ইয়াহিয়ার ভাগ্যসূর্য কি অস্তাচলগামী?
অত্যাচারী আয়ুবের আমলের কুখ্যাত গভর্নর মােনায়েম খাকে জনৈক মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। মুসলিম লীগের এই কট্টর দুঃশাসন বাষট্টি সাল থেকে উনসত্তর সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষকে অনেক জ্বালিয়েছে। তার দাপটে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারই চরম শাস্তি পেতে হলাে তাকে। নরহত্যায় ইয়াহিয়ার দালাল এ এম মালিকও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছে। তার হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল; কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সে যাত্রা কোনােরকম সে বেঁচে গেছে। জঙ্গি জুন্টার গােলাম এই মালিকের পুতুল সরকারের একজন মন্ত্রী জখম হয়ে এখন হাসপাতালে।
ইয়াহিয়া খান যখন বাংলাদেশে একটা নির্বাচন প্রহসনের তালিম দিচ্ছেন তখনই পরপর ঘটনাগুলাে ঘটছে। সেই কারণেই এগুলাে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দালালদের যারা শিরােমণি তাদের এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে চুনােপুঁটিরা ভয়েই জীবস্মৃত হয়ে থাকবে। রাজাকার নামে যে আধাসামরিক ফ্যাসিস্ট বাহিনী খাড়া করা হয়েছে তাদের পেলেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা কচুকাটা করে ছাড়ছে। মুসলিম লীগের চামুণ্ডারা এখন ভয়ে কাঁপছে এবং মফস্বল ছেড়ে ঢাকা শহরে এসে সৈন্যদের আশ্রয়ে থাকার জন্য পাগল। সামরিক কর্তৃপক্ষ নাকি সেভাবে তাদের আশ্রয় দিতে নারাজ। এই অনাথের দল এখন কোথায় গিয়ে প্রাণ বাঁচাবে তারই জন্য অহােরাত্র দুর্ভাবনা।
এদিকে গেরিলাদের ভয়ে পাক সৈন্যরা ঘাঁটি ছেড়ে পিছু হঠছে। খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহাকুমায় মুক্তিবাহিনী ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেছে। তার ফলে ইয়াহিয়ার বাহিনীতে বিভীষিকা দেখা দিয়েছে। চারদিকেই তারা শত্রু দেখছে।
ইয়াহিয়া অনবরত দাঁত খিচিয়ে বলছেন, ভারত থেকেই নাকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চালানাে হচ্ছে। কিন্তু মােনায়েম খাঁকে খতম ও মালিককে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ তাে সীমান্তের কাছাকাছি হয়নি, হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আর তার নায়ক সে দেশেরই মুক্তিযােদ্ধা। এসব কথা ইয়াহিয়া খানের অজানা নেই। আসলে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে তার যতই হৃৎকম্প উপস্থিত হচ্ছে ততােই তিনি মৃগী রােগীর মতাে হাত-পা ছুঁড়ছেন আর প্রলাপ বকছেন।
রাস্তার ভােজবাজিওয়ালাদের মতাে সংবিধান রচনা ও শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের আবােল-তাবােল ছড়া কেটে যতই তিনি ডুগডুগি বাজান না কেন, তার বুকের ঢিপঢিপানি যে ক্রমশই বাড়ছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা টুকরাে টুকরাে খরবগুলাে দেখেই তা বােঝা যায়। ইয়াহিয়ার অনুপস্থিতিতে জেনারেল আবদুল হামিদ খান পাকিস্তানের মুখ্য সামরিক শাসকরূপে কাজ করবেন- এর অর্থ কী? ইয়াহিয়া খানের আপাতত কোনাে বিদেশ সফরের অভিপ্রায় আছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। আর তা গেলেই বা কী? পূর্বে তিনি বিদেশ সফরে গিয়েছেন, কিন্তু তখন তাঁর অনুপস্থিতিতে কাউকে তিনি নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যাননি। ইয়াহিয়া খানের আইন উপদেষ্টা ও পাকিস্তানের ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস তাঁর পদত্যাগপত্র দাখিল করেছন। ভুট্টো তাঁর সমালােচনা করায়ই নাকি এই পদত্যাগ। ভুট্টো কে যে তাঁর কথায় গােসা করে তিনি পদত্যাগ করতে যাবেন! নিয়ােগকর্তা ইয়াহিয়া তার প্রতি খুশি থাকলে অন্যের কথায় তিনি কান দিতে যাবেন কেন? আসলে বােধহয় কোথাও বিসমিল্লায় গলদ। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা।
পশ্চিম পাকিস্তানেও যে ইয়াহিয়ার পায়ের তলা থেকে ক্রমশ জমি সরে যাচ্ছে তার আভাস আসছে নানান সূত্র ধরেই। ক’দিন আগে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা খবর দেয় কাবুলে পাখতুন ও বালুচরা নাকি এক সম্মেলনে স্থির করেছে যে, গেরিলা যুদ্ধে ট্রেনিং দিয়ে পাকিস্তান ও বেলুচিস্তানে পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মুক্তিযােদ্ধা পাঠানাে হবে। তাছাড়া পাখতুনদের মতাে বালুচরাও স্বাধীনতার দাবি তুলেছে এবং সিন্ধুতে নাকি বাংলাদেশেরই মতাে ধ্বনি উঠেছে ‘জয় সিন্ধু’। গণতান্ত্রিক দলের পশ্চিম পাকিস্তান শাখার সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লা খান বলেছেন যে, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-মহলে সামরিক জুন্টার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ। আবার পাঞ্জাবে নাকি ‘একলা চলাে রে সুর উঠেছে। ভয়ে ইয়াহিয়া খান কিছু করছেন না পাছে চারদিকে দাবানলের মতাে আগুন জ্বলে ওঠে ও অবস্থা গিয়ে বাংলাদেশের মতাে হয়ে দাঁড়ায়।
মুখে যত দম্ভই প্রকাশ পাক, এ থেকে অনুমিত হয় ইয়াহিয়া নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়েছেন। জাঁদরেল আয়ুব খান গদি থেকে চ্যুত হয়েই রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান যে আগুন জ্বেলেছেন তাতে তার নিজের মুখই পুড়ে যাবার সম্ভাবনা। বাংলাদেশে নির্বাচনের ফাঁকা বুলি কপচাতে কপচাতে হির্কে উঠে না তাকে অক্কা পেতে হয়।
সূত্র: কালান্তর
১৬.১০.১৯৭১