিলেন আওয়ামী লীগের দৃঢ়তা দেখে সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আর তিনি পারলেন না, মঞ্চে একেবারে পর্দার সামনে চলে এসে বিকট দর্শন বের করে জঙ্গি মূর্তি ধারণ করলেন। ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা উপস্থিত হলে পাকিস্তান বিপন্ন হতে পারে বলে ভুট্টো যে ভেলকি দেখিয়েছিলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ডুগডুগি বাজনায়ও সেই একই বােল। ভুট্টো বলেছিলেন, ভারত নাকি পাকিস্তান আক্রমণের জন্য ওঁৎ পেতে আছে। জাঁদরেল জেনারেল ইয়াহিয়া খানও সেই কথাই একটু ঘুরিয়ে বলেছেন। তার জন্য দুই পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সম্মুখ সমরের জন্য কোমর বেঁধেছেন যার ফলে পাকিস্তানের অবস্থা সঙ্গীন আর পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের আচরণই নাকি অবস্থা আরাে সঙ্গীন করে তুলেছে। ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ শুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবার নিশ্চয়ই আনন্দে নৃত্য করতে থাকবেন; কারণ তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। গণতন্ত্রের কণ্ঠরােধের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে আর তাকে গলাবাজি ও লম্ফঝম্ফ করতে হবে না; তার প্রভু জঙ্গি শাসনকর্তা নিজেই এবার স্বহস্তে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছেন।
তের বছর বুটের তলায় রেখেও জঙ্গি শাসন পাকিস্তানের জনসাধারণকে পিষে মারতে পারেনি। পাকিস্তানের, বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানের সংগ্রামী মানুষ দীর্ঘকাল কঠোর সংগ্রাম করে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকার অর্জন করে। জঙ্গি শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান নবজাগ্রত এই গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত হানতে ইতস্ততবােধ করেন। তাই তিনি সাধারণ নির্বাচনের ফতােয়া দেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জঙ্গিশাহী টিকিয়ে রেখে পশ্চিম-পাকিস্তানের শােষক গােষ্ঠীর স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করা যায় তারও ফিকির খুঁজতে থাকেন। এ বিষয়ে পরামর্শ দেবার জন্য নয়া-উপনিবেশবাদীরা কখনাে পিছিয়ে থাকে না। বাইরে থেকে আঘাত হেনে গণতন্ত্রকে যখন হত্যা করা সম্ভব নয় তখন গণতন্ত্রের মুখােশধারী অন্তর্ঘাতকদের খুঁজে বের করতে পারলেই কাজ হাসিল করতে সুবিধে। এদিক থেকে উগ্র-বামপন্থী ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল দু’পক্ষই হাতিয়ার হতে পারে। সার্বভৌম পূর্ব-পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিদার মওলানা ভাসানী ভােট বর্জনের জিগির তুলেও আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক অভিযানকে বিন্দুমাত্রও শ্লথ করতে পারেননি। কিন্তু পশ্চিমপাকিস্তানে ভুট্টো গণতন্ত্রের সাইনবাের্ড সামনে রেখে নির্বাচনে নামলেন এবং নির্বাচনের পরে গণতান্ত্রিক ছদ্মবেশ ধারণ করেই ভেতর থেকে গণতন্ত্রের বুকে ছােরা বসালেন। পশ্চিম-পাকিস্তানের শােষকগােষ্ঠীও নয়া-উপনিবেশবাদীদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করলেন ভুট্টো সাহেব অন্তর্ঘাতের দ্বারা।
প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদীদের এ খেলা কেবল পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ নয়। এই অশুভ লক্ষণ ভারতের বুকেও বিদ্যমান। এখানেও একদিকে ভােট বর্জনের আহ্বান, অন্যদিকে গণতন্ত্রের মৌখিক দাবিদার হয়েও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বুকেই ছুরিকাঘাত। দু’দিকের এই আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে ও সবল করে না তুলতে পারলে পাকিস্তানের মতােই পরিণামে মিলিটারি শাসন ও সেই ছত্রছায়ায় নয়াউপনিবেশবাদীদের সঙ্গে জোট বেঁধে দেশী একচেটিয়া পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের অবাধ শােষণ।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন শেষ হতে না হতেই ভারতের বিমান ছিনতাই করে যে নির্লজ্জতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলাে তাতেই বােঝা গিয়েছিল পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর আঘাত হানার একটা প্রাথমিক মহড়া। তারপর অতি দ্রুত পট পরিবর্তন। ভুট্টোর হুমকির পর হুমকি। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া। তারপরই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল স্থগিতের আদেশ। গভর্নর খারিজ করে প্রত্যেক প্রদেশে সামরিক শাসনকর্তা নিয়ােগ। অর্থাৎ পূর্ণ মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ।
গণতন্ত্রের ওপর এই জল্লাদপনা পাকিস্তানের সংগ্রামী মানুষ নত মস্তকে মেনে নেবে না। তাই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান জনসাধারণকে শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। তাতে যদি রক্ত ঝরে তবে তার জন্য দায়ী হবেন সামরিক শাসনকর্তারা। গণতন্তের ভয়ে পাকিস্তান বিপন্ন বলে যারা জিগির তুলেছেন গণতন্ত্রের বুকে আঘাত হেনে তাঁরাই পাকিস্তানের ঐক্যকে কবর দিতে চলেছেন ও তার বিপদ ডেকে আনছেন, কারণ, পাকিস্তানের অনৈক্যের সুযােগ নিতে নয়া-উপনিবেশবাদীরা কখনাে ছাড়বে না।
সূত্র: কালান্তর
৩.৩.১৯৭১