বুনাে ওল বাঘা তেঁতুল
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। এই জটিলতার সৃষ্টি করে প্রথম পাকিস্তান আকস্মিকভাবে কলকাতায় তার ডেপুটি হাইকমিশনের পাততাড়ি গুটোবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ও ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন বন্ধ করার ফতােয়া দিয়ে। পাকিস্তান রাতারাতি এই সিদ্ধান্ত নেয়ায় তখনই বােঝা গিয়েছিল যে, তার মতলব মােটেই ভালাে নয়। একটা পরিকল্পিত চক্রান্তের এটা প্রথম ধাপ মাত্র। পাকিস্তানের মতিগতি দেখে আমাদের যে অনুমান হয়েছিল এখন তাই বাস্তব ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
ছাব্বিশে এপ্রিল বেলা বারােটার মধ্যে ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন বন্ধ করে দেবার ফতােয়া দিলেও সেখানকার স্টাফ ও আসবাবপত্র এবং দলিল-দস্তাবেজ ভারতে আনার কী ব্যবস্থা হবে পাকিস্তান সে সম্বন্ধে কোনাে কথাই বলেনি। একটি কূটনৈতিক দপ্তর বন্ধ করে দিলেই হয় না, স্থানান্তরণের জন্য তাকে সময়ও দিতে হয়। কিন্তু দুষ্টবুদ্ধি পাক সরকার তার প্রয়ােজন মনে করেননি। স্বাভাবিকভাবেই ভারত সরকার এ ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের লােকজনের নিরাপত্তার প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত।
ভারত সরকার বাধ্য হয়েই পাক-সরকারকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন যে, তাঁরা ১৯৬১ সালের জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে রাজি কিনা? তা যদি তারা মেনে চলেন তবে কমিশনের লােকজন ও আসবাবপত্র স্থানান্তরণের জন্য প্রয়ােজনীয় সময় দিতে হবে। তাছাড়া গােটা স্টাফের ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিতেও তারা বাধ্য।
বেলা সাড়ে এগারােটার মধ্যে এর জবাব দেবার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ছাব্বিশে এপ্রিল তার পূর্বেই দিল্লীস্থিত পাক হাইকমিশনার জনাব সাজ্জাদ হায়দার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রককে জানান যে, তাঁর সরকার জেনেভা কনভেনশন মেনে চলবেন এবং ঢাকার কূটনৈতিক মিশনকে দপ্তর গুটোবার সময় দেবেন। কিন্তু পাল্টা চাল চাললেন পাক-সরকার। তাঁর দাবি কলকাতার ভূতপূর্ব পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হুসেন আলী ও তার সমস্ত বাঙালি কর্মচারী সমেত সবাইকে করাচীতে পাঠিয়ে দিতে হবে। তার অর্থ ভারত সরকার যদি পাকিস্তানের এই মর্জিমাফিক কাজ না করেন তবে ঢাকা কমিশনের স্টাফকে জামিন স্বরূপ আটক রাখা হবে।
মাথায় যাদের দুর্বুদ্ধি তারা সােজা পথে কখনাে চলে না। ভারত সরকার নিজে উদ্যোগী হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তিক্ত করেননি বা কলকাতার পাক কমিশন বন্ধ করে দেননি। বরং দিল্লীর অনুমােদন পেয়ে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনাররূপে যিনি কলকাতায় আসেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার তাঁর প্রতি যথােচিত সৌজন্যই দেখিয়েছেন। কোনাে কূটনৈতিক মিশন যদি পূর্ব আনুগত্য পরিহার করে নতুন কোনাে সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে থাকেন তবে তার জন্য দায়ী ভারত সরকার নন। তাদের সম্বন্ধে পাকিস্তানি সরকার যে কোনাে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন কিন্তু পাকিস্তানের এজেন্ট হয়ে ভারত সরকার তা করতে যাবেন কেন? তাই জনাব হুসেন আলী ও তাঁর বাঙালি কর্মচারীদের প্যাক করে করাচিতে পাঠাতে ভারত সরকার অসম্মত হয়েছেন।
খল পাক-সরকারের দুরভিসন্ধি ধরতে পেরে ভারত সরকারও কঠোর হতে বাধ্য হয়েছেন। যেহেতু ভারতীয় কমিশনের সমস্ত লােকজন ও তাঁদের পরিবারবর্গকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে এবং পাকিস্তান থেকে তাদের ভারতে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে সেহেতু ভারতস্থিত পাক-মিশনের কোনাে কূটনীতিক, কর্মচারী বা তাঁদের পরিবারবর্গের গতিবিধি ভারত সরকার গণ্ডিবদ্ধ করে দিয়েছেন। ভারত সরকারের অনুমতি ব্যতীত তাঁদের কেউ ভারত থেকে পাকিস্তানে যেতে পারবেন না। একমাত্র বার্তাবহদের এই কড়া নিষেধবিধি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
বাঘা তেঁতুল ছাড়া বুননা ওল জব্দ হয় না। ভারত সরকারের ভদ্রতার সুযােগ নিয়ে পাকিস্তান ভেবেছে তার যা খুশি তাই সে করে যাবে। কিন্তু সে যেন মনে রাখে, ছায়াকে লাথি দেখালে সেও লাথি দেখায়। ভারতের সঙ্গে সে যেরূপ ব্যবহার করবে সেরূপ ব্যবহারই সে পাবে ভারতের কাছ থেকে। শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ।
সূত্র: কালান্তর
২৮.৪.১৯৭১